রংধনুর_রঙ_কালো,পর্ব ৩১,৩২

রংধনুর_রঙ_কালো,পর্ব ৩১,৩২
লিখা: Sidratul Muntaz
৩২

অরিনের অনুরোধে আহত, ক্ষত-বিক্ষত ইলহানকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। তার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। শরীর থেকে অনেক রক্ত যাওয়ায় ইমারজেন্সী ব্লাড লেগেছে। আইসিউতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অরিনের পুরো সময়টা ভয়ংকরভাবে কাটছিল। প্রতি মুহুর্তে সে ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করে অন্বয়ের কাছে এসে প্রশ্ন করেছে, ” অন্বয়সাহেব, সে বাঁচবে তো? মরে যাবে না তো!”
অন্বয় সান্ত্বনা স্বরূপ শুধু একটা কথাই বলল,” মিসেস অরিন, আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ।”
অরিন চিৎকার করে উত্তর দিল,” সে বাঁচবে কি মরবে জ্ঞান না ফিরলে নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। আর আপনি আমাকে বলছেন ধৈর্য্য ধরতে? এই অবস্থায় আমি কিভাবে ধৈর্য্য ধরবো বলতে পারেন?”
অরিন কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। অন্বয় হতবাক হয়ে রইল অরিনের আচরণে। একটা বিশ্বাসঘাতক নরপশুর জন্য অরিনের কিসের এতো টান বুঝে না অন্বয়। সে মরুক বা বাঁচুক তাতে অরিনের কি? এখনও কি সে এই মানুষটাকে ভালোবাসে? এখনও! এতোকিছুর পরেও! সারাদিন অরিন হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে কেঁদেছে। পাগলের মতো ছটফট করেছে। অন্বয় শুধু বসে অবলোকন করেছে তার নাজেহাল অবস্থা। বিকালে খবর এলো ইলহানের সুস্থতার। বিপদ কেটে যাওয়ার কথা শুনে অরিন শান্ত হলো বটে। কিন্তু ইলহানের সাথে দেখা করতে গেল না। অন্বয়কে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। অন্বয় এসবের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। তার মেজাজ মাথায় চড়ে আছে। সারাদিন কান্নাকাটি করে অপেক্ষার পর যখন ইলহানের জ্ঞান ফিরল তখন দেখা না করে ফিরে আসার মানে কি? এতোই যখন রাগ তাহলে তার জন্য কাঁদলো কেনো অরিন? তাকে হসপিটালে ভর্তি করালো কেনো? এই মেয়েটা আসলে কি চায়? অন্বয় বুঝতে পারছে না। ক্ষীপ্ত মেজাজ নিয়ে নিজের রুমে বসে ছিল৷ তখন অরিন দরজায় কড়া নেড়ে বলল,
” আসবো অন্বয়সাহেব?”
” হুম আসুন।”
অন্বয়ের কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা গেল সে মনে মনে প্রচন্ড ক্ষীপ্ত। অরিন ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বলল,
” ইলহানকে আমি হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি, ওর জন্য কেঁদেছি, অস্থির হয়েছি তার মানে এই না যে ওর প্রতি আমার এখনও কোনো দূর্বলতা আছে। আমি কেনো এসব করেছি…”
অরিনকে থামিয়েই অন্বয় বলল,” থাক মিসেস অরিন। এ বিষয়ে এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
” আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন মি. অন্বয়?”
অন্বয় কোনো জবাব দিল না। তার নিস্তব্ধতা দেখে অরিন উত্তর বুঝে নিল। কিছুটা কাঠখোট্টা স্বরে বলল,
” আপনি এ কারণে আমার উপর রাগতে পারেন না। একজন ব্যারিস্টার হিসেবে আপনার উচিৎ ইনভেস্টিগেশন করে ইলহানকে যারা মেরেছে তাদের খুঁজে বের করা।”
অন্বয় সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। জোরে টেবিলে একটা লাথি মেরে প্রায় চিৎকার করে এতোদিনের জমে থাকা সমস্ত রাগ ঝাড়তে লাগল। বলতে লাগল,
” হ্যাঁ, আমিই তো সব করবো! সব দায় তো আমারই! আপনি যখন যেটা বলবেন ক্রীতদাসের মতো আমাকে সেটাই করতে হবে তাই না? আমি আপনার হাসব্যান্ডের হাতে শুধু মার খাবো, অপমান সহ্য করবো। আবার আমিই তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনবো৷ তাকে হসপিটালে ভর্তি করবো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু যে, আপনার জন্য তাকেই আমার বারবার সাহায্য করতে হবে। যে আপনার সাথে বারবার প্রতারণা করছে, আপনাকে ঠকাচ্ছে, এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকেই বাঁচানোর জন্য আপনি আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করছেন বাহ! অসাধারণ বিচার আপনার। আর এদিকে যে আমি মরে যাচ্ছি? আমার প্রতি কোনো খেয়াল করছে আপনার?”
অরিন প্রায় থতমত খেয়ে অন্বয়ের কথা শুনছে। অন্বয় অরিনের কাছে এসে তার বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” স্বার্থপরতার একটা সীমা থাকা উচিৎ মিসেস অরিন। আপনি সেই সীমাটুকুও অতিক্রম করেছেন।”
অরিন কতক্ষণ চেয়ে থেকে শীতল কণ্ঠে বলল,” আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
অন্বয় ধাক্কা মেরে অরিনকে ছেড়ে বলল,” বুঝতে পারবেনও না। কারণ আপনি বুঝতে চান না।”
” কি বুঝতে চাই না আমি?”
” আপনি বুঝেন না আমি কি চাই?”
অরিন সাহসী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি চান?”
অন্বয় আক্রমণাত্মক গতিতে আলমারীর দিকে এগিয়ে গেল। শব্দ করে আলমারী খুলল। আলমারীর সমস্ত জিনিসপত্র ঢিল মেরে ফেলতে লাগল৷ অবশেষে একটা ডায়েরী বের করল। ডায়েরীটা অরিনের পায়ের কাছে ছুড়ে মেরে বলল,
” এই ডায়েরী তো আপনি অনেক আগেই পড়েছিলেন। আমার অনুভূতির কথা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি মিসেস অরিন। আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না? আই নিড ইউ।”
অন্বয় উদ্ভ্রান্তের মতো আলমারীর দেয়ালে চপোটাঘাত করল। অরিন কেঁপে উঠলো শব্দে। ধীরে ধীরে মেঝে থেকে ডায়েরীটা তুলল। তার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। কাঁপছে কণ্ঠনালী। চোখ দিয়ে অচিরেই জল বেরিয়ে গেছে। সে ভাবেনি অন্বয় এখনও তাকে ওই নজরে দেখে। অন্বয়ের কাজের জন্য ফিস দিয়েই তো অরিন তাকে অস্ট্রেলিয়া এনেছে। তাই তাদের সম্পর্কটা ব্যারিস্টার আর ক্লায়েন্টের মধ্যে যেমন সম্পর্ক হয়, তেমনই হওয়া উচিৎ। তাছাড়া অরিন এই ডায়েরীর কাহিনি জানার পরদিনই অন্বয় তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। অন্বয় বলেছিল অরিনকে শ্যানিন ভেবে সে ডায়েরীতে এইসব লিখেছে। তাহলে ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। আজ এতোদিন পর অন্বয় আবার কেনো এই প্রসঙ্গ তুলে আনছে? সে অরিনকে পাওয়ার স্বপ্ন কিভাবে দেখছে? অরিনের মনে হয়, এখন সময় এসে গেছে অন্বয়কে সবকিছু জানানোর। অরিন নিজেকে প্রস্তুত করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অন্বয় আলমারীর দেয়াল চেপে ধরে রাগ সামলাতে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার গলার রগ, হাতের রগ ফুলে উঠেছে। অরিন বলল,
” আমি তো প্রেগন্যান্ট, অন্বয় সাহেব।”
অন্বয় চকিতে মাথা তুলে তাকাল। তুমুল বিস্ময়ে বলল,” হোয়াট?”
অরিন ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” বেশিদিন হয়নি, মাত্র দুইমাস। ভেবেছিলাম কাউকে জানাবো না। কিন্তু আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি। আমি ইলহানের থেকে ডিভোর্স নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাবো। আমার বাচ্চাকে আমি একা মানুষ করবো।সিঙ্গেল মাদার হবো। তাও আমাদের লাইফে অন্যকেউকে থাকতে দিবো না। আমি কাউকে জীবনে আনতে চাই না। কাউকে না! তাই আপনি যেটা চাইছেন, সেটা কখনও সম্ভব না অন্বয়সাহেব।”
” তার মানে তো এটাই দাঁড়ায়, আপনি এখনও মি. ইলহানকেই ভালোবাসেন। এতোকিছুর পরেও?”
” না! ওর মতো বিশ্বাসঘাতককে আমি ভালোবাসি না৷ কোনোদিনও না। কিন্তু আমি চাই ও বেঁচে থাকুক। এই বাচ্চার উপর ওরও অধিকার আছে। আর এই বাচ্চারও অধিকার আছে তার বাবাকে পাওয়ার। আমি ইলহানের কাছে কোনোদিন ফিরবো না ঠিক। কিন্তু ওকে তো বাবার কাছে ফিরতেই হবে। ইলহান ভালো স্বামী না হতে না পারুক, ভালো বাবা নিশ্চয়ই হবে। আমি চাই, ইলহান ওর বাচ্চার জন্য হলেও বেঁচে থাকুক। একদিন আমার বাচ্চার সাথে তার বাবার দেখা হোক। সেদিন হয়তো আমি পৃথিবীতে থাকবো না। কিন্তু আমার বাচ্চা যেনো কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত না হয়। সে যেনো তার বাবাকে খুঁজে পায়।”
অরিন আর কথা বলতে পারল না। তার খুব কান্না আসছে। মুখে হাত রেখে সে শুধু কাঁদছে। কান্নার তোড়ে তার সারা শরীর কাঁপছে। অন্বয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন কি বলবে সে? তার যে কিছুই বলার নেই।

চলবে

#রংধনুর_রঙ_কালো
৩২.

তারপর কেটে যায় অনেকগুলো দিন,মাস,বছর। ইলহানের কাছে ডিভোর্স পেপার পাঠানোর পর অরিন লন্ডনে চলে আসে। এখানে তার জীবনটা নতুনভাবে শুরু হয়। এখন অরিন একজন সুপরিচিত পাবলিক ফিগার। তার নাম, যশ, খ্যাতি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে। এক নামেই প্রত্যেকে চেনে৷ বাংলাদেশী ব্ল্যাক গার্ল অরিন তাবাসসুম হিসেবে। যেই কালো রঙকে একটা সময় অরিন অভিশাপ মনে করেছিল এখন সেই কালো রঙই তার সবচেয়ে বড় শক্তি! ওর অনন্য গাঁয়ের রঙ ওকে অন্যদের তুলনায় বিশেষ করে তুলেছে অনায়াসেই। বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল চ্যানেলের বিজ্ঞাপন, গান, শর্টফিল্মে অভিনয় করছে অরিন। তার এই ক্যারিয়ারের শুরুটা যদিও অনেক সাদামাটাভাবে হয়েছিল। মিসেস এলেক্স নামের একজন অস্ট্রেলিয়ান সুন্দরী তাকে তার অনুষ্ঠানের মডেল হিসেবে নির্বাচন করেছিলেম। সেই অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটি মেয়ের ত্বকের রঙ ছিল কালো। কিন্তু অরিন ছিল সবার মধ্যে বিশেষ। ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটি’ নামের সেই অনুষ্ঠানের একটা ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হতে হতেই অরিনের পরিচিত যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। তারপর মিডিয়া থেকে মানুষ-জন আসতে শুরু করে, অরিনের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। ডিরেক্টররা তাকে সিনেমার প্রস্তাব দেয়। কালো রঙের অত্যাশ্চর্য সুন্দরী মেয়েটি বিজ্ঞাপন, পপ সং এ কাজ করলেও কখনও মুভি নিয়ে চিন্তা করেনি। বাস্তবজীবনে সে ঐকিক। তাই বড়পর্দায় কারো সাথে জুটি বাঁধার ইচ্ছে হয়নি কখনও। তবে একক সিনেমা হলে অভিনয় করতে দ্বিধা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার এই ঐকিক জীবন সম্পর্কে মানুষ অবগত। কিন্তু এই একাকিত্বের রহস্য ভেদ করার সৌভাগ্য কারো হয়নি। তবে এ নিয়ে অনেক প্রচলিত গুজব আছে। একেকজনের মুখে একেক রকম কথা শোনা যায়। সবচেয়ে বানোয়াট ও প্রচলিত গুজবটি হলো কালো রঙের জন্য একসময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল অরিন তাবাসসুম। তারপর তিনি নিজের সৌন্দর্য্য বিকশিত করার লক্ষ্যে মডেলিং এর পেশা বেছে নেন। আর আজ তিনি জনপ্রিয় ফ্যাশন আইকন। অরিনের এই বানোয়াট জীবন কাহিনী আজ মানুষের ইন্সপিরেশনের কাজে লাগে। ম্যাগাজিনেও এই নিয়ে প্রতিবেদন বের হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের লেখা পড়ে অরিনের হাসি থামে না। জনপ্রিয় সাংবাদিক জনসন অরচার্ড লিখেছেন,” মিসেস অরিন শ্বশুরবাড়িতে খুব অবহেলিত, নির্যাতিত হতেন। গায়ের রঙ কালো বলে শ্বাশুড়ি মা তাকে রান্নাঘরে শুতে দিতেন। বাসি খাবার খাওয়াতেন। অনাড়ম্বরপূর্ণ ছিল অরিন তাবাসসুমের বিবাহিত জীবন। অরিনের স্বামী কখনও স্বীয় স্ত্রীর মুখ দেখেননি। তিনি কালো স্ত্রীকে ঘৃণা করতেন এবং নারী নেশায় মত্ত ছিলেন…”
পুরো প্রতিবেদনে শুধু ওই একটা কথাই সত্যি। অরিনের স্বামী নারী নেশায় মত্ত ছিলেন৷ তাই অরিন তাকে ছেড়ে এসেছে৷ কিন্তু এটা কি আদৌ অরিনের কালো রঙের দোষ? কে জানে? বুক ভারী করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অরিন। সে তার ব্যক্তিগত ব্ল্যাক পাজেরোর বামপাশের সিট দখল করে বসে আছে। তার থেকে সামনের আসনে ঠিক ডানপাশে ড্রাইভার হ্যারি। গাড়ি থামলো গোল্ডেন হ্যাভেনে। এই প্যালেস অরিনের নিজের টাকায় কেনা। গাড়িটাও নিজের টাকার। এইখানে যা কিছু আছে সব অরিনের নিজস্ব অর্জন। অরিনের মা হালিমা বেগম ও মেয়ে সাদিকাকে নিয়েই এখন অরিনের সংসার। অরিনের বাবা গত হয়েছেন ছয়মাস আগে। খুবই কষ্টের দিন ছিল। সাদিকা তার নানাভাইয়ের জন্য সে কি কান্না! মাত্র চার বছরের ছোট্ট মেয়েটিও যেন বুঝতে পেরেছিল প্রিয়জনের মৃত্যু সবচেয়ে করুণ সত্য। গাড়ির দরজা খুলে দিল বাড়ির দাড়োয়ান। অরিনের গায়ে গাঢ় রঙের সিল্ক শাড়ি, হাতাকাটা ব্লাউজ। চুলগুলো কার্ল করে সামনে ছড়িয়ে দেওয়া। শ্যুটিং শেষ করে বাড়িতে প্রবেশ করতেই সাদিকা দৌড়ে নেমে আসল। মা এসেছে, মা এসেছে বলে হল্লা শুরু করল। সারাদিনের ক্লান্তির পর ছোট্ট মেয়েটার চেহারা দেখে কিছুটা স্বস্তি অনুভব হলেও অরিন বিরক্তির সুরে বলল,” তুমি এখনও ঘুমাওনি মা? নানু কোথায়?”
” আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নানুমণিই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি ঘুমাইনি। ঘুমের ভাণ করে শুয়েছিলাম।”
অরিন চোখ রাঙিয়ে বলল,
” দুষ্টু মেয়ে!”
মেয়েটা মুখ টিপে হেসে উঠল। অরিন বুকের বামপাশে তীক্ষ্ণ, সুচালো এক ঝলসে দেওয়া ব্যথা অনুভব করল। তার মেয়েটা এতো সুন্দর কেনো হয়েছে? কৃষ্ণকলীর ঘরে এমন সোনালী চাঁদ কি মানায়? মেয়েটার গাঁয়ের রঙ চকচকে সোনালী। ছোট ছোট পাগুলো যখন সে টিপিয়ে হাঁটে, সিল্কি চুলের পনিটেইল পিঠের এই পাশ ওই পাশ দুলতে থাকে। ওই অবস্থায় মেয়েটাকে যে কি সুন্দর লাগে! অরিনের খুশিতে কান্না পায়। বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে,” আমার মেয়ে, তুই শুধুই আমার মেয়ে। ”
অরিন হাঁটু গেড়ে সাদিকার সামনে বসে বলল,” তাই? মাম্মামের জন্য অপেক্ষা করছিলে? এখন তো মাম্মাম এসে গেছি। এখন ঘুমাবে তো?”
” হ্যাঁ ঘুমাবো। তার আগে আমার কিউরিয়াস মাইন্ড তোমাকে একটা কুয়েশ্চন করতে চায়। ইউ হ্যাভ টু এনসার মি।”
” ওকে বেবি। তোমার সব কুয়েশ্চনের এনসার আমি দিবো। এখন চলো।”
মেয়েটার নাক টেনে অরিন তাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে এলো। হালিমা বিছানায় শরীর এলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। অরিন সাদিকাকে বিছানায় রেখে আগে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। শাড়ি পাল্টে টি শার্ট আর স্কার্ট পড়লো। তার চোখে এখন রাজ্যের ঘুম। কিন্তু সাদিকা না ঘুমালে সে নিজে কিছুতেই ঘুমাতে পারবে না। সাদিকার জন্য আলাদা রুম আছে। সাদিকা রাতে নিজের রুমে একা ঘুমায় না। কিন্তু সারাদিন সেই রুমেই একাই থাকে। রাত হলেই তার যত ভয়। তখনি মায়ের কথা মনে পড়ে। অরিন সাদিকাকে কোলে নিয়ে সাদিকার রুমে চলে এলো। এই রুম অসংখ্য, পুতুল, টেডি বিয়ার দিয়ে সাজানো। অরিন বিছানায় শুয়ে সাদিকার সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” এইবার শুনি তো, আমার প্রিন্সেসের কিউরিয়াস মাইন্ডের কুয়েশ্চনটা কি?
” আমার বাপ্পা কোথায় মাম্মাম?”
অরিন হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ল। বাবাকে সে ‘বাবা’ বলতে পারে না। ‘বাপ্পা’ বলে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে এই প্রশ্নটা সে করবেই। অরিন তখন বানিয়ে বানিয়ে তাকে বাবার গল্প শুনায়। অরিনের মাঝে মাঝে মনে হয়, শুধু গল্প শুনেই সাদিকা তার কাল্পনিক বাবাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর সেই ভালোবাসাটা হয়তো বাস্তবের মায়ের চেয়েও বেশি। সাদিকা মায়ের থেকে তার বাবাকেই বেশি ভালোবাসে। কি আশ্চর্য! অরিন গল্প বলতে শুরু করল,
” একদিন আমি আর তোমার বাপ্পা বিশাল সমুদ্রে ঘুরতে গেছিলাম। তুমি তখন অনেক ছোট ছিলে। কুট্টি একটা বাবু চুপটি করে তার বাবার কোলে শুয়ে ছিল। তারপর হঠাৎ সেই সমুদ্রে ঝড় এলো। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল সেই ঝড়। আমাদের সুখের তরী ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তোমার বাবা তোমাকে বুকে আগলে রেখে বাঁচিয়েছে। তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজেই সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে। আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু গহীন সমুদ্রে তোমার বাবাকে কোথাও খুঁজে পাইনি। স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে সে বিলীন হয়ে গেছে। হারানোর আগে তোমার বাবা বলেছিল, সাদিকা যেনো রোজ স্কুলে যায়, মন দিয়ে লেখাপড়া করে, সময়মতো ঘুমায়, বেশি করে ভেজিটেবলস খায় আর সবসময় মায়ের কথা মেনে চলে। তাহলেই বাবা অনেক খুশি থাকবে৷ তুমি বাবাকে খুশি রাখতে চাও?”
সাদিকা ছোট্ট হাতে চোখের জল মুছে। ভেজা কণ্ঠে বলে,” চাই।”
অরিন দুইহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে,” তাহলে এখন ঘুমাও মা, কত রাত হয়ে গেছে। দেরি করে ঘুমালে বাবা রাগ করবে না?”
সাদিকা এইবার কোনো জবাব দিল না। একটু পর বলল,” সমুদ্র খুব পচা মাম্মাম। কেনো বাপ্পাকে নিয়ে গেল? সমুদ্র কেন বাপ্পাকে আমার কাছে আসতে দেয় না? ”
” সমুদ্রে কেউ একবার হারিয়ে গেলে আর কখনও ফিরে আসে না মা।”
” আই হেইট সমুদ্র। আই হেইট ওশ্যান।”
অরিন চোখের পানি মুছে মুছে বলল,” আমিও মা। আমিও সমুদ্র অনেক ঘৃণা করি।”
এরপর একগুচ্ছ নীরবতা। আস্তে আস্তে সাদিকার ঘুমে বিভোর হওয়া। আর অরিনের সারারাত নির্ঘুম জেগে থাকা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here