রংধনুর_রঙ_কালো,১৫,১৬

রংধনুর_রঙ_কালো,১৫,১৬
Sidratul Muntaz
১৫

অন্বয়ের একদম পাশাপাশি আলাদা একটা রুম ভাড়া করা হয়েছে অরিনের জন্য। অন্বয়-অরিন এখন সারাদিন একসাথেই থাকে। অরিনের মন ভালো করার জন্য অন্বয় তাকে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। শুধু রাতেরবেলা তারা আলাদা হয়। ওইটুকু সময় অরিনের জন্য সবচেয়ে বিষাক্ত। ইলহানের স্মৃতিগুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। ইলহানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে হলে পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। এর থেকে যদি ইলহান মরে যেতো, তাও অরিনের কষ্ট কম হতো। তখন সে অন্তত ইলহানের কল্পনাগুলো আঁকড়ে ধরে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগটাও নেই। ইলহানের কথা মনে পড়লে ঘৃণা ছাড়া অন্যকোনো অনুভূতি আসে না। সেই ঘৃণাময় অনুভূতিটাও অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক! কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসলে যেমন তার কথা মনে না করে থাকা যায় না। উঠতে,বসতে, খেতে, চলতে শুধু তার কথাই মনে পড়ে। তেমনি কাউকে ঘৃণা করলেও ব্যাপারটা একই ঘটে। পার্থক্য শুধু, ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে হলে বুকে অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। আর ঘৃণিত ব্যক্তিটির কথা মনে হলে কষ্টে বুক জ্বলে যায়। এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় সর্বক্ষণ। এমন ঘটনা তখনি ঘটে যখন কেউ তাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, যাকে সে অতীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। অরিন মাঝে মাঝে রাতেরবেলা অন্বয়কে করিডোরে ডেকে গল্প করে কাটায়। কারণ রাতে তার ঘুম আসে না। অন্বয়ের সাথে গল্প করলে সময়টা ভালো যায়। কখনও কখনও গল্প করতে গিয়ে ভোর হয়ে যায়। অরিন তখন দুঃখিত গলায় বলে,” স্যরি, আমার জন্য আপনার রাতের ঘুমটা নষ্ট হলো।”
অন্বয় তখন বলে,” সমস্যা নেই। আমি রাতে এমনিতেও ঘুমাই না। ভাগ্যিস আপনি গল্প করতে ডেকেছেন। নাহলে আমার সময়টাও খুব বোরিং কাটতো।”
অরিন তখন মুচকি হাসে। কারণ সে বুঝতে পারে, অন্বয়ের কথাগুলো মিথ্যে। তার চোখে তখন ঘুমের পাহাড় জমে থাকে। ক্রমাগত হাই তুলতে তুলতে সে অরিনের গল্প শোনে। অরিন এটাও জানে, ঘুমের থেকেও অন্বয় অরিনের সঙ্গ পেতে বেশি পছন্দ করে। এই মানুষটি না থাকলে অরিন তার জীবনের এতোবড় ধাক্কা কখনোই সামলে উঠতে পারতো না। অন্বয়ের এপার্টমেন্টে অরিন এক সপ্তাহ ধরে আছে। এর মধ্যে একবারও ইলহানের সাথে যোগাযোগ হয়নি। অরিন নতুন মোবাইল কিনেছে। কিন্তু ইলহান তাকে একবারও ফোন করেনি। এমন না যে সে ইলহানের ফোনের অপেক্ষায় ছিল। আসলে অরিন শুধু অবাক হয়েছে। একটা মানুষ কত ভয়ানকভাবে অভিনয় করতে পারে। কথায় কথায় যার স্বভাব ছিল পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া সে এখন অবধি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিচ্ছে না। অরিন ভেবেছিল ইলহানকে ডিভোর্স পেপার পাঠাবে। কিন্তু এটা করতে গেলে তাকে প্রথমে ইলহানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে৷ অরিন এই কাজ ভুলেও করবে না। বরং ইলহান যদি কখনও তার সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে আসে তখনি কেবল অরিন তাকে ডিভোর্সের কথা বলবে। অরিন বাংলাদেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করছে না। অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরে বেড়াতে তার ভালোই লাগছে। সে আরও কিছুদিন অস্ট্রেলিয়া থাকবে।নিজের মতো সময় কাটাবে। শপিং করবে, ঘুরা-ফেরা করবে, ইচ্ছে মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। আর যদি কখনও ইলহানের সাথে দেখা হয়ে যায়, সাথে সাথে জুতো ছুঁড়ে মারবে৷ মারবেই।
অরিন ইদানীং নিয়মিত নেশাদ্রব্য পান করে। অন্বয় তাকে কড়াভাবে ড্রিংক করতে নিষেধ করেছে। তার নিষেধাজ্ঞার কিছু কারণ আছে। অরিন ড্রিংক করলে পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। তার আচরণ হয় বাচ্চাদের মতো। দুইদিন আগেও সে বারে গিয়ে ফরসা দেখতে একটা লম্বা ছেলেকে ইলহান মনে করে চড় দিয়েছে। শুধু তাই না, চুল, নাক-মুখ খামচে একবারে যা-তা অবস্থা। বাংলা ভাষায় এমনসব গালি-গালাজ করেছে, ওই ছেলেটি যদি বাংলা বুঝতো তাহলে শুধু গালা-গালি শুনেই অজ্ঞান হয়ে যেতো। অন্বয় অনেক কষ্টে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তাছাড়া ড্রিংকিং তো শরীরের জন্যও ক্ষতিকারক। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সেই অভ্যাস আর ছাড়ানো যায় না। অরিন আজ-কাল কিছুতেই পাত্তা দেয় না৷ সে দিন দিন অনেক বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তার মেজাজ বেশিরভাগ সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে কেউ ফোন করলে অরিন কখনও ধরে না। তার কারো সাথে যোগাযোগের ইচ্ছে নেই। সে এখন চূড়ান্ত বেপরোয়া, চূড়ান্ত স্বাধীন! এভাবে সারাজীবন কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। একদিন সকালে অন্বয় দেখলো খবরের কাগজে একটা বিশেষ খবর ছাপানো হয়েছে। অন্বয় সেই খবরের কাগজ আর দুই মগ কফি নিয়ে অরিনের ঘরে এলো। জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছেন মিসেস অরিন?”
অরিন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। চোখে-মুখে তেলতেলে ভাব। এই অবস্থায় অরিনকে দেখে অন্বয়ের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোঁয়ার আগ পর্যন্ত অরিনের চেহারায় যে ভাবটা থাকে তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। অন্বয়ের তাই বিশ্বাস। অরিন আলতো হাসি দিয়ে বললো,” ভালো আছি। আপনি আজকে সকাল-সকাল আমার ঘরে?”
” আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো। তার আগে জানা উচিৎ আপনার মন ভালো আছে নাকি? যদি মন ভালো হয় তাহলে নিউজটা দিবো না। যখন মনখারাপ থাকবে তখন দিবো।”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো,” তাহলে নিশ্চয়ই এটা কোনো গুড নিউজ। আপনি চাইছেন গুড নিউজটা শুনে আমার খারাপ মন ভালো হয়ে যাক৷ তাই না?”
” উহুম। এটা নিঃসন্দেহে ব্যাড নিউজ। আমি চাইছি মনখারাপের সময় আরও মনখারাপের খবর দিয়ে আপনাকে একেবারে কাঁদিয়ে ফেলতে।”
অরিন আরও ভ্রু কুচকে বললো,” কেনো?”
” জানি না কেনো। আমার আপনার কান্না দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কাঁদলে আপনাকে কিউট লাগে।”
” আপনি কি আমাকে টুশকি মারতে এসেছেন?”
” টুশকি না। প্রশংসা করলাম।”
” আচ্ছা, আমার মনখারাপ। এখন বলুন তো নিউজটা কি?”
অন্বয় খবরের কাগজ অরিনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,” আগে কফিটা খাবেন। তারপর চার নাম্বার পেইজটা পড়বেন। আগেই কিন্তু পড়বেন না। তাহলে আপনার কফি খাওয়া মাটি হয়ে যাবে। আজকের কফিটা অনেক ভালো হয়েছে।”
অরিন কফি খেলো না। উদগ্রীব হয়ে খবরের কাগজের চার নাম্বার পেইজ বের করে নিউজটা পড়লো। তারপর তিন-চার মিনিট একদম নীরবে কাটলো। অরিন একটু পর খবরের কাগজ রেখে বিছানা থেকে নেমে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অন্বয় দ্রুত উঠে তার পেছন পেছন গেল। অরিন করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশে হালকা বাতাস। অরিনের লম্বা চুলগুলো মাতাল ভাবে উড়ছে। অন্বয়ের ইচ্ছে করলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলো। অরিনের সামনে থাকলে সে যথেষ্ট এলোমেলো হয়ে পড়ে। নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অরিন হঠাৎ বললো,
” আমার একটুও মনখারাপ হয়নি অন্বয়সাহেব। চলুন আজকে আপনাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবো। আপনার গাড়ি আমি ড্রাইভ করবো। রাজি?”
” আপনি ড্রাইভিং জানেন?”
” মোটামুটি জানি। কেউ শিখিয়েছিল একসময়। যাতে তার অনুপস্থিতিতেও আমার চলতে অসুবিধা না হয়।ভয় নেই, আপনাকে এক্সিডেন্ট করাবো না। আমি আবার ড্রাইভিং-এ এতোটাও খারাপ না।”
অরিন কথা বলতে বলতে তৈরী হওয়ার জন্য রুমে চলে গেল। অন্বয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে বুঝতে পেরেছে সেই কেউটা হলো ইলহান। অরিন আজ-কাল ইলহানের নাম মুখে নেয় না। একটু আগে অন্বয় তাকে যে নিউজটা দেখিয়েছে সেটা ছিল মডেল সোফিয়া রিভেরার বিয়ের নিউজ। আর তার উড বি হচ্ছে ইলহান মাহদী। অরিন যে এতো সহজভাবে বিষয়টা গ্রহণ করবে অন্বয় ভাবতেও পারেনি। আচ্ছা, তিনি কি এখন রুমে গিয়ে কাঁদছেন? মনে তো হয় না। এই কয়েকদিনে মিসেস অরিন যথেষ্ট স্ট্রং হয়ে গেছেন। এখন আর ছোট-খাটো কারণেই কেঁদে ফেলেন না। কিন্তু এখানেই ভয়। মানুষের কান্না থেমে যাওয়া মানেই কষ্ট কমে যাওয়া নয়। বরং না কাঁদলে কষ্টগুলো জমতে থাকে। জমতে জমতে একদিন তা মহাপ্রলয়ের রূপ ধারণ করে। তারপর হয় মহা বিস্ফোরণ। তার চেয়ে তো এটাই ভালো, কেঁদে-কেটে কষ্টগুলো একদম ঝেড়ে ফেলা। অন্বয় চায় অরিন কাঁদুক। প্রাণ খুলে কাঁদুক।

চলবে

– Sidratul Muntaz

#রংধনুর_রঙ_কালো
১৬.

পর্যটকদের জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অন্বয় তার কাজের সুবিধার জন্য একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করেছিল। যখন তখন সেই গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া যায়। আজকে অরিন ড্রাইভ করছে। অন্বয় তার পাশে বসে আছে। গন্তব্য কোথায় সে জানে না। অরিন তো বলেছে লংড্রাইভে যাবে। তাই তাদের এই যাত্রাটা হয়তো উদ্দেশ্যহীন। অন্বয় হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভব করলো। অরিন প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। সে বার-বার গাড়িটা ডানে-বামে ঘুরাচ্ছে। একটা সবুজ রঙের প্রাইভেট কারকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা। অন্বয় বললো,
” মিসেস অরিন, হোয়াটস রং উইদ ইউ? এটা আপনি কি করছেন?”
অন্বয়ের কথা শেষ হওয়ার কয়েক মুহুর্তেই দুই গাড়ির মধ্যে একটা সংঘর্ষ হয়ে গেল। আরেকটু হলেই এক্সিডেন্ট ঘটতো। অন্বয় উন্মত্ত গলায় বললো,” আর ইউ লস্টেড মিসেস অরিন?”
অরিন অন্বয়ের কথার জবাব না দিয়ে সবুজ রঙের গাড়িটির পথ আটকে দাঁড়ালো। গাড়ির চালক থামতে বাধ্য হলো। অরিন গাড়ি থেকে নেমেই গাড়ির চালকের কাছে গিয়ে বললো,
” এক্সকিউজ মি, কাম আউট।”
অন্বয় অরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সে এখনও বুঝতে পারছে না ঝামেলো কোথায়। গাড়ির চালক গাড়িতে বসে থেকেই বললো,” হোয়াটস ইউর প্রবলেম ইয়াং লেডি?”
অরিন শাসিয়ে উঠলো,” আপনি বের হবেন নাকি টেনে বের করতে হবে? কাম আউট ফাস্ট।”
সবুজ গাড়িওয়ালা শুকনো মুখে বেরিয়ে এলো। লোকটির চোখে সানগ্লাস, কিছুটা স্বাস্থ্যবান। থুতনির খাঁজে অল্পকিছু দাঁড়ি। অরিন সরাসরি লোকটার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,” আমাদের ফলো করছেন কেনো? মতলবটা কি আপনার?”
” আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন। আমি কেনো আপনাদের ফলো করবো?”
অরিন হুমকি দিল,” আর কখনও যদি আমাদের আশেপাশে দেখি তাহলে গুলি করে ভুড়ি উড়িয়ে দিবো। আই উইল ব্লাস্ট ইউর ইন্ট্রেইলস। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
ভদ্রলোক হতভম্ব চেহারায় তাকিয়ে রইল। অরিন অন্বয়ের হাত ধরে বললো,” চলুন অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় অবাক হয়ে খেয়াল করলো ভদ্রলোক অরিনকে কিছুই বলছে না। তার মানে অরিনের অভিযোগ সত্যি। নয়তো ভদ্রলোক নীরব কেনো?গাড়িতে উঠে অন্বয় জিজ্ঞেস করলো,” আপনি বুঝলেন কিভাবে উনি আমাদের ফলো করছে?”
অরিন চোখ বড় করে বললো,” সবসময় আমাদের আশেপাশে এই লোক ঘুরঘুর করে আপনি কি দেখেননি? আপনার সন্দেহ হয়নি? আপনি তো ব্যারিস্টার মানুষ। তাও বুঝলেন না?”
অন্বয় মনে মনে বললো,” আপনি আমার পাশে থাকলে তো আমি নিজেকেও দেখতে ভুলে যাই। সেখানে কোথাকার কোন ভূড়িওয়ালা। তাকে খেয়াল করার সময় কি আমার আছে? আপনি জানেন না মিসেস অরিন, আমার মনের সমস্ত খেয়াল এখন আটকে থাকে আপনার ওই ডাগর চোখের মায়ায়। দিন দিন কি আমি বেহায়া হয়ে যাচ্ছি?”
অন্বয় অবশ্য লোকটিকে তাদের আশেপাশে কয়েকবার দেখেছে। কিন্তু সেরকমভাবে খেয়াল করেনি। একবারও তার এইটা মাথায় আসেনি যে লোকটি তাদের ফলো করছে। অরিন পর্যন্ত ব্যাপারটা ধরে ফেললো কিন্তু অন্বয় টেরও পেল না। আজকে অরিনের সাথে পরপর দু’টি অপ্রত্যাশিত ঘটনা হয়েছে। প্রথমটা হলো, সকাল-সকাল ইলহানের বিয়ের খবর পাওয়া। যদিও অরিন বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো আজ বিকালে শ্যানিন ফোন করেছিল। শ্যানিন হচ্ছে ইলহানের বাংলাদেশী মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। আইনত ইলহানের আপন ছোটবোন। সে স্কলারশীপ পেয়ে কানাডায় পড়তে গিয়েছে। এখনও সে কানাডায় অবস্থান করছে। ভ্যাকেশনে দেশে ফিরলেই তার সাথে অন্বয়সাহেবের এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইলহান তার পরিবারে যেই গুজব রটিয়েছে তাতে এই বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ! অরিন তো প্রথমে ভয় পাচ্ছিল শ্যানিনের ফোন ধরতে। অরিন সম্পর্কের দিক থেকে শ্যানিনের ভাবী। আর শ্যানিন তার ননদ। কিন্তু এর বাইরেও তাদের অন্যরকম আরেকটা সম্পর্ক আছে। তারা স্কুল- কলেজ লাইফের বেস্টফ্রেন্ড। ওদের কথা-বার্তাও তুই-তূকারী পর্যায়ের। শ্যানিনের আইডি দেখে অরিনের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিল। কারণ তার ধারণা শ্যানিন তাকে অপমান করার জন্য ফোন করেছে। শ্যানিন হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওকল দিয়েছিল। অরিন ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করলো। শ্যানিন মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়ে বললো,” কেমন আছিস অরিন?”
শ্যানিনের হাসি দেখেই অরিন ভড়কে গেল। হালকা গলায় বললো,” ভালো।”
” মুখ প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেনো? আমার ফোন পেয়ে খুশি হোসনি?”
” খুশি হবো না কেনো?”
” তাহলে এইভাবে কথা বলছিস কেনো? একটু হাসি দে।”
অরিন জোর করে হাসলো। শ্যানিন বললো,” শুনলাম তুই নাকি ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে অস্ট্রেলিয়া গেছিস? কেমন কাটছে তোদের?”
অরিন এতোক্ষণে বুঝে গেল যে শ্যানিন এখনও কিছুই জানে না। সে অবশ্য নিজে থেকে শ্যানিনকে কিছু জানানোর আগ্রহও পেল না। কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,” ভালোই কাটছে। তোর খবর বল।”
” আমি তো একদম বিন্দাস আছি। আর গুড নিউজটা শোনার পর থেকে তো আরও ভালো আছি। ”
” কিসের গুড নিউজ?”
” তুই শুনিসনি? ”
অরিন ঠোঁট উল্টে বললো,” উহুম।”
” বলিস কি? ঘটনা দশদিন আগে ঘটে গেছে। আর তুই এখনও গুড নিউজ জানিস না? অবশ্য তোদের সবার জন্য তো এটা ব্যাড নিউজ। গুড নিউজ শুধু আমার জন্য। ”
” কি গুড নিউজ?”
” ব্যারিস্টার অন্বয়ের সাথে আমার বিয়ে ক্যান্সেল হয়ে গেছে। এটা তুই শুনিসনি?”
” ক্যান্সেল হলো কিভাবে?”
” সেটা আমি জানি না। মা শুধু বলেছে ক্যান্সেল। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। মাও নিজে থেকে কিছু বলেনি। তাছাড়া আমি জানতেও চাই না। বিয়েটা যে ভেঙেছে এতেই আমি খুশি।”
” তুই খুশি কেনো? ব্যারিস্টার অন্বয়কে তোর পছন্দ না?”
” ঠিক অপছন্দ যে তা নয়। কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
” কেনো?”
শ্যানিন ফিসফিস করে বললো,
” আই হ্যাভ আ বয়ফ্রেন্ড। ”
অরিন চোখ বড় করে বললো,
” কবে হলো এইসব?”
” কয়েকদিন আগে। এইখানে আসার পর থেকেই একটা ছেলে প্রচুর জ্বালাতন করতো বুঝেছিস? আমি মোটেও পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু কিভাবে যেনো হয়ে গেল.. পাত্তা না দিয়ে পারলাম না।”
” ছেলেটা কি বিদেশী?”
” তো কানাডার ছেলে বিদেশী হবে না?”
” খ্রিস্টান?”
শ্যানিন নিচুগলায় বললো,” হুম। কিন্তু ও বলেছে আমার জন্য ধর্ম চেঞ্জ করবে।”
” তাহলে তো ভালোই। মা-বাবাকে এই খবর জানিয়েছিস?”
” এখনও সাহস হচ্ছে না। বাবার তো ছোট-খাটো যেকোনো বিষয়ে স্ট্রোক করার ঝুঁকি। ভাইয়া যখন রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিল তখন মনে নেই বাবার কি অবস্থা হয়েছিল? এই খবর শুনলে মনে হয় বাবা স্ট্রোক করার আগেই মরে যাবে।”
” থাক, এখনি বাসায় জানানোর দরকার নেই।”
” আমিও তাই ভাবছি। আগে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ হোক। বিয়ে-শাদি নিয়ে ভাবার অনেক সময় আছে। কি বলিস?”
” হুম। আচ্ছা, তোরা আবার লিভিং-ফিভিং করছিস না তো?”
” ছি, ছি, তুই আমাকে এই চিনলি অরিন? এখন পর্যন্ত একটা কিস এরও চান্স দেইনি।”
” এটাই ভালো। সাবধানের মার নেই।”
” এভাবে বলছিস কেনো? ও কিন্তু খুব ভালো ছেলে। দাঁড়া, তোকে ছবি দিচ্ছি। ছবি দেখলেই বুঝবি কত্ত ইনোসেন্ট।”
শ্যানিন সঙ্গে সঙ্গে ছবি পাঠালো। অরিন ছবিটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। লাল চুলওয়ালা টাটকা একটা বিদেশী বাদর। শ্যানিনের সাথে ভালোই মানাবে। অরিনের এখন একটু স্বস্তি লাগছে। মন থেকে যেনো অনেক বড় একটা অপরাধবোধের বোঝা নেমে গেল। এতোদিন শ্যানিনের বিয়ে ভাঙার কারণ হিসেবে নিজেকে দায়ী করে যে আত্ম গ্লানিতে অরিন ভুগছিল, আজ তার অবসান হয়েছে। অরিনের শ্বশুর-শাশুড়ি শ্যানিনকে বিয়ে ভাঙার আসল কারণটা বলেনি। কিন্তু একদিন না একদিন তো শ্যানিন নিশ্চয়ই জানতে পারবে। তখন কি কষ্ট পাবে? অরিনকে ঘৃণা করবে? কিন্তু এইখানে অরিনের কি দোষ?
আজকে সন্ধ্যা থেকেই অরিন খুব সাজ-গোজ করছে। ধবধবে সাদা রঙের একটা জমকালো শাড়ি পড়েছে। শাড়ির ব্লাউজ অফ শোল্ডার, ছাই রঙের। কানের বড় দুলগুলো ঝিলমিল করছে। অরিনের মেকাপ নিয়ে অনেক ফ্যাসিনেশন আছে। অনেক দিন ধরে সে মেকাপ করে না। আজকে মনের আনন্দ নিয়ে মেকাপ করতে বসেছিল। নিজ পরিকল্পনায় চমৎকার একটা লুক ক্রিয়েট করেছে। তাকে দেখতে ঠিক জাপানিজ এনিমি ডলের মতো লাগছে। এনিমি ডলগুলোর চোখ হয় বড় বড়, নাকের গঠন হয় ছোট্ট এবং সরু। ঠোঁটের আকৃতি একদম এইটুকু হয়। অরিনের চেহারায় সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। শুধু একটাই কমতি। এনিমি ডল হয় ফরসা আর অরিন কুচকুচে কালো। ভাইয়া এখানে থাকলে ঠিক বলতেন,” আরে অরিন, তোকে তো পুরো জাপানিজ এনিমি ডলের মতো লাগছে। টোকিও বাসী জানতে পারলে এখনি লোক পাঠিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। এমন ইউনিক ব্ল্যাক ডল তারা আর কোথায় পাবে?”
অরিন আয়নায় তাকিয়ে হেসে ফেললো। চুলগুলো একপাশে আঁচড়ে পিঠময় ছড়িয়ে দিল। সামনের কিছু ছোট চুল কপালের ঠিক ডানপাশে পড়ে রইল। ব্যস, পারফেক্ট লাগছে! অরিন এইবার পারফিউম মেখে রুমের চাবি ব্যাগে নিয়ে বের হয়ে এলো। অন্বয়ের দরজায় টোকা মেরে বললো,” আপনার হয়েছে?”
অন্বয় হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে উত্তর দিল,” আমি তো সেই কখন থেকেই তৈরী!”
একথা বলে সে দরজা খুলতেই বিষম খেল। তার চোখের পলক স্থির হয়ে গেল। বুকের মধ্যে দামামা বেজে উঠলো। অরিনকে আজ ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। হায়, হায়, অন্বয়ের মনে হচ্ছে বিরাট বড় সর্বনাশ তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই সর্বনাশ এক নিমেষে তার হৃদয় খনন করে স্থায়ীভাবে গেঁড়ে বসেছে। আর বাঁচার উপায় নেই। অন্বয় লক্ষ্য করলো, তার শরীরের টেম্পারেচার বাড়ছে। সে কি একবার অরিনকে বলবে,” মিসেস অরিন, আজ আমার কোথাও যেতে ভালো লাগছে না। আমি খুবই অসুস্থ বোধ করছি। চলুন না, আজ বরং সারারাত আমরা করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করি। গল্প আপনি বলবেন। আর আমি শুধু শুনবো, দেখবো।”
অরিন অন্বয়ের মুখের কাছে তূরি বাজিয়ে বললো,” হ্যাং মেরে গেলেন নাকি? চলুন, আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
অন্বয় তার মনের কথা মনের মধ্যেই দাবিয়ে রাখলো। কিচ্ছু বলা হলো না। গাড়িতে উঠার সময় অরিন অন্বয়কে থামিয়ে বললো,” আমি ড্রাইভিং সিটে বসবো। আজকে আমি ড্রাইভ করবো।”
অন্বয় নিষ্পলক চেয়ে ঘাড় কাত করে বললো,
” ওকে।”
তার চোখেমুখে মুগ্ধতার ঘোর লেগে আছে। অরিনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুধু দেখতেই মন চাইছে। যেনো এক টুকরো ঝলমলে কালো মুক্তো। গাড়িতে বসার পাঁচমিনিট পর অন্বয় জিজ্ঞেস করলো,” আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
অরিন স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,” এংগেজমেন্ট পার্টিতে।”
” কার এংগেজমেন্ট? আপনার কোনো আত্মীয়? ”
” অস্ট্রেলিয়ায় আমার কোনো আত্মীয় নেই অন্বয় সাহেব। আপনি সেটা জানেন। তবে একজন বিশ্বাসঘাতক স্বামী আছে। যার আজকে অন্য একটি মেয়ের সাথে এংগেজমেন্ট।”
অন্বয়ের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল। তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে বললো,” আমরা ইলহান মাহদী আর সোফিয়ার এনগেজমেন্ট পার্টিতে যাচ্ছি?”
” ঠিক বলেছেন।”
” কিন্তু কেনো? আর আপনি জানলেন কিভাবে?”
” নিউজপেপারে আজকের ডেইট লেখা ছিল। আপনার মনে নেই?”
” আমি এতো মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। শুধু হেডলাইন দেখেছিলাম।”
অন্বয় খুব অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন বললো,” আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাবেন না। আমরা শুধু গেস্ট হিসেবে যাচ্ছি।”
” আমাদের কি দাওয়াত করা হয়েছে?”
” ইলহানের সাথে কিন্তু আমার ডিভোর্স হয়নি।আইনত আমরা এখনও হাসব্যান্ড-ওয়াইফ। নিজের হাসব্যান্ডের এংগেজমেন্টে যেতে দাওয়াত লাগবে কেনো?”
” আপনিই পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে যে সাজ-গোজ করে হাসিমুখে নিজের হাসব্যান্ডের এংগেজমেন্টে যাচ্ছেন।”
” আপনিই না বলেছিলেন? বাঙালি মেয়েদের মূলশক্তি, স্বামীভক্তি। আমি তো সেই স্বামীভক্তিটাই পালন করছি। স্বামীর খুশিতে খুশি হওয়া আমার কর্তব্য। সে যদি হাসি মুখে বিয়ে করতে পারে আমি কেনো তার বিয়েতে হাসি মুখে যেতে পারবো না?”
অন্বয় কি বলবে ভেবে না পেয়ে হাসলো।
” মিসেস অরিন, আমি বুঝতে পারছি না আমার এখন কি বলা উচিৎ। আচ্ছা আপনি ঠিকানা কোথায় পেলেন? মানে জানলেন কিভাবে এংগেজমেন্ট কোথায় হচ্ছে?
” সিক্সথ সেন্স থেকে অনুমান করেছি। ইলহানের যে বাগানবাড়িতে আমি প্রথমবার গিয়েছিলাম সেখানেকার স্পটটা অনেক সুন্দর। আমার মনে হয় এংগেজমেন্টের আয়োজন সেখানেই হচ্ছে।”
” যদি না হয়?”
” তাহলে ফিরে যাবো।”
” ভালো কথা, ইলহান মাহদী তো বিয়ে করে ফেলছেন। কিন্তু আপনাদের ডিভোর্সটা যে হলো না?”
অরিন এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। থমথমে মুখে সামনে তাকিয়ে রইল। অন্বয় দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করে অরিনকে বিব্রত করলো না। চুপ করে থাকলো।
ইলহানের বিশাল বাগানবাড়িতেই এংগেজমেন্টের আয়োজন হয়েছে। চারদিকে প্যান্ডেল, দামী ফুল, বেলুন দিয়ে সাজিয়ে একেবারে জমজমাট অবস্থা। বাগানের ঠিক মাঝখানে স্ট্যান্ড বসিয়ে প্রায় দশতলা সাইজের রেড ভেলভেট কেক রাখা হয়েছে। সামনে স্টেজ৷ বিরাট সাইজের দু’টো রাজকীয় ফাঁকা আসন। এখানে নিশ্চয়ই বর-কনে বসবে। ইলহানের পাশে সোফিয়া নামের মেয়েটিকে দেখে অরিন তার মুখের হাসি বজায় রাখতে পারবে তো? কেনো পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। হঠাৎ করে আবেগে পিছলা খাওয়ার কোনো কারণ নেই। অরিন নিজের মনকে প্রস্তুত করেই এখানে এসেছে। আশেপাশে সব পরিচিত মুখদের দেখা যাচ্ছে। অরিন ইলহানের সাথে একবার যেই ক্লাবে গিয়েছিল সেখানে প্রায় অনেকের সাথেই তার পরিচিত হয়েছিল। তারাই বোধহয় আজকের অনুষ্ঠানের মূল মেহমান। অন্বয় তো কাউকে চেনে না। সে অরিনের পিছে পিছেই ঘুরছে। অরিনের চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইলহানকে খুঁজছে।মনে হচ্ছে ইলহানকে দেখামাত্রই অরিনের শরীর বিদ্যুৎ চমকের মতো কেঁপে উঠবে। এইটা কেনো মনে হচ্ছে অরিন জানে না। ওয়েটাররা ডিশভর্তি ড্রিংক নিয়ে কাছাকাছি ঘুরছে। অরিন তাদের থেকে এক গ্লাস এলকোহল মেশানো ড্রিংক নিল। অন্বয় সেটা দেখে বললো,” মিসেস অরিন, এইখানে ড্রিংক করাটা কি ঠিক হচ্ছে?”
” ভুল হবে কেনো?”
” ড্রিংক করলে তো আপনার নিজের উপর কোনো কন্ট্রোল থাকে না। পরে কোনো অঘটন হলে?”
” আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
অন্বয় টাই লুজ করে বললো,” ভয়ে আমার ঘাম ছুটে যাচ্ছে।”
অরিন খিলখিল করে হাসলো। তখনি দেখতে পেল হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য। সোফিয়া পার্পেল গাউন পড়ে ইলহানের হাতের কনুইভাজে হাত ঢুকিয়ে স্টেজে উঠছে। তাদের দেখে সবাই হাত তালি দেওয়া শুরু করলো। আনন্দময় চিৎকারে জায়গাটা মুখোরিত হয়ে উঠলো। ইলহান পড়েছে নেভি ব্লু ব্লেজার। চুলগুলোকে মনে হয় জেল দিয়ে সেট করেছে। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটগুলো আরও বেশি লাল দেখাচ্ছে। হাইটে কি সে আরও লম্বা হয়েছে? নাকি ব্লেজার পড়ায় তাকে বেশি লম্বা দেখাচ্ছে? অরিন খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো। ইলহানের চেহারার হাসিটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম। সে নকল হাসি দিচ্ছে কেনো? আজ তো তার আসল হাসির দিন। ইলহানের চোখমুখও শুকনো দেখাচ্ছে। কিন্তু কেনো?এই পরম আনন্দের দিনে চোখমুখ শুকনো রাখলে চলে? ইলহানের চোখের নিচে তো কালশীটেও পড়ে গেছে। বিয়ের আনন্দে কি রাতে ঘুম হয় না তার? এখন সে নিশ্চয়ই সোফিয়ার সাথে লিভিং শুরু করেছে। দু’জনই হয়তো রাত জেগে সময় কাটায়। এখন তো তাদেরই দিন। চোখের নিচের কালিগুলো আর মলিন মুখখানাও ইলহানের সৌন্দর্য্যের মাত্রা একফোঁটা কমাতে পারেনি। বরং এই অবস্থাতেও তাকে সবথেকে সুন্দর দেখাচ্ছে। অরিনের খুব রাগ হয়। নিকৃষ্ট চরিত্রের একটি মানুষের চেহারায় কেনো এতো মাধুর্যতা থাকবে? তার চেহারাও তার চরিত্রের মতো নিকৃষ্ট হওয়ার দরকার ছিল। রাজকীয় আসনে এখন বসে আছে চোখ ধাঁধানো সুন্দর দুই নর-নারী। এখানে কেউই অন্বয় আর অরিনকে তেমনভাবে খেয়াল করছে না। যে অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণদ্বয় এতো সুন্দর সেখানে ভীড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা কালোবর্ণের দুই অপরিচিত ব্যক্তির দিকে মানুষ কেনো তাকাবে? এংগেজমেন্টের আসল কাজই তো আংটি বদল। তার আগের সূচনা হলো আয়োজন করে কেক কাটা। বেশিরভাগ মানুষ বাগানের মাঝখানে সমবেত হলো কেক কাটার সময়। অরিন তখনও ইলহানের নজরে পড়েনি। কেকে ছুড়ি চালানোর পর প্রথম টুকরোটাই সোফিয়া ইলহানের মুখে দিল। ইলহান এক বাইট খাওয়ার পর সেই একই টুকরো সোফিয়াকে খাওয়ালো। তারপর দু’জন লিপকিস করলো। আশেপাশের মানুষ হাত তালির মাধ্যমে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে লাগলো। অন্বয় তৎক্ষণাৎ অরিনের দিকে তাকালো। কিন্তু অরিনকে পাশে পেল না। দূরে তাকিয়ে দেখলো অরিন টেবিলে বসে একের পর এক গ্লাস সাবাড় করছে। অন্বয় মাথায় হাত দিল। আজকে কোনো সর্বনাশ হবে। অরিনের ড্রিংক করাটা হলো সর্বনাশের আসন্ন সংকেত। এখন আংটি বদল পর্ব শুরু হয়েছে। ইলহান আগে সোফিয়ার আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিল। এখন সোফিয়ার পালা। সে আংটি পড়াবে ইলহানকে।অরিন মদ খেয়ে টেবিলে টাল দিয়ে পড়ে আছে। অন্বয় তার শরীরে ধাক্কা মেরে ডাকলো,” মিসেস অরিন, আসল কাজ তো হয়ে যাচ্ছে। দেখবেন না?”
অরিন চোখ মেলে তাকালো। অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলো ডাবল ইলহান আর ডাবল সোফিয়া। ইলহানের গালের টোল পর্যন্ত চারটা হয়ে গেছে। আগে না টোল দুইটা ছিল? অরিন হাতে মদের গ্লাস নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। এতো জোরে দাঁড়ালো যে চেয়ারটা পর্যন্ত উল্টে পড়ে গেল। অন্বয় চেয়ারটা ঠিক জায়গামতো উঠিয়ে রাখলো। এই কাজ করতে তার সর্বোচ্চ দশসেকেন্ড লেগেছে। এরই মধ্যে অরিন ছুটে চলে গেছে স্টেজে। অন্বয় পেছন থেকে ডাকলো,” মিসেস অরিন, কোথায় যাচ্ছেন? দাঁড়ান!”
লাভ হলো না। অরিন সোফিয়ার হাত থেকে আংটির বক্স নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। ইলহান আর সোফিয়া হতচকিত দৃষ্টিতে তাকালো। ইলহানের চেহারা রঙ বদলে গেল অরিনকে দেখে। সোফিয়া কটমট করে বললো,” ইউ ব্লাডি স্টুপিড! তোমার এইখানে কি কাজ? কে ইনভাইট করেছে তোমাকে? ইলহান, তুমি কি ওকে ডেকেছো? ”
ইলহান জবাব দিল না। অরিনের দিকে চেয়ে আছে। অরিন সোফিয়ার তীব্র মেজাজের কোনো তোয়াক্কাই করলো না। মুখ থেকে মদ বের করে সোফিয়ার মুখে ঢেলে দিল। সোফিয়ার উঁচু পর্বতশৃঙ্গের মতো হেয়ারস্টাইল ভিজে চিমসে গেল। বিস্ময়ে তার ঠোঁটের উপর-নিচের অংশ বিভক্ত হয়ে গেল। মাঝখানে বিরাট গর্ত। অরিন ফট করে লাথি মেরে কেকের স্ট্যান্ড ফেলে দিল। কেকের ক্রিম ইলহানের মুখে ছিটকে পড়লো। সোফিয়ার চুল মাখামাখি হলো। লোকজনের মধ্যে এতোক্ষণে হল্লাহল্লি বেঁধে গেছে। বেশিরভাগ মানুষ অরিনকে চেনে। জানে সে ইলহানের বউ। যারা জানে না তারাও অন্যদের থেকে জেনে গেল। পরিবেশ হয়ে উঠলো বিশৃঙ্খলময়। অরিন কারো কথায় কান না দিয়ে ইলহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে তার মুখ বরাবর থু মারলো। গ্লাসের বাকি মদটুকুও ইলহানের মুখে ছুড়ে মারলো। এতেও ক্ষান্ত হলো না। সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় দিল ইলহানের গালে। সোফিয়া সাপের মতো ফণা তুলে অরিনের দিকে এগিয়ে আসলে তাকেও ঠাস করে চড় দিল অরিন। অন্বয় পরিস্থিতি সামলাতে অরিনের হাত ধরে টানলো। সে আসছে না দেখে অন্বয় তার কোমর জড়িয়ে ধরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। ঠিক তখনি ইলহানের বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল। সবাই আতঙ্ক নিয়ে তাকালো। অরিনের দিকে নয়, অন্বয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেছে ইলহান। অন্বয় যে হাতে অরিনের কোমড় ছুঁয়েছে সেই হাত খামচে ধরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইলো সে। বড় একটা ঝগড়া সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল সোফিয়া আর অরিনের মধ্যে। কিন্তু সেই ঝগড়া হয়ে গেল ইলহান আর অন্বয়ের মধ্যে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here