মন_বিনিময় #পর্বঃ১৭ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ১৭
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

ঘণ্টা দুয়েক টানা পড়াশুনার পর ক্লান্ত ভঙ্গিমায় পড়ার টেবিল থেকে মাথা তুলে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় রাহিতা। মূলত আজ সন্ধ্যায় শাশুড়ির সাথে বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর হেলেদুলে রুমে ঢুকতেই বিছানায় স্বপ্নিলকে বসে থাকতে দেখে সে৷ স্বপ্নিলের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিলো যেন এতক্ষণ এখানে বসে রাহিতার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো সে। তাইতো ও ফ্রেশ হয়ে আসামাত্রই ওকে টেনে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসায় স্বপ্নিল। একিসাথে নিজেও আরেকটা চেয়ার টেনে বসে ওর পাশে। কোন কোন জায়গায় রাহিতার বুঝতে অসুবিধে সব শুনে এরপর ওকে বুঝানোর কাজে লেগে পড়ে স্বপ্নিল। স্বপ্নিলের উদ্যোগে ও নিজের প্রচেস্টায় বেশ ভালোভাবেই ম্যাথগুলো মাথায় ঢুকে রাহিতার৷ ওকে বুঝতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বই ঘেটে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ম্যাথ দাগিয়ে করতে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্বপ্নিল। এতক্ষণ বসে বসে সেগুলোই প্র‍্যাকটিস করছিলো রাহিতা। স্বপ্নিল এতক্ষণ রুমেই ছিলো, বিছানায় বসে নিজের কাজ করছিলো ল্যাপটপে। কিছুক্ষণ আগে উঠে বেরিয়েছে রুম থেকে। এরই মাঝে রাহিতার পড়াও শেষ হয়ে যায়। হাফ ছেড়ে শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় সে!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতল বাতাস উপভোগ করছে রাহিতা। এতক্ষণ পড়ার পর মাথা ভার হয়ে এসেছিলো যেন। একটা চা/ কফি হলে মন্দ হতোনা। আনমনে ভাবে রাহিতা। এরই মাঝে হিম বায়ুর সংস্পর্শে নিমিষেই মনে প্রশান্তি আসে। আবেশে চোখ বুজে যায়। সেভাবেই রেলিং ধরে কিছুক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে সে। খানিকবাদে পায়ের শব্দ কানে আসতেই চোখ মেলে তাকায় রাহিতা এবং চোখ খুলতেই সামনে বাড়ানো পাশে দাঁড়ানো স্বপ্নিলের সাথে চোখাচোখি হয়। সে নিষ্পলক ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আজ স্বপ্নিলের চাহনিতে আলাদা কিছু ছিলো যার দরুন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা দায় হয়, মুহুর্তের মাঝে চোখ নামিয়ে নেয় রাহিতা। ঠিক সেসময় ওর নত হওয়া চোখের সামনের একটি বাড়িয়ে রাখা হাতে কফির মগ ভাসে। স্বপ্নিল ওর দিকে কফির মগ বাড়িয়ে দিয়েছে। চমকে উঠে পুনরায় স্বপ্নিলের দিকে তাকায় রাহিতা। এবার ওর অপর হাতে আরেকটি কফির মগ দেখে সে। রাহিতাকে তাকাতে দেখে মাথা নাড়িয়ে নিজের হাত থেকে মগটি নিতে ইশারা করে স্বপ্নিল। ধীরহস্তে সে কাপ নিয়ে হালকা হাসে রাহিতা, যে হাসি লক্ষ্য করে ওর দৃষ্টির অগোচরে হাসে স্বপ্নিল নিজেও।

ধোয়া উঠা কাপে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে কফি পান করছে রাহিতা। স্বাদ একদম পারফেক্ট, যেমনটা ও খায় আর অদ্ভুতভাবে স্বপ্নিল অজান্তেই ওর জন্য কফি করে এনেছে এটা ভেবেই মনে মনে একিসাথে বিস্ময় ও ভালোলাগা কাজ করছে ওর! সে কিভাবে বুঝলো ওর কফি খেতে ইচ্ছে করছে? জিজ্ঞেস করবে কি? ভাবতে ভাবতেই আবারো স্বপ্নিলের দিকে তাকায় সে। নিজের কাপে চুমুক দিয়ে দৃষ্টি সামনে রেখে একমনে রাস্তা দেখছে স্বপ্নিল। নীরবতার অবসান ঘটিয়ে হাসি হাসি মুখে রাহিতা নিজেই প্রশ্ন করে,

—থ্যাংক ইউ। এটার সত্যিই খুব দরকার ছিলো এখন! আচ্ছা আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছিলো?

—অনেকক্ষণ থেকেই তো পড়ছো। স্বাভাবিক মাথা ধরে যাওয়ার কথা, আমারও এতক্ষণ ল্যাপটপ চালিয়ে কফির প্রয়োজন ছিলো। ভাবলাম তোমার জন্যও নিয়ে আসি।

আড়চোখে ওর হাসিমুখ প্রত্যক্ষ করে ধীরগলায় জবাব দেয় স্বপ্নিল। ওর জবাবে খানিকটা দমে যায় রাহিতা। তবে কি শুধু নিজের খেতে ইচ্ছে করছিলো বলেই সৌজন্যতার খাতিরে ওর জন্য নিয়ে এলো স্বপ্নিল? ওর জন্য চিন্তা করে নয়? এদিকে রাহিতাকে দমে যেতে দেখে মনে মনে হাসে স্বপ্নিল। বস্তুত রাহিতার জন্যই কফি করতে নিচে নেমেছিলো সে, এতক্ষণ ধরে পড়ছে মেয়েটা ওর কফির প্রয়োজন বিধায় স্বপ্নিল সবার চোখ ফাকি দিয়ে নিজহাতে বানিয়ে এনেছে ওর জন্য, একিসাথে নিজের জন্যও বানিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নিল জানে রাহিতা কি উত্তর শুনতে চেয়েছিলো ওর থেকে এজন্য ইচ্ছে করেই ওকে জ্বা’লানোর জন্য কথা ঘুরিয়ে এভাবে বলে সে। কিন্তু আসল কারণ তো শুধু স্বপ্নিল নিজেই জানে!

রাহিতাকে চুপ হতে দেখে স্বপ্নিল এবার নিজে কথা বলার উদ্যোগ নেয়। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে অবশিষ্ট কফি সাবাড় করে আগ্রহী ভঙ্গিতে বলে,

—কেমন হয়েছে বললেনা তো? আমি তো খুব একটা চিনি খাইনা। তুমি হয়তো খাও তাই আন্দাজে দিয়েছি। ঠিকঠাক আছে সব?

—উহু, একদম ভালো হয়নি।

প্রতি’শোধ নিতে স্বপ্নিলকে রাগানোর জন্য বললো রাহিতা। ওর কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় স্বপ্নিল। সে নিজে ঠিকভাবে চেক করে এসেছে, সব ঠিক আছে। খানিকবাদে তার খেয়াল হলো রাহিতা কেন এটা বললো আর সেটা ভেবেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো স্বপ্নিল। হাত নিজের চুলের মধ্যে চালিয়ে বললো,

—হ্যাঁ বুঝতে পারছি তো! এজন্যই বুঝি এত তাড়াতাড়ি পুরো কাপ সাবাড় করলে?

ধরা পড়ে যেয়ে মেকি রাগ দেখাতে চোখ পাকিয়ে তাকায় রাহিতা। একপ্রকার জোর করেই নিজের কাপ স্বপ্নিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে আসে বারান্দা থেকে। ওর কাণ্ডে হো হো করে হেসে উঠে স্বপ্নিল। রাহিতার পিছু পিছু সে নিজেও চলে আসে রুমে। সাইড টেবিলে কাপগুলো রেখে বিছানায় বসে থাকা রাহিতার সামনে গিয়ে বসে। মুখ ফুলিয়ে থাকা রাহিতার দিক চেয়ে মৃদুভাবে হাসে। এভাবে স্বপ্নিলকে হাসতে দেখে এবার আর চুপ করে থাকতে পারেনা রাহিতা। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

—আপনি কফি বানাতে পারেন আমি জানতাম না। কবে শিখলেন এসব?

—ভার্সিটি লাইফ থেকেই পারি৷ নিজের প্রয়োজনেই শেখা। এছাড়াও নুডুলস সহ টুকিটাকি রান্না পারি আমি।

—ওমা তাই? কখনো বলেননি যে?

বিস্মিত সুরে বলে রাহিতা। ওকে চমকাতে দেখে আরেকটু গাঢ় হয় স্বপ্নিলের হাসি৷ বিছানায় গা এলিয়ে আয়েশ করে বসে বলে,

—এতো অবাক হচ্ছো কেন তুমি? রান্না পারাটা কি না কোনো অসম্ভব কাজ? তুমি তো জানোই আমি ভার্সিটি লাইফ থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেস সামলাচ্ছিলাম। তো একসাথে এত প্রেশার হ্যান্ডেল করে চলা সহজ ছিলোনা, রাত জাগতে হতো প্রচুর। তখন আমাদের কাজের লোকও ছিলোনা আর মা সারাদিন সামির সাথে থাকতো, ওর স্কুল- কোচিং এ যেতো ওর সাথে। এছাড়া বাসার কাজ করে বেশ টায়ার্ড থাকতেন তাই রাতের বেলা কফি খাওয়ার প্রয়োজন হলে আর ডাকতাম না তাকে। নিজে থেকেই শিখে নেই কফি বানানো। এরপর কখনো মাঝরাতে ক্ষুধা লাগলে একাই নুডুলস করতাম। তবে জানো যেদিন প্রথম নুডুলস বানাতে যাই ওইদিন কি হয়েছে?

—কি হয়েছে?

চোখেমুখে আগ্রহ নিয়ে বলে রাহিতা। স্বপ্নিল যখনি ওর সাথে নিজের জীবনের কথা শেয়ার করে তখন খুব ভালো লাগে ওর। আজকেও ব্যতিক্রম নয়। ওর আগ্রহ দেখে স্বপ্নিল আবার বলে,

—একদিন সব কাজ শেষে মাঝরাতে ভার্সিটির এসাইনমেন্ট কর‍তে বসেছিলাম। রাত দুটো কি তিনটে হবে এমন সময় প্রচুর ক্ষুধা পায়, মা-কে তো জাগাতে পারছিলাম না আবার কিছু না খেয়েও থাকতে পারছিলাম না। ফ্রিজ ঘেটে খাওয়ার মতো বিশেষ কিছু না পাওয়ায় ঠিক করি নুডুলস রান্না করবো। তো চুলোয় পানি বসানোর জন্য পাতিল খুজতে যেয়ে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলি। একসাথে কয়েকটা পাতিল পড়ে গিয়ে শব্দ হয়। ওই মাঝরাতে হঠাৎ এমন শব্দ হওয়ায় বাসায় বিড়াল ঢুকেছে মনে করে মা ঝাড়ু নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে৷

কথাগুলো বলার মাঝেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো স্বপ্নিল। হাসির মাঝেই আবারো বললো,

—ক্যান ইউ বিলিভ ইট, রাহি? মা আমায় বিড়াল ভেবেছিলো! লাইক সিরিয়াসলি!

কিছুক্ষণ স্বপ্নিলের প্রাণখোলা হাসির দিকে একধ্যানে চেয়ে থাকে রাহিতা, হাসির দমকে ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে ওর বলিষ্ঠ শরীর। অতঃপর সব ভুলে সে নিজেও হাসিতে যোগ দেয় স্বপ্নিলের সাথে। ওদের দুজনের হাসির মাঝেই হঠাৎ রুমে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো দুজনে। দরজার সামনে বাড়ির হেল্পিংহ্যান্ড তথা রহিমা খালা দাঁড়িয়ে আছেন, তার এক হাতে খাবারের ট্রে ধরা। নিচে পানির গ্লাস ফ্লোরে পরে ভেঙে গেছে। সেদিক চেয়ে হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় স্বপ্নিল, ওকে দেখে স্বাভাবিক হয় রাহিতা নিজেও। ঠান্ডা গলায় স্বপ্নিল জিজ্ঞেস করে,

—এটা কিভাবে পড়লো খালা?

—মাফ করবেন, সাহেব। খালাম্মা আফনাগো জন্যে খাবার পাঠাইতে কইলো উপরে। হঠাৎ রুমে ঢুইকা আফনাদের হাসির শব্দ শুইনে চমকে গেছি আর গ্লাসটা হাত ফসকে পড়ে গেছে নিচে।

ভয়ে ভয়ে বললেন মহিলা। সেদিক চেয়ে কিছু একটা ভেবে মুখ আরেকটু গম্ভীর করে স্বপ্নিল বললো,

—কাজটা তো ঠিক হলোনা খালা। জিনিস ভেঙেছো যখন, এখন তো তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে।

স্বপ্নিলের এহেন কথায় অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকায় রাহিতা। এ সামান্য ব্যাপারে শাস্তি? স্বপ্নিলের কি হলো হঠাৎ? রহিমা খালার ভয়ার্ত মুখের দিক চেয়ে ও স্বপ্নিলকে কিছু বলতে যাবে এর আগে স্বপ্নিল নিজেই বলে,

—তোমার শাস্তি হচ্ছে সাবধানে কাচগুলো মাটি থেকে পরিষ্কার করে যেয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেও। আর আসতে হবেনা উপরে, আমরা পানি নিয়ে নেবো। তুমি খাবার খেয়ে মা-র কাছে যাও। মা খেয়েছে?

এতক্ষণে স্বপ্নিলের স্বাভাবিক কথা ও ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাহিতা, হাফ ছেড়ে বাচে রহিমা খালাও। খুশিতে গদগদ খাবারের ট্রে সাইড টেবিলে রেখে হয়ে ফ্লোর থেকে কাচগুলো তুলতে তুলতে বললো,

—আফনে তো এহনি ডরাইয়া দিছিলেন, সাহেব। খালাম্মার ঘুম ধরছে তাই আগেই খাইয়ে শুয়ে পড়লো আর আফনাগো জন্যে খাবার পাঠাইলো।

—আচ্ছা, তুমিও যেয়ে শুয়ে পড়ো।

কথা শেষ করে ফ্লোর পরিষ্কার করে চলে গেলো রহিমা খালা। তিনি যেতেই ট্রে থেকে রাহিতার প্লেট ওর হাতে দিয়ে স্বপ্নিল ভ্রু নাচিয়ে বললো,

—কি হলো ম্যাডাম? চমকে গিয়েছিলে বুঝি?

—আপনি পারেনও বটে!

স্বপ্নিলের থেকে প্লেট নিয়ে হাসতে হাসতে বললো রাহিতা। অতঃপর হাত ধুয়ে এসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো দুজনে। একদিকে স্বপ্নিল চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে অপরদিকে রাহিতা ওর কথা ভাবছে! বেশ কিছুদিন ধরে রাহিতা খেয়াল করছে স্বপ্নিল ধীরে ধীরে সবার সাথে আগেকার ন্যায় স্বাভাবিক আচরণ করছে, যে হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলকে রাহিতা একসময় চিনতো, ও যার প্রেমে পড়েছিলো সেই স্বপ্নিল ঠিকই নিজের স্বাভাবিক সত্ত্বায় ফিরে আসছে। আসলে জীবনে দুঃখ নামক মেঘের আড়ালে অনেক সময় মানুষের ফুল-সদৃশ আসল রুপ নেতিয়ে পড়ে ঠিকই কিন্তু সুখ নামক ঝলমলে রোদের সান্নিধ্যে যার পুনরায় নিজের রুপ ফিরে পেতে সময় লাগেনা বৈকি৷ স্বপ্নিলের সাথেও ঠিক একি ঘটনা-ই ঘটছে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here