“মনসায়রী”
২৯.
বাকহারা হয়ে গেলো দুপুর। নির্বাক চোখে নিষ্পলক ভাবে সায়রের দিকে তাকালো। সায়র অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলো। দুপুরের নিরবতায় ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
দুপুর মাথা নিচু করে খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল,
‘সব কথায় এতো রসিকতা কেনো করো তুমি?’
‘আমার কখনো রসিকতা করিনা দুপুর, আপনি আমার কথার মেটাফোড় বুঝতে পারেন না৷ ‘
কথাটা বলে থেমে সায়র আবারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেন?’
দুপুর থতমত খেয়ে গেলো। সে যে অভিনয় করতে গিয়ে সায়রের কাছে ধরা খেয়েছে, এটা বুঝতে আর বাকী রইলো না। বিব্রত হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো। অন্য দিকে তাকিয়েও বুঝলো, সায়র ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়েই নয়, সঙ্গে হাসছেও। দুপুর বিরক্ত হয়ে বলল,
‘হাসছো কেনো তুমি? আমার মুখে কী জোকার আঁকা আছে? নাকি আমাকেই জোকার মনে হয় তোমার? তাকিয়ে আছো কেনো, আমার মুখে কী দেখছো শুনি? ‘
সায়র নিভৃতে দুপুরের হাতের খালি কাপটা নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘আপনার দিকে তাকালে আমি আমার দুনিয়া দেখি। ‘
দুপুর ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কথার মানেটা বুঝতে দুই সেকেন্ডও লাগেনি। আর লাগেনি বলেই, চোখে সিক্ততা অনুভব হলো। বুকে কে যেনো একশোটা রঙিন প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে।
শিরশির করে সারা শরীর কাঁপছে। অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। না চাইতেও ভালো লাগছে। ছোট থেকে সবারই তো স্বপ্ন থাকে, কেউ একজন তাঁকে নিজের দুনিয়া মনে করবে ৷ আপন করে ভালোবাসবে। নিখাদ সেই ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছিলো দুপুর, কিন্তু কপালে তা সহ্য হয়নি। ভালোবাসা হারানোর ক্ষত ভরে উঠতে উঠতেই মাঝের অনেক গুলো সময় পার হয়ে গেছে। কলেজ, ভার্সিটি, রাস্তাঘাট সবখানেই প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে। অথচ, কারো উপরই মন বসেনি। দুপুরের এখনো মনে আছে, শিহাবের বিয়ের সময় দুপুর মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলো। যাকে ভালোবেসে দুপুর নিজের মৃত্যু পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছে তাঁকে চোখের সামনে প্রতিনিয়ত অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা কতোটা কষ্টকর। বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাধ্য ছিলো না। বরংচ, বিয়েতে যাতে কোনো বাঁধা না আসে সেজন্য সৌরভ মাহবুব মানে বড়চাচা দুপুরকে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলেন। দুপুর যেনো চুপ থাকে। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর অনুরোধ পায়ে ঠেলতে পারেনি সে। শিহাবকে কখনো বলেনি, কারণ মৃত পিতার জন্য মনে ঘৃণা জমে আছে আগে থেকেই। যদি শিহাব জানতে পারে দুপুর শিহাবের বাবাকে তাদের দুজনের প্রণয়ের কথা জানানোর পরও তিনি তনয়ার সাথে বিয়ে দিয়েছেন তাহলে কখনো ক্ষমা করবেনা শিহাব। এমনিতেই দুপুরের উপর শিহাবের অনেক অভিমান। হয়তো একদিন ঠিকই তনয়াকে মেনে নেবে শিহাব। ভুলে যাবে দুপুরকে। দুপুরও চায়, শিহাব ভালো থাকুক নিজের জীবনে। আবার এটাও জানে, তনয়াকে আজও ভালোবাসতে পারেনি শিহাব। শিহাবের মনের সবচেয়ে উপরের স্থানে খোদাই করা দুপুরের নাম। বোকা তনয়া ভুল করে গোলাপ পেতে চেয়ে, হাত রক্তাক্ত করেছে কাঁটায়। অজস্র দিন রাত পার হচ্ছে সেই ভুলের মাশুল দিয়ে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে বোধ হয় এটাই ছিলো।
দুপুরের ভয় হয় ভালোবাসায়। শিহাবকে দুপুর এতোটা ভালোবেসে হারিয়েছে, এখন সবচেয়ে বেশি ভয়টা দুপুরের এখানেই। অতিরিক্ত ভালোবাসাগুলোকে প্রকৃতি এক হতে দেয়না। ইতিহাসে নাম লেখানো প্রতিটি প্রেমের গল্পই অপূর্ণ।
হয়তো এটাই পরীক্ষা। জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকাই মূল লক্ষ্য।
‘উঠে আসুন৷ আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই।’
সায়রের ডাকে কেঁপে উঠলো দুপুর। খেয়াল করলো, সায়র গাড়িতে উঠে বসেছে। এটা বোধ হয় সায়রের নিজের গাড়ি। ড্রাইভিং সিটে বসে সানগ্লাস পড়ে হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে দুপুরের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপুর হাতের ভারী ব্যাগটা কাঁধে তুলে বলল,
‘আমি একটা রিকশা ভাড়া করে চলে যেতে পারবো। ‘
বলেই গটগট করে হাঁটতে লাগলো দুপুর। আশেপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজছে। সায়র লম্বা শ্বাস টেনে খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল,
‘আপনি আমাকে কিছুতেই শান্ত থাকতে দিচ্ছেন না। আপনি যদি এই মুহুর্তে গাড়িতে না ওঠেন, তাহলে আমি কিন্তু কোলে তুলে গাড়িতে ওঠাবো। ‘
দুপুর সায়রের কথায় ঘাবড়ে গেলেও চোখ মুখে তা দেখালো না। ভাবলেশহীন পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সায়র দুপুরের এহেন আচরণে রেগে গেলো। দুপুরের সামনে সায়র নিজের রাগকে সবসময় চেপে রাখে। সায়রের রাগ অনেক ভয়ঙ্কর। একবার রাগ হলে হুঁশ থাকেনা। তাই যতোটা সম্ভব হাসিখুশি রূপে থাকে। অথচ, এখন মনে হচ্ছে শান্ত থাকলে দুপুর তাঁর কোনো কথাতেই গুরুত্ব দেয়না। অথচ,সায়র এটা জানে দুপুরের মনেও তাঁর জন্য কিছু আছে। প্রায় সময়ই দুপুর আড়চোখে তাকায় তাঁর দিকে।
সায়র দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নামলো। দুপুর সেটা দেখেনি। সায়র পেছন থেকে দুপুরের হাত টেনে ধরলো শক্ত করে। দুপুর ভয় পেয়ে পিছনে ফিরলো। সায়রের মুখচোখে রাগ স্পষ্ট। দুপুর শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘তুমি আমার হাত ধরলে কেনো! ছাড়ো।’
দুপুরের কথায় কান দিলো না সায়র। জোড়পূর্বক টেনে গাড়িতে উঠালো। দুপুর চেচিয়ে বলল,
‘এগুলো কী ধরনের অসভ্যতা! আমি বললাম তো আমি একাই রিকশা দিয়ে চলে যাবো! ‘
সায়র দুপুরের ব্যাগটা পেছনের সিটে রেখে, নিজের সিটে এসে বসলো। দুপুরের দরজাটা লক করে দিলো। দুপুর চেষ্টা করেও আর খুলতে পারলো না। সায়র ড্রাইভিং সিটে বসে দুপুরকে ধমকে উঠলো,
‘চুপ! একদম কথা বলবে না! চুপচাপ বসো নাহলে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলবো। ‘
দুপুর ভয়ে আঁতকে উঠলো। ঠোঁট কেপে উঠেছে বকা খেয়ে। চোখ টলমল করছে। একটা হাত নিজের বুকে চেপে ফুপিয়ে উঠলো সে। সায়র ড্রাইভ করছে। পুরো রাস্তায় আর একটা কথাও উচ্চারণ করেনি। চোখ মুখ তখনো শক্ত। দুপুর জানালার দিকে মুখ করে নিঃশব্দে কাঁদছে। মনে মনে বকছেও সায়রকে। কী অসভ্য! বেয়াদব! নিজের চেয়ে বড় একটা মেয়ে ধমকে কাঁদিয়ে ফেললো। হাত পায়ে, চেহারায় এখনো কলেজ পড়ুয়া মনে হয় বলে কী এখনো ছোটো আছে সে! মোটেও না। অথচ, বয়সে ছোটো হয়েও হাতে পায়ে, ব্যাক্তিত্বে নিজের বয়সের চেয়ে দশ বছরের বড়দের মতো আচরণ করে। সায়রের ওই ধারালো ব্যাক্তিত্বের দিকে তাকালে, দুপুরের নিজেকে কোনো ছোট্ট বাচ্চা বলে মনে হয়। এজন্য এতো জোরে ধমক খাওয়ার পরও টু শব্দ করতে পারলো না ভয়ে। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো, সত্যি সত্যি একটা কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দেবে। সংসারের এতো বড় দায়িত্বের চাপে নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জ্জন দিলেও, ভেতরের সেই আহ্লাদী দুপুর এখনো বকা খেলে ঠোঁট ফুলিয়ে নেয়। এতো জোরে বকা শিপুদাও দেয়নি তাঁকে ম্যাথ করানোর সময়। ছেলেটা খুব বাজে। এই বাজে ছেলের সঙ্গে আর কখনো কথা বলবেনা দুপুর। কক্ষনো না। নিজেকে কী ভাবে, কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট!
দুপুরের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো সায়র। সেদিন ঝড়বৃষ্টির রাতে দুপুরের বাড়ির ঠিকানা জেনেছিলো সায়র। গাড়িতে ব্রেক চেপে চোখের সানগ্লাসটা খুলে সাইডে রাখলো। দুপুরকে নামতে বলার জন্য ওর দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো দুপুর ঠোঁট উল্টে ফুপিয়ে উঠছে একটু পর পর। আনমনে কী যেনো ভাবছে, নিজের বাসার সামনে যে গাড়ি থেমেছে সেটাও খেয়াল করেনি। সায়র নিজের উপর রেগে জানালার কাঁচে ঘুষি দিয়ে উচ্চ শব্দে বলল,
‘ওহহ শিট!’
দুপুর আরেকবার কেঁপে উঠলো। টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি তো ভারী বাজে ছেলে, এখন কী আমাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেবে!’
সায়র দুপুরের দীঘল কালো ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। কান্না করায় চোখ দুটো লাল হয়ে অথৈজলে থৈ থৈ করছে। সায়র দুপুরের গালটা হাতের আজলায় উঠিয়ে নিয়ে বলল,
‘আপনাকে যদি এখনই একটা চুমু খাই, আপনি কী রাগ করবেন?’
চলবে –
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।