মেঘের_অন্তরালে,পর্বঃ ০৯,১০

মেঘের_অন্তরালে,পর্বঃ ০৯,১০
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৯

পরদিন সকালে ইসরা বাবা-মাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর রেজওয়ান বাড়িতে আসে। সকাল প্রায় এগারোটা বাজে ইসরা বাসায় পৌঁছায়। শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসে কারণ তার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।

কিচেনে মনিরা দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করছিলো, তার কাছে গিয়ে বলে, মনিখালা আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু আছে খাওয়ার মতো ?

মনিরা কিছু না বলে ফ্রিজে রাখা সকালের খাবার ওভেনে গরম করে ইসরার সামনে ধরলো। ইসরা খাবারের প্লেট নিয়ে বের হতে যাবে তার আগেই নিহানের মা কিচেনে প্রবেশ করলো।

ইসরাকে দেখে বললো, তোমার বাবা এখন কেমন আছে ?

ইসরা নিচুস্বরে বললো, আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে ?

ঠিক আছে নিজের রুমে যাও।

ইসরা নিজের রুমে গিয়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। ক্লান্তিতে শরীরটা অসার হয়ে আসছিলো। ক্লান্ত থাকায় বেশ অনেকটা সময় ঘুমালো ইসরা। আগামীকাল আবার কলেজে যাবে ভর্তির বাকি কাজ শেষ করতে।

১৪.
সকালে ইসরা বের হওয়ার সময় নিহানের সামনে পড়ে গেলো।

নিহান ইসরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছো ? তোমার বাবা তো এখন সুস্থ।

ইসরা নিজের কাগজপত্র আর একবার চেক করতে করতে বললো, কলেজে যাচ্ছি কিছু কাজ বাকি আছে।

নিহান কিছু একটা ভেবে বললো, চলো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, প্রয়োজন নেই আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।

বাসস্টপ পর্যন্ত চলো বাকিটা বাসে চলে যেও। এখন অফিস টাইম রিকশা পাওয়া কষ্টকর হবে।

নিহানের অতিরিক্ত ভালোমানুষি ইসরার কাছে সন্দেহজনক মনে হলো। তবু একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলো। ড্রাইভার ড্রাইভ করছে নিহান আর ইসরা পেছনের সীটে বসে আছে। ইসরা বাইরে তাকিয়ে আছে আর নিহান ইসরার দিকে।

মনে মনে বললো, যে না কুৎসিত চেহারা তার জন্য আবার বোরখা পরে হাত-পা ঢেকে এসেছে। কুৎসিত চেহারা মানুষের থেকে আড়াল করার ভালো বুদ্ধি বের করেছে। এই মেয়ের আবার কেমন সাহস আমাকে উপেক্ষা করে নিজেই চলে গিয়েছিলো সেদিন। আজ তার শোধ তুলবো, অপমানের বদলে অপমান।

নিহান হঠাৎ বলে উঠলো, ড্রাইভার গাড়ি থামাও।

ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলে ইসরা নিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে কেনো থামাতে বললো। তার আগেই দেখলো নিহান নিজের সাইটের জানালার কাচ নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে।

তন্বী অফিস টাইম হয়ে গেছে তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?

তন্বী এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, দেখুন না স্যার সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি একটা রিকশাও পাচ্ছি না।

সমস্যা নেই তুমি আমার সাথে চলে এসো, এক অফিসেই তো যাবো।

তন্বী ভিতরে তাকিয়ে বললো, কিন্তু স্যার আপনার সাথে তো কেউ আছে মনে হচ্ছে।

নিহান ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বরং এখান থেকেই রিকশা করে চলে যাও। তন্বীর লেট হচ্ছে, তোমার তো টাইম ফিক্সড করা নেই। লেট হলেও সমস্যা হবে না।

নিহানের কথায় ইসরা হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেই ডেকে এনে এখন মাঝ রাস্তায় নেমে যেতে বলছে। যেখানে এই মেয়েই রিকশা পাচ্ছে না, তাহলে সে কী করে পাবে ?

ইসরা থেমে থেমে বললো, উনি না-হয় সামনে,,,

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? ও একটা মেয়ে মানুষ ড্রাইভারের সাথে কীভাবে বসবে ?

তাহলে আপনি,,,

ইসরা কথা শেষ করার আগেই নিহান বললো, তুমি কিন্তু আমাদের লেট করাচ্ছো ।

ইসরা নিহানের দিকে একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলো। নিহান তা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেলো।

মনে মনে বললো, নিহান রেজওয়ানকে উপেক্ষা আর অপমান করার পরিণাম ভোগ করো এবার মিস আনজুম ইসরা। উপস সরি, মিসেস আনজুম ইসরা।

ইসরা নেমে যেতেই তন্বী খুশিতে গদগদ হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ইসরা নিহানের দিকে একবার তাকাতেই নিহান ভেতর থেকে জানলার কাঁচ উঠিয়ে দিলো।

গাড়ি চলতে শুরু করলেই তন্বী বললো, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।

নিহান গম্ভীর মুখে বললো, লিফট দিয়েছি বলে খুশিতে গায়ে ঢলে পড়ার প্রয়োজন নেই। অফিসের গাড়ি অফিসের স্বার্থে ব্যবহার করেছি।

মনে মনে বললো, আর কিছুটা নিজের স্বার্থে।

তন্বী বেশ অবাক হলো নিহানের ব্যবহারে। এই তো বেশ হেঁসে কথা বলছিলো, এখনই আবার কী হয়ে গেলো ? তন্বী এ বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে গাড়ির বাইরে দৃষ্টি রাখলো।

নিহান কীভাবে ইসরাকে শাস্তিটা দেবে সেটাই ভাবছিলো আর এমন সময় তন্বী তার সামনে আসাটা যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো কাজ করেছে। এদিকে ইসরা বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা পেলো। ইসরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, নিহানের এতো ভালোমানুষি করে গাড়িতে নিয়ে আসা আর মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে সেদিনের কথা মনে পরে গেলো। ইসরার বুঝতে বাকি রইলো না নিহান ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে। নিজেকে বকতে লাগলে কেনো উঠতে গেলো নিহানের গাড়িতে। নিজের উপর বিরক্তির মাঝেই ইসরা বাসস্টপে পৌঁছে গেলো। এখন আবার বাসের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে ?

১৫.
দেখতে দেখতে সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো। আর মাত্র হাতে গুণা কয়েকটা দিন বাকি আছে। ইসরা নিজের পড়াশোনা নিয়েই পার করেছে এই লম্বা সময়টা। মাঝে মাঝে এ বাড়ির মানুষের তিক্ত কথাগুলো তাকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিতো। তবু মুখ বুজে সব সহ্য করতো কারণ অন্যায়টা তার বাবার ছিলো। ইসরা চাইলেও সেটা অস্বীকার করতে পারবে না। নিহানের বিরক্তি ইসরার উপর দিন দিন যেনো বেড়ে পাহাড় সমান হয়েছে। ইসরা সহজে নিহানের সামনে যায় না। কিন্তু ভুল করেও যদি নিহানের সামনে চলে যায় তাহলে হাজার অপমান করতে নিহান ভুলে না। আজ পুরো রেজওয়ান পরিবার কোনো আত্নীয় বাড়ি যাবে বিয়ে খেতে। মনিরা কয়েকদিন হলো ছুটিতে গেছে। এখন একা বাড়িতে ইসরাকে কীভাবে রেখে যাবে বুঝতে পারছে না আর ইসরাকে সাথে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব।

আমিরা সোফায় বসে ভ্রু কুঁচকে বললো, ঐ মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে যাবে ,যদি আমাদের দামী জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায় ?

ইসরা ড্রয়িংরুমের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমিরার কথা শুনে বিস্ফুরিত চোখে তাকালো, আর কতো অপমান সহ্য করতে হবে ইসরার জানা নেই। সে নিজের বাবার বাড়ি চলে যেতো কিন্তু সেখানে তার সব ফুপিরা এসেছে। তারা আগে থেকেই ইসরাকে পছন্দ করে না। এখন যদি ইসরা বাড়ি যায়, তাহলে তার বাঁচা মুশকিল করে তুলবে এরা। ইসরা চাইছে না তারা থাকতে ও বাড়িতে যেতে। তাই বলে তাকে চোরের অপবাদও সহ্য করতে হবে ? ইসরার সারা শরীরের রক্ত যেনো হিম হয়ে আসছে।

আকরাম রেজওয়ান গম্ভীর গলায় বললো, আমিরা তুমি সবসময় বেশি কথা বলো। নিজেকে একটু শুধরানোর চেষ্টা করো, নাহলে এই অভ্যাসটাই একদিন তোমার কাল হবে।

কথাটা শুনে আমিরা মুখ কালো করে ফেললো। ইসরার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো। এ পর্যন্ত আমিরা তার বাবা আর বড় আব্বুর কাছে কম কথা শুনেনি ইসরার জন্য।

হঠাৎ নিহান বলে উঠলো, আমিরা ভুল কী বলেছে ? নিউজপেপারে এমন অনেক ঘটনা দেখা যায় আজকাল।

ইসরা অপমানে চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখের কোণে নোনাজলের স্রোতধারা। মনে মনে হিসাব করতে লাগলে ও বাড়ি গেলে কী, এর থেকেও বেশি অপমানিত হতে হতো তাকে ?

ইসরার হিসাব নিকাশের মাঝে আকরাম গম্ভীর গলায় বললো, তোমরা একটু চুপ করবে সবাই ?

তার আওয়াজে ড্রয়িংরুমের গুনগুন আওয়াজ থেমে গেলে সে ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, ইসরা তুমি একা থাকতে পারবে এই বাড়িতে ?

ইসরা কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

ও যেহেতু থাকতে পারবে তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায় ? সকাল সকাল সবার মতো রেডি হয়ে যেও।

ড্রয়িংরুমের মিটিং শেষ হলে আমিরা ইসরার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। ইসরাও নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার সামনে ফ্লোরে বসে পড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। জীবনের এই দুটো মাস ইসরা চাইলেও কখনো ভুলতে পারবে না। জীবনে এতো অপমান আর কখনো হয়তো হয়নি, এই বাড়িতে যতটা হয়েছে। ইসরা উঠে ক্যালেন্ডারের পাতায় হিসেব করতে লাগলো আর কতদিন বাকি আছে। লাল কালিতে গোল মার্ক করা তারিখটার কাছে যেতে আর মাত্র পাঁচটা দিন বাকি আছে। তারপর হয়তো এই অপমান থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাবে সে।

১৬.
ইসরা সকালে রুম থেকে বের হয়নি। সবাই রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে কথা বলছে আর যারা বাকি আছে হয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাইরের শোরগোল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেলো। ইসরা বুঝতে পারলো সবাই চলে গেছে। হঠাৎ করেই ইসরার ভয় করতে শুরু করলো, এই বাড়িতে শুধু সে একা আর একটা মানুষও নেই। গা ছমছমে মনে হচ্ছে পুরো বাড়ি। পরক্ষণে আবার ভাবলো এই পৃথিবীতে যার কোনো প্রয়োজনই নেই তার নিজের জীবন নিয়ে ভয় পাওয়ার মানেই হয় না। আর এই বাড়িতে মানুষ থাকা আর না থাকা তার জন্য সমান। তার সাথে কেউ তো আর ভালো করে দুটো কথা বলতে আসে না।

নিহানরা সেখানে দুদিন থাকবে। ইসরা একবার নিজেকে সাহস দিচ্ছে তো আবার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। দুপুরে নিজের জন্য কিছু রান্না করে খেয়ে নিলো। তার রান্নার হাত খুব বেশি ভালো না হলেও চলে যায়। রাতেও দুপুরের খাবার গরম করে খেয়ে নিলো। ভয়ে ভয়ে ইসরার দুদিন কেটে গেলো। কেউ একটা কল করে ইসরার খবরও নেয়নি দু’দিনে। তবে এই দুদিন ইসরার খুব একটা খারাপ যায়নি। যখন ইচ্ছা বাড়ির যেখানে সেখানে যেতে পেরেছে তার জন্য কারো কথা শুনতে হয়নি। যখন ইচ্ছে ছাঁদে বসে থেকেছে। মোটামুটি পুরো বাড়ি ভালো করে দেখে নিয়েছে দু’দিনে যেটা গত দু-মাসেও পারেনি। একটা রুমের সামনে লেখা নিশান। নিশান নামে এই বাড়িতে ইসরা কাউকে পায়নি। পরে চিন্তা করে বুঝতে পারলো এটা আমিরার ভাইয়ের রুম। ইসরার কৌতূহল হলো, নিশানকে নিয়ে দুমাসে দুটো কথাও শুনেনি সে। এ বাড়ির ছেলে অথচ কেউ তাকে নিয়ে কোনো কথা বলে না। দুমাসে তাকে দেখেনি ইসরা, কোথায় আছে সে ? হাজার ভেবেও কোনো উত্তর পায়নি তাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। এ বাড়ির কিছু নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না।

ফজরের নামাজ সেরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলো আকাশ আজ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নেমে যাবে। ইসরা আজ মুক্ত পাখি কেউ নেই তাকে কিছু বলার বা তার কাজে বাঁধা দেওয়ার। ইসরা দৌড়ে ছাঁদে চলে গেলো। আজ সে বৃষ্টিতে ভিজবে নিজের ইচ্ছে মতো। কেউ তাকে বাঁধা দিতে পারবে না। নিহানরা আসতে আজ বিকেল হয়ে যাবে, সে পর্যন্ত ইসরার স্বাধীনতা। ইসরা ছাঁদে গিয়ে দাড়ানোর দু মিনিটের মধ্যে সূর্য উঠার পরিবর্তে চারপাশ আরো অন্ধকার হয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। ইসরা দু’হাত দু’দিকে মেলে মুক্ত পাখির মতো ভিজতে লাগলো। বৃষ্টির পানিতে গায়ের জামা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।

ভেজা শরীর দেখিয়ে হাত করার চেষ্টা করছো ?

কথাটা ইসরার কানে গেলে কান গরম হয়ে উঠলো ঘৃণায়। চোখ মেলে ছাঁদের একপাশে ছাউনির নিচে নিহানকে দেখে অবাক, রাগ আর ঘৃণা তিনটাই হলো তার। ইসরা কিছু বলার আগেই নিহান তার সামনে এসে ইসরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।

রাগে চিৎকার করে বললো, ভেজা শরীর দেখিয়ে সংসার বাঁচাতে চাইছো ?

ইসরা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে নিহানের কথায় রাগে দাঁত কিটিমিটি করে বললো, নিহান মুখ সামলে কথা বলুন ?

সকালবেলা সাদা পোশাকে বৃষ্টিতে ভিজছো। শরীর দেখানোর জন্য যদি না হয় তাহলে কেনো ? তুমি জানো এখন আমি ছাঁদে থাকবো আর তাই এটা করছো। লজ্জা করলো না এতটা নিচে নামতে ? প্রস্টিটিউটদের মতো শরীর দেখাতে লজ্জা করলো না ?

লজ্জা, ঘৃণা, রাগ আর অপমানে বৃষ্টির বরফ ঠান্ডা পানিগুলো ইসরার কাছে আগুনের ফুলকি মনে হচ্ছে। সারা শরীরে মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে। চোখদুটো ভড়ে উঠছে অপমানের কষ্টে।

ইসরা হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, শাট আপ মিস্টার নিহান রেজওয়ান। অনেক বলে ফেলেছেন আর একটা শব্দও বলবেন না। এতোদিন বাবার অন্যায়ের জন্য মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। কিন্তু আজ আপনি আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। আপনাকে শরীর দেখানোর জন্য বৃষ্টিতে ভিজছি ? মিস্টার নিহান আমার নিশ্চয়ই জানার কথা নয় আপনি পরিবার রেখে একদিন আগেই বাড়ি ফিরে আসবেন ? আজকের সকালটা আপনি বিয়ে বাড়ি না থেকে এখানে থাকবেন। এসব নিশ্চয়ই আমার জানার কথায় নয় ?

একটু দম নিয়ে আবার বললো, আজ আপনি যেটা করলেন এর জন্য আমি আপনাকে কোনোদিন মাফ করবো না নিহান রেজওয়ান।

ইসরা এক ছুটে ছাঁদের গেইট দিয়ে নিচে চলে গেলো। নিহান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গতকাল বিকেলে অফিস থেকে ফোনে জানানো হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে আজ সকালে। তাই গতরাতেই নিহান বাড়ি চলে আসে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। ইসরার কোনোভাবেই জানার কথা নয় নিহান বাসায় আছে। অলসতার জন্য আজ মসজিদে না গিয়ে বাসায় ফজরের নামাজ আদায় করে ফেলেছে আর স্বভাবতই ছাঁদে এসেছে। ইসরা ছাঁদে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে ভিজতে শুরু করে দেয়। আর হঠাৎই ইসারার দিকে তাকিয়ে নিহানের চোখ আঁটকে যায়। সাদা পোশাকে শুভ্র একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ইসরার চিবুক বেয়ে নামতে দেখে একটা ঢোক গিলে নেয় নিহান। চোখ যায় বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপতে থাকা চোখের পাতার দিকে। নিহান যেনো অন্যকোনো জগতে হারিয়ে গিয়েছিলো কিছু মুহূর্তের জন্য। যখন হুঁশ ফিরে নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয় ইসরাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার জন্য। আর সেই রাগটাই ইসরার উপর ঝেড়েছে নিহান। কিন্তু এখন নিহানের মনে হচ্ছে সে অনেক বেশি বলে ফেলেছে। একটা মেয়েকে প্রস্টিটিউটদের সাথে তুলনা করার মতো বড় অপমান হয়তো আর কিছু হয় না। নিহান ভেজা গায়ে পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে, মাথার উপর টিনের ছাউনিতে ঝমঝম বৃষ্টি ফোঁটার শব্দ হচ্ছে। ছাদের এই জায়গাটাতে টিনের একটা ছাউনি তোলা আর সেখানে কিছু বসার চেয়ার। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আর তার ভিতরে বইছে অপরাধবোধের ঝড়।

ইসরা দৌড়ে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইসরার চিৎকার ওয়াশরুমের প্রতিটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চোখের পানিগুলো ঝর্নার ঠান্ডা পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। নিহানের কথাগুলো তাকে বিষের মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে। কথাগুলো যেনো বিষাক্ত তীরের মতো সারা শরীরে বিঁধেছে। ইসরা নিজের চুল আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদছে আর নিজের মাথার চুল টানছে। ইসরার জানা নেই সে কতটা সময় এভাবে বসে ছিলো। অনেকটা সময় পর উঠে বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে, কোনোরকমে চেঞ্জ করে বাবার নাম্বারে কল করে।

ইখতিয়ার আহমেদ মেয়ের কল দেখে খুশি হয়ে রিসিভ করে বলে, হ্যাঁ মা বল কেমন আছিস তুই ?

ইসরা বাবার গলা শুনে শুধু বাবা শব্দটা উচ্চারণ করে ডুকরে কেঁদে উঠে। কোনোভাবেই নিজের কান্না আটকাতে পারছে না। মেয়ের কান্না শুনে ইখতিয়ার আহমেদের বুক কেঁপে উঠে। ব্যস্ত গলায় বারবার জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে ? কিন্তু ইসরা কিছু বলতে পারছে না শুরু কেঁদে যাচ্ছে।

অনেকটা সময় পর ভেঙে ভেঙে বললো, বাবা আমি এখানে আর এক মুহুর্ত থাকতে পারছি না। দয়া করে তুমি এখনই আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। তুমি এখনই আমাকে না নিয়ে গেলে, চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলবে তোমার মেয়েকে।

ইসরা আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো। ইখতিয়ার আহমেদ বারবার কল দিতে লাগলেন কিন্তু ইসরা রিসিভ করছে না। তাই ব্যস্ত হয়ে রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং টেবিলে কাজ করতে থাকা পারভীন বেগম বারবার জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছেন ? কিন্তু ইখতিয়ার আহমেদের কোনো দিকে হুঁশ নেই। সে এখন পারলে বিদ্যুৎ গতিতে মেয়ের কাছে পৌঁছে যেতো কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। কিছু না বলেই দ্রুত বের হয়ে গেলো ইখতিয়ার আহমেদ। পারভীন বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। আজ সকাল থেকেই তার মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু খারাপ হবে। মেয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছিলো এখন সেই চিন্তা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। রুমে গিয়ে নিজের ফোন এনে মেয়েকে কল দিলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।

১৭.
নিহান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পানি পান করছে। ইসরার রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলো অফিস থেকে এসে সরি বলবে। এখন গেলে হয়তো আরো রেগে যাবে। নিহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেইন ডোরের দিকে যাবে তার আগেই কলিং বেজে উঠলো। নিহান চিন্তা করতে লাগলো এখন কে এলো ? সবাই আসতে তো বিকেল হবে। নিহান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ইসরার বাবা দাড়িয়ে আছে তার সামনে। এ বাড়িতে আসতে তার প্রায় এক ঘন্টা লেগেছে, এতোটা সময় শুধু ছটফট করে গেছে।

নিহান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ইসরার বাবা ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো ইসরা কোথায় ? দু তিনবার জিজ্ঞেস করার পর নিহান ইসরার রুমের দিকে ইশারা করলো। তিনি এক সেকেন্ড দেরি না করে ছুটে চলে গেলো সেদিকে।

দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, দরজা খোল মা। দেখ আমি চলে এসেছি তোকে নিতে আর এখানে থাকতে হবে না তোকে।

নিহান রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইসরার বাবা অনেক সময় ইসরাকে ডাকার পর নিহানের হুঁশ ফিরলো।ইসরা এখনো দরজা খোলেনি আবার সেন্সলেস হয়ে গেছে ভেবে দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে চাবি এনে দরজা খোলে দিলো নিহান ।

ইসরার বাবা দ্রুত রুমে ঢুকে ইসরা বলে চিৎকার করে উঠলো। নিহান তার পেছনে ভেতরে ঢুকে আঁতকে উঠলো। সাদা ফ্লোর লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর ইসরা বেডের সামনে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। একহাতে ছুরি আর অন্যহাতে এখনো রক্তের স্রোত বইছে। ইখতিয়ার আহমেদ আর নিহান দুজনেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

চলবে,,,

আজকের পার্ট ২৪০০+ শব্দে। প্রতিদিন ১৫০০+ থেকে ২০০০+ শব্দে গল্প দেই তবু সবাই বলে ছোট। আজের পর্ব আরো বড় করে দিয়েছি আগামী দুদিন গল্প দিতে পারবো না। তার জন্য আগেই বলে নিচ্ছি দুঃখীত।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১০

নিহান স্তব্ধ হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত ইসরার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে কাটা জায়গাটা শক্ত করে বেঁধে দিলো। ইসরার বাবা তখনো মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিহান কিছু না ভেবে দ্রুত ইসরাকে কোলে তোলে বের হয়ে গেলে ইসরার বাবাও পেছনে ছুটে যায়। নিহান বাসায় আসার সময় নিজের বাবার গাড়িটা নিয়ে এসেছিলো। ইসরাকে পেছনের সীটে শুইয়ে দিলে ইসরার বাবা ভেতরে গিয়ে ইসরার মাথাটা কোলে নিয়ে বসলো। নিহান দ্রুত ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

ইসরার বাবা বিড়বিড় করে বলছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমার জন্য আজ, আমার মেয়ের এমন অবস্থা। আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে।

হসপিটালে পৌঁছালে নিহান পুনরায় ইসরাকে কোলে তুলে নিলো। ইসরার বাবা শুধু পুতুলের মতো নিহানের পেছনে যাচ্ছে। সে এখন নিজের মধ্যে নেই।

ইসরাকে ইমারজেন্সি কেবিনে নেওয়া হয়। নিহানের সাদা রুমালটা রক্তে ভিজে গেছে। রুমালের উপর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পরছে। নিহান আর ইসরার বাবা দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে সারিবাঁধা চেয়ারে বসে পড়লো।

ইখতিয়ার আহমেদ এখনো বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমি নিজের হাতে নিজের মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছি।

নিহান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। মেয়েটা এমন একটা স্টেপ নেবে সে ভাবতে পারেনি। যদি ইখতিয়ার আহমেদ না যেতেন তাহলে কী হতো ভাবতেই নিহানের কলিজা কেঁপে উঠছে। নিহান অফিসে চলে যেতো আর ইসরা সারাদিন ওভাবেই পড়ে থাকতো আর একটা সময় হয়তো নিঃশব্দে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতো। পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলে নিহান বের করে দেখে অফিস থেকে কল দিয়েছে। নিহান উঠে একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করলো।

স্যার আমি মিটিংয়ে আসতে পারছি না।

নিহান তুমি এখন এটা কী বলছো ? পুরো প্রজেক্ট তুমি দেখেছো আর তুমি সবচেয়ে ভালো জানো। এখন শেষ মুহূর্তে এসে না করলে আমি বিপদে পরে যাবো।

স্যার আমার খুব কাছের একজন হসপিটালে, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না।

ঠিক আছে তুমি শুধু মিটিংটা করেই চলে যেও। ক্লাইট অলরেডি চলে এসেছে। বেশি সময় লাগবে না, তুমি আমাকে বিপদে ফেলো না প্লিজ।

নিহান একটু ভেবে বললো, ওকে স্যার আমি আসছি।

নিহান একবার ইখতিয়ার আহমেদের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে। সে জানে না তার যাওয়া উচিত হচ্ছে কিনা তবু যাচ্ছে। আজ মিটিংয়ে না গেলে কোম্পানির অনেক বড় লস হয়ে যাবে। কোম্পানির লস হলে মালিক নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিবে না। এদিকে ইসরার কিছু হলে ইসরার বাবা তাকে কী করবে সেটাও তার জানা নেই। নিহান নিজের চারদিকে অন্ধকার দেখছে। বাসায় গিয়ে মিটিংয়ের ফাইল নিয়ে দ্রুত অফিসে চলে গেলো।

এদিকে নার্স বের হয়ে বললো, রোগীর সাথে কে আছেন ?

ইখতিয়ার আহমেদ মাথা নিচু করে কাঁদছিলেন। নার্সের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে আমার মেয়ের ?

রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত রক্ত নেই। যা আছে তাতে হবে না আরো লাগবে।আপনি তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করুন।

আমার আর ইসরার রক্তের গ্রুপ একই। যত রক্ত লাগে আমার থেকে নিন। শুধু আমার মেয়েকে ঠিক করে দিন।

ঠিক আছে আসুন আমার সাথে।

ইখতিয়ার আহমেদ নার্সের সাথে যাওয়ার আগে কল করে পারভীন বেগমকে সংক্ষেপে যতটা পারলেন বলে দিলেন। যত তাড়াতাড়ি পারে হসপিটালে আসতে বললেন। ইখতিয়ার আহমেদ রক্ত দিতে চলে গেলো। পারভীন বেগম কী করবে বুঝতে পারছে না ? এমন খবর পেয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। ইমন কাছেই ছিলো সে ফোনটা নিয়ে হুরকে কল দিলো। হুর সব জানা মাত্রই ইসরার বাড়ি গিয়ে পারভীন বেগম আর ইমনকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলো। হসপিটালে যাওয়ার বেশ অনেক সময় পর ইখতিয়ার আহমেদ আসলেন। রক্ত দিয়ে তাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। পারভীন বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। সবাই চুপচাপ বসে আছে কেবিনের বাইরে, ইসরার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। নিহান কোনোরকমে মিটিং শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। মিটিংয়ে একদমই মনোযোগ দিতে পারছিলো না, বস সবটা সামলে নিয়েছে। নিহানকে সবার আগে ইমনের চোখেই পড়লো।

ইমন দৌড়ে গিয়ে নিহানকে মারতে লাগলো আর বলছে, তুমি আমার আপুকে মেরে ফেলেছো ? কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমার আপু কতো ভালো তুমি কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমিও তোমাকে মেরে ফেলবো, তোমার মতো বাজে ভাইয়া চাই না আমার।

নিহান ইমনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ইমনকে বাধাও দিচ্ছে না। আজ ইমন বড় থাকলে হয়তো নিহানকে এতো সহজে ছেড়ে দিতো না। হুর গিয়ে ইমনকে ছাড়িয়ে নিলো।

কঠিন গলায় বললো, কেনো এসেছেন এখানে ? এখনো বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটা জানতে ?

হঠাৎ ডক্টর বের হলে ইখতিয়ার আহমেদ তার সামনে গিয়ে দাড়ায় আর ভেজা গলায় বলে, আমার মেয়ে কেমন আছে ডক্টর ?

এখন বিপদমুক্ত, একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে। পেশেন্ট মানসিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। উনি রেসপন্স করতে চাইছিলেন না। তাই আমাদের এতো কষ্ট করে হলো। দেখুন সুইসাইড কেইস আমাদের পুলিশকে ইনফর্ম করতে হবে।

আমাদের কোনো অভিযোগ নেই কারো উপর। আমার মেয়ে বেঁচে আছে এটাই অনেক আমার জন্য। আমি চাই না এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হোক। আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি পুলিশকে জানাবেন না।

ডক্টর রাজি না হলে অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর রাজি হয়।

আমরা ওর সাথে দেখা করতে পারি ?

পেশেন্ট কারো সাথে দেখা করতে চাইছে না।

ডক্টর চলে গেলে ইখতিয়ার আহমেদ নিহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

ভেবেছিলাম আবার তোমার সামনে গেলে হাত জোর করে ক্ষমা চাইবো। কিন্তু এখন আর সেটা প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কারণ আমার করা অন্যায়ের খুব ভালো প্রতিশোধ নিয়েছো আমার মেয়ের উপর। আশা করি আর কোনো ক্ষোভ নেই আমার বা আমার মেয়ের উপর। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর আর কোনোদিন তুমি আমার মেয়ের মুখও দেখবে না। আমি নিজে চেষ্টা করবো যাতে ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তোমার জন্য নয় নিজের মেয়ের জন্য। এখন তুমি আসতে পারো।

নিহান নিচু গলায় বললো, আঙ্কেল ?

ইখতিয়ার আহমেদ কিছু না বলে নিহানের সামনে হাত জোর করে চলে গেলেন। নিহান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হুর নিহানের সামনে গেলো।

সেদিন আপনার অফিসে গিয়েছিলাম ইশুর হয়ে সাফাই গাইতে নয়। ইশু নির্দোষ সেটা প্রমাণ করতে।

ইসরা নিজের ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে নিহানের সামনে ধরলো।

নিহান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে হুর বলে, এটা বিয়ে ভাঙার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছিলো ইশু। দূর্ভাগ্য সেটা ফুপার হাতে পরে যায়।

বিয়ের আগে হাজারবার ইশু চেষ্টা করেছিলো বিয়েটা ভাঙার। হাজারবার আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো। ফুপার জন্য ওর সব দিকের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যেটুকু সুযোগ ছিলো সব চেষ্টা করেছে।

নিহান চিঠিটা নিয়ে বললো, আমি একবার দেখা করতে চাই ওর সাথে।

সেটা আর সম্ভব নয় মিস্টার নিহান রেজওয়ান। অনেক উপকার করেছেন, ওকে হসপিটালে আনতে সাহায্য করে। এখন আপনি আসতে পারেন।

ইমন আবার রেগে নিহানের দিকে তেড়ে গেলে হুর ইমনকে টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।

উপরের সাদা ছাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ইসরা। একহাতে স্যালইনের ক্যানেলা আর অন্যহাতে রক্তের। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে তার। ইসরা মনে করার চেষ্টা করলো ইখতিয়ার আহমেদকে কল দেওয়ার পর সে কী কী করেছিলো। কল কেটে দেওয়ার পর ইসরার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিলো। নিজের মাথার চুল টেনে কান্না করেছিলো চিৎকার করে।

হঠাৎই মনে হলো, বাবা কেনো আমাকে নিতে আসবে ? সে আসবে না আমাকে নিতে। আজ শুধু তার জন্য আমাকে এতো এতো অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। আমি তো তার বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম তাই এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে। না না আমি আবার তাদের বোঝা হতে পারবো না। এর থেকে ভালো হবে এতো দূরে চলে যাবো যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। সেখানে আমি কারো এতো সমস্যার কারণ হবো না। আমাকে এতো অপমান সহ্য করতে হবে না।

ইসরা আনমনে এসব বলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। সাইড টেবিলে আপেলের সাথে রাখা ফল কাঁটার ছুরি তার কাজটা একদমই সহজ করে দিয়েছে। বামহাতের উপর বসিয়ে একটা টান ব্যস এটুকুই।

ইসরা,,,,

কারো ডাকে ঘাড় কাত করে তাকাতেই নিজের গর্ভধারিনী মাকে দেখে চোখের শুকনো জলের ধারা আবার ভিজে উঠে।

একবার আমার কথা ভাবলি না ? একবার মনে হলো না আমার মা, যে আমাকে জন্ম দিয়েছে সে আমার লাশ কীভাবে সহ্য করবে ? একবার আমার মুখটা ভেসে উঠলো না তোর চোখে। আমি কী অন্যায় করেছি ? আমাকে কেনো এতোবড় শাস্তি দিচ্ছিলি ?

মায়ের কথায় ইসরা কেঁদে উঠে বলে, আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না।

পারভীন বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে আর ইসরাও মাকে জড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।

ইমন কোথা থেকে দৌড়ে এসে বললো, আপু আমি আর কোথাও যেতে দিবো না তোকে। ঐ বাজে ভাইয়াটার সাথে তো একদমই না। তুই আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না কথা দে।

ইসরা ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বড় ভাই হলে হয়তো কিছু করতে পারতো বোনের জন্য। ইখতিয়ার আহমেদ এতোক্ষণ কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

মাথা নিচু করে ঢুকে বলে, তুই হয়তো কোনোদিনই তোর পাপী বাবাকে মাফ করতে পারবি না। বিশ্বাস কর মা আমি তোর ভালোর জন্য এসব করেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার ভালো চাওয়া আমার সন্তানের জীবনে কাল হয়ে আসবে, তবে আর ভুল করবো না আমি। এই সমাজ যা ইচ্ছা বলুক আর করুক আমি তোর পাশে আছি। এবার থেকে যা হবে সব তোর ইচ্ছেতে হবে।

১৮.
হসপিটালের সামনের খোলা জায়গায় একটা বেঞ্চে বসে আছে নিহান। আজ সবকিছু বিষাক্ত লাগছে তার কাছে। নিজের কাজের জন্য প্রচন্ড অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই আজ। সব তার হাতের বাইরে চলে গেছে। হুরের দেওয়া চিঠিটা এখনো হাতে। খুব বেশি কিছু নয় মাত্র কয়েক লাইনের একটা চিঠি আবার চিরকুটও বলা চলে।

আমি আনজুম ইসরা, যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তবে সে নই আপনি যাকে দেখেছেন। আপনি যাকে দেখেছেন সে আমার মামাতো বোন হুর ছিলো। এটা আমার বাবার ভয়ংকর পরিকল্পনা। হুরের মতো সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়ে নিজের কালো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। আপনার ভালোর জন্য বলছি আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি হুরের মতো নই বরং তার বিপরীত। দয়া করে আপনি আমার বাবাকে বলবেন না এসব আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন বিয়েটা ভেঙে দিন, আল্লাহ হাফেজ।

আরো একটা মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে যাচ্ছিলে তুমি। পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে।

কারো কথায় হকচকিয়ে তাকায় নিহান। পাশেই ছেঁড়া আর ময়লা পোশাকে এক পাগল বসে আছে। অন্যসময় হলে হয়তো নিহান ঘৃণায় মুখ কুঁচকে নিতো। কিন্তু পাগলের বলা কথায় সে বিস্মিত। আরো একটা মৃত্যুর দায় মানে কী ?

পাগলটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, বুঝতে পারছো না আমার কথা ? আমাকে চিনতে পেরেছো ? জানি চিনতে পারোনি। মোহিনীকে মনে আছে তোমার, নাকি তাকেও ভুলে গেছো ?

নিহান নিজের অতীত খুঁজে মোহিনী নামের কাউকে পেলো না।

কপাল কুঁচকে বললো, আপনি কোন মোহিনীর কথা বলছেন ?

আজ থেকে সাত বছর আগে তোমার জন্য কেউ আত্মহত্যা করেছিলো আর তুমি এতো তাড়াতাড়ি তাকে ভুলে গেলে।

কথাটা কানে যেতেই নিহানের গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো। হ্যাঁ মনে পরে গেছে নিহানের। আজ থেকে সাত বছর আগে তারই জন্য তার ভার্সিটির এক হিন্দু মেয়ে আত্নহত্যা করেছিলো। প্রত্যক্ষভাবে সে দায়ী না হলেও পরোক্ষভাবে সম্পূর্ণ সেই দায়ী।

নিহান ভয়ে ভয়ে বললো, আপনি ?

চিনতে পেরেছো তাহলে ? হ্যাঁ আমি সেই হতভাগী মোহিনীর বাবা। সেদিন তোমাকে আমি একটা ডাইরি দিয়েছিলাম। তুমি হয়তো পড়োনি, যদি পড়তে তাহলে আজ এই হসপিটালের সামনে বসে থাকতে না, সাথে তোমার জন্য আর কোনো মেয়েও মৃত্যুকে আপন করার কথা ভাবতো না। তোমার ভেতরের কুৎসিত মনটা মরে যেতো সেই ডায়রি পড়লে।

নিহান ফট করে উঠে দাঁড়ালো আর নিজের গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। লোকটা পেছন থেকে হাসতে হাসতে বললো, চোখের পানির মূল্য তোমাকে দিতে হবে। নিজের কর্মের ফল থেকে কেউ পালাতে পারে না। তুমিও পারবে না, কখনো না।

নিহান গাড়ি নিয়ে বাসার দিকে গেলো, বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে পাগলের মতো ডাইরিটা খুঁজতে লাগলো। মোহিনী মারা যাওয়ার পাঁচদিন পর ডাইরিটা মোহিনীর বাবা নিহানের কাছে পাঠিয়েছিলো নিহানের এক বন্ধুর হাতে। মোহিনীর আত্নহত্যা নিয়ে পুলিশ নিহানকে অনেক হয়রানি করেছিলো তাই রাগে ডাইরিটা ছুঁড়ে ফেলেছিলো রুমের এক কোণে। তারপর আর কখনো খোঁজ করেনি সেই ডায়রির। সাত বছর আগের ডাইরি এখন কী খুঁজলেই পাবে ? নিহান সারারুম তন্নতন্ন করে খুজেও ডাইরি পেলো না। এলোমেলো রুমের ফ্লোরে বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। হঠাৎ কী মনে করে নিজের মাকে ফোন দিলো।

মা আমার রুমে একটা ডাইরি পেয়েছিলে ?

নিহানের মা তাড়াহুড়োয় বললো, তুই আবার ডাইরি লিখতে শুরু করলি কবে থেকে ?

মা আজ থেকে সাত বছর আগে তুমি আমার রুমে কোনো ডাইরি পেয়েছিলে ?

নিহানের কথা শুনে নিহানের মা একদম চুপ হয়ে গেলো। নিহান বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

নিহানের মা গম্ভীর গলায় বললো, সেদিন বলেছিলাম অতীত হাঁতড়ে দেখ নিজের কোনো অন্যায় খোঁজে পাস কিনা। নিজের অন্যায় নিজের চোখে সহজে পরে না রে নিহান। দেখ তুই নিজেই নিজের করা অন্যায় খুঁজে পেতে সাতটা বছর সময় লাগিয়ে দিলি।

ডাইরিটা কোথায় মা ?

প্রতিদিনের মতো সেদিনও তোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। তোর ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই, তাই তোর রুমে ডাইরি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। কৌতূহলের বশেই ডাইরিটা নিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিলো তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়ে পাপ করেছি আমি। নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃণা হয়েছিলো। চোখ দুটোর বৃষ্টি সেদিন থামতেই চায়নি।

মা, ডাইরিটা কোথায় আছে ?

আমার আলমারির একদম নিচের তাকে, জুয়েলারি বক্সের নিচে। আলমারির চাবি ড্রয়ারে আছে।

এতোটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো নিহানের মা। যে ছেলেকে নিয়ে সবসময় গর্ব হতো সেই ছেলেকে নিয়ে আজ সাত বছর ধরে লজ্জা হয় নিহানের মায়ের। তিনি নিজেই চান ইসরা চলে যাক নিহানের জীবন থেকে। কারণ নিহানের মতো মানুষ ইসরার মতো মেয়েকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে ডিজার্ভ করে না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here