মিঠে_আলোয়,পর্ব_৬
ফায়জা_করিম
গাড়িতে বসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা মিঠাই, কান্নায় ভাসতে লাগল।
অভ্র বিয়ে করেছে.. অভ্রর বউয়ের নাম তন্বী। কী সুন্দর হেসে হেসে নিজের বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অভ্র মিঠাইকে আর মিঠাই হাসি হাসি মুখে সেটা গিলল।
মিঠাইর খুব কষ্ট হচ্ছিল যখন অভ্র ওর বউয়ের সামনে মিঠাইকে ছেলেবেলার খেলার সাথী বললো শুধু। আর কিছু না! আর কোন বিশেষত্ব নেই ওর… শুধু বন্ধু! কোন একজন বিশেষ বন্ধুও না? এমনকি মিঠাই তো অভ্রর কাছে একটা খুব ভালো বন্ধুর জায়গাটাও দখল করতে পারেনি।
ঠিক এতোটা কষ্ট বোধহয় মিঠাইর অভ্রকে.. গতবার বিদায় দেওয়ার সময়ও হয়নি। ওর এতোদিনের জমান ভালোবাসা কেমন ধুঁকে ধুঁকে মরছে আর মিঠাই অসহায়ের মতো সেই দৃশ্য দেখছে। কী করবে… ওর যে শুধু এই রোগের কারন জানা আছে কিন্তু কোন ওষুধে তার প্রতিকার হবে সেটা তো ও জানেনা।
রেজওয়ান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলাতেই মিঠাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার কোলে।
“বাবা, অভ্রর আমাকে একটুও মনে নেই.. ও আমাকে ভুলে গেছে বাবা। আমাকে আজ ও নিজের বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, আমি.. আমি আমার ছোটবেলার বন্ধুকে কোথাও খুঁজে পেলাম না… ও আমাকে ভুলে কেন গেল বাবা, ও কী করে ভুলে গেল.. ও, ও কী করে পারল।”
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো রেজওয়ান সাহেবের বুক চিরে।
“আমি খুব সরি রে মা.. আমার জন্যই হয়তো তোরা দুজন দূরে সরে গেলি, আমার জন্যই হয়তো তোদের বন্ধনটা ছিন্ন হয়ে গেল। আমায় তুই ক্ষমা করে দিস মা।”
বাবার স্বীকারোক্তিতে কান্নার বেগ আরো বাড়ল মিঠাইর। কিন্তু সত্যি কী বাবা দোষী? ওর আর অভ্রর বন্ধন যদি মজবুতই হতো তাহলে কী এই দূরত্বে সম্পর্কটা ভাঙ্গত? আসলে ওটা সত্যই কী কোন বন্ধন ছিল? মিঠাইর মনে হলো সম্পর্কটা আসলে ও একা কাঁধে নিয়ে ঘুরছিল… অভ্র তো ওতে কখনো ছিলই না।
“মিঠাই আমি আসলে.. ” মেয়ের কান্নায় ভিতরে ভিতরে অস্থির বোধ করলেন রেজওয়ান সাহেব।
“না বাবা তুমি দোষী নও, এতে তোমার কোন দোষ নেই।”
“মিঠাই… মারে দোষ তোদের দুজনেরও কারও না, দোষ পরিস্থিতির।”
“জানিনা বাবা কিন্তু অভ্র আমাকে একদম মুছে ফেলেছে ওর জীবন থেকে… এটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি ওর সাথে আর কক্ষনো যোগাযোগ করব না।”
রেজওয়ান সাহেবের মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠল মেয়ের পাগলামি দেখে। মিঠাই ছোটবেলা থেকে একটু একরোখা আর জেদি। সেই মেয়ের জেদ ভাঙ্গছে এটা যেমন একদিকে তার জন্য খুশির খবর তেমনি আরেকদিকে দুশ্চিন্তার কারনও বটে।
“আচ্ছা মিঠাই একটা কথা বলত… অভ্রদের বাসায় যেয়ে তোর কেমন লাগল?”
“জানিনা বাবা… অভ্রর আচরনে আমি খুব হার্ট হয়েছি, আমার ওদের বাসা দেখার মতো কোন মানসিক সিচুয়েশন ছিল না। ”
“হমম.. তোর যদি ওটা ভাল লেগে থাকে তাহলে আমি ওটা কিনে তোকে গিফট করতে পারি। কী বলিস কিনব? অভ্রর খুব একটা শাস্তি হবে তাহলে।”
“না বাবা,” চোখ মুছল মিঠাই। অভ্র ওকে ভালো না বাসুক মিঠাই নিজে কখনো অভ্রর ক্ষতির কারন হতে পারবে না।
“কেন? ছেলেটা আমার একমাত্র মেয়ের মন ভেঙ্গে দিয়েছে। ওর তো হিসেবে খুব বড়ো ধরনের একটা পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। ”
“না বাবা… তাহলে ওর আর আমার মধ্যে তো কোন পার্থক্য রইল না।”
“তাহলে অভ্রর সাথে ওই তন্বী না কী ফন্বী ওর ডিভোর্স করিয়ে দেই?”
“কী সব আবোল তাবোল বলছ বাবা! ”
“আবোল তাবোল কেন.. ও তোর সাথে যেমন চিট করেছে.. তুইও তেমনি ওকে তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়ে দে।”
চিট করেছে.. অভ্র ওর সাথে চিট করেছে… কিন্তু ওর আর অভ্রর মধ্যে তো কখনো কোন কমিটমেন্ট হয়নি। হ্যাঁ মনে মনে ছিল হয়তো কিন্তু সেটা যে একতরফা সেটা বুঝতে আর মেনে নিতে মিঠাইর অনেক দেরী হয়ে গেল। বাবা এই দূরত্বটা তৈরি না করলেও হয়তো ওদের রিলেশনের কোন ভবিষ্যত ছিল না। হয়তো একপেশে একটা ভালো লাগা হয়েই সম্পর্কটা টিকে থাকত। আসলে অভ্রর পরিবার আর ওর পরিবারের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। সেটা পজিশন হোক আর প্রতিপত্তি। এ কারনেই হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে অভ্রর মনে কোন প্রোগ্রেস হয়নি… তাছাড়া আজ যেভাবে অভ্র মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসায় ফিরল ওদের বাসায় এই কাজটা সব সময় কেয়ারটেকার আঙ্কেল করে থাকে। বাবাকে সব সময় কেতা দুরস্থ থাকতেই দেখেছে মিঠাই। ওর বাবার বাজারে যাওয়া মানে বাসার কেয়ারটেকার হালিম আর কাজের ছেলে সাথে যাওয়া।
তাছাড়া মনিরুল আন্টির কিচেনের মতো ঘুটঘুটে কিচেনে মিঠাই কখনো যেতে পারত কী না জানা নেই ওর.. আর বাবা বলছে ওই বাড়ি কিনে নিবে.. মাথা খারাপ হয়ে গেছে বাবার। তবে মিঠাই ওর বাসার কিচেনটা বেড রুমের চেয়ে বড়ো করবে আর ওতে কিচেনহুড তো মাস্ট, না হলে মিঠাই দমবন্ধ হয়েই মারা যাবে। যদিও এসব নিয়ে আগে কখনো মাথা ঘামায়নি মিঠাই… কিন্তু অন্তরার ব্যবহারে আজ কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল মিঠাইর। মনে হচ্ছিল অন্তরা মিঠাইকে, ওর সামাজিক অবস্থানকে ঘৃনা করে। যেন মিঠাই মানুষ হলেও ওদের থেকে আলাদা, ওর বসবাসের পৃথিবীও আলাদা।”
“মিঠাই”
“বলো বাবা”
“বলছি অনন্য ছেলেটা কিন্তু একেবার মন্দ না.. কথায় কথায় একটু বেশি হাসে বোকার মতো এই আরকি ”
“জানি বাবা”
“তাহলে ওর বাবা-মায়ের সাথে তোদের বিয়ে নিয়ে আলাপ করি। ওরা অনেকদিন ধরে আশা করে আছে।”
মিঠাই বাবার বুকের আরও গভীরে ঢুকে যায়। ওর এখন কিছুই ভালো লাগছে না… কিন্তু বাবারা কেন যে কিছুই বুঝতে চায় না। শুধু ফোর্স করে আর ফোর্স করে।
“মিঠাই…”
“আচ্ছা বাবা ” চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে মিঠাইর।
“আমার লক্ষী মা,” রেজওয়ান সাহেব মিঠাইর মাথায় চিবুক ঠেকান। মেয়ের কান্নাটা এখনো তিনি হজম করতে পারছেন না, সত্যি পারছেন না।
অনন্য আর মিঠাইর বিয়ের সানাইটা বাজল ঠিক দুই মাস পর।
বিয়ের দিন সকাল থেকে এক মিনিটের জন্য ফুরসত পাচ্ছিল না মিঠাই। নিজের কোম্পানি ছাড়াও বড়ো বড়ো কয়েকটি কোম্পানির বড়ো শেয়ার হোল্ডার রেজওয়ান আহমেদ.. তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা, গত কয়েকদিন ধরে বাড়তি মেহমানের চাপে বাসার কাজের লোকগুলো প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল চা-নাস্তা দিতে দিতে… এর মধ্যেই আবার মিঠাইর বিশাল বন্ধু-বহর আর আত্মীয়-স্বজনের দেখাশোনা.. তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল মিঠাইর। অনন্যর ফোনটা পেতেই তাই নিজেকে একটু রিলিফ দিল ও।
“ম্যাডামের হাল কী খুব বেহাল?” ফুরফুরে মেজাজে জানতে চাইল অনন্য।
“অতোটাও নয় যতোটা ভাবছ তবে একটু টালমাটাল। ”
“পারমিশন দিলে আমি এসে ধরতে পারি… হাল।”
“নো থ্যাঙ্কস.. তুমি তোমার ডিউটটা ঠিক মতো পালন করো তাহলেই হবে।”
“হমম.. আমি তো ডিউটি করার জন্য ভোর বেলা থেকে রেডি হয়ে আছি কিন্তু এই সূর্যমামা শত্রুতা করে ডুবে যাওয়ার নামও নিচ্ছে না… কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে।”
চুকচুক করে শব্দ করলো মিঠাই।
” আহারে.. কিন্তু বিয়ে তো রাত আটটার আগে হবে না অনন্য সাহেব।”
“মিঞা বিবি রাজি তো কিয়া কারেগা কাজি… চলো মগবাজারের কাজী অফিসে আমার এক নানা আছে, উনার কাছে চলে যাই।”
“তারপর!”
“তারপর আর কী, শুভ কাজে দেরী করতে নেই.. তাই সকাল সকাল বিয়েটা সেরে ফেলি।”
“পাগল একটা ”
“তোমার জন্যে ”
“বাপরে তুমি দেখি ফ্ল্যাটারিও জানো ”
” তালিম নিচ্ছি.. বউ পাবোতো আজ একটা, আগে কখনো ছিল না তাই সব রকম কসরত শিখে রাখতে চাচ্ছি… যাতে বউ আমাকে…”
“বউ তোমাকে?”
“রাতে ঘরে থাকতে দেয়, ঘর থেকে বের করে না দেয়।”
অনন্যর কথায় খিলখিল করে হেসে ফেলল মিঠাই।
“ভালো। খুব ভালো করে তালিম নাও যাতে কিভাবে সোফায় শোয়া যায় বুঝতে কোন সমস্যা না হয়। দেখ না গল্পে, সিনেমায় নায়করা রেগে গেলে সোফায় গিয়ে ঘুমায়।”
“আমার রুমে ওসবের কোন কারবার নেই, একটা বিছানা দুটো বালিশ.. কোলবালিও বের করে দিয়েছি.. বউ থাকতে কোলবালিশ দিয়ে কী করব বলো? আর বউয়ের সাথে রাগ করা মানে নিজের লস… আমি ওসব রাগ ফাগের মধ্যে নেই।”
অনন্যর কথায় মিঠাই তখনও হাসছে কিন্তু কেন যেন হাসিটায় কোন প্রান নেই। ফোনের বিপরীত প্রান্ত থেকে অনন্যর কান সেটা ধরতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না… কিন্তু মিঠাইর চোখ দুটো হাসছে না। ওর কেবল মনে হচ্ছে ও অনন্যকে ঠকাচ্ছে না তো… ওকে বিয়ে করে অনন্য সুখি হবে তো?
চলবে……