মন_বিনিময় #পর্বঃ২৬ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাহিতার সামনে চেয়ারে গম্ভীরমুখে বসে আছে স্বপ্নিল। তার দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহিতা। যেন ওর এমন মুখভঙ্গি দেখে বুঝার চেস্টা করছে সে কি এমন জরুরি কথা বলতে চাইছে। তবে রাহিতাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা, স্বপ্নিল নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করলো।

—আমি আসার আগে খালামনি কি কি বলেছে তোমায়?

চমকে গেলো রাহিতা। স্বপ্নিল যে হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা ভাবেনি সে। ওকে চমকাতে দেখে স্বপ্নিল চেয়ারটা আরেকটু এগিয়ে নেয়। একদম রাহিতা মুখোমুখি, কাছাকাছি বসে। এখন দুজনের মাঝে দূরত্ব নেহাৎ অল্প, একটু হাত বাড়ালেই একে-অপরকে অনায়াসে ছুয়ে দেওয়া যাবে। স্বপ্নিলকে নিজের এত কাছাকাছি দেখে রাহিতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। তবে তা ভয়ে নয়, লজ্জায়। স্বপ্নিলকে এত কাছে এভাবে একদৃষ্টিতে নিজের দিক চেয়ে থাকতে দেখে লজ্জাবতীর ন্যায় আরেকটু নুইয়ে পড়ে মেয়েটা। চোখে চোখ রাখতে পারেনা বেশিক্ষণ, নামিয়ে নেয় মাথা। কিন্তু স্বপ্নিল নির্বিকার, সেটা দেখেও যেন বুঝেনা। সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নির্লজ্জের ন্যায় বলে,

—এখন রোমান্স করতে আসিনি যে এত লজ্জা পাচ্ছো তুমি৷ সিরিয়াস কিছু জিজ্ঞেস করেছি, সিরিয়াসলি উত্তর দাও। যখন রোমান্স করতে আসবো, তখন না হয় লজ্জা পেয়ো।

স্বপ্নিলের কথায় চোখ খিচে বন্ধ করে রাহিতা। রক্তিম আভায় লালিত হয় মুখ। মনে মনে কয়েকশ বকা দেয় ওকে। এভাবে না বললে কি হতোনা? এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। মাথা নাড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,

—আচ্ছা ঠিক আছে। আর বলবোনা এসব। এখন কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি রাহি৷ আমি বাসায় আসার আগে সীমা খালামনি তোমায় কি কি বলেছিলো আমায় সব খুলে বলো। একদম কোনোকিছুই লুকোবেনা।

এবার নিজেকে ধাতস্থ করে রাহিতা। গলা ঝেড়ে এক এক করে সব খুলে বলে। লুকোয়না কোনোকিছু। সব শুনে স্বপ্নিলের গম্ভীর হয়ে থাকা মুখশ্রী আরেকটু থমথমে হয়। ফোস করে এক শ্বাস ফেলে গমগমে গলায় বলে,

—আমি জানতাম! এমন কিছুই হবে। উনি এতদিন মনের মাঝে আমার ও মায়ের উপর যে রাগ পুষে রেখেছিলেন তা আজ সুযোগ বুঝে তোমার উপর ঝেড়েছেন। এজন্যই আমি তোমায় বলেছিলাম তার থেকে দূরে থাকতে, তাকে এভোয়েড করতে। দেখলে তো কেমন তার ব্যবহার? তবুও তুমি শুনোনি কেন আমার কথা?

স্বপ্নিলের কণ্ঠে স্পষ্ট ক্রো’ধ। কপালে পড়েছে ভাজ, যেন রাহিতার সাথে হওয়া এমন আচরণের কারণ সে নিজে। ওকে বিচলিত হতে দেখে নিজেকে তটস্থ করে রাহিতা। বুঝে স্বপ্নিল রেগে আছে, অপরাধবোধে ভুগছে, ওকে ঠান্ডা করতে হবে। অতঃপর আলতোভাবে হাত রাখে ওর সামনে বসে থাকা স্বপ্নিলের কাধে। চোখে চোখ রাখে নির্দ্বিধায়। নরম গলায় বলে,

—আমি জানি আপনি খালামনির থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি কি করে থাকতাম বলুন? মাত্র এসেছেন তিনি বাসায়। আর আমি নতুন বউ। এখন যদি আমি হুট করে তাকে ইগ্নোর করতাম তবে সেটা কি ভালো দেখাতো, বলুন? সবাই কি ভাবতো?

—সবাই কি ভাবতো সেটা দিয়ে তুমি কি করবে। আমি তো সবারটা চিন্তা করিনি, তোমারটা চিন্তা করেছিলাম বলেই তোমায় আগেভাগে সতর্ক করেছিলাম। যদি তুমি তো তুমিই। সবার কথা ভাবতে যেয়ে নিজে এতগুলো কথা শুনলে। এত ভালো হয়ে কি হবে, রাহি? ভালো মানুষদের সবাই কস্ট দেয়।

—তাই? এ কথা আপনি আমায় বলছেন? তবে আপনি নিজে কি করলেন আগে সেটার ব্যাখা দেন।

—মানে?

চমকে উঠে স্বপ্নিল। ওর চোখে বিস্ময় দেখে মৃদু হেসে রাহিতা বলে,

—আমায় যে ভালো হওয়ার জন্য এত কথা বলছেন, আপনি নিজেও তো একি কাজই করলেন।

—আ,আমি কি করেছি? কিসের কথা বলছো তুমি?

—এই যে আপনি এতকিছু শুনলেন খালামনির থেকে, আপনায় তিনি কতকিছুই না বললেন। তখন তো আপনি চাইলেই তাকে আনিকা আপুর সম্পর্কে সবকিছু সত্যি বলে দিতে পারতেন, তার চোখে আংগুল দিয়ে নিজের মেয়ের বৃত্তান্ত খোলাসা করতে পারতেন। কিন্তু সেটা আপনি করেননি। কেন বলেন তো?

রাহিতার প্রশ্নে স্বপ্নিল চোখ সরায়। ধরা পড়ায় খানিকটা ইতস্তত করে এদিক সেদিক তাকায়। ওর হাবভাবে হেসে রাহিতা বলে,

—কারণ আপনি চাননি রুম ভর্তি মানুষের সামনে তার মেয়ের কীর্তির জন্য তিনি অপমানিত হোক, আপনি চাননি মৃত মেয়ের প্রতি মায়ের অন্তরে কোনো খারাপ অনুভূতির জন্ম হোক। আপনি…

রাহিতা আর কথা বাড়াতে পারেনা। অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই ওর ঠোঁটে আংগুল চেপে ধরে স্বপ্নিল। হুট করে ওর এহেন আচরণে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় রাহিতা! চোখ বড় বড় করে তাকায় স্বপ্নিলের পানে। সেদিক লক্ষ্য করে স্বপ্নিল বলে,

—কি? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, হ্যাঁ? আমার সবকিছু এত কেন বুঝতে হবে তোমার? এগুলো স্বভাব বাদ দেও, বুঝেছো?

স্বপ্নিলের কথার ধরনে মনে মনে হেসে ফেলে রাহিতা। ওর কথার বিপরীতে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে “না-বোধক” উত্তর দেয়। ওর রিয়েকশন দেখে চোখ ছোট ছোট করে ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে ফেলে স্বপ্নিল। তখনি রাহিতা বলে,

—আচ্ছা, বাদ দিন এসব। যা হওয়ার হয়েছে।

—হু

এবার রাহিতা নিঃশব্দে উঠে যেতে ধরে। ঠিক সে সময় হাতে টান পড়ায় থেমে যেতে বাধ্য হয়। স্বপ্নিলের দিক তাকাতেই সে হঠাৎ কোমল স্বরে সুধায়,

—খারাপ লেগেছে না খালামনির কথায়? কস্ট পেয়েছো খুব?

—না, ঠিকাছি আমি।

—উহু, তুমি বললেই হলো? আমি জানি তো কস্ট পেয়েছো। তার কথা মনে নিয়োনা, কেমন? আজকে যা হয়েছে হয়েছে। এরপর থেকে তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবে। তার আবার গ্যারান্টি নেই কখন কি বলে ফেলে। আমি বা মা থাকলে তো সামলে নিবোই। তুমিও সাবধানে চলবে।

—আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এত চিন্তা করছেন কেন এ সামান্য বিষয়ে সেটাই তো বুঝছিনা। এসব বাদ দিন তো! বললাম না আমি?

হাসতে হাসতে কথাটা বলে রাহিতা। ওর প্রশ্ন শুনে চোখ নামিয়ে নেয় স্বপ্নিল। কোনো উত্তর না দিয়ে আলগোছে নিজ হাতে চেপে ধরে রাখা রাহিতার হাত ছেড়ে দিয়ে চেয়ার টেনে বের হয়ে যেতে নেয় রুম থেকে। রাহিতা একধ্যানে চেয়ে ছিলো ওর যাওয়ার পানে। আচমকা কদম থেমে যায় স্বপ্নিলের। ঘাড় কাত করে পেছন ফিরে তাকায় এক মুহুর্তের জন্য। রাহিতার চাহনি লক্ষ্য করে ধীর স্বরে বলে,

—তোমায় কস্ট দেয় এমন কোনো বিষয়ই আমার কাছে সামান্য নয়, রাহি।

স্বপ্নিল দাঁড়ায় না আর, চলে যায় নিজের মতোন করে। পেছনে ফেলে যায় এক বিমূর্ত রাহিতাকে। স্বপ্নিলের কথা কর্ণগোচর হতেই এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট বেড়ে যায় ওর। স্বপ্নিলের কথায়, ওর আচরণে আজ অন্যকিছু ছিলো যা রাহিতার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। যে চোখে রাহিতা এতদিন তাচ্ছিল্য দেখে এসেছিলো, আজকাল সেই চোখেই নাম না জানা সুন্দর অনুভুতিরা স্পষ্ট উকি দেয়!

#চলবে

কেমন লেগেছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here