মনসায়রী’ ৯.

‘মনসায়রী’

৯.
এখন গ্রীষ্মকাল। কোথাও কাশফুলের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্টাংশ নেই। থাকার কথাও না৷ তবে,আকাশে আদুরে মেঘ জমেছে। কতদিন ধরে বৃষ্টি হয়না। আজও বৃষ্টি হবে কিনা বোঝা যায় না।
এই রোদ তো আবার এই বাতাস। দিয়াবাড়িতে এখন কাশফুল না, থাকলেও অনেক লোকজন রয়েছে। কাশফুলের জন্য না, এই হৃদয়শীতলকারী মনোরম পরিবেশের জন্য। রাস্তার দুই ধারে সফেদ কাশফুলের জায়গায় এখন অর্ধমৃত পাতারা ঝিমাচ্ছে বয়সের ভারে। কোন সময় যেনো ঝড়ে গিয়ে নতুন পাতার জন্ম হয়। বিকেলের সময়টা এখানে আসার জন্য একদম খাপে খাপ।
লেকের পাড়ে একটা মোড়ার উপর বসে দুপুর। লেকের অস্বচ্ছ পানির মাঝেই তাঁর দৃষ্টি আবদ্ধ। পানিতে বললে ভুল হবে।
লেকের মাঝে হাঁসের আকৃতির দুটো বোট চলছে। একটাতে আকাশ আর মিহা আর অন্যটাতে কাজল আর দিহান। মিহা আর আকাশের মধ্যে অনেক আগে থেকেই সম্পর্ক রয়েছে। কলেজের শেষের দিকে সবাই বুঝতে পারতো, আকাশ মিহাকে পছন্দ করে।
কীভাবে যেন এক হলো দুজন। সেই রহস্য কেউ আপাতত জানেনা। কাজল আর দিহানের সম্পর্কটা অবশ্য অন্যরকম। একসময় তাদের দেখা হলেই তারা তুমুল ঝগড়ায় ফেটে পড়তো। যে সে ঝগড়া নয়। একেবারে চুল ছিঁড়েফেলা ঝগড়াঝাটি। একদিন দিহান কাজলকে জানায় সে কাজলকে ভীষণভাবে চায়।
কাজল সাফ মানা করে দিয়েছিলো। প্রথম কারণ হলো, দিহান আর সে সমবয়সী। তাদের মধ্যে প্রেম হলে তা শুধু প্রণয়ই রয়ে যাবে, পরিণয় আর হবেনা। কাজল রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। অনেক কষ্ট এতদূর এসে পড়াশোনা করছে। নাহলে এতদিনে, তার বয়সী মেয়েদের সবার গ্রামে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সবার সাথে লড়াই করেই সে আজ ভার্সিটিতে পড়ছে। দুপুরের দিকে চুড়ি পড়া হাতদুটো ঝনঝন শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে এলোমেলো চুলে এগিয়ে আসলো কাজল। দুপুর কাজলের পেছনে তাকিয়ে দেখলো, দিহান হেঁসে বোটের ভাড়া দিচ্ছে। দুপুর বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই কোনো ভাবে কাজলকে এটা ওটা বলে রাগিয়ে দিয়েছে। দিহান সবসময় এমন করে। কাজল গাল ফুলিয়ে দুপুরের পাশে এসে বসলো। দুপুর মৃদু হেঁসে বলল,
‘কেমন হলো বোটভ্রমণ? ‘

কাজল ঠোঁট উল্টে অভিমানী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ফালতু হয়েছে। একদম ফালতুরে দুপুর! ফালতু মানুষের সাথে উঠেছি না! আমার তোর সাথেই থাকা উচিত ছিলো।’

দুপুর হেঁসে ফেললো। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে পড়লো। একহাতে কানের পিঠে চুল গুঁজে নিলো। হালকা রোদের সোনালী আলো এসে দুপুরের উজ্জ্বল মুখ ছুঁয়ে আছে। নীল রঙের সাধারণ শাড়িতেই অপরূপা লাগছে। গলা, কান সব খালি। কোনো প্রসাধনীও নেই। গোলগাল মুখটা হাসিতে টুইটুই করছে।
গোলাপি রঙের লালাভ রঙে ফুলে ফুলে উঠছে। শুধু খোঁপা করা চুলের খাঁজে দুটো তরতাজা রঙিন শিমুল ফুল শোভা পাচ্ছে। কত সুন্দর দেখাচ্ছে দুপুরকে! মনটাই খারাপ হয়ে গেলো কাজলের।
যথেচ্ছ কারণ আছে বটে। দুপুর কাজলের ফ্যাকাশে মুখ লক্ষ্য করে বলল,

‘কী হলো হঠাৎ? চুপ করে গেলি যে! ‘

কাজল জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,

‘তুই শিমুল ফুল কোথায় পেলি?’

আচমকা প্রশ্নে থতমত খেলো দুপুর৷ একবার ফুলদুটোতে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

‘রাস্তায় একটা মেয়ে বিক্রি করছিলো। ওই মেয়ের কাছে থেকেই কিনে নিলাম। ‘

‘তুই নিজের জন্য ফুল কিনলি!’

কাজলের চোখেমুখে বিস্ময় উপচে পড়লো। এমন হতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যেনো। বন্ধুমহলে সবাই জানে, আর যেই হোক দুপুর নিজের জন্য কখনো বিশেষ করে কিছু কিনে না।
সবসময়ই সবাই দেখে এসেছে, সবাই টিফিন টাইমে ক্যান্টিন থেকে কিনে কিছু না কিছু খেলেও দুপুর তা করতো না। টিফিনের টাকাটা জমিয়ে একটা বক্সে রাখতো। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো, সে না খেয়ে কেনো এভাবে টাকা জমায়। তখন দুপুর মিষ্টি হেঁসে স্নেহময়ী কন্ঠে বলতো,এই টাকা দিয়ে দিতিয়ার কোনো পছন্দের জিনিস কিনবে। অথবা, মায়ের কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস। যা কেনার মতো টাকা মায়ের কাছে নেই। এভাবেই দিনের পর দিন শতশত ত্যাগতিতিক্ষা দিয়েছে দুপুর। কাজলের অবাক চোখ দেখে অস্বস্তি হলো দুপুরের। নিজের জিহ্বাকেই কয়েকটা বকা দিলো। কেনো যে বেফাস কথা বলল!কাজলের কৌতূহল দমাতে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,

‘আরে, দশ টাকা করে বিক্রি করছিলো। তাই কিনে নিলাম দুটো। তুই ফুল নিয়ে পড়লি কেনো? বল তো দিহানের সঙ্গে কেমন ঘুরলি?চোখ মুখ এমন কালো করে এলি কেনো? গেলি তো লাফাতে লাফাতে। ‘

কাজল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দিহানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,

‘সব দোষ ঐ দিহাইন্নার। জানোস ও কী করসে! আমি কতো শখ করে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে আসলাম। বোটে উঠতে চাইলাম রিয়াদের সাথে। রিয়াদ কত ভালো করে ছবি তুলে। দিহাইন্না উঠতে দিলো না ওর সাথে। জোর কইরা উঠলো। কত সুন্দর কইরা পোজ দিলাম। মাত্র দশটা ছবি তুলে বলে আর পারবেনা। যেই আমি বললাম সুন্দর করে একটাও ছবি তুলতে পারে নাই। তখনই আমাকে ভেঙচিয়ে বলে, আমার মুখটাই নাকি ভূতুম পেঁচার মতো। আমার জায়গায় যদি দুপুর উঠতো, তাহলে অনেক সুন্দর ছবি উঠতো।’

ভেবে আরেক দফা মন খারাপ হলো কাজলের। গায়ের রঙটা শ্যামলা হওয়ায় মা বাবা কাজল নাম রাখলো৷ সব জায়গাতেই গায়ের রং নিয়ে অন্যদের মাথাব্যথার কারণ ছিলো। নিজের কোনো সমস্যা নেই। অথচ,পাড়া প্রতিবেশীরা সময় পেলেই যা তা শুনিয়ে দেন। এই পর্যন্ত মেনে নিয়েছে কাজল। কিন্তু, শেষমেষ দিহানও তাঁকে এমন বললো! অবশ্য দিহান সবসময়ই এমন বলে রাগায় ওকে। সেটা জেনেও আজ খারাপ লাগছে। এই যে এতো সাজ। সবই তো ঐ পাগল দিহানের জন্য। দিহান প্রশংসা তো দূর, তাঁকে তুলনা করলো। দুপুরকে নিজের বোন মানে কাজল। হিংসা তো কখনোই করেনা। কিন্তু, হঠাৎ করেই দিহান বলার পর নিজেকে দুপুরের সঙ্গে তুলনা করে মন খারাপ বাড়াচ্ছে। আসলেই তো কোথায় ফর্সাদেহী কোমল দুপুর। আর কোথায় শ্যামবর্ণীয় কাজল। ভাবতেই কান্না পেয়ে যায় কাজলের।
দুপুর হেঁসে ফেললো কাজলের কান্ডে। কাজলের মুখ তুলে বলল,

‘এই নিয়ে মন খারাপ হলো! দিহান একটা পাগল আর তুই হলি আরেকটা পাগলী। তুই তো জানিসই যে দিহান তোকে রাগিয়ে মজা নেয়। ‘

‘তাই বলে সবসময়! ‘

‘তুই নাকি ওকে পছন্দই করিস না। তাহলে এখন জ্বলে কেনো!’

কাজল চুপ করে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও তার ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। দুপুর আবারো জিজ্ঞেস করলো,

‘পছন্দ না করলে একটুতেই মন খারাপ হয় কেনো? বল। উত্তর দিসনা কেনো?’

‘উত্তর তুই জানিস দুপুর। ‘

‘মুখে বলতে দোষ কী কাজল? এতদিন ধরে কেউ পাগলের মতো তোকে চায়। তুই দিহানকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখ। তোর মা বাবা যে একেবারেই মানবে না, কীভাবে এতো সিয়র তুই?’

‘আমার ভয় শুধু আমার মা বাবার জন্য নয়রে। দিহানের পারিবারিক অবস্থান জানিস না! আমি গ্রাম থেকে আসা সাধারণ একটা মেয়ে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা। তার উপর গায়ের রঙটাও কালো। তুই-ই চিন্তা কর, দিহানের সাথে কী আমাকে মানায়? দিহানের পরিবার কতো উচ্চবংশজাত। দিহান আমার কাছে আকাশের চাঁদ। যাকে দূর থেকেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার কল্পনা পোষা যায়। সত্যিকারে ছোঁয়া যায় না। এটা জাস্ট একটা ইনফ্যাচুয়েশন। এজন্যই আমি দূরে থাকার চেষ্টা করি ওর। কী লাভ বল মায়া বাড়িয়ে? ‘

বলতে বলতে কাজলের কাজলকালো চোখ দুটো রঙহীন জলে ভরে টুইটুম্বর হলো। একহাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঝাড়ার ভঙ্গিতে অন্য পাশে চলে গেলো। কেউ টেরও পেলো না বট গাছের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে মন ভরে কাঁদতে গেছে। দুপুর নিরূপায় তাকিয়ে রইলো মিনিটখানেক। উঠে দিহান, আকাশ আর মিহার মাঝে আসলো। আকাশ আর মিহা কী যেনো নিয়ে কথা বলছে। এই সুযোগে চোখের ইশারায় একটা কর্ণারে ডাকলো দুপুর দিহানকে। দিহান এসে স্বাভাবিক হেঁসে বলল,

‘কী হয়েছে ডাকলি কেনো?’

‘তুই এমন করিস কেনো বল তো দিহান? ‘

দিহান অবাক হয়ে বলল,

‘এমা! আমি কী করলাম? ‘

‘কাজলকে ইচ্ছে করে রাগালি কেনো? ‘

দিহান সিরিয়াস হয়ে গেছিলো। এবার ফিক করে হেঁসে বলল,

‘তুই জানিস না কেনো? পাগলী একটা। অন্য কোনো মেয়ের নাম আমার মুখে সহ্য করতে পারেনা। আবার নিজেও মনের কথা স্বীকার করে না। এজন্যই রাগায় দেই। তবুও লোহার মতো শক্ত। ‘

দুপুর গম্ভীর গলায় বলল,

‘দিহান, মনে কর কাজল তোকে এক্সেপ্ট করলো। তোদের প্রেম হলো। তুই নিজের মা বাবাকে রাজি করাতে পারবি তো? সে সময় কাজলের গায়ের রঙয়ের হাত ছেড়ে দিবি না তো?’

দিহান একগাল হেঁসে বলল,

‘তোর কী মনে হয়? ‘

‘আমি সিরিয়াস দিহান। ফাজলামো করিস না। ‘

‘তুই কী পাগল? কাজলের গায়ের রং এর জন্য ওকে ছাড়বো আমি! কাজলের গায়ের রং দেখে ওকে আমি ভালোবাসিনি দুপুর। ওর বাচ্চামি,অভিমানী মুখে কেঁদে ফেলা, ওর ওই গায়ের রঙয়েরও প্রেমে পড়েছি আমি। দুপুর, একটা কথা কী জানিস? ভালোবাসা কোনো বয়স, কাল, সময়, অসময় দেখে হয়না। যাকে একবার সত্যিকারে ভালোবেসে ফেলা হয়। অজান্তেই তার সবটাকেই ভালোবাসে মন। ‘

দুপুর এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। দিহান এবার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হেঁসে উঠে বলল,
‘অভিমানী কন্যার আবারো অভিমান হয়েছে। তুই দাঁড়া। আমি যাই কন্যার রাগ অভিমান ভাঙাই। ‘

দুপুর লেকের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। না চাইতেও নজর পড়লো দিহান কী সুন্দর করে রাগ ভাঙাচ্ছে কাজলের। কখনো কান ধরে। কখনো চুরি পড়া হাত মুঠোয় নিয়ে। শাড়ি পড়া শ্যাম রঙের মেয়েটার রাগ গলে পানি। অথচ, এখনো আহ্লাদী হয়ে মেকি রাগ দেখাচ্ছে। দুপুর তা দেখে মুচকি হাসলো। প্রেমিকার সব আহ্লাদ শুধু তার প্রেমিকের জন্যই বুঝি বরাদ্দ করা থাকে। আর কোথায় কারো সাথে কী কাজল এতো আহ্লাদ করে! করে না। এ তো এক অলিখিত নিয়ম। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো দুপুর। উঠে দাঁড়িয়ে লেকের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। খোঁপায় হাত দিয়ে আরেকবার দেখে নিলো ফুল গুলো। ফুলগুলোর জন্য আজ বিপাকে পড়ে গিয়েছিলো সে। কাজলের কাছেও দুপুর মিথ্যা বলেছে। ফুল কিনেনি। ক্লাস শেষ হওয়ার পর বের হতেই সেই র্যাগ করা ছেলে মেয়ে গুলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলো দুপুর। না জানি আবার কী করে। কিন্তু, দুপুরকে অবাক করে দিয়ে ওরা একগুচ্ছ শিমুল ফুল হাতে ধরিয়ে বারবার সরি বলে ক্ষমা চাইলো। কিছুই আর বলার ছিলো না দুপুরের। ফুলগুলো বাধ্য হয়েই নিতে হলো। শিমুল ফুল পেয়ে একপ্রকার খুশিই হলো। সকাল বেলাই তো মনে মনে শিমুল ফুল চাচ্ছিলো সে। কাউকে বলেওনি। এরা কাকতালীয় ভাবে সেই পছন্দের ফুলই এনে দিলো। খোঁপা থেকে একটা ফুলের কলি নিয়ে হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে সিঁড়ির পাশে বসলো। অপলক ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সুবাস নিচ্ছিলো। কী মনে করে, পানির আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। অঘটন সেখানেই ঘটলো। জায়গাটা স্যাতস্যাতে ভেজা থাকায় পা পিছলে আকস্মিক তাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি লেকের পানিতে গিয়ে পড়লো। গলাফাটানো চিৎকারে বৈরী হলো পরিবেশ। সব বন্ধুরা ছুটে আসলো। আতঙ্কিত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। দুপুর তো সাতার জানে না। কী হবে এবার?

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here