মেঘসন্ধি,পর্ব-০৭
লেখনীতে:সারা মেহেক
হৃদয়ের প্রশ্নে মৌ বিস্ময়ভরা চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালো। হৃদয় যে এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে তা সে কখনও চিন্তা করেনি। এদিকে আয়ান কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো হৃদয়ের এহেন প্রশ্নে। সে আনমনে ভাবছে, এ প্রশ্নটার উত্তর দুইজন মানুষের কাছে দুই ধরণের পাওয়া যাবে। তার কাছে এর জবাব হবে ‘না’ এবং মৌ এর কাছে এর জবাব হবে ‘হ্যাঁ’। সুতরাং মানুষভেদে একই প্রশ্নের জবাব সত্য মিথ্যা হতে পারে! এই ভেবে আয়ান মাথা নামিয়ে হালকা হেসে দিলো। বলা বাহুল্য, আয়ানের এ হাসি হৃদয়ের মনে সন্দেহের বাতিক জাগিয়ে তুললো। তবুও সে এ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে নিজের করা প্রশ্নের জন্য তৈরী হওয়া অস্বস্তিকর পরিবেশ কাটাতে বললো,
” কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। আমি একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের তো, এজন্য এ বিষয়ে আজই সরাসরি জিজ্ঞাস করলাম। আমার অফিসের দুজন কলিগ এমন আছেন, যারা বিয়ের আগেই নিজেদের পছন্দের মানুষের সাথে রিলেশনে ছিলো। কিন্তু পরিবারের চাপে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পরও তারা এদিকে রিলেশন চালিয়ে যেতে থাকে। এখন আমার পক্ষ থেকে এমন কিছু হবে না। কিন্তু…….”
মৌ এতক্ষণ চুপচাপ সব সহ্য করলেও এখন মোটেও সে হৃদয়কে সহ্য করতে পারলো না৷ হৃদয়ের শেষের কথা যে তাকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে তা ধরে নিতে মৌ এর সময় লাগলো না। সে ক্ষুব্ধ গলায় তেড়ে গিয়ে বললো,
” আপনি আমার উপর সন্দেহ করছেন! আপনার সাহস তো কম নয়!”
মৌ এর তেজি কথাবার্তা শুনে হৃদয় ভয়ে চুপসে গেলো। তবুও ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাজনক হাসি এঁটে বললো,
” আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মৌ। আজকালের সময়ে এই রিলেশন থাকাটা অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই এমনটা জিজ্ঞাস করলাম আপনাকে।”
মৌ গরম চোখে একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তাই বলে উনার সাথে!”
আয়ান মৌ এর রেগে যাওয়া এবং হৃদয়ের প্রশ্ন শুনে হেসেই কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। তবে সবটাই নিজের ভিতরে। চাওয়া সত্ত্বেও এ হাসি সে বাইরে দেখাতে পারছে না।
এই প্রথম সে মৌ কে ক্রুদ্ধ হতে দেখেছে। পূর্বে সে মৌ কে নম্র অবস্থায় থাকতে দেখেছে। তবে আজ সম্পূর্ণ উল্টো। যেনো ভেজা বেড়াল আচমকা এক হিংস্র বাঘিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আয়ান নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, ‘মৌ এর তাহলে দুই রূপ আছে? আগে তো কখনও দেখিনি!” উত্তরটা আর হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে হলো না তাকে। কারণ উত্তরদাতা স্বয়ং তার সামনে উপস্থিত।
হৃদয় কিছু বলতে যাবে এর আগেই আয়ান প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে হালকা হেসে বললো,
” আরে ভাই….এমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এমন কিছু হলে কি মৌ এর সাথে আপনার বিয়ে হতো নাকি? আমিই ওকে বিয়ে করে নিতাম। ” এই বলে সে পরক্ষণেই জিব কেটে বললো,
” আই মিন, আমাদের ফ্যামিলি আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতো আরকি। কারণ, দুই ফ্যামিলির মধ্যকার সম্পর্কটা অনেক গাঢ়।”
আয়ানের কথাবার্তা শুনে হৃদয় বেশ আশ্বস্ত হলো। আয়ানের জবাব হ্যা হলে সে বেশ কষ্টই পেতো। কারণ সে মৌ এর ছবি দেখার সাথে সাথেই মৌ কে পছন্দ করে ফেলেছিলো। আর আজকে সরাসরি মৌ কে দেখে মৌ এর প্রেমে পরে গিয়েছে সে। এ মূহুর্তে যদি সে কোনোরকমে বুঝতে পারতো মৌ এবং আয়ানের মাঝে কিছু ছিলো বা আছে তাহলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতো সে। অবশ্য মৌ এর ব্যবহারগুলো দেখে সে কিছুটা সন্দেহ করেছিলো। তবে আয়ানের কথাবার্তায় অদ্ভুতভাবে সে সন্দেহ দূর হয়ে যায়!
আয়ান কয়েক সেকেন্ড মৌ এর দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
” আচ্ছা, আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি। পরে দেখা হচ্ছে তাহলে?”
হৃদয় মৃদু হেসে বললো,
” জ্বি অবশ্যই। ”
আয়ান প্রত্যুত্তরে আর কিছুই বললো না। বরং দ্রুত পায়ে ব্যালকনি ত্যাগ করলো।
.
হৃদয় এবং তার পরিবার চলে যেতেই মৌ নিজের রুমে এসে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। হৃদয়ের প্রশ্নগুলো এখন অব্দিও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কি করে হৃদয় এসব প্রশ্ন করতে পারলো! বিয়ের আগেই যদি সে এতো সন্দেহ করে তাহলে বিয়ের পরে কি করবে সে? যদিও মৌ জানে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন প্রশ্ন করা কিছুটা স্বাভাবিক। তবুও কোথায় যেনো একটা বাঁধা কাজ করছে বিয়েটা করতে।
মৌ চাইলেই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে পারতো। কিন্তু তার চোখের সামনে তার এবং হৃদয়ের বাবা একে অপরকে ওয়াদা করেছেন বিয়ের ব্যাপারে। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে চাইলেও কিছু করতে পারেনি। এসব জানার পরও যেহেতু তাকে বিয়েটা করতে হচ্ছে সেহেতু তাকে ‘এডযাস্টমেন্ট’ নামক একটা ভারিক্কি ধরণের শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে। যে শব্দটা একজন মেয়ের জীবনে খুব বড় প্রভাব ফেলে।
মৌ এর শব্দ করে দরজা লাগানোর বিষয়টা অবন্তিকা ইসলাম এবং জহির ইসলাম মোটেও ভালো নজরে নিলেন না। মৌ কি আদৌ বিয়েতে রাজি কি না এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে তারা আলোচনা করলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তারা মৌ এর রুমে গিয়ে মৌ এর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে। মৌ তাদেরকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললে জহির ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন হৃদয়ের বাবার কাছে ওয়াদা বদ্ধ। চাইলেও এ বিয়ে ভাঙা সম্ভব না। তোকে এটা সহ্য করে নিতেই হবে। হৃদয়…..” জহির ইসলামের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অবন্তিকা ইসলাম বললেন, ‘যেহেতু সবদিক দিয়েই তুই আটকে পড়েছিস, সেহেতু এই বড় বিষয়টাকেও নিতান্তই ছোট হিসেবে ধরে নিতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই মৌ। আল্লাহ তোর কপালে কি লিখে রেখেছেন তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। ‘ এই বলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই মৌ এর রুম থেকে চলে যায়। এদিকে মৌ দাঁতে দাঁত চেপে বিছানার চাদর খামচে ধরে কান্না করে দেয়। সামনের দিনগুলো তার জন্য কি নিয়ে আসছে তা সে জানে না। তবে মন বলছে, কিছু একটা খারাপ হবে। সেই সাথে ভালো কিছুও হবে, মন এমনটাই ইশারা করছে। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণা ছাড়া আর উপায় নেই তার কাছে।
.
এশার আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মৌ নামাজ পড়ে সকলের দৃষ্টির অগোচরে ছাদে এসে উপস্থিত হয়। এ মূহুর্তে একটু ঠাণ্ডা এবং সতেজ হাওয়া উপভোগ করে নিজের মধ্যকার অশান্তি, উৎকণ্ঠা, দম বন্ধ হয়ে আসার মতো পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবে সে।
মৌ ক্লান্ত দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাঝেমাঝে এ নিঃশ্বাস নেওয়াও কেমন যেনো বোঝা মনে হয় তার কাছে। অবশ্য এমনটা গত তিনদিন যাবত মনে হচ্ছে। পূর্বে এমন কিছুই তার মনে হতো না। তখন তো দুনিয়াকেই অন্য রকম লাগতো তার কাছে। অথচ আজকে………
মৌ এক ধ্যানে রাতের নিকষ কালো আকাশের দিকে চেয়ে আছে। যদিও এ মূহুর্তে শহুরে আলোর জন্য রাতের আকাশের গাঢ় ভাব কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তবুও যেমন কালো আছে তা কি আদৌ কম! মোটেও না। কারোর জীবন এমন কালো রঙে ছেয়ে গেলে তা সমাপ্তি পর্যায়ে পৌঁছে যায় বললেই চলে। যদিওবা অনেকে ক্ষেত্রে এ কালো আকাশ ফুঁড়ে সকালের সূর্যের দেখা মিলে। তবে তা কি সবার ক্ষেত্রে? উত্তর হলো, না। মৌ এর মনে এ মূহুর্তে একটা প্রশ্নই জেগে উঠছে, তার জীবনের আকাশে এ নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে কি আদৌ কখনো সকালের সূর্যের দেখা মিলবে? আদৌ কখন সে সুখী হতে পারবে? নাকি সারাজীবন এ কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে?
” মৌ? তুই সত্যিই হৃদয়কে বিয়ে করছিস?”
হঠাৎ আয়ানের কণ্ঠস্বরে শুনে মৌ চমকে উঠলো। তড়াক করে রেলিঙের উপর হতে হাত সরিয়ে পিছিয়ে এলো সে। কয়েক সেকেন্ড আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে সে চলে যেতে নিলো। কিন্তু আয়ান পিছন হতে তার হাত চেপে ধরে বললো,
” এখন অন্তত কথা বল মৌ। আজ নিয়ে তিনদিন যাবত তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে চলছি। অথচ তুই আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না! ”
আয়ানের কোনো কথাই কানে তুললো না মৌ। সে আয়ানের হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তোরজোড় করতে লাগলো। কিন্তু আয়ানের শক্তির কাছে সে পেরে উঠলো না। আয়ান মৌ এর দিকে দু কদম এগিয়ে এসে কাতর গলায় বললো,
” মৌ, প্লিজ আমার সাথে কথা বল। আমি কখনই তোর সাথে অতোটা খারাপ বিহেইভ হয়তো করতাম না। কিন্তু সেদিন করে ফেলেছি। কারণ আমার মাথা প্রচণ্ড গরম ছিলো তখন। ভালোমন্দ বিচার করার সময় ছিলো না সেদিন। যা মুখে এসেছি বলে দিয়েছি। কিন্তু পরে ঠাণ্ডা মাথায় সেসব নিয়ে ভাবতেই বুঝলাম কত বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। মৌ, আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে, আমি তোকে সরি বলেছি। কিন্তু আজ বলছি। এটা আমার প্রথম ভুল ভেবে ক্ষমা করে দে মৌ। ”
আয়ানকে অনেক কথাই বলতে মন চাইলো মৌ এর। কিন্তু মৌনব্রত নেওয়ার ব্যাপারটা মাথায় আসতেই সে নিজেকে সামলে নিলো। টু শব্দ করা ব্যতিতই সে সর্বশক্তি দিয়ে আয়ানকে ধাক্কা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছাদ হতে নেমে এলো। নিরুপায় আয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে ছাদের রেলিঙে একটা ঘুষি মারলো।
.
আয়ান বাসায় এসে নিজের রুমের ব্যালকনিতে উপস্থিত হলো। এখান হতে মৌ এর রুম এবং ব্যালকনি স্পষ্টরুপে দেখা যায়। এ মূহুর্তে মৌ এর রুমে লাইট জ্বালানো রয়েছে। ব্যালকনির দরজা বন্ধ রয়েছে এবং রুমের যে জানালা ব্যালকনিতে বের হয় সে জানালার পর্দা অর্ধেক টাঙানো রয়েছে। সবটাই বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো আয়ান। কিছুক্ষণ বাদে নিজেই নিজের এ কাজে চমকে উঠলো সে। বিড়বিড় করে বললো,
” আয়ান…তুই এমন কাজ করবি এটা কখনও চিন্তা করিনি৷ শেষমেশ কি না মৌ এর রুমে উঁকিঝুঁকি!! ”
আয়ান কিছুক্ষণ মৌ এর রুমে সে জানালার দিকে চেয়ে রইলো। হঠাৎ মৌ এসে সেই জানালার পর্দা পুরোপুরি টাঙিয়ে দিয়ে গেলো। আয়ানকে কিছুটা ভড়কে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
” এটা কি হলো!”
মৌ জানতো না আয়ান নিজেট রুম থেকে তার রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। সে স্বভাব বশতই নিজের রুমের জানালার পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে।
মৌ পর্দা টাঙিয়ে দিতেই আয়ান হতাশ ভঙ্গিতে রুমে এসে উপস্থিত হলো। সে নিজেও বুঝতে পারলো না, ঠিক কি কারণে সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মৌ এর রুমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ এ নিয়ে ভাবাভাবির পরও উত্তর না পেয়ে সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে আজকের সকল ঘটনা মনে মনে আওড়াতে লাগলো সে। হঠাৎ মৌ এর সৌন্দর্য নিয়ে হৃদয়ের মায়ের কথাগুলো তার কানে বাজতে লাগলো। কিছুটা অবহেলার সুরে সে বললো,
” মৌ এর মধ্যে এতো কিসের সৌন্দর্য আছে! আমি তো এতোদিনে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায়নি।” এই বলে সে চিন্তা করতে লাগলো, মৌ এর ছবিগুলো দেখবে কি না। যেই ভাবা সেই কাজ৷
আয়ান দ্রুততার সহিত পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি ঘেঁটে মৌ এর ছবি বের করলো। মৌ এর হাতেগোনা কয়েকটা ছবি আছে তার ফোনে এবং সবগুলোই অহনা নাহয় মাহতাবের সাথে তোলা। সেসব ছবির মধ্যেই একটা ছবি সে বের করলো।
গত বছর শীতে আয়ানদের বাড়ির ছাদে দু পরিবার মিলে ছোটখাটো একটা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছিলো। সেখানেই মৌ হালকা মিষ্টি রঙয়ের একটা থ্রি পিছ পরে এসেছিলো। যদিও রাতের বেলায় ছাদে রাখা হলদে বাতির আলোয় সেই মিষ্টি রঙ আর মিষ্টি রঙ রইলো না। বরং হলদে মিষ্টি রঙয়ের মিশ্রণে অদ্ভুত এক রঙ তৈরী হলো।
ছবিতে অহনা এবং মৌ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান মৌ এর চেহারার দিকে জুম করে দেখতে লাগলো। মৌ এর চেহারার রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা৷ আয়ান তা জানে। তবে এ ছবিতে মৌ এট চোখেমুখে হালকা হলুদ রঙের ছটা পড়েছে। হরিণীর মতো টানাটানা চোখজোড়া আর মৌ এর ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা সেই মিষ্টি হাসিটা আয়ানকে জোরালোভাবে আকর্ষণ করছে। এর আগে সে কখনই মৌ এর চেহারা, হাসি এর দিকে দৃষ্টিপাত করেনি৷ অথচ আজ ফোনে সেই মৌ এর ছবিই ঘেঁটে দেখছে সে! অদ্ভুত ঠেকছে সবকিছু তার কাছে।
এ মূহুর্তে আশ্চর্যজনকভাবে মৌ এর রূপের বর্ণনা দিতে মন চাইছে আয়ানের। একদম গল্প উপন্যাসে একজন প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর রূপের বর্ণনা যেভাবে দেয় সেভাবে! আয়ান নিজেই নিজের এ কাণ্ডে হতবাক হয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
” এক ‘সরি’ বলা আমাকে এতোটা চেঞ্জ করে দিলো! দিজ ইনসিডেন্ট গনা হন্ট মি ফর রেস্ট অফ মাই লাইফ।”
.
আগামী পরশুদিন মৌ এর হলুদ। হলদু এবং বিয়ে উপলক্ষে মৌ এর কাছের বান্ধবীদের এবং চেনা পরিচিত প্রায় সকল আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল হতেই এক এক করে মৌ এর খালা, মামা, চাচা, ফুফুরা আসতে শুরু করেছে। জহির ইসলামের পুরো বাড়ি এখন উৎসবমুখর পরিবেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
বিয়ের পাত্রী হিসেবে আজকে মৌ এর উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও ভার্সিটিতে জরুরী ক্লাস পরায় তাকে ভার্সিটিতে যেতে হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য পাত্রীদের মতো তার বিয়ে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তার বাবা জহির ইসলামের এ নিয়ে বেশ মাথাব্যথা। একমাত্র আদরের মেয়েকে বিয়ে দিবেন আর বড়সড় অনুষ্ঠান হবে না! এটা তো হতে দেওয়া যায় না। এজন্য জহির ইসলাম নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সকল সাজসরঞ্জাম করছেন।
মৌ এবং অহনা ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে এসে বসলো। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ তারা। মাথার উপরে ঘূর্ণনরত ফ্যানটার বাতাস তাদের কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। এজন্য অহনা ব্যাগ থেকে একটা শক্তপোক্ত খাতা বের করে হাতপাখার মতো বাতাস নিতে থাকে।
হঠাৎ অহনার পিছন থেকে তাদের ক্লাসের এক মেয়ে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
” তোমাকে এখনই ফাহাদ ভাইয়া ডাকছে। ”
ফাহাদ এ ভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। তবে একজন ছাত্রের চেয়ে নিজেকে নেতা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিতি দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। অহনাকে সে প্রথম থেকেই পছন্দ করে। অর্থাৎ অহনা যখনযখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলো তখন থেকেই। অহনা অবশ্য ফাহাদকে তেমন একটা পছন্দ করে না। সে বেশিরভাগ সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে। কারণ একে তো ফাহাদ তার সিনিয়র এবং এ ভার্সিটির এক ভয়ংকর নেতা। সবাই ফাহাদকে দেখে ভয় পায়। সেখানে অহনার ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক।
অহনা ফাহাদের কথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গেলো। শুকনো একটা ঢোক গিলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করলো,
” কেনো ডাকছে?”
মেয়েটা নিচু স্বরে বললো,
” আমি জানি না। তুমি সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে।”
অহনা ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলো,
” এখনই যেতে হবে?”
মেয়েটা হ্যাঁ বোধক জবাব দিলো। অহনা একবার মৌ এর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোক দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। সে এগিয়ে মৌ এর হাত ধরে তাকেও নিজের সাথে নিতে চাইলো। কিন্তু মেয়েটি তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
” মৌ কে নিতে নিষেধ করেছে। আমার সাথেই যেতে বললো তোমাকে।”
মেয়েটার এ কথা শুনে অহনা এবং মৌ ভয়ে চুপসে এলো। মৌ এর বুকের ভেতরটা ধুকপুক শব্দ করে চলছে। তার মন চাইছে অহনার সাথে যেতে। তবে সে নিরুপায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে অহনাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত হতে বললো। অহনা অসহায় চাহনিতে মৌ এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়েটার সাথে হাঁটা ধরলো। সে চলে যেতেই মৌ মনে মনে দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলো।
পাঁচ মিনিট বাদে সেই মেয়েটিই মৌ কে ডাকতে এলো। মেয়েটি মৌ কে বললো, অহনা তাকে ডাকছে এখনই। মেয়েটার কথায় মৌ বেশ ভয় পেয়ে গেলো। অহনার বিপদের কথা চিন্তা করতেই কয়েক মূহুর্তের জন্য তার শ্বাস আটকে আসছিলো যেনো। এজন্য কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে মেয়েটির সাথে চলে এলো।
মেয়েটি মৌ কে একটা ক্লাসরুমের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে বললো,
” এই রুমেই অহনা তোমাকে ডাকছে। ফাহাদ ভাইয়া এবং অহনা এখানেই আছে। তুমি যাও।”
মেয়েটির কথাবার্তা শুনে অজানা আশংকায় মৌ এর বুক কেঁপে উঠলো। সে তড়িৎগতিতে রুমে প্রবেশ করলো। তার কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি তাকে ক্লাসরুমের দরজা আটকে সেখান থেকে চলে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌ থ বনে গেলো। সামনের দিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তার বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করছে। সে বুঝতে পারছে, কোনো এক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে সে৷
” দরজা ধাক্কিয়ে লাভ নেই মৌ।”
হঠাৎ পিছন থেকে আয়ানেট কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো মৌ। চট করে পিছনে ঘুরতেই আয়ানকে দেখতে পেলো সে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে এলো,
” আয়ান ভাইয়া, আপনি এখানে!”
পরক্ষণেই তার মনে পরলো, সে তো আয়ানের সাথে মৌনব্রত পালন করছে! সাথে সাথেই সে দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো।আয়ান মৌ এর কাণ্ডকারখানা দেখে শব্দ করে হেসে বললো,
” এট লাস্ট তুই আমার সাথে কথা বললি। একবার যেহেতু কথা বলেই ফেলেছিস, এর মানে তোর মৌনব্রত ভেঙে গিয়েছে। এবার আমার সাথে ভালোমতো কথা বলে সবকিছু সলভ করবি।”
আয়ানের কথা শুনে মৌ এর মাথা যেনো দপ করে জ্বলে উঠলো। যেহেতু সে আয়ানের সামনে মুখ খুলেই ফেলেছে সেহেতু আজ সে আড়পার করেই দম নিবে। নিজের ভেতর জমিয়ে রাখা ক্রোধ আজ আয়ানের সামনে দেখিয়েই ছাড়বে। আয়ানের প্রতিটা কড়া কথার বদলে সেও তিক্ত কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়েই সে মুখ থেকে হাত সরিয়ে রাগত স্বরে বললো,
” কি সলভ করার কথা বলছেন আপনি? আমি যে সবার সামনে অপমানিত হয়েছি সেটা সলভ করবেন আপনি?”
মৌ এর উচ্চ এবং রাগত স্বর শুনে আয়ান থতমত খেয়ে গেলো। এমন প্রলয়ঙ্কারী রূপে মৌ কে সে কখনই দেখেনি। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে, ‘আমি কি আদৌ আজকে সবকিছু সলভ করতে পারবো?’
চলবে