রংধনুর_রঙ_কালো,১৩
অরিন জানালার গ্রিল মুঠোয় নিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটলো। অরিনের ঘোর কাটলো না। বুকের মাঝের তিক্ত সেই অনুভূতির সঞ্চার বন্ধ হলো না। দীর্ঘসময় জানালার লৌহ গ্রিল চেপে রাখার কারণে হাতে ক্ষত সৃষ্টি হলো। ব্যথায় আঙুল জমে গেল। অরিন তাও টের পেল না। ইলহান বাড়ি ফিরলো অগোছালো চিন্তা নিয়ে। বিছানার কাছে এসেই লম্বা শরীর এলিয়ে সটান শুয়ে পড়লো সে। বুকের মধ্যে বালিশ চেপে ধরলো। চোখমুখ কুচকে বন্ধ করলো। তাকে দেখলে মনে হবে শরীরের কোথাও ভয়ানকভাবে আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাতের গাঢ় ব্যথা সহ্য করতেই দাঁত খিচে পড়ে আছে। সে নিজে থেকে কোনো কথা বলছে না দেখে অরিনের মনে অসম্ভব ক্রোধ সৃষ্টি হলো। নিজে থেকেই সে জানতে চাইলো,
” কোথায় ছিলে তুমি?”
ইলহান সরল দৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকালো। তার তাকানো দেখে মনে হলো সে এখন দিন-দুনিয়ার কিছুই বুঝতে পারছে না। অরিন তার অদ্ভুত সুন্দর বড় বড় চোখের দৃষ্টি প্রসারিত করলো। তার রক্তিম দুই চোখ এখন ঠিক আগুনের লাভার মতো দেখাচ্ছে। ইলহান হালকা গলায় বললো,” কি?”
তার এতো সহজ ব্যবহার অরিনের মোটেও পছন্দ হলো না। হিংস্র বাঘিনীর মতো হুংকার ছেড়ে অরিন বললো,” এতোবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে এসেও তুমি নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করছো কি? ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকলে তুমি এই চেহারা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াতে না। ইতর, জানোয়ার! এমন জঘন্য ঘটনার পরেও তোমার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই কেনো? ”
ইলহানের কপালে তুখোড় বিরক্তির ভাজ দেখা হলো।
” কি অপরাধ করেছি আমি?”
” ওহ স্যরি, অপরাধ তুমি করোনি। অপরাধ করেছে সোফিয়া। তোমার সন্তানের মা হতে চলেছে সে। অপরাধ তো তারই। এইখানে তোমার কি দোষ?”
ইলহান অবাক হয়ে বললো,” তোমাকে এই খবর কে দিল?”
” খবর দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। আমি কোথা থেকে খবর পেয়েছি সেটা জরুরী বিষয় না। জরুরী বিষয় হচ্ছে, আমি আর তোমার সাথে এক মুহুর্তও থাকতে চাই না বুঝেছো? যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নোংরামি, পাপ তার সঙ্গে থাকলে আমিও পাপী হয়ে যাবো। নিজেকে অপবিত্র বানানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে যদি তুমি এরপরেও আটকে রাখো তাহলে আমি…”
ইলহান মাঝপথে অরিনকে থামিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ কচলে বললো,” অরিন, এখন এসব নিয়ে আলোচনা করতে আমার ভালো লাগছে না। আমরা এই বিষয়ে পরে কথা বলবো।”
অরিন বজ্র কণ্ঠে বললো,” তুমি কি ভেবেছো? আমি এতো সহজে সব মেনে নিবো? তোমাকে ক্ষমা করে দিবো? জোর করে তুমি আমাকে সাময়িকভাবে আটকে রাখতে পারলেও চিরকাল পারবে না। গাঁয়ের জোরে সবকিছু হয় না। আমি এতো সস্তা না যে তোমার মতো পুরুষের কাছে পরে থাকবো যার কি-না অন্য জায়গায় সংসার তৈরী হচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই সোফিয়াকে তুমি বিয়ে করবে। তারপর কি আমরা সবাই একসাথে থাকবো? সোফিয়ার বাচ্চা কি আমাকে ছোট মা ডাকবে?”
” কি বলছো আবোলতাবোল। সোফিয়ার বাচ্চা তোমাকে কেনো ছোট মা ডাকবে?”
” আমাদের বিয়ের আগে থেকেই তো সোফিয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক। তাহলে সোফিয়া হবে তোমার সন্তানের বড় মা। আর আমি ছোট মা। হিসাব ঠিকাছে তো? নাকি মাঝখানে আরও মা আছে? মেঝো,সেঝো,তেঝো?”
ইলহান মাথায় দুইহাত চেপে ধরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো।
” উফফ! অরিন, আমার খুব মাথাব্যথা করছে। প্লিজ আমরা এই সম্পর্কে আলাপটা কি এখন বন্ধ রাখতে পারি?”
” একদমই না। তোমার মাথা ব্যথা করছে? আর আমার মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। শোনো, আমি কারো মেঝো, সেঝো বা ছোট মা হতে চাই না। আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই। সোফিয়া যেহেতু তোমার সন্তান জন্ম দিচ্ছে তোমার উচিৎ ওর পাশেই থাকা। আর আমাকে ছেড়ে দেওয়া। এরপরেও যদি তুমি আমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করো তার পরিণাম মোটেও ভালো হবে না ইলহান মাহদী। তোমার কাছে দু’টো রাস্তা খোলা আছে। হয় আমাকে মুক্ত করো নয় তুমি নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও৷ হ্যাঁ ঠিক শুনেছো, আমার এই হুমকিকে হালকাভাবে নিলে কিন্তু পস্তাতে হবে। আমি তোমাকে খুন করে হলেও নিজের মুক্তি নিশ্চিত করবো। তুমি কি চাও তোমার অনাগত সন্তান জন্মের আগেই অনাথ হয়ে যাক? বাবার মুখ দেখার আগেই বাবা ডাকার অধিকার হারাক?”
ইলহানের থেকে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। সে ভ্রু কুচকে নিচের দিকে চেয়ে আছে। গভীরভাবে মগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে। হয়তো বাচ্চাটার কথাই ভাবছে। বাচ্চাটা কি ছেলে হবে নাকি মেয়ে? দেখতে কি ইলহানের মতো হবে নাকি সোফিয়ার মতো? যার মতোই হোক, বাচ্চাটা পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্য্যের অধিকারী হবে৷ এই ব্যাপারটা নিশ্চিত। একটা সময় তো অরিনও স্বপ্ন দেখতো৷ তাদের ঘরে ছোট্ট একটা জীবন্ত পুতুল আসবে। পুতুলটা হবে ঠিক তার বাবার মতো লোভনীয় সৌন্দর্য্যের অধিকারী৷ সেই স্বপ্নের গুড়ে বালি। অরিন ভাঙা কণ্ঠে বললো,” শোনো মি. ইলহান মাহদী৷ আমি কিছুতেই অন্যকারো বাচ্চার বাবার সাথে একবাড়িতে থাকবো না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসবে বুঝেছো? এখনি আমি অক্সিজেনের অভাব বোধ করছি। আর কিছুক্ষণ পর হয়তো আমি নিঃশ্বাসই নিতে পারবো না। আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি আমাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্তি দাও।”
ইলহান হঠাৎ উঠে এসে চাবির সাহায্যে অরিনের হ্যান্ডকাপ খুলে দিয়ে বললো,” এতো মুক্তি মুক্তি করে চেঁচানোর কি আছে? থাকতে না চাইলে থাকবে না। দরজা খোলা আছে বের হয়ে যাও৷ বাট এট লিস্ট আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমারও তোমার ভয়েসটা আর সহ্য হচ্ছে না।”
অরিন হতচকিত, স্তম্ভিত এবং একইসাথে আহত হলো। ইলহানের বিরক্তমাখা চেহারার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে রইল। সে ঠিক শুনেছে তো? ইলহান অরিনের বাহু ধরে ধাক্কা মেরে বললো,” কি হলো এখন দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চলে যেতে বললাম না? মুক্ত করে দিলাম তো তোমাকে। যাও প্লিজ। আল্লাহর দোহাই লাগে স্ট্যাচুর মতো এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না।”
কিছু কিছু কালো মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল হয়। অরিনও সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ইলহানের মুখে এমন কথা শুনে অপমানে অরিনের শিরা-উপশিরা ফুলে উঠলো। চোখমুখ লাল হতে লাগলো। সে বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুত গতিতে নিজের স্যুটকেস গুছাতে শুরু করলো। ইলহান এই অবস্থা দেখে দেয়ালে একটা জোরে লাথি মেরে ড্রয়িং রুমে চলে গেল।অরিনের চোখ উপচে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে প্রচন্ড যুদ্ধ করে চোখের জল আটকে রেখেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইলহান বললো,
” তোমার একটা জিনিসও যেনো এইখানে না থাকে। সবকিছু নিয়ে যাবে। সব মানে সব! বুঝতে পেরেছো?”
অরিন মনে মনে পেছন ফিরে ইলহানকে ধুমধাম আচ্ছামতো কয়েকটা কিল লাগালো। অনেকগুলো থাপ্পড় দিল। বাথরুম থেকে এক বালতি পানি এনে ইলহানের মাথায় ঢেলে দিল। বালতিটাও ইলহানের মুখে ছুঁড়ে দিল।তারপর তার বিশেষ জায়গায় লাথি মারলো। খটমটে গলায় বললো,” তোর মতো স্বার্থপর আমি জীবনে কোথাও দেখিনি। স্বার্থপরের থেকেও স্বার্থপর তুই। ইবলিশ শয়তানও তোকে দেখলে লজ্জা পাবে।”
মনে মনে এতোকিছু চিন্তা করলেও বাস্তবে অরিন কিছুই করতে পারলো না। তার হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। এক কদম আগাতেও শরীরে অনেক শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে। আচ্ছা, ইলহান হঠাৎ তাকে ছেড়ে দিতে চাইছে কেনো? সকালেও সে উন্মাদের মতো অরিনের কাছে ক্ষমা চাইছিল। কতটা আকুলতা, ব্যাকুলতা ছিল তার কণ্ঠে। সেই মানুষটার ব্যবহার বিকালের মধ্যেই এতো বদলে গেল কি করে? আচ্ছা এমনটা কি হতে পারে? ইলহান অরিনের কাছে শুধুই একটা বাচ্চা প্রত্যাশা করেছিল। এজন্যই অরিনকে মাথায় করে রাখতো। সোফিয়া তো বিদেশী মেয়ে। পেশায় মডেল৷ সে হয়তো বাচ্চা জন্ম দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই ইলহান অরিনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। বাচ্চা বলতে সে পাগল। তাই এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া সোফিয়াও তো সেদিন বলেছিল, ইলহান তাকে ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য বিয়ে করেছে। বাচ্চা জন্মদানও এর একটা কারণ হতে পারে।তারপর যখন ইলহান সোফিয়ার সাথে ব্রেকাপ করতে চাইলো তখন সোফিয়া বাচ্চা জন্ম দিতে রাজি হয়ে গেল। তাই এখন অরিনকে ইলহানের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্যই কি সে অরিনকে এভাবে বের করে দিচ্ছে? কষ্টে অরিনের বুক চিড়ে কান্না আসছে। গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলহান রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললো,
” সমস্যা কি তোমার? এখনও কেনো দাঁড়িয়ে আছো? চলেই তো যাবে। তাহলে তাড়াতাড়িই যাও। আমার চোখের সামনে প্লিজ দাঁড়িয়ে থেকো না।”
অরিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, সে ইলহানকে অন্তত একটা জবাব দিবেই। এই ভেবে পেছনে ফিরতেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেল সে। তার শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও পুরোপুরি ক্ষয়ে গেল। মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। ইলহান পেছন থেকে অরিনের চুলের মুঠি চেপে ধরে শক্তভাবে ঠোঁটে চুম্বন করে যাচ্ছে। অরিনের সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগলো!
চলবে
-Sidratul Muntaz