রংধনুর_রঙ_কালো,পর্ব ৩৩,৩৪

রংধনুর_রঙ_কালো,পর্ব ৩৩,৩৪
লিখা: Sidratul Muntaz
৩৩
আজ ছুটির দিন। সপ্তাহের এই দিনটিতেই অরিন সারাক্ষণ তার মেয়ের সঙ্গে কাটায়। সাদিকা তার যত প্রিয় এনিমেশন সিরিজ, মুভিজ, কার্টুন আছে সব জমিয়ে রাখে মায়ের সাথে দেখবে বলে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মা-মেয়ে ল্যাপটপে এনিমেশন দেখে। বিকালে তিনজন ঘুরতে যায়। সাদিকা তৈরী হওয়ার সময় হালিমার দিকে আঙুল তাক করে বলে,” তোমাকে নিবো না।”
হালিমাও কান্না কান্না ভাব করে বলে,” আমি যাবোই।”
নানু-নাতনীর খুঁনশুটি দেখে অরিনের মন ভরে যায়। এভাবেই জীবন সুন্দর। সুখী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য লাইফ পার্টনারের প্রয়োজন নেই। সাদিকার মতো ছোট্ট এক জ্যান্ত পুতুল হলেই চলে। আজকের সকালটা নিত্যদিনের তুলনায় অন্যরকম হলো। অরিন সাদিকাকে মাত্র ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়িয়েছে। এখন মা-মেয়ে গোসলে যাবে। অরিন সাদিকার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। তখনি মোবাইল ফোন কানে নিয়ে দৌড়ে এলেন হালিমা। একটা দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ থেকে খবর এসেছে শায়িখ সাহেব মাগরিবের আযানের সময় ইন্তেকাল করেছেন। লন্ডনে এখন সকাল আটটা বাজে। অর্থাৎ বাংলাদেশে রাত আটটা। খবর এসেছে অন্বয়ের বাবা আমানত সাহেবের কাছ থেকে। অরিন মনে মনে উচ্চারণ করল,” ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলহাইহি রাজিউন।”
তার চোখ দু’টো জলে ভরপুর। হালিমা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,” দ্রুত তৈরী হো। বাংলাদেশে যেতে হবে।”
অরিন তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল,” কি হবে গিয়ে? আমাদের জন্য কি কেউ অপেক্ষা করে থাকবে? কবর দেওয়া হয়ে যাবে না? দেখতেই যদি না পারি তাহলে গিয়ে লাভ কি?”
” তবুও যাওয়া উচিৎ। তোর শ্বশুর মারা গেছে অরিন। একমাত্র পুত্রবধূ হিসেবে তোর যাওয়া উচিৎ না?”
” না, উচিৎ না। তুমি কি বারবার ভুলে যাও মা? ইলহানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি এখন কারো পুত্রবধূ না। আমি শুধুই সাদিকার মা।”
” আচ্ছা বুঝেছি। তবুও আমি বলবো তোর যাওয়া উচিৎ। ”
” বাবা যখন মারা গেছিল তখন কি ওদের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে? তাহলে আমরা কেনো যাবো?”
” ওরা তো জানতেই পারেনি। আসবে কি করে? আমরা তো জেনেছি। তাও যাবো না? এতোটা অমানবিক হতে পারবি তুই?”
” এখন ওই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কাছে আমি চক্ষুশূল। ওরা কেউ আমাকে পছন্দ করে না। তাছাড়া আমি এখন গিয়ে তো বাবার মুখ দেখতে পারব না। হয়তো দেখতে হবে ইলহানের নতুন বউয়ের মুখ! সোফিয়ার মুখ!”
” তাতে তোর কি? তুই তো ওকে ডিভোর্স দিয়েছিস। এবার ও একটা বিয়ে করুক কি দশটা বিয়ে করুক তোর তো কিছু যায় আসার কথা না।”
সাদিকা হঠাৎ প্রশ্ন করল,” ডিভোর্স কি মাম্মাম?”
অরিনের এতোক্ষণে টনক নড়ল। মেয়ের সামনে এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। অরিন চোখের পানি মুছে বলল,” মা, এই বিষয়ে পরে কথা বলবো। এখন অফ যাও প্লিজ।”
সাদিকাকে নিয়ে গোসলে চলে গেল অরিন। হালিমা নিশ্চুপ বসে রইলেন। দিনে দিনে অরিন বড্ড পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের এতো পাষাণ হতে নেই।
বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তে শেষমেষ রাজি হয়েছিল অরিন। তাদের পৌঁছাতে একদিন লেগে যায়। মরাবাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই। নুসাইবা শেষ বয়সে সঙ্গী হারিয়ে পরিপূর্ণ ভেঙে পড়েছেন। বিছানায় থম মেরে শুয়ে আছেন সারাদিন। কাঁদেনও না, হাসেনও না। তেমন কথাও বলেন না। শায়িখ সাহেবকে কবর দেওয়া হয়েছে তার নিজস্ব গ্রামের বাড়িতে। তাই সেখানেই সবাইকে উপস্থিত হতে হয়েছে। অরিনরাও সেই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ঢাকার এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে আবার মাইক্রোবাস জার্নি করে গ্রামের বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায় অরিনদের। এয়ারপোর্ট থেকে ওদের রিসিভ করেছিল অর্ণভ, সুমনা আর মিহরীমা। মিহরীমা অরিনের ছোটবোন। আর অর্ণভ অরিনের বড়ভাই। সুমনা অর্ণভের স্ত্রী। সাদিকা মিহরীমাকে পেয়ে খুশিতে ঝলমল। সে তার মিহি আন্টিকে খুব পছন্দ করে। মিহরীমার বয়স এখন দশ বছর। মেয়েটা ভালোই লম্বা হয়েছে। অরিনের বাবা ফয়সাল সাহেবের মৃত্যুর পর অর্ণভ লন্ডন এসে মিহরীমাকে তার সাথে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। গ্রামের বাড়িতে প্রবেশ করার পর বিদেশ ফেরত অরিনকে দেখে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকায়। তাদের চাহনী দেখে মনে হলো অরিন ভয়ংকর অপরাধী। তার কারণেই শায়িখ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে। এই বাড়িতে অরিন ঢুকেছে আধঘণ্টাও হয়নি। এর মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশী কানা-ঘুষা শুরু করেছে। এখন ইলহান তাদের কাছে নিষ্পাপ। সমস্ত দোষ শুধু অরিনের। নুসাইবার সাথে অরিনের মাত্র একবার দেখা হলো। তখন দুইজন মধ্যবয়স্কা মহিলা নুসাইবার মাথায় পানি দিয়ে তাকে দুইদিক থেকে ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অরিন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল নুসাইবাকে। সাদিকাকে দেখিয়ে বলল,” মা, এইতো আমার মেয়ে।”
নুসাইবা একটা শব্দও করলেন না। এমনভাবে সাদিকার দিকে তাকালেন যেনো ঘৃণিত কোনো বস্তু দেখছেন। তারপর দুজনকেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন নুসাইবা। অরিন মনে মনে প্রচন্ড আহত হলো। নুসাইবা তখন ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি যে চেতনায় ছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সবার সাথেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পেরেছেন। তাহলে অরিনের সাথে একটু কথা বললে কি হতো? সাদিকার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে কি হতো? অরিনের মন একদম খারাপ হয়ে গেল। ইলহানের সাথে অরিনের একবার শুধু চোখাচোখি হয়েছিল। কয়েক মুহুর্তের জন্য হৃদয়ে কম্পন, সবকিছু ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে আবার সব স্বাভাবিক। ইলহানকে দেখে এখন কেউ চিনতে পারবে না। আগাছার মতো দাড়ি বেড়েছে। অরিন প্রথম দর্শনে চেহারা চিনতে পারেনি। উচ্চতা দেখেই বুঝেছে এটা ইলহান। মুখভর্তি ঘন-কালো দাঁড়ি, চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। চোখের চারপাশে ঘন কালো। চুল বেড়ে কাধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ওই চুলে ঝুটি করা যাবে। অরিন শুনেছে ইলহান নাকি আর বিয়ে করেনি। অবশ্য ওর মতো ছেলের বিয়ের দরকার কি? অবৈধ সম্পর্ক যে করতে পারে তার বিয়ের দরকার হয় না। অরিন সাদিকাকে খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিছুতেই ইলহানের সামনে যেতে দেয়নি। তার ধারণা ইলহান সাদিকাকে দেখলেই কেড়ে নিবে।
মরাবাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। একটু পর পর শুধু মানুষ জন আসে আর কান্নাকাটি করে। এই শোক পালন কমপক্ষে এক সপ্তাহ চলবে।অপ্রয়োজনেই মানুষ কাঁদবে। কেঁদে কোনো লাভ নেই। তাও মানুষ কাঁদে। অরিন সাদিকাকে সাথে নিয়ে উঠানের কোণায় বসে ছিল৷ অর্ণভ এসে সাদিকাকে কোলে নিয়ে বলল,” আমার মামাটা কি করে?”
সাদিকা মুখভর্তি হাসি এনে বলল,” মাম্মামের সাথে বসে আছে।”
” তাই? এবার মামার সাথে চলো। মামা তোমাকে একজন স্পেশাল পারসনের সাথে দেখা করাবে।”
স্পেশাল পারসনটি কে হতে পারে সেটা আন্দাজ করেই অরিন ঝেঁঝে উঠলো,” ভাইয়া, ওকে এখানে রাখো বলছি। কোথাও নিবে না আমার মেয়েকে।”
” কেন? মেয়ে কি শুধু তোর একার? আমার ভাগ্নী না? মামা, তুমি যাবে না আমার সাথে? মাম্মামকে শাটআপ করে দাও তো।”
সাদিকা হি-হি করে শুধু হাসল। অর্ণভ আঙুলের সাহায্যে একটু দূরে ইশারা করে বলল,” ওই লোকটাকে চিনো?”
সাদিকার সাথে সাথে অরিনও তাকালো। ঝিলপাড়ে ইলহান দাঁড়িয়ে আছে। ওর আউল বাউল চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। উড়ছে দাড়ির গোছাও। সাদিকা বলল,” হ্যাঁ চিনি। এইটা ইলহান মামা।”
অর্ণভের চক্ষু চড়কগাছ। কপালে তিন-চারটা ভাজ ফেলে বলল,” মামা?”
” হ্যাঁ। মাম্মাম বলেছে তোমার মতো এটাও আমার একটা মামা। কিন্তু ওইটা পচা মামা। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমি ওই মামার কাছে যাবো না। ওইটা ভুতু মামা।”
অর্ণভ একবার অরিনের দিকে তাকালো। অরিন ঠোঁট বাকা করে হাসছে। অর্ণভ সাদিকার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বলল,” ধূর বলদী। ওইটা তোর মামা না, তোর বাপ লাগে। তোর মামা খালি আমি।”
অরিন জোরে ধমক দিল,” ভাইয়া প্লিজ, আমার মেয়ের সামনে তুমি এইসব কথা বলবে না।”
” তুই ওকে এইসব কি শিখিয়ে রেখেছিস অরিন? মেয়ে বাপের কাছে যাবে না? এটা তো তুই না- ইনসাফী করছিস।”
” আমার সাথে যা হয়েছে সেই তুলনায় এটা কিছুই না।”
” তুই এখনও ওইসব মনে রেখে বসে আছিস?”
অরিন তাজ্জব হয়ে বলল,” তো এগুলো কি মনে রাখার বিষয় না?”
” না। অতীত সবারই থাকে। তার মানে এই না যে সেই অতীত মনে করে সারাজীবন জেদ পুষে রাখতে হবে। তুই অতিরিক্ত জেদী অরিন। এইবার জেদ একটু কমানোর সময় হয়েছে।”
” তুমি কি বলতে চাও ভাইয়া?”
” ইলহানকে তুই মাফ কর। অনেক হয়েছে, ছেলেটাকে আর মারিস না।”
অরিনের চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এটা কি আসলেই তার ভাই? মুখে হাত দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টায় অরিন অন্যদিকে মুখ ফেরাল। অর্ণভ কাছে এসে বলল,” প্লিজ অরিন, আমার লক্ষী বোন। যা হয়েছে সব ভুলে যা এইবার। এইভাবে তোরা কেউই ভালো নেই। আমি তোর ভালো চাই সেজন্যই বলছি। কি হয় যদি আবার তোরা একসাথে জীবনটা শুরু করিস?”
” ভাইয়া, ইলহানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
” আমি মানি না এই ডিভোর্স। ইলহান ডিভোর্স পেপারে এখনও সাইন করেনি।”
অরিন উচ্চকণ্ঠে বলল,” তাতে আমার কিছু যায় আসে না ভাইয়া। আমি তো সাইন করেছি। একজন সাইন করলেই ডিভোর্স কার্যকর হয়।”
এইকথা বলে অরিন সাদিকাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। এই মাত্র সে একটা মিথ্যে বলেছে। ডিভোর্স পেপারে সে নিজেও সাইন করেনি। অন্বয় অরিনের নাম লিখে সাইন করেছিল।

চলবে

#রংধনুর_রঙ_কালো
৩৪.

এই বাড়িতে আসার পর মোটামুটি সবার সাথেই অরিনের দেখা হয়েছে। কিন্তু শ্যানিনের সাথে এখনও দেখা হয়নি৷ শ্যানিনকে আশেপাশে কোথাও পাওয়াও যাচ্ছে না। শ্যানিন ছিল বাবা ভক্ত মেয়ে। প্রিয় বাবার মৃত্যুতে তার কি অবস্থা হয়েছে কে জানে? অরিনের উচিৎ শ্যানিনের সাথে দেখা করে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া। এই কঠিন সময়ে তার পাশে দাঁড়ানো। শত হলেও শ্যানিন তার বেস্টফ্রেন্ড। ইলহানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে মানে এই না যে শ্যানিনের সাথেও তার ফ্রেন্ডশিপ শেষ হয়ে যাবে। বিগত পাঁচ বছরে শ্যানিনের সাথে একদম যোগাযোগ হয়নি অরিনের। এর অবশ্য কারণ আছে। অরিন ইলহানের সাথে ডিভোর্সের কারণ কাউকে জানায়নি। সে পরিবারের কাছে ইলহানকে ছোট করতে চায়নি। ইলহান তার পরিবারকে কতটুকু ভালোবাসে তা অরিন জানে না। কিন্তু অরিন নিজে ইলহানের পরিবারকে অনেক বেশি ভালোবেসেছিল। নিজের বাবা-মায়ের মতোই শায়িখ-নুসাইবাকে সে ভালোবাসতো। শায়িখ সাহেবের মতো বাবা, নুসাইবার মতো মা, শ্যানিনের মতো বোন, সবাইকে কাঁদিয়ে আসল সত্যি প্রকাশ করতে অরিনের হৃদয় কেঁপেছে। তাছাড়া ইলহান ঠকিয়েছে শুধু অরিনকে। তার পরিবারকে তো ঠকায়নি। অরিনকে ছাড়াই সে ভালো থাকুক, তার মতো। অরিন কোনো বিশ্বাসঘাতকের সাথে সংসার করবে না। এই শপথ নিয়েই অরিন ছেড়ে এসেছিল সবকিছু। অরিন- ইলহানের ডিভোর্সের যথোপযুক্ত কারণ ইলহানের পরিবার আজও জানে না। এ কারণে এখন তাদের সবার কাছে অরিন এখন শত্রু। কারণ সবার ধারণা অরিন ইচ্ছে করেই ইলহানকে ছেড়ে গিয়েছে। শ্যানিনের খোঁজ করতে অরিন দোতলায় এসেছিল। সেখানে শ্যানিনকে পাওয়া গেল না। সাদিকা কাঁদছে ঘুমানোর জন্য। মেয়েটার রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস। এখন রাত বারোটা বাজছে। তাও মেয়েটাকে বিছানায় নেওয়া যায়নি। বাড়িতে এতো মানুষ। ঘুমানোর জন্য উপযুক্ত জায়গাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কাউকে কি অরিন বলবে, তাকে আর তার মেয়েকে ঘুমানোর জন্য একটা বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে? বলতে লজ্জা লাগছে। এইখানে প্রায় সবাই অরিনের দিকে কেমন বীভৎস দৃষ্টিতে তাকায়। কারো সাথে কথা বলতেও ভয় লাগে। শ্যানিনের দেখা পাওয়া গেল একটু পরেই। মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছে। চেহারার উজ্জ্বলতা কমেছে। ওর চোখে এখন চশমা। চুল উশকো-খুশকো। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করেনা। নিজের যত্ন নেওয়া হয়তো ভুলেই গেছে। সবই হয়তো বাবার মৃত্যুর কুফল। শ্যানিন তার বাবা আর বড়ভাইকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ছোটবেলায় শ্যানিন বলতো, তার দুটো আত্মা। প্রথমজন তার বাবা আর দ্বিতীয়জন তার ইলহান ভাই। অরিন শ্যানিনকে দেখেই হাসি মুখে হাত নাড়ল। কিন্তু আশ্চর্য, শ্যানিন শান্ত দৃষ্টিতে অরিনের দিকে চেয়ে খট করে রুমের দরজা আটকে দিল। ভেতর থেকে একটা অপমানবোধ অসহ্য অনুভূতির মতো খামচে ধরলো অরিনকে। মনটা ব্যথাতুর হয়ে উঠল। শ্যানিনও তাকে ভুল বুঝছে? অরিন মেয়েকে নিয়ে নিচে চলে এলো। হালিমা অরিনকে দেখেই বললেন,
” এইতো অরিন, তোকেই এতোক্ষণ খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলি?”
অরিন বিরস মুখে বলল,” কোথাও না!”
সাদিকা মলিন মুখে অনবরত হাই তুলছে। হালিমা সাদিকাকে কোলে নিয়ে বললেন,” আহারে আমার নানুমণিটা। ঘুম পেয়েছে তোমার?”
সাদিকা আলতোভাবে মাথা নাড়ল। হালিমা নাতনির গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন,” অনেক হয়েছে। মেয়েটাকে এইবার ঘুম পাড়িয়ে দে। কোণার রুমে দ্যাখ সুমনা আর মিহরীমা আছে। তুইও যা। ওদের সাথে শুয়ে পড়।”
অরিন সাদিকাকে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। হাঁটতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। নুসাইবা, শ্যানিনের এমন ব্যবহার সে মেনে নিতে পারছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাও কেনো এতোবড় শাস্তি পেতে হচ্ছে?

ঘুমানোর সময় অরিন অনুভব করল, ইলহান তার আশেপাশেই আছে। দরজা খুলে সে নীরবে রুমে ঢুকেছে। সাদিকার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। অরিন ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। লাইট জ্বালিয়ে পানির জগে হাত দিতে নিয়েই তার হৃৎপিন্ড থমকে এলো। কারণ সাদিকা তার পাশে নেই। সুমনা আর মিহরীমা বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে। সুমনার পাশেই, অরিনের সাথেই তো সাদিকা ছিল। অরিন উন্মত্ত হয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগলো মেয়েকে। আরেকটু হলেই সে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই মনে হলো মা অথবা অর্ণভ ভাইয়া হয়তো সাদিকাকে বাহিরে নিয়ে গেছে। কারণ এই রুমের দরজা খোলা। অরিন বাহিরে বেরিয়ে উঠানে চলে আসলো। ঝিলপাড়ের অন্ধকারে দুটো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। তন্মধ্যে একজন নিঃসন্দেহে সাদিকা। মেয়েটার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, সিল্কি চুলের সুন্দর পনিটেইল দেখেই তাকে অনায়াসে অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা করে ফেলা যায়। আকাশে একরাশ ঝলমলে তারা। চাঁদের আলো ঝিলের ঠিক মাঝখানে ভেসে উঠেছে। অরিন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। তার বুক কাঁপছে। সাদিকার সাথে ওই মানুষটি কে? অরিন যা ভাবছে তা যেনো না হয়। তাই হলো। ইলহান সাদিকাকে কোলে নিয়ে ঝিলপাড়ে বসে আছে। সাদিকা তার ছোট্ট হাত দিয়ে ইলহানের লম্বা দাড়ি স্পর্শ করে কি যেনো বলছে। ওদের কথা অরিন শুনতে পেলেও উপলব্ধি করতে পারল না। এর আগেই রুক্ষ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
” সাদিকা, তুমি এখানে কি করছো?”
সাদিকা মাকে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। এই প্রথম মায়ের উপস্থিতি তার ভালো লাগলো না। এখন মা তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে এইটা বুঝতে পেরেই দুইহাতে ইলহানের গলা জড়িয়ে ধরল সে। অরিনের মনে হলো তার ভেতরটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। অরিন আরও তিরিক্ষ কণ্ঠে ধমক দিল,” আমার সাথে এদিকে এসো সাদিকা।”
সাদিকার নির্বিকার স্বীকারোক্তি, ” আসবো না।”
ইলহানের দৃষ্টি ঝিলের পানিতে৷ একটিবারও অরিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো না সে। কিন্তু অরিন বারবারই তাকাচ্ছে। না চাইতেও ইলহানের মুখের দিকে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে তার। অরিন অপ্রতিভ হয়ে বলল,” আসবে না মানে? কেনো আসবে না?”
” তুমি মিথ্যে বলেছো। ইলহান ভুতু মামা না। সে খুব ভালো। আমি ইলহানের কাছে থাকবো। হি ইজ মাই বেস্টফ্রেন্ড।”
রাগে, ক্রোধে অরিনের মাথা খারাপ হওয়ার যোগান। তার বাচ্চা মেয়েটা এইসব কি বলছে? অরিন নিজ দায়িত্বে এগিয়ে এসে সাদিকাকে ইলহানের কোল থেকে ছিনিয়ে নিল। ইলহান কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। মাথা নিচু করে বসে রইল। তার এই নীরবতা অরিনের সহ্য হচ্ছে না। অযথাই সাদিকাকে ধমকালো অরিন।
” আরেকবার ঘর থেকে বের হলে থাপড়িয়ে তোর গাল লাল করে ফেলবো আমি। ফাজিল কোথাকার!”
সাদিকা ঠোঁট ভেঙে কাঁদার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু কি মনে করে যেনো চুপ হয়ে গেল। কাঁদলো না। অরিন ইলহানের উদ্দেশ্যে বলল,
” এতোবছর কোনো খোঁজ নেই আর এখন এসেছে ঢং দেখাতে। যত্তসব আজাইরা! মানুষের নাটক দেখলে গাঁ জ্বলে যায়।”
ইলহান এইবারও প্রতিউত্তর করল না। ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো শুধু। কি আশ্চর্য! অরিন হাসির মতো কি এমন বলল? ঝিলপাড়ের সিঁড়ি ভেঙে সাদিকাকে নিয়ে উঠানে চলে আসলো অরিন। সাদিকা হঠাৎই কোল থেকে নেমে বলল,
” আমার ইলহানের সাথে একটা কথা আছে। তুমি ভেতরে যাও। আমি কথা শেষ করে আসছি।”
আঙুল উঠিয়ে চার বছরের মেয়েটা বড়দের মতো এমনভাবে আদেশ করল যে অরিন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল। সবথেকে বড় কথা সে ইলহানকে নাম ধরে ডাকছে। এইসব হচ্ছেটা কি? অরিন বলল,
” কোথাও যাবে না তুমি। আমার সাথে ঘরে চলবে।”
মেয়েটা হাত ভাজ করে ঠোঁট বাকিয়ে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল,” উঁহু, আমি ঘরে চলবো না। আগে কথা বলবো।”
” তোমাকে আমি একটা থাপ্পড় মারবো সাদিকা।”
” না, তোমাকে আমি থাপ্পড় মারবো।”
অরিন কোনোদিন যা করেনি এই প্রথমবার সেটা করল। সাদিকার গালে ঠাসিয়ে একটা চড় মারল। সাদিকা অপ্রত্যাশিত আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেল। ফরসা গাল টুকটকে লাল হলো। নাকের ডগা ফুলে সেইখানে ঘাম জমে উঠলো। সাদিকার চোখে পানি টুইটম্বুর। অরিন বলল,
” আর ঘরে আসতে হবে না তোর। বাহিরেই থাক। ওই ভুতুটা যখন এসে ধরে নিয়ে যাবে তখন বুঝবি মায়ের কথা না শুনলে কি হয়?”
অরিন ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। সাদিকা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
” মাম্মাম, দরজা খোলো। আমার ভয় লাগছে মাম্মাম।”
অরিন দরজা লাগিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। সাদিকা দরজা ধাক্কিয়েই চলেছে। আহ্লাদী স্বরে অনবরত কাঁদছে। অরিনের তাতেও মন গলছে না। আজকে ভয়ংকর রেগেছে সে মেয়ের উপর। একটু পর সবকিছু নীরব হয়ে গেল। সাদিকাও আর ডাকছে না। অরিন একটু চিন্তিতবোধ করল। উঠে দরজা খুলতে যাবে তখনি খেয়াল করল সাদিকা ডাকছে, ” মায়াপরী, এই মায়াপরী। দরজা খোলো না মায়াপরী!”
অরিনের কপালে ভাজ সৃষ্টি হলো। মেজাজটা আরও চড়ে গেল। দরজা খুলেই খিটমিট করে জিজ্ঞেস করল,” কি বললি তুই?”
সাদিকার চোখ দুটি আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। দুইহাতে তালি বাজিয়ে সে খুশিতে ডগমগ স্বরে বলল, ” ইয়েস! খুলেছে, খুলেছে, মাম্মাম দরজা খুলেছে। ইলহান বলেছিল এইভাবে ডাকলেই তুমি দরজা খুলবে। সত্যিই খুলেছো। ইলহান ইজ গ্রেইট। হি ইজ আ মেজিশিয়ান!”
সাদিকা দুইহাতে তালি বাজাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। অরিন পাশে তাকিয়ে দেখল ইলহান হেঁটে দোতলায় উঠে যাচ্ছে। অরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদিকাকে কোলে নিল। গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,” স্যরি মা।”
সাদিকাও অরিনের গালে চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,” ইটস ওকে মাম্মাম। আই লভ ইউ।”
সাদিকাকে নিয়ে বিছানায় আসতে না আসতেই সুমনা ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে বলল,” অরিন আপু, এখনও ঘুমাওনি তোমরা? ”
অরিন বলল,” এইতো ঘুমাচ্ছি সুমনা। অপরিচিত জায়গা তো, তাই সাদিকার একটু অসুবিধা হচ্ছে।”
সত্যি কথাটা ইচ্ছে করেই চেপে গেল অরিন। সুমনা হঠাৎ ঘুমন্ত কণ্ঠেই বলল,” বাড়িতে যদি জেল ফেরত খুনের আসামী থাকে, ঘুম কি আর চোখে ধরে? আমার তো একটু পর পর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে ভয়ে।”
অরিন হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” খুনের আসামী মানে? কে খুনের আসামী?”
” কেনো ইলহান ভাই! জানো না তুমি? উনি তো এতোদিন জেলে ছিল। শায়িখ আঙ্কেল মরার পর আমানত আঙ্কেল পাঁচদিনের জামিনে তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। পাঁচদিন পর আবার জেলে ঢুকে যাবে। তার ফাসির রায়ও কার্যকর হয়েছে। খুনী তো! ফাসি হবেই।”
অরিন কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ, অনুভূতিশূন্য হয়ে গেল।

চলবে

– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here