রংধনুর_রঙ_কালো,১৪
অরিন কিছু সময়ের জন্য শারিরীকভাবে একদম দূর্বল হয়ে পড়লো। নিঃসাড় হয়ে আসা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে স্থির দাঁড়িয়েই রইল। ইলহান অতি আবেগময় গভীর পরশে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। অরিন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক হলো, সোফিয়ার প্রেগন্যান্সির ঘটনা পুনরায় তার মনে পড়লো এবং ইলহানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ঠিক তখনি সে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ইলহানের পেটে ধাক্কা মারলো। এক ধাক্কায় ইলহান পিছিয়ে গেল অনেকটা। অরিনের শরীরেও অদ্ভুতভাবে শক্তি চলে এসেছে এখন। তার বিশাল চোখ দু’টো অগ্নিবলয়ের মতো দেখাচ্ছে। সারা দেহে আশ্চর্য এক ঝংকার তৈরী হয়েছে। অরিন প্রতি মুহুর্তে কেঁপে উঠছে। কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে বললো,” এতোবড় সাহস কিভাবে হলো? লজ্জা করে না তোমার?”
ইলহান নরম কণ্ঠে কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল এর আগেই তাকে ডানগালে চড় খেতে হলো। এই পর্যন্ত অরিন যতবার ইলহানকে চড় মেরেছে, ডানগালেই মেরেছে। এতোদিনে তার ডানগালে কালশিটে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ওই জায়গায় কিছুই হয়নি। চড় মারার পাঁচমিনিট পর্যন্ত গালটা গোলাপি হয়ে থাকে। তারপর আবার আগের মতো ঝকঝকে হয়ে যায়। ইলহানের আচরণও ঠিক তার ডান গালের মতোই। এতোবার অপমান করার পরেও তার কিচ্ছু হয় না। পাঁচমিনিট রাগ দেখায় তারপর আবার ছ্যাঁচড়ার মতো পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া শুরু। এবারও নিশ্চয়ই সে অরিনের পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। করুণ মুখ করে বলবে, ” ক্ষমা করে দাও অরিন। আমি আর কখনও কোনো মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করবো না। এইবারের মতো কি এই অধমকে মাফ করা যায় না?” ইলহান যদি সত্যিই এখন এমন কিছু বলে তাহলে অরিন তাকে জুতোপেটা করবে। চড় খেয়ে ইলহান অরিনের কাছে আগের মতো আর ক্ষমা চাইলো না। শুধু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো,” তুমি এখন কোথায় যাবে?”
অরিন রাগান্বিত ভঙ্গিতে দুইহাতে ঠোঁট মুছলো।যেনো তার ঠোঁটে আবর্জনা লেগে আছে। তারপর রাশভারী কণ্ঠে উত্তর দিল,” যেখানেই যাই, তোমার কি?”
ইলহান শান্ত স্বরে বললো,” অন্বয়সাহেবের এপার্টমেন্টে যাবে?”
অরিন তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো। ওর চোখের তারায় আগুন জ্বলছে। ইলহান আগের চেয়েও শান্ত কণ্ঠে বললো,” ভালো থেকো অরিন। আই উইল মিস ইউ।”
এই কথা বলেই সে দরজা আটকে দিল। অরিন ঘটনাটা হজম করতে পারলো না। অবাক হলো কিছুটা। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ইলহানের উচিৎ ছিল আবার অরিনের পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া। অরিন তখন তাকে জুতো মারতো। ইলহানের যদি ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে, অরিনের জুতো মারার অধিকার কেনো থাকবে না? আফসোসের বিষয় ইলহান তার কাছে ক্ষমা চায়নি। তাকে সত্যি সত্যি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে হলো। লিফটে উঠলো না অরিন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে ভাবতে লাগলো, কেনো সে আশা করছিল যে ইলহান তার কাছে ক্ষমা চাইবে? ক্ষমা চাইলেও তো অরিন তাকে ক্ষমা করতে পারবে না। এমন অপরাধের কি ক্ষমা হয়? এমন জঘন্য অপরাধের শুধু শাস্তি হতে পারে। আর সেই শাস্তি হলো ছেঁড়ে দেওয়া, নয় মেরে দেওয়া। অরিন প্রথম কাজটি করে ফেলেছে। ইলহানকে ছেঁড়ে চলে এসেছে। তবুও তার মনে হচ্ছে, এইভাবে ইলহানকে ছেঁড়ে আসা উচিৎ হয়নি। এইভাবে এসে লাভ কি হলো? যদি এমন হতো, অরিন স্যুটকেস গুছাচ্ছে আর ইলহান তার পা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করে বলছে, “যেও না অরিন। তোমাকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে? ও অরিন, আমার অরিন। যেও না।” অরিন কিছুতেই পা ছুটাতে পারছে না। তবুও কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার কাছে এলো। তারপর ইলহানকে একটা লাথি মেরে গটগট করে স্যুটকেস হাতে বেরিয়ে এলো। এইভাবে চলে আসতে পারলেই না একটা মজা ছিল। আত্ম অহামিকার তৃপ্তি পাওয়া যেতো। ইগো সেটিসফ্যাকশন। বাহিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অরিনের কাছে না আছে ছাতা না আছে গাড়ি। অপরিচিত এই শহরে তার আপন বলতে একজনই আছে। সেই একজনের এপার্টমেন্টে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অরিন ট্যাক্সি নিল। মোবাইলটা তখন জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারা উচিৎ হয়নি। এইসময় মোবাইলটা থাকলে কাজে লাগানো যেতো।যদিও অন্বয়সাহেবের এপার্টমেন্টের ঠিকানা অরিনের মুখস্ত আছে। তবুও তাকে ফোন করে একটা খবর দিতে পারলে ভালো হতো। অরিন বলতো,” অন্বয়সাহেব, আমি আসছি। আজরাতে আপনার এপার্টমেন্টে থাকবো। কোনো অসুবিধা নেই তো? অসুবিধা থাকলে বলুন। নতুন একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার মতো টাকাও আমার আছে। আপনার অসুবিধা থাকলে আমি নতুন এপার্টমেন্ট ভাড়া নিবো।”
অরিন জানে, সে যদি অন্বয়ের এপার্টমেন্টে গিয়ে উঠে তাহলে অন্বয়ের কোনো অসুবিধা হবে না। বরং সে আনন্দিত হবে। আনন্দের ঝলক তার চোখেমুখে প্রকাশ পাবে। অরিন তাকালেই দেখবে, অন্বয়সাহেবের চেহারাটা ঝলমল করছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার অরিনকে অন্যরাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে এই নিয়ে অরিন কোনো প্রতিবাদ করার তাগিদ অনুভব করেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রতিবাদ করতেই হবে। কারণ তিনি অদ্ভুত একটা জায়গায় গাড়ি থামাতে যাচ্ছেন।সেটা অত্যন্ত খারাপ একটা জায়গা। মেয়েরা ছোট জামা-কাপড় পরে ঘোরা-ফেরা করছে। চারদিকে উৎকট গন্ধ। অরিন ধমক দেওয়ার মতো বললো,” এইযে, এটা কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে?”
ট্যাক্সি ড্রাইভার বাংলা বুঝেন না। তিনি অবাক চোখে অরিনের দিকে তাকালেন। অরিন এইবার তার কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বললো। ড্রাইভার হেসে বললেন তিনি এখান থেকে কয়েক বোতল দামী পানীয় কিনবেন। তাই গাড়ি থামিয়েছেন। এইখানে চড়া দামের পানীয় পাওয়া যায়। অরিন প্রশ্ন করলো,
” এতো চড়া দামের পানীয় খেয়ে কি করবেন? সাধারণ পানিতে কি আপনার তৃষ্ণা মেটে না?”
ট্যাক্সি ড্রাইভার হো হো করে হাসলেন। অরিন তো কোনো কৌতুক বলেনি। তাহলে তিনি হাসছেন কেনো? ড্রাইভার বললেন,” এগুলো এমন ধরণের পানি যা খেলে মানসিক প্রশান্তি বাড়ে। যারা ব্যক্তিগত জীবনে খুব হতাশাগ্রস্ত তারা এই পানীয় পান করে হতাশা ভুলে যায়।”
অরিন তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলো এইটা কেমন পানীয়। সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,” আপনার জীবনেও হতাশা আছে?”
ট্যাক্সি ড্রাইভারের চেহারা কালো বর্ণ ধারণ করলো। তিনি থমথমে মুখে চেয়ে রইলেন। হয়তো বলতে চাইছেন না। অরিন বললো,” থাক, আপনাকে বলতে হবে না। আপনি বরং আমার জন্যও কয়েক বোতল দামী পানীয় কিনেন আনুন। আজকে আমি পরীক্ষা করবো, টাকা দিয়ে দামী পানীয় কিনে আসলেই জীবনের হতাশা ভুলে থাকা যায় কি-না।”
ট্যাক্সি ড্রাইভার বড় বড় দুই বোতল মদ আনলেন। অরিন দু’টোই রেখে দিল। আজকে সে একটা নতুন জিনিসের স্বাদ নিবে। অনুভূতিটা ভালোই লাগছে। ভাইয়া যদি এই মুহুর্তে অরিনকে দেখতেন তাহলে ঠিকই নাক-মুখ কুচকে বলতেন,” আমার বোন হয়ে তুই মদ খাচ্ছিস? তোর এতোবড় সাহস? আজ থেকে আমি জানবো, আমার কোনো বোন নেই। তোকে বাতিলের খাতায় তুলে রাখলাম। কাট,কাট,কাট!”
অরিন হাসতে লাগলো। ভাইয়া যেহেতু এখানে নেই, মদ খেতেও অসুবিধা নেই। সে তো জানবেই না তাহলে অরিনকে ধমকাবে কি করে? তাছাড়া অরিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ থেকে সে কারো কথা ভাববে না। স্বাধীনভাবে নিজের মতো চলবে। শুধুই নিজের জন্য বাঁচবে। এখন যেমন তার মদ খেতে ইচ্ছে করছে, সে মদ খাবে। এপার্টমেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অরিন দুই বোতল মদই খেয়ে শেষ করে ফেললো। প্রথম চুমুকে তার বমি এসেছিল। তারপর নাক টিপে কয়েক চুমুক একসাথে খেল। এরপর আর একবারও বমি আসেনি। সে শুধু একাধারে ঢোক গিলেছে। এখন তার অবস্থা টালমাটাল। পৃথিবী যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রতিনিয়ত ঘুরছে সেই ঘূর্ণন গতি অরিন এখন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে। তার চোখের সামনে সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি জিনিস সে দু’টো করে দেখছে। হতাশা নামক জিনিসটা তার মধ্যে থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে৷ অরিন ঠিক করলো এখন থেকে সে রোজ দামী পানীয় খাবে। ট্যাক্সি ড্রাইভার অরিনকে এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে চলে গেলেন। অরিনের হেঁটে যাওয়ার শক্তি ছিল না। সে সড়কের একপাশে চুপ করে বসে রইল। বেশ কিছুসময় পর অন্বয়ের ড্রাইভার বাবা অরিনকে দেখতে পেল। কাছে এগিয়ে এসে বললো,” আরে ম্যাডাম না? ভালো আছেন?”
অরিন চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। হঠাৎ পাগলের মতো হা-হা করে হেসে উঠে বললো,” বাবা ভাই!”
বাবা বললো,” ম্যাডাম কি অসুস্থ? আমার হাত ধরে উঠেন। আপনাকে স্যারের কাছে নিয়ে যাই। স্যার তো আপনার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন।”
” আমাকে ধরতে হবে না। আপনি আগে আমার মোটা বাচ্চাটাকে ধরুন।”
” মোটা বাচ্চা?”
বাবা নিজে থেকেই বুঝলো অরিন তার স্যুটকেসের কথা বলছে। সে স্যুটকেস হাত নিল। অরিন বাবার কাঁধে হাত রেখে সিরিয়াস ভাবে বললো,” আচ্ছা বাবা ভাই, আপনার এই অদ্ভুত নামের পেছনের রহস্যটা বলবেন? কে রাখলো এমন নাম? বা-বা!”
বাবা উত্তর দেওয়ার আগেই অরিন আবার প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা আপনি বিয়ে করেছেন?”
” জ্বী না।”
” ভালো করেছেন। খবরদার জীবনেও বিয়ে করবেন না!”
” কেনো ম্যাডাম?”
” আরে বুঝলেন না? আপনি যদি বিয়ে করেন, আপনার বউ তো আপনাকে বাবা বলে ডাকবে। আপনি তো আর জামাই হতে পারবেন না। বিয়ে করে বউয়ের কাছেও বাবা হয়ে যাবেন। লাভ কি? তার চেয়ে ভালো চিরকুমার থাকুন।”
বাবা বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালো। অরিন বললো,” আপনি কাকা’কে চিনেন? প্লেয়ার! সে কিন্তু বিয়ে করেছে। বিয়ের পরেও বউয়ের কাছে সে কাকা। এমনকি তার বাচ্চাদের কাছেও কাকা। এদিক থেকে অবশ্য আপনার কপাল ভালো। আপনার বাচ্চারা আপনাকে বাবা বলেই ডাকবে। কাকা বলবে না। কিন্তু বিয়েই যদি না করেন তাহলে বাচ্চা আসবে কোথ থেকে? হা-হা-হা!”
অরিন হাতে তালি বাজিয়ে হাসতে লাগলো। বাবা মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবলো, কিছু একটা গন্ডগোল আছে। অন্বয়ের ঘরে এসে অরিন চোখ বাঁকা করে গানের সুরে ডাকলো,” অন্বয় সাহেব! দেখুন আমি এসে গেছি!”
অন্বয় হেসে বললো,” আরে মিসেস অরিন, আপনি হঠাৎ চলে এলেন যে? আবার কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আর আপনার ফোন বন্ধ কেনো?”
” মোবাইল আমি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছি।”
“কেনো?”
” মেজাজ খারাপ হয়েছিল। শুনুন অন্বয়সাহেব, আজকে কিন্তু আমি এইখানে থাকবো। একদম সব গুছিয়ে চলে এসেছি। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?”
” না, না, আপত্তি কেনো থাকবে? আপনি ভেতরে আসুন।”
” আপনার বউ আবার মাইন্ড করবে না তো? ওহ স্যরি, আপনার তো বউই নেই৷ যদি থাকতো আমাকে নিশ্চয়ই ঝাঁটার বারি মেরে বের করে দিতো। তাই না? ভালোই হয়েছে আপনার কোনো বউ নেই। আপনিও চিরকুমার থাকবেন। চিরকুমার থাকাই ভালো। বিয়ে-শাদি হচ্ছে ঝামেলার কাজ। আমি বাবা ভাইকেও বলে দিয়েছি চিরকুমার থাকার কথা। তিনি কিন্তু রাজী হয়েছেন। আপনি রাজি তো?”
অন্বয় ভ্রু কুচকে বাবার দিকে তাকালো। বাবা মাথায় হাত দিয়ে বুঝালো কিছু একটা গন্ডগোল আছে। অরিন ভেতরে এসে বসলো। চারপাশে তাকিয়ে বললো,” রুমটা সুন্দর। কিন্তু একটু ছোট। অন্বয়সাহেব, আপনি আমার পাশে এসে বসুন তো। আমি আপনার সাথে একটা ইম্পোর্ট্যান্ট ডিসকাস করবো।”
বাবাকে চলে যেতে বলে অন্বয় অরিনের পাশে এসে বসলো।
” বলুন কি ইম্পোর্ট্যান্ট ডিসকাশন করবেন?”
” তার আগে বলুন, আপনার জীবনে কি কোনো হতাশা আছে?”
” হতাশা তো সবার জীবনেই থাকে।”
” গ্রেইট! ”
অরিন এমনভাবে হেসে উঠলো যেনো জীবনে হতাশা থাকাটা খুব সৌভাগ্যের বিষয়। সে আঙুল উঠিয়ে বললো,” তাহলে আপনাকে একটা পরামর্শ দেই। দামী পানীয় খান। রঙিন ধরণের বিশেষ পানীয়। লাল, নীল, হলুদ।”
” হলুদ?”
” হুম। হতাশা কেটে কোথায় পালিয়ে যাবে টর্চ মেরেও খুঁজে পাবেন না। হা-হা-হা।”
অন্বয় লক্ষ্য করেছে মিসেস অরিন আজ অযথাই হাসছেন। কোনো কারণ ছাড়া। সন্দেহবশত সে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনিও কি রঙিন পানীয় খেয়ে এসেছেন?”
অরিন উত্তর দেওয়ার আগেই সুন্দরী হোটেল গার্ল দরজায় টোকা দিল। অন্বয় কিছুক্ষণ আগেই খাবার অর্ডার করেছিল। তার লাঞ্চ হয়নি। এখন সে জমিয়ে লাঞ্চ করার প্রস্তুতি নিবে। সন্ধ্যার শেষদিকে এসে লাঞ্চ। মধ্যরাতে ডিনার। বিদেশে এসে খাওয়া-দাওয়ায় খুব অনিয়ম হচ্ছে। অরিন মাথা বের করে হোটেল গার্লটিকে দেখলো। তারপর বড় বড় চোখে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করলো,” ইনি কে? আপনার গার্লফ্রেন্ড? ”
অন্বয়ের হাত থেকে খাবারের প্লেট পড়ে যেতে নিচ্ছিল। সে বিব্রত গলায় বললো,” কি বলছেন? উনি আমার গার্লফ্রেন্ড হবে কেনো?”
ভাগ্যিস হোটেল গার্ল বাংলা বুঝে না। সে হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে গেল। অরিন বললো,” মেয়েটা তো সুন্দরী। আপনি এক কাজ করুন। এই মেয়ের সাথে লাইন মারুন।”
” আমি কেনো এই মেয়ের সাথে লাইন মারবো?”
” আরে, বিদেশী মেয়েদের মন তাদের চামড়ার মতোই ঝকঝকে হয়। জানেন না? তারা বিবাহিত পুরুষের বাচ্চাও গর্ভে ধারণ করতে দ্বিধান্বিত হয় না। এতো মহান!”
” আপনি কি সোফিয়াকে মিন করছেন?”
” ঠিক বলছেন, সোফিয়া। ইলহান যেমন সোফিয়াকে প্রেগন্যান্ট করেছে আপনি এইবার এই মেয়েটাকে প্রেগন্যান্ট করুন তো!”
অন্বয়ের কাশি উঠে গেল। অরিন আরও বললো, “এদের পটানো কিন্তু খুব সহজ৷ একবার শুধু ফ্লায়িং কিস দিয়ে কামুক দৃষ্টিতে তাকাবেন। দেখবেন আপনার সামনে পায়জামা খুলে চিৎ হয়ে গেছে। বাঙালি মেয়েদের চিৎ করা কিন্তু এতো সহজ না।আমরা বিয়ে ছাড়া সহজে কারো সামনে চিৎ হই না।” অন্বয় খাওয়া থামিয়ে দিল। যতক্ষণ মিসেস অরিন কথা বলবেন ততক্ষণ তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। খেতে গেলেই বিষম উঠবে। অরিন অন্বয়ের একটু কাছে এসে গোপন পরিকল্পনা করার মতো বললো,” আমার মনে হচ্ছে এই মেয়ের সঙ্গে আপনাকে খুব মানাবে। দাঁড়ান, আমি ফোন নাম্বার এনে দিচ্ছি।”
অরিন হোটেল গার্লের পিছু নিতে যাচ্ছিল। অন্বয় তাকে থামিয়ে বললো,” আরে কি করছেন? আমার কারো ফোন নাম্বার লাগবে না। আপনি বসুন প্লিজ।”
” কেনো? আপনি কি মেয়েটার প্রতি ইন্টারেস্টেড না? ”
” আমি কেনো শুধু শুধু তার প্রতি ইন্টারেস্টেড হতে যাবো?”
” এতো সুন্দরী মেয়ে। তাও আপনার ইন্টারেস্ট জাগলো না?”
” না। সুন্দর দিয়ে আমি কি করবো? আমি তো তাকে ভালোবাসি না। ”
অরিন হঠাৎ ঠোঁট ভেঙে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করলো। অন্বয় হকচকিয়ে বললো,” কি হয়েছে মিসেস অরিন?”
” আপনি খুব ভালো মানুষ অন্বয়সাহেব। সবাই কেনো আপনার মতো ভালো হয় না?”
অন্বয় নিরব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” আপনার রেস্ট দরকার। আপনি একটু শুয়ে আরাম করুন।”
অরিন নিষ্পাপের মতো বললো,” আমি কি আপনাকে একটা চুমু দিতে পারি? না থাক, আপনি তো পুরুষ। আমি তো মহিলা। চুমু খেলে গুণাহ হবে। তাই না?”
মিসেস অরিন একদম বাচ্চাদের মতো করছেন। অন্বয় হতাশ কণ্ঠে বললো,” জ্বী।”
অরিন সোফায় বসতে বসতে বললো,” জানেন অন্বয়সাহেব, আমার এই জীবনটা একটুও সহ্য হচ্ছে না। দুই বোতল মদের পরিবর্তে আমি যদি দুই বোতল বিষপান করতে পারতাম..”
” কি বলছেন? আপনি কেনো বিষপান করবেন?”
অরিনের চোখ দিয়ে অনর্গল জল বের হচ্ছে। এতো অশ্রু তার চোখে? অরিন গাঁয়ের জ্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,” আমার ভীষণ গরম লাগছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। চারপাশে আমি শুধু একটা মানুষকেই দেখতে পাচ্ছি। সে একজন বিশ্বাসঘাতক। কারো অনাগত সন্তানের বাবা!”
শেষ কথাটুকু বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো।সাথে কেঁপে উঠলো অন্বয়ের হৃদয়টাও। মিসেস অরিন বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন। ইশশ, এমন মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ কিভাবে ঠকাতে পারে? মি.ইলহান মাহদী কি মানুষ? জানোয়ারের চেয়েও অধম সে। অন্বয়ের ইচ্ছে করলো এখনি মি. ইলহানের ফাঁসির আদেশ দিতে। তার এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। শুধু সে কেনো? যে-ই মিসেস অরিনকে কাঁদাতে আসবে তাকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। অন্বয় এই ব্যাপারে কাউকে ছাড় দিবে না। একটুও না। অরিন কাঁদতে কাঁদতে বললো,” আপনি আমাকে কালকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আসবেন অন্বয়সাহেব? আমি বাংলাদেশে ফিতে যেতে চাই।”
” বাংলাদেশে গিয়ে কি করবেন? আমরা যে কাজে এসেছি সেই কাজ তো এখনও শেষ হয়নি। আপনাকে মার্ডার করতে চেয়েছিল তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
” আমি কাউকে খুঁজে পেতে চাই না। শুধু এই দেশ থেকে বের হতে চাই। অভিশপ্ত এই দেশে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
মেয়ে মানুষ আসলেই অদ্ভুত। তারা সব সহ্য করতে পারে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মতো অসাধ্যও সাধন করতে পারে। কিন্তু নিজের স্বামীর পরনারীর প্রতি আকর্ষণ কখনও সহ্য করতে পারে না। এই একটি কষ্টের কাছে হয়তো পৃথিবীর সব কষ্ট তাদের নিকট তুচ্ছ! অন্বয়ের এখন মনে হচ্ছে সোফিয়ার প্রেগন্যান্সির কথাটা মিসেস অরিনকে জানানোই উচিৎ হয়নি। এই তথ্য জানার পর ভেতর থেকে একদম ভেঙে পড়েছেন তিনি। এতোই ভেঙে পড়েছেন যে তার কান্না দেখে অন্বয়ের হৃৎপিন্ড দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। অরিন গাঁয়ের টপটাও খুলে ফেললো। অন্বয় সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললো,” এইসব কি করছেন মিসেস অরিন?” অরিনের পক্ষ থেকে কোনো জবাব এলো না। সে চিৎকার করে কেঁদে যেতে লাগলো। টেবিল থেকে জগ নিয়ে নিজের মাথায় পানি ঢেলে দিল। এরপর উন্মত্তের মতো ছটফট করে বললো,” আমার সাথে কেনো এমন হলো অন্বয়সাহেব? আমি কি অপরাধ করেছিলাম? কখনও তো কাউকে ঠকাইনি আমি। তাহলে আমাকে কেনো ঠকতে হলো। কেন?” অরিন জগটা ছুড়ে মারলো দেয়ালে। বিকট শব্দ হলো। অন্বয় যথাসম্ভব দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। তার আর সহ্য হচ্ছে না। বাহিরে এসে সে রুমের দরজা আটকে দিল। জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল। অরিনের আর্তচিৎকারে তার নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে আসছে! সে কেনো তার ব্ল্যাক পার্লের জন্য কিছু করতে পারছে না? যে কোনো পরিস্থিতিতেই অন্বয় চায় ব্ল্যাক পার্লটা ভালো থাকুক। তার ঝলমলে ঝর্ণার মতো হাসি সবসময় অটুট থাকুক। অন্বয় চোখ বন্ধ করে বিরবির করলো,” ব্ল্যাক পার্ল! আমার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে বিশেষ, সুন্দরী ব্ল্যাক পার্ল। প্লিজ ডন্ট ক্রাই।”
চলবে
– Sidratul Muntaz