‘মনসায়রী’
৬.
যতটা ভয় নিয়ে দুপুর গেলো। সেরকম কিছুই হলো না। দেখা গেলো, দুপুর স্যারের কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলো ভেতরে কী কথা হচ্ছে জানতে। কোনো ভাবে ছেলেটা তাঁর নামে বিচার টিচার দিয়ে ফেলেনি তো আবার! কিন্তু সেখান থেকে উচ্চস্বরে হাসিঠাট্টার আওয়াজ শোনা গেলো৷ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো দুপুর। মনে মনে ভাবলো, একবার ধন্যবাদ দিবে। পরক্ষনেই উপলব্ধি করলো দোষ তো সম্পূর্ণই ছেলেটার। তাহলে, সে কেনোইবা ধন্যবাদ দিবে! হাতটা ব্যাথায় খানিকটা চিনচিন করে উঠছে। রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। আহ উহ করতে করতে ফারাহর কাছে ফিরে এলো। কেবিনে নিয়ে ফারাহ ওকে প্রাথমিক কাজগুলো শিখিয়ে পড়িয়ে প্র্যাক্টিকাল দেখিয়ে দিচ্ছে। যতটা অস্বস্তি ছিলো তাঁর অধিকাংশই কেটে যেতে লাগলো। আরো দুই একজনের সাথে পরিচয়ও হলো। এমনকি অফিসেরই একজন কলিগ দুপুরের ভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে। আগে থেকে পরিচয় না হলেও মনে হলো, চেনা কাউকেই অনায়াসে পেয়ে গেলো দুপুর। ছেলেটার নাম হিয়ান। প্রথম দেখাতেই অনেক মিশুক ও ডিসেন্ট মনে হলো। খারাপ লাগেনি।
ডেস্কে বসে টুকটাক কথাবার্তা হলো। বেশিরভাগ কথা হিয়ানই আগ বাড়িয়ে বললো। মজার কথা বলে হাসানো হিয়ানের অন্য তম গুণ বোঝা যায়। এদিকে দুপুর কথায় অপটু। কেউ অনবরত পাঁচ দশেক কথা বলে গেলেও, দুপুর হেঁসে একটা কথা বলে। অনেকেই ওকে গম্ভীর এবং কঠিন স্বভাবের ভাবে এ কারণে। মনের কথা মুখে আনতে অনেক সঙ্কোচ অনেক দ্বিধা। কোনো কথা বলার আগেও দুই সেকেন্ড ভেবে নেয়। আজ যেহেতু দুপুর নতুন। তাই বেশিক্ষণ কাজ করলো না৷ কারণ, এখন অমিতের বাসায় পড়াতে যেতে হবে। এই মাস থেকে দুটো টিউশনি ছাড়বে সে। যেহেতু চাকরি হয়েছে। ওই দুটো টিউশনির টাকা থেকে কম হলেও তিনগুণ বেশি টাকা পাবে। আর বাকি রইলো অমিত আর ওর পাশের বাড়ির একটা মেয়ে। এদের দুজনকে একটু কষ্ট হলেও পড়াবে। অমিতের মতো ভদ্র ছেলেকে পড়াতে ভালোই লাগে। মোবাইলে আকাশকে কল করে ওকে ধন্যবাদ দিতে দিতে অফিস থেকে বের হচ্ছিল দুপুর। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেকবার দূরন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই আগুনের মতো গরমে হেঁটে যাওয়াটা দুঃসাধ্যই বটে। আর দুঃসাধ্য কাজগুলোই সবসময় বেছে বেছে দুপুরের ভাগ্যে জোটে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো বুড়ো আঙুলের এক পাশে ফুলে আছে। অতিরিক্ত হাঁটাহাটির তেঁতো ফল। এখন ভুগো। অবশ্য আজ খুব একটা খারাপ লাগবে না। মনের এককোনায় চাকরি পাওয়ার আনন্দে উড়ে উড়ে বাসায় চলে যাবে। এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে হাঁটতে লাগলো। দুপুর আগের নানান কথা ভেবে হাসতে শুরু করলো। দুপুর নিজের খুব ভালো বন্ধু। সময়ই অবশ্য এর কারণ। চঞ্চলতায় ঘেরা অনেক মানুষের মধ্যে থাকা মেয়েটা যখন হুট করেই মধ্যবিত্ত পরিবার টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়লো। তখন ম্যাচুয়োরিটি আপনা-আপনি এসে গেলো৷ ঘন্টার পর ঘন্টা বন্ধুদের স্পাইসি গসিপ ছেড়ে যখন রাস্তায় রাস্তায় টিউশনের লিফলেট দিয়ে বেরালো তখন কোনো অদৃশ্য কানের পাশ ছুঁয়ে যেতে যেতে বলেছিলো, এটাই নিয়তি৷ নিয়তিকে এড়িয়ে গেলেও নিয়তি আমাদের এড়ায় না। নিয়তিকে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মেনে নিয়েছিলো দুপুর। না মানলে কী আর আজকের দুপুর রোদ মাথায় করে এতদূরের পথ চলতে পারতো! কথাটা ভেবে আকাশের দিকে তাকিয়ে হেঁসে উঠলো দুপুর। রাস্তার দুই একজন মানুষ আড়চোখে দেখলো মাথা ঘুরিয়ে। তারা তো জানেনা, কোনো কোনো হাসিতে কান্নাও জমে থাকে।
–
ভুলে যাওয়া কখনো ভালো। শোক ভুলে থাকা যায়৷ মানুষ বলে, মৃতের শোক খুব বেশি হলে চল্লিশ দিন থাকে। মৃতের জন্য সবাই কাঁদে। কেঁদে আকাশ পাতাল ভিজিয়ে দেয়৷ জীবন্ত মরা মানুষ দেখা যায় না বলে তাদের শোকও কেউ করেনা। কেউ এসে চুলের উপর হাত ছুঁইয়ে বলেনা, কেনো মরে গেলে! আমি ছিলাম না! আমাকে কেনো বললে না!
কেউ বলেনা সে কথা। শোনায়না কোনো স্বান্তনা বাণী। বেঁচে ওঠা আর হয়না তনয়ার। রোজ একবার করে মৃত্যু হয় যেনো ওর। রঙবেরঙের মৃত্যু। নামহীন গন্ধছাড়া মৃত্যু। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোণায় ভেসে আসা পানির ঢেউ মুছে নিয়ে আরেকটু নিঃশব্দে ফুপিয়ে ওঠে। নিজের গায়ের নতুন ভাজভাঙাহীন শাড়িটা নিজের গায়ের থেকে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে। সেখানই গড়াগড়ি খাচ্ছে শাড়ি। হাঁটু মুড়িয়ে মুখ লুকিয়ে নেয়। লজ্জা পেয়ে গেলো যেনো৷ এ লজ্জা অপমানের। এ লজ্জায় গাল লালনীল হয়না। শুধু বুকের শিরায় বিষাক্ততা দাঁত কাটে। মুখ নিচু হয়ে যায়। মরার উপর নুনের ছিটার মতো যার জ্বলুনি।
মেঝেতে থাকা শাড়িটা আরেকবার দেখে নেয়। নতুন শাড়িটা একঘন্টা আগেই দুপুুর তাঁকে এনে দিয়েছে। সবার জন্যই কিছু না কিছু এনেছে। শিপুর জন্য নতুন পাঞ্জাবি, মা চাচীর শাড়ি, দিতিয়ার জন্য নতুন একটা ব্যাগ আর কামিজ। খুশিতে নেচে-কুঁদে বেড়াচ্ছে দিতিয়া। মনে হলো যেনো আজই ইদ।
তনয়াও খুব খুশি হলো। কতদিন এমন সবাইকে আনন্দ করতে দেখেনা। দুপুর গোলাপি রঙের সুন্দর একটা শাড়ি এনে তনয়াকে দিতে দিতে বলেছিলো,
‘এটাতে তোমাকে খুব মানাবে ভাবী। ‘
ঘরে এসে আজকে তনয়া ভাবলো নতুন শাড়ি পড়ে কাজল চোখে দিয়ে সেজেগুজে সারপ্রাইজ দিবে শিপুকে। আজ নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবেনা শিপু। আজকে শিপুর মনমেজাজ হাসিখুশি লাগছিলো। দুপুরের আনা লাড্ডু থেকে দুই তিনটা খেয়ে নিয়েছিলো। এতগুলো দিনেও কী শিপুর ওর প্রতি মায়া আসেনি! হয়ত আজ শিপু দুই হাতে আগলে বুকে জড়িয়ে ধরবে। এতদিনের স্বপ্ন দেখা, সেই কাল্পনিক চুম্বনটা যদি ওর মুখে এঁকে দেবে! আশায় বুক বেঁধে সেজে বসে তনয়া। শিপু হুইলচেয়ার চালিয়ে ঘরে আসে। তনয়া দরজায় ছিটকিনি লাগায়। প্রশংসার আশায় শিপুর মুখের দিকে তাকায়। শিপু যেনো ওকে দেখেইনি। এমন ভাব করে দেয়ালে হাত রেখে ধীরে ধীরে বিছানায় বসে। মূলত এক পায়ের হাঁটুতে সমস্যা শিপুর। ডক্টর বলেছে বাহিরের দেশে নিয়ে চিকিৎসা করালে ঠিক হবে। টাকার অভাবে সেটা হয়ে উঠছেনা। মাঝে মাঝে হাঁটার চেষ্টা করে একা। তনয়া গোমড়ামুখে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বিছানার পাশের কোণাটায়। হঠাৎ করেই একটা দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় চাপে৷ এমন চিন্তা আগে কখনো আসেনি। শিপুকে প্রচন্ড ভয় পায় তনয়া। শিপু সবার কাছে শিপু হলেও তনয়ার কাছে, ভার্সিটির সিনিয়র সুদর্শন শিহাব ভাই-ই রয়ে গেছে। শিপুকে বাড়ির সবাই শিপু ডাকলেও স্কুল কলেজ সবখানেই শিহাব মাহবুব নামে পরিচিত। এতোটা দিন একসাথে এক বিছানায় থেকেও দুজন অপরিচিত মানুষ। তনয়া ভাঙতে চায় এই দ্বিধার দেয়াল। পরিবার আত্মীয়স্বজন ছেড়ে যে মানুষটার জন্য সে গরীবি দষায় দিন কাটাচ্ছে। সেই মানুষটাকে জানতে চায়, ভালো মন্দ কথা বলতে চায়, দিনশেষে মানুষটার বুকের উপর মাথা রাখতে চায়৷ অনেক অল্প চাওয়া। কিন্তু এতটুকু ভাবতেও তনয়া ভীষণ ভয় পায়। আজ সে সত্যিই সাহস করে এসব করবে। হাত নাড়াতে নাড়াতে খাটের উপর উঠলো। কাঁচের চুড়ির ঝনঝন শব্দে একবার নড়ে উঠলো শিপু। তারপর আবারো পাথরের মতো শক্ত হয়ে রইলো। তনয়া চুপিসারে শিপুর গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। শিপু কিছু না বলায় একটু সাহস পেলো। ডান হাতটা দিয়ে শিপুকে জড়িয়ে ধরতেই শিপু আস্তে করে ছাড়িয়ে দিলো। কিন্তু থামলো না তনয়া। সে অনড় হয়ে শিপুকে আবারো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। নিজের কোমল ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিলো শিপুর ঘাড়। শিপুর শক্ত হাতদুটো টেনে নিজের কোমরে নিয়ে আসলো। এমন করে কেনো শিপু! কেনো তাকে একটু ভালোবাসে না! ছলছল করে ওঠে চোখদুটো তনয়ার। পুরোপুরি ঘনিষ্ঠ হতেই শিপু মৃদু চেচিয়ে বলে,
‘সমস্যা কী তোমার! বুঝতে পারছো না আমার ভালো লাগছে না।’
রেগে গেলো তনয়াও। সেও দ্বিগুণ চিৎকার করে বলল,
‘তাহলে কী ভালো লাগে আপনার? ‘
‘দেখো তনয়া, আমি তোমাকে আগেও বলেছি তোমাকে ভালোবাসি না এমনকি পছন্দও করিনা৷ তুমি চলে যাও। আমার মতো একজন বেকার পঙ্গু লোকের সাথে থেকে কী পাচ্ছো তুমি!’
শিপুর শান্ত কঠিন কন্ঠ। তনয়া ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। সে শিপুর বুকে ঝাঁপিয়ে বলল,
‘আমাকে একটু ভালোবাসুন না শিহাব! ‘
শিপু উত্তর দিলো না। পাশ ফিরে উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো। তনয়া আকুল তৃষ্ণায় ধুঁকে বলল,
‘আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না শিহাব?’
‘না। ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(সবাইকে ইদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আরো আগেই বলতাম কিন্তু ইচ্ছে করলো গল্প দিয়েই নাহয় বলি। সবার ইদ আনন্দে কাটুক। ইদ মুবারাক🌙তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম!)