মেঘসন্ধি,পর্ব-০২
লেখনীতে:সারা মেহেক
মৌ মুচকি হেসে আয়ানের দিকে তাকালো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও মৌ এর ঠোঁটের কোনে আটকে থাকা সে মিষ্টি হাসি আয়ানের নজর এড়ালো না। তবে বরাবরের মতোই সেই হাসিটা অগ্রাহ্য করলো সে। আজও এ হাসিটা তার উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। যেমনটা এর আগেও হয়েছে।
আয়ান ছাতা নিয়ে মৌ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৌ এর মাথার উপর ছাতা ধরতেই মৌ চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
” এসব কি আয়ান ভাইয়া?”
আয়ান গরম চোখে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বললো,
” এটা আমি আর আমার হাতে থাকা এ জিনিসটা হলো ছাতা।”
আয়ানের খোঁচা দেওয়া কথাবার্তা শুনে মৌ সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
” সে আমি জানি। আমি বলছি, আমাকে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে বাঁধা দিচ্ছো কেনো?”
আয়ান শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মৌ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর হুট করে কোনো প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই মৌ এর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সে। মৌ বেশ বুঝে গিয়েছে, আয়ান তাকে এ মূহুর্তে বৃষ্টিতে ভিজতে দিবে না। কিন্তু সে-ও নাছোড়বান্দা। আর যাই হোক, আজ সে ভালোমতো বৃষ্টিতে ভিজে তবেই বাসায় যাবে। এজন্য ছাদের দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই সে আয়ানের হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
” আমি এখন বাসায় যাবো না। বৃষ্টিতে ভিজবো। অনেকদিন পর আজকে একটু বৃষ্টিতে ভিজার সুযোগ হলো। আর তুমি সেই সুযোগ কেড়ে নিবে! মোটেও না৷ তুমি চলে যাও। বৃষ্টি থেমে গেলে আমি চলে আসবো।”
আয়ান কিছুটা রাগত স্বরে বললো,
” দেখ মৌ…..বাচ্চাদের মতো জিদ করিস না। ভালোমতো বলছি, বাসায় ফিরে চল। শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজে কি হবে? কোনো লাভ তো নেই বরং ক্ষতি আছে। এই যে এখন, বৃষ্টিতে ভিজছিস, রাতের মধ্যেই তোর জ্বর এসে যাবে৷ তখন পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবি আর আংকেল, আন্টী, মাহতাব, জান্নাতের রাতের ঘুম হারাম করে দিবি৷ এজন্য বলছি, চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মত আমার সাথে নিচে চল।”
আয়ানের যুক্তিপূর্ণ কথা শোনার পরও মৌ নিজের জায়গা থেকে এক পা নড়ে উঠলো না৷ বরং দৃঢ়চিত্তে বললো,
” এবার জ্বরও আসবে না৷ পুরো বাড়িও মাথায় তুলবো না। সুতরাং, আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজবো। ”
” তুই তো শরীরের ভেতরকার সব খবর জানিস তাইনা? তোর যে এবার জ্বর আসবে না কে বললো?”
” গত বছরে দুইবার বৃষ্টিতে ভিজেছি। একবারও জ্বর আসেনি। তাই এবারও আসবে না। ”
” এতো ভবিষ্যতবাণী না করে বাসায় চল। নাহলে আজ পর্যন্ত মাহতাব যেটা করেনি, সেটা আজ করবো আমি। দু গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিবো। ”
আয়ানের এ ধমকও কাজ করলো না মৌ এর উপর। সে জানে, আয়ানের রাগ বেশ ভয়ংকর। তবুও সে এখন আয়ানের রাগ দেখে ভয় পাচ্ছে না। উল্টো হুট করে সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো সে।
কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই আয়ানের হাত থেকে ছাতা নিয়ে ছাদের অপর দিকে ছুট লাগালো সে। আচমকা এমন হওয়ায় আয়ান হতভম্ব হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘটনাটি বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তার।
ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ বুঝে উঠার সাথে সাথেই আয়ান বড় বড় পা ফেলে মৌ এর দিকে এগিয়ে এলো। গরম চোখে মৌ এর তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” আজ যদি তোর জ্বর এসেছে….তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। ” এই বলে আয়ান শক্ত হাতে মৌ এর হাত চেপে ধরে ছাদ হতে বাসায় নিয়ে আসলো।
বাসায় আসার সাথে সাথেই মৌ মুখ কালো করে রুমে চলে গেলো। মৌ কে বাসায় দিয়েই আয়ান চলে যেতে নিলো। কিন্তু মাহতাব আয়ানকে ভেজা অবস্থায় দেখে কিছুটা অবাক হলো। দরজার কাছে এসে সে আয়ানকে জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার আয়ান? তুই ভিজলি কি করে?”
মাথার ভেজা চুলগুলো হালকা নাড়াচাড়া করে আয়ান বললো,
” তোর ঢিটমার্কা বোনের জন্য। ”
” ও আবার কি করলো?”
” আর বলিস না….আমরা ছাদে থাকতে থাকতেই বৃষ্টি শুরু হয়। সবাই চলে আসতে চাইলেও মৌ আসতে চায় না। পরে জান্নাত ভাবী আমাকে বললো, একটা ছাতা নিয়ে মৌ কে ছাদ থেকে নিয়ে আসতে। আমিও বেশ আনতে গেলাম….কিন্তু সে কিছুতেই আসবে না। আমি যেনো ওকে না নিয়ে যেতে পারি, এজন্য আমার কাছ থেকে ছাতা নিয়ে এক ছুট দিলো। ” এই বলে আয়ান ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেললো। মাহতাব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
” এই মেয়েটার কিছু কিছু স্বভাব পুরোই বাচ্চাদের মতো। আবার কিছু কিছু জ্ঞানীগুণীদেরও হার মানায়। তুই বাসায় চলে যা। বৃষ্টি থামলে আমি অহনাকে দিয়ে আসবো।”
হঠাৎ অহনার কথা বলতেই আয়ান মাহতাবের কাঁধ ছাপিয়ে ড্রইংরুমে চোখ বুলালো। সেখানে অহনাকে দেখতে না পেয়ে সে জিজ্ঞাস করলো,
” অহনা কোথায়?”
” আমাদের রুমে। জান্নাতের সাথে গল্প করছে।”
” ওহ আচ্ছা। তো তুই বাসায় কখন এলি?”
” বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসি। ”
” আচ্ছা ভালো….. তাহলে আমি যাচ্ছি।”
” ওকে যা।” এই বলে আয়ান সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলো।
আয়ান চলে যাওয়ার পর মাহতাব ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে দিয়ে খবর দেখতে বসে পরলো।
.
ঘুমের মাঝে প্রচণ্ড শীত অনুভব করলো মৌ। একদম হাড় কাঁপানো শীত যাকে বলে। অথচ এখন বর্ষাকাল চলছে!
শীতের কামড়ে ঘুম থেকে উঠে পরলো মৌ। বোজা বোজা চোখ নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারির কাছে গেলো। আলমারির দরজা খুলে একটা কাঁথা বের করেই বিছানায় এসে শুয়ে পরলো। এরপর আপাদমস্তক নিজেকে কাঁথায় ঢেকে নিলো।
কিছুক্ষণ পর সে অনুভব করলো তার শীত লাগা ভাবটা কমে আসছে। কিন্তু নিজের এক হাত দিয়ে অপর হাত স্পর্শ করতেই গরম ছোঁয়া অনুভব করলো সে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, সে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে আলতো হাতে কপাল চেপে ধরলো। প্রচণ্ড গরমে কপাল পুরে যাচ্ছে যেনো! এ মূহুর্তে একটা ‘নাপা’ না খেলেই নয়। এ মূহুর্তে মৌ এর শরীরে ওষুধ প্রবেশের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ সে তা চাইছে না। ধীরেধীরে শরীর যেনো ভেঙে আসছে তার। মনমস্তিষ্ক কিছুতেই সায় দিচ্ছে না, এখন উঠে গিয়ে ওষুধ খেতে। যেখানে মনমস্তিষ্কই সাফ মানা করে দিয়েছে সেখানে মৌ এর সাধ্য নেই এ ভাঙা শরীরকে টেনে নিয়ে উঠে যেতে। বরং এখন কষ্ট করে ঘুমিয়ে পরলে সকালে উঠে জ্বর ঠিক হয়ে যাবে। এই বুঝ দিলো সে নিজেকে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আয়ানের কথা মনে আসতে মৌ ম্লান হেসে বিড়বিড় করে বললো,
” আমার ভবিষ্যতবাণী তো ঠিক হলো না আয়ান ভাইয়া। শেষমেশ জ্বরটা আমাকে জড়িয়েই ধরলো। ” এসব বিড়বিড় করে বলতে বলতেই মৌ ঘুমের দেশে তলিয়ে পরলো।
.
প্রচণ্ড জ্বরে মৌ এর দুচোখ জ্বলছে। চোখ খোলা রাখা দায় হয়ে পরেছে তার জন্য। কিন্তু ক্লাস তো করতেই হবে। আগামী পরশু এ ক্লাসের উপর পরীক্ষা আছে তার। বরাবরের মতো এবারও তাকে পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। এজন্য ক্লাসে মনযোগ দেওয়াটা খুব দরকার। অথচ এ দরকারী কাজটা সে করতে পারছে না।
সকালে ঘুম ভাঙার পর মৌ নিজের জ্বর পরীক্ষা করেছিলো। তখন মোটামুটি সুস্থই ছিলো সে। তবুও ভার্সিটিতে যেতে মন চাইলো না তার। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে আসার পরপরই আজকের ক্লাসের কথা মনে পরতেই ভার্সিটি আসার তাগিদ অনুভব করে সে। যথারীতি সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ করে অহনার সাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে সে। তখন থেকে একটু একটু করে আবারও অসুস্থতা অনুভব করে সে। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লাস বাদ দেওয়া যাবেনা। ফলে শরীর আর মনের উপর এক প্রকার জোর খাটিয়ে সে ক্লাস করতে চলে আসে। অহনা তার সাথে থাকার পরও তার অবস্থা বুঝতে পারেনি। কারণ সে নিকাব পরে বাহিরে বের হয়।
যতো সময় পার হচ্ছে ততোই বেশি অসুস্থতা অনুভব করছে মৌ। তার পুরো শরীর জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছে যেনো। পরনের জামাকাপড়ও হয়তো এতক্ষণে গরম হয়ে পরেছে।চোখ খোলা রাখাও দায় হয়ে পরেছে তার জন্য। হঠাৎ করেই কোনো এক কারণে গলবিলের কাছে তেতো তেতো অনুভূত হচ্ছে। মৌ এর কারণট আপাতত জানে না। সে জানে জ্বর হলেই তার এসব লক্ষণ দেখা দেয়।
পুরো ক্লাসটা অতি কষ্টে শেষ করে উঠলো মৌ। অহনা এতক্ষণ তার পাশেই বসে ছিলো। কিন্তু মৌ এর অসুস্থতা সে খেয়াল করেনি। পুরো ক্লাস মনযোগ দিয়ে করেছে সে। কারন চলমান টপিকটা সে খুব একটা ভালোভাবে বুঝে না। এর উপর আবার পরশুদিন পরীক্ষা!
অহনা যে মৌ এর অসুস্থতা বুঝেনি তা নয়। সে প্রথম প্রথম কিছুটা আন্দাজ করেছিলো। মৌ কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসও করেছিলো। কিন্তু মৌ সাফ নাকচ করে দেয়। পরবর্তীতে ক্লাস শুরু হওয়ায় এ বিষয়ে অহনা আর ঘাটাঘাটি করেনি।
ক্লাস শেষে অত্যন্ত দূর্বল ভঙ্গিতে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মৌ। অহনা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার মৌ? তুই এভাবে উঠলি কেনো? কোনো সমস্যা?”
মৌ ম্লান হেসে জবাব দিলো,
” একটু জ্বর এসেছে, এই তো…..”
অহনা এবার চিন্তিত হয়ে মৌ এর ডান হাত চেপে ধরলো। নিজের হাতে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হলে সে বিস্ময় নিয়ে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বললো,
” মৌ!! তোর গায়ে তো প্রচণ্ড জ্বর! এতো জ্বর নিয়ে ক্লাস করলি কি করে এতক্ষণে? ”
মৌ জবাবে কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখার পর নিচু গলায় বললো,
” শরীরটা একদমই ভালো লাগছে না। বাসায় নিয়ে চল অহনা….”
মৌ এর কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই অহনা মৌ এর হাত ধরে বললো,
” চল। হাঁটতে কষ্ট হলে বলিস। আর তুই এতো জ্বর নিয়ে ক্লাস করলি কেনো?”
মৌ আবারও নিচু গলায় বহু কষ্টেসৃষ্টে বললো,
” পরশুদিন পরীক্ষা বলে আজ কষ্ট করে ক্লাসটা করলাম।”
অহনা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
” তোরও না….. পুরো মাথাই খারাপ। আমাকে বললে আমি সব ঠিকঠাক নোট করে তোকে দিয়ে দিতাম। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়া।”
মৌ প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না। কিছুদূর যাওয়ার পর সে আয়ানকে নিজের বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দূর্বল কণ্ঠে অহনাকে জিজ্ঞাস করলো,
” আয়ান ভাইয়া এখানে কেনো?”
” কয়েকটা জিনিস কেনাকাটার জন্য ডেকেছি। কিন্তু আজকে তো আর যাওয়া সম্ভব না। দাঁড়া, আমি ভাইয়াকে বলি, একটা সিএনজি ঠিক করতে।”
মৌ আর কথা বাড়ালো না। অহনার সাথে ধীর পায়ে হেঁটে চললো। তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো শেষ হয়ে আসছে একটু একটু করে। যেনো নিভে যাচ্ছে তার জীয়নকাঠি। ধীরে ধীরে পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। মাথাটা অল্পবিস্তর চক্কর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই যেনো সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।
মৌ এর এই ‘মনে হওয়া’টা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস্তবে পরিণত হয়। অহনাকে কিছু বলে উঠার আগেই মৌ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায়। তার সাথে অহনাও পরে যেতে নেয়। তবে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নেয়।
ওদিকে আয়ান এতক্ষণ স্বাভাবিকভাবেই মৌ আর অহনার চলার পানে তাকিয়ে ছিলো। মৌ এর দূর্বল চলনে সে একটু সন্দিহান ছিলো। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো, ‘মৌ কি অসুস্থ?’।
অবশেষে কিছুক্ষণের মাঝেই মৌ অজ্ঞান হতেই তার সে সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়। মৌ কে পরে যেতে দেখে হাতে থাকা হেলমেটটা কোনোরকমে বাইকের উপর রেখে মৌ আর অহনার দিকে দৌড়ে আসে সে। মৌ কে এভাবে পরে থাকতে দেখে দুশ্চিন্তা এবং হতভম্বের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠে আয়ানের চোখেমুখে।
চলবে