‘মনসায়রী’
৭.
সিদ্ধ ডিমের গন্ধ দিতিয়ার একদমই সহ্য হয়না। গা গুলিয়ে বমি আসে। মিরা কখনো কখনো কি’ল গু’তা দিয়ে জোর করে খাওয়ান। জেদি দিতিয়া গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে হলেও সে ডিম ফেলে দেয়৷ মিরা একদিন তা দেখে উদাম মেরেছে। গরীব ঘরে জন্ম নিয়ে এতো হেডম কীসের! যেদিন তনয়া আদর করে হাতে তুলে খাওয়ায় শুধু সেদিনই একমাত্র খায় দিতিয়া। সিদ্ধ ডিমের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে সে৷ আজকে তনয়া ভাবিও ঘর থেকে বের হচ্ছে না। কালকে ভাই ভাবি দু’জনের ঝগড়া হয়েছে এই কথা সবাই কমবেশি বুঝেছে। কী নিয়ে ঝগড়া জানেনা কেউই। এমন সময় পায়েসের বাটি হাতে সামনে আসলো দুপুর৷ ওড়নার আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে পাশে বসে সামান্য হাসলো৷ দিতিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
‘কী হয়েছে আপুনি?’
দুপুর মুচকি হেসে বলল,
‘কই? কী হবে?’
‘তাহলে আজ হঠাৎ পায়েস করলে যে?’
‘এমনি মন চাইলো। ‘
‘উহু,তোমার মন যখন খুব ভালো থাকে তুমি শুধু তখনই পায়েস রান্না কর। ‘
দুপুর কিছু বলল না। আজ তার মনটা সত্যি ভালো। চাকরিটা হওয়ার পর দুপুর চিন্তা করছিলো, চাকরি পড়াশোনা সব মিলিয়ে কী করে কুলিয়ে উঠবে। নতুন নতুন মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। ভালো রেজাল্ট করতে ক্লাসও তো করতে হবে৷ বন্ধুদের দিয়ে কতইবা নোটস কালেক্ট করাবে। এর উপর আবার দুটো টিউশনি আর পত্রিকার কাজ। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। আজ সকালে অফিসে গিয়ে কাজ করার সময় পলাশ স্যার নিজেই ডেকেছিলেন দুপুরকে। দুপুর তখন ভাবলো, তিনি ফাইলপত্র জমা নিতে ডেকেছেন। হন্তদন্ত হয়ে স্যারের কেবিনে গেলে তিনি বললেন,
‘দুপুর মা, ফারাহর কাছে শুনলাম তুমি নাকি এবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছো। তাহলে,অফিসের কাজ সামলাবে কী করে? ‘
বুকে ধক করে উঠলো দুপুরের। এবার কী কাজ থেকে বের করে দেবে! তাহলে সংসার কী করে চলবে!অন্য টিউশনি গুলোও তো বাদ দিয়ে দিয়েছে। কাজ না থাকলে পড়াশোনাই বা কী করে চলবে। সব মিলিয়ে আঁতকে উঠে বলল,
‘না স্যার,আমার কোনো সমস্যা হবেনা। আমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেবো। তবুও কাজ থেকে বাদ দিবেন না প্লিজ!’
পলাশ দেওয়ান বড়সড় চোখ করে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই হেঁসে বললেন,
‘আরে কী বলছো এসব! কাজ বাদ দেয়ার তো কথা বলিনি মা। আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। ‘
দুপুর হাফ ছেড়ে বলল,
‘কী আইডিয়া স্যার?’
‘সপ্তাহে যেহেতু ক্লাস আর অফিস দুটোই ছয়দিন। তাহলে তুমি এক কাজ করতে পারো, আমাদের অফিসে অনলাইনে কাজ করার সুযোগ আছে স্টুডেন্টেসদের জন্য। তুমি ঘরে বসে চারদিন কাজ করবে। নিজের সুবিধা অনুযায়ী। আর বাকি দুইদিন অফিসে এসে বাকি কাজগুলো কভার আপ করবে। এতে তুমি পড়াশোনাও ভালো মতো করতে পারবে আবার অফিসও করতে পারবে। ‘
দুপুর বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো। এতো আনন্দ হলো যে প্রকাশ করতে কষ্ট হলো। আনন্দে ভেজা চোখে একগাল হেঁসে বলল,
‘আপনি অনেক ভালো স্যার! ধন্যবাদ! ‘
তিনি মুচকি হেসে বললেন,
‘বোকা মেয়ে! বাবাকে কেউ ধন্যবাদ দেয়! ‘
দুপুর ভ্রু কুচকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো। পলাশ দেওয়ান কথাটা বলে নিজেই থতমত খেলেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘তুমি তো আমার মেয়ের মতোই তাই না! এজন্যই বললাম। তোমাকে দেখলে আমার মেয়ের কথাই মনে পড়ে। ‘
দুপুর হাসলো৷ কিছু একটা ভেবে চিন্তিত মুখে বলল,
‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটা সমস্যা আছে স্যার? ‘
‘কী সমস্যা? ‘
‘আসলে, আমার তো স্মার্ট ফোন নেই অনলাইন কাজ করার জন্য আর না আছে ল্যাপটপ। ‘
দুপুরের কথা শুনে তিনি নিশ্চিন্ত মনে হাসলেন। যেনো সব সমস্যার সমাধান তাঁর কাছেই আছে। কাউকে কল করতে করতে তিনি বললেন,
‘এটা কোনো সমস্যা হলো! আমাদের এখানে যারা অনলাইনে কাজ করে তাদেরকে স্পেশালি ল্যাপটপ এবং মোবাইল দেওয়া হয়। তোমাকেও দেয়া হবে। ‘
দুপুরের কাছে ব্যাপারটা অবাক করার মতো লাগলেও, সরল মনে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। বিভোর হয়ে ভাবতে লাগলো, এখন থেকে কষ্ট কতোটা কমে যাবে। সবটা খুশিমনে ভাবতে ভাবতে বের হয়ে গেলো। কালকে ভার্সিটির প্রথম ক্লাস। অনেক দিন পর নিজেকে ভীষণ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। আনন্দেই আজকে নিজের হাতে পায়েস বানিয়ে সবাইকে খাওয়াচ্ছে।
_
হালকা বাতাসের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে শ্যামল পাতাগুলো।
আকাশের বুকে ছন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে ছন্নছাড়া নীলাভ-সাদা মেঘ।
পড়নের নীল সাদা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো দুপুর।
প্রকৃতির সাথে মিল হয়ে গেলো কীভাবে যেন! নিজের খোলা চুল গুলোকে বাঁধতে নিয়েও বাঁধলো না। সকালে হঠাৎ করেই সবাই প্ল্যান করলো শাড়ি পড়বে। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কারণ, নিজের তো কোনো ভালো শাড়ি নেই। কী পড়বে এটাও তো চিন্তার বিষয়। তার কিছুক্ষণ পরই তনয়া ভাবি এসে দুপুরকে এই সুন্দর নীল সাদা শাড়িটা দিয়ে গেলেন। প্রথমে নিতে চায়নি দুপুর। কিন্তু, তনয়া নাছোড়বান্দা৷ কোনো কাজে একবার হাত দিলে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই তার। দুপুরকে শাড়ি পড়িয়ে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলেন৷ চুল বাঁধতে গিয়ে আফসোস করে বলেছিলেন,
‘ইশ! একটা বেলি ফুলের মালা হলে তোমাকে নায়িকার মতো লাগতো। এমনিতেও অবশ্য তুমি নায়িকার চেয়ে কম নও। ‘
তখন হেসে ফেলেছিলো দুপুর। কোথায় নায়িকা আর কোথায় সে। হ্যা, পাড়ায় সুন্দরীদের তালিকায় নাম আছে দুপুরের। গোলগাল ফর্সা চেহারা। মাঝারি নাক। আর কোমর জড়ানো চুল।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুটি হচ্ছে, দুপুরের ঠোঁট। যে কেউ দেখলে বলতে বাধ্য হবে এটি কোনো শিল্পীর আঁকা যত্নের ছবি। ঠোঁটের ডানপাশে লাগোয়া ছোটো তিল যার সৌন্দর্য আরো বাড়ায়। রাস্তায় হেঁটে গেলে চোখ এসে পড়ে দুপুরের দিকে। স্কুল কলেজে পড়াকালীন কতশত প্রেমের প্রস্তাব এসেছে। সেইসব কিছুই এখন ভাঁটা পড়েছে কর্মব্যস্ততার চাপে। এখন নিজেকে আয়নায় দেখবার সময়টুকুও নেই। সময় এমনই বহমান। আজকে তো আর হেঁটে যেতে পারবেনা। শাড়ি পড়ে এতদূর হাঁটা সম্ভব না। তাই, একটা রিকশা ডাকলো। ভার্সিটির সামনে এসে থামলো রিকশা। দুপুর রিকশা থেকে নেমে শাড়িটা ঠিক করে। নিজের ব্যাগ থেকে বিশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালাকে দিতে নিয়ে দেখলো, রিকশাওয়ালা সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। দুপুর হতভম্ব হয়ে চিৎকার করে বলল,
‘আরে! এই মামা ভাড়া নিলেন না তো!’
রিকশাওয়ালা আর ফিরেই তাকালেন না। তিনি খুশিমনে চালিয়ে চলে যাচ্ছেন প্যাডেল দিয়ে। দুপুর টাকা হাতে হা করে তাকিয়ে রইলো। প্রথম কোনো রিকশাওয়ালা টাকা না নিয়েই চলে গেলো। এমন কী হয়! দুপুর বোকা চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘বুঝতে পারলাম না। বড়লোক রিকশাওয়ালা নাকি!’
বিরক্ত মুখে ভার্সিটির গেটে ঢুকলো। গতকাল ফ্রেশারদের জন্য অনুষ্ঠান ছিলো। এখনো আশেপাশে অনেক কিছু সাজানো আছে। এসব দেখতে দেখতে ভেতরে যাচ্ছিলো দুপুর। হঠাৎ করেই এক জায়গায় এসে থমকে গেলো। পাশেই কয়েকজন ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুর তাদের পাশ দিয়ে যেতে নিলেই একজন ছেলে বলল,
‘স্টপ দেয়ার!’
কথাটা যে দুপুরকেই বলা হয়েছে তা বুঝতে পারলো দুপুর। কারণ ওর পাশে এখন কেউই নেই। অবুঝ চোখে সেখানেই দাঁড়ালো সে।
ছেলেমেয়ের দলটার মাঝে দুটো বাইক দাঁড় করানো। একটাতে একজন সানগ্লাস পরিহিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বাইকটা খালি। সানগ্লাস পড়া ছেলেটা এগিয়ে এসে দুপুরের সামনে দাঁড়ালো। দুপুরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে আঙুল তাঁক করে বলল,
‘ফ্রেশার?’
দুপুর কী বলবে বুঝতে পারলো না। সে তো মাস্টার্সে পড়ছে। তাঁকে কী দেখতে এখনো অনার্স পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে লাগে! কেমন একটা লজ্জা পেয়ে বসলো সে। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই আরেকটা মেয়ে ওদের মধ্যে থেকে বলল,
‘ফাহাদ এখানে আবার জিজ্ঞেসের কী আছে! দেখেই বোঝা যায় সদ্য ভর্তি হয়েছে। আজকে ফ্রেশাররা শাড়ি পড়েছে। ‘
দুপুর আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, আসলেই অনেক মেয়েরা শাড়ি পড়েছে। মোটামুটি সবাই ফ্রেশার। কিন্তু, দুপুরের শাড়ি পড়ার কারণ ভিন্ন। আজকে বন্ধুরা সবাই মিলে দিয়াবাড়ি ঘুরতে যাবে। দুপুরের মনে হচ্ছে, শাড়ি পড়াটাই ভুল হয়েছে। ফাহাদ নামের ছেলেটা এবার বাইকে হেলান দিয়ে স্মিত হেসে বলল,
‘এই নিপা একটা গান ছাড় তো। আজকে মিস ব্লু আমাদের নেচে দেখাবে। কী গানে নাচবে মিস ব্লু? বলো তো।’
দুপুর বিস্মিত চোখে তাকিয়ে নিজের দিকে আঙুল তুলে বলল,
‘আমি! ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।