মনসায়রী’ ২৭.

‘মনসায়রী’

২৭.
সূর্যের মিষ্টি রোদ এসে পৃথিবীর বুকে মিশে যাচ্ছে। সমুদ্রের জলে পিনপতন নীরবতা। বাতাসে ঠান্ডা গন্ধ। চোখ জুড়ানো অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। তাঁর মাঝেই একজোড়া নরনারী বেঞ্চে ঘুমাচ্ছে। দূর থেকে চমৎকার দৃশ্যটি দেখে দশ বছরের শিমুল নিজের ক্যামেরায় তা বন্দী করে নিলো। বহুদিন পর মনমতো একটা ছবি দেখে আপনমনে হেঁসে উঠলো।

ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে উঠলো সায়র। কোলের দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত দুপুরকে দেখে নিলো। লম্বা হাই তুলে আলসেমি তাড়ালো। গতরাত্রে দুপুরকে সমুদ্রের দিকে আসতে দেখে সায়রও পিছু নিয়েছিলো। মাঝে পৃথিলার বকবক শুনে সময় নষ্ট হলো। যখন এখানে আসলো। তখন দুপুর বেঞ্চেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সায়র পাশে বসে দুপুরের মাথাটা ধীরেসুস্থে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বসেছিলো। কখন যে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। বুঝতেই পারেনি সে। সায়র পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো হোটেল থেকে ফারহা অনেক গুলো কল করেছে, সাথে বাবারও অনেক গুলো মিসডকল। ফোন রেখে দুপুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। হঠাৎ করেই চোখ গেলো খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো একটা ছেলেকে দেখে। ওদের দিকে তাকিয়ে ক্যাবলাকান্তের মতো হাসছে। সায়র ভ্রু কুচকে ফেললো তা দেখে। জোরে ডাকলে যদি দুপুরের ঘুম ভেঙে যায়, এজন্য হাত উঁচু করে ইশারা করলো এদিকে আসতে। ছেলেটা সায়রের দিকে তাকিয়ে একবার কী যেনো ভাবলো, তারপর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসলো। সায়র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল,

‘এভাবে হাসছিলে কেনো তুমি আমার দিকে তাকিয়ে? আমাকে কী দেখতে পঁচা দেখায়?’

ছেলেটা হেঁসে ফেললো। মাথা নেড়ে অতিশয় বলে উঠলো,

‘না না, তা হইবো ক্যান! আমি আমার কাজ করতেসিলাম। ‘

সায়র অবাক হয়ে বলল,

‘আমার দিকে তাকিয়ে কী কাজ? আর তোমার হাতে ওটা কী?’

ছেলেটা হাতে থাকা ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এইডা ক্যামেরা। আমার কাম হইলো মাইনষের ছবি তুইলা দেওন। আইজকা এহনো কোনো কাস্টমার পাইতাসিলাম না, আপনাগো দেইখা অনেক ভাল্লাগলো। তাই একটা ছবি তুললাম। ‘

সায়র ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কেমন তুলেছো দেখি। ‘

ছেলেটা হেঁসে আনন্দের সঙ্গে ছবিটা বের করে দেখালো। সায়রের কাছে ছবিটা এতো বেশি ভালো লাগলো! মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো সে। পকেট হাতড়ে দুটো এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘এই ছবিটা তুমি আমাকে দাও, আর টাকাগুলো রাখো। ‘

ছেলেটা হাসি থামালো। হাতের ক্যামেরাটা পেছনে নিয়ে নিলো। টাকাগুলো সায়রের হাতে দিয়ে বলল,

‘আমি সব ছবি বিক্রি করি না! এইডা আমার পছন্দের ছবি! ‘

সায়র বাকরুদ্ধ হলো। থমকে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই হেঁসে বলল,

‘নাম কী তোমার? ‘

‘শিমুল। ‘

‘বাসায় কে কে আছে?’

শিমুল মন খারাপ করে বলল,

‘একটাই বইন আসে। বাপ মরার পর, নানী মায়রে নিয়া আরেক জায়গায় বিয়া দিসে। নানী মরলো দুই বছর। এহন আমি আমার বইনরে নিয়াই থাকি। ‘

সায়র কিছু বলতে পারলো না, ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একটু থেমে বলল,

‘তোমাকে দেখে ক্ষুধার্ত লাগছে। আজকে কিছু খেয়েছো বলে মনে হচ্ছে না। ছবি জীবনে আরো অনেক তুলতে পারবে। এখন টাকা গুলো রাখো। আর বলো তো আমাদের দু’জনকে একসাথে কেমন দেখাচ্ছে? ‘

শিমুল একবার ঘুমিয়ে থাকা দুপুরের দিকে তাকালো আরেকবার সায়রের দিকে। এরপর একগাল হেঁসে বলল,

‘অনেক ভালা মানাইসে!’

‘তাই! একটা কথা জানো, উনি আমার থেকে আড়াই বছরের বড়। ‘

ছেলেটা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জিহ্বা কেটে বলল,

‘ও মোর খোদা! উনি তাইলে আপনার বইন! আমি তো বউ ভাবসিলাম!’

সায়র হো হো হেসে উঠে বলল,

‘ধুর বোকা ছেলে! এটা আমার বউ-ই। ভবিষ্যত বউ। ‘

ছেলেটা বোকা চোখে চেয়ে বলল,

‘তাইলে যে কইলেন, আপনার চেয়ে বয়সে বড়! ‘

সায়র ঘুমন্ত দুপুরের মাথার মসৃণ চুলগুলোতে হাত গলিয়ে বলল,

‘তুমি বুঝবেনা। ছবিটা দাও। ‘

শিমুল আর আপত্তি করলো না। গরীবের বেশি শখ আহ্লাদ থাকতে নেই। দুই হাজার টাকা তো কম নয়। কতদিন হলো বোনকে ভালো কিছু খাওয়ানো হয়না৷ পোশাকটাও প্রায় ছেঁড়া। টাকাগুলো দিয়ে ভালো একটা জামা কিনে দেয়া যাবে ওকে। সায়র ছবিটা হাতে নিয়ে সাইডে রাখলো। ছেলেটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছিলো। সায়র পিছুডেকে বলল,

‘এই কার্ডটা রাখো। আমার নাম্বার লেখা আছে। কখনো টাকা পয়সার দরকার হলে, কল করো। আমাকে বড় ভাই ভাবতে পারো। ‘


মেয়েলি কন্ঠের ডাকে ঘুম হালকা হয়ে আসলো দুপুরের। চোখ কচলে গলায় ওড়না টেনে উঠে বসলো সে। ঘোলাটে হয়ে থাকা চোখ খুলে দেখলো ফারাহ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ভারী প্রসাধনী। গায়ে টিপটাপ জামাকাপড়। খোলা চুলে সুন্দর দেখাচ্ছে। নিজেকে বেঞ্চে আবিষ্কার করে প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তেই মনে পড়লো গতকাল রাতে এখানেই কীভাবে যেনো ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ফারাহ দুপুরকে বলল,

‘উঠেছো ঘুম থেকে! এবার তাড়াতাড়ি তৈরি হও ৷ বেরও তো হতে হবে। বাস ছাড়বে নয়টায়। এখন অলরেডি সাড়ে আটটা। এতো খুজলাম তোমাকে ৷ শেষে এসে দেখি এখানে এসে ঘুমাচ্ছো। ‘

দুপুর সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো ভালোই সকাল হয়েছে। রাতে দেরিতে ঘুমানোয় উঠতে লেট হলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফারাহর পিছনে পিছনে হোটেলে গেলো। সবাই-ই রেডি হয়ে বসে আছে। বাস আসার অপেক্ষায় আছে এখন। নিজের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা তাড়াহুড়ো করতে লাগলো দুপুর। কোনোরকম গোসল করে জামা কাপড় পড়ে তৈরি হলো। এরপর ভেজা চুলগুলো আর বাঁধতে না পেরে এভাবেই রেখে দিলো। কী আশ্চর্য! দ্রুত করতে নিলে আরো বেশি দেরি হয়! সবকিছু যদিও গোছানোই ছিলো। তবুও আরেকবার চেক করে নিলো। নাহ, আর কিছু বাকি আছে মনে পড়ছে না।
রুমটা শেষ বার ভালো মতো দেখে নিয়ে চাবি দিয়ে লক করে বেরিয়ে গেলো। একদিকে বাড়ি ফিরে যাবার আনন্দ অনুভব হলেও। আরেকদিকে সমুদ্রদর্শনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো আর দেখতে পাবেনা, ভেবে বিষন্নতাও অনুভব করছে।

হোটেল থেকে বের হয়ে বাসে উঠতে গিয়ে দুপুর দেখলো, বাসের সবগুলো সিটই প্রায় দখল হয়ে গেছে। ফারাহ এই পুরো টিমের দেখভালের দায়িত্বে ছিলো। তাই, কেউ বাকী আছে কিনা তা দেখতেই বাস থেকে নেমেছে। দুপুর অসহায়ের মতো তাকালো সবগুলো সিটের দিকে। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলো সায়রের পাশের সিটটাই একমাত্র খালি। দুপুরের সন্দেহ হলো, আচ্ছা ছেলেটা কী ইচ্ছে করেই ওই সিটটা ফাঁকা রেখেছে। যাতে দুপুরকে বাধ্য হয়ে ওখানে বসতে হয়! উহু,দুপুর কখনো ওর পাশে বসবেনা বলে মনে মনে ঠিক করলো। সায়র চোখ বন্ধ করে সিটে বসে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিলো। দুপুরকে দেখতে পেয়ে বলল,

‘চাইলে এই সিটে বসতে পারেন৷ ‘

দুপুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুঁসে উঠলো। থমথমে কন্ঠে বলল,

‘দরকার নেই। আমি ওখানে বসবো না৷ ‘

সায়র ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

‘এজ ইয়োর উইশ!’

বলেই আবারো চোখ বুঁজে বসে রইলো সায়র। দুপুর মনোক্ষুণ্ণ হলো। ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়। দুপুরের তো সন্দেহ হয়, আসলেও কী ছেলেটা তাঁকে পছন্দ করে নাকি তার সাথে মজা করছে।

একটু পরই ফারাহ আসলো। বাস ছেড়ে দিলো। দুপুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

‘একি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? সায়রের পাশের সিটটা তো খালি পড়ে আছে তুমি ওখানে বসো। ‘

দুপুর অস্বস্তি নিয়ে বলল,

‘না আপু, আমার বসার দরকার নেই। আমি বরং দাঁড়িয়েই থাকি।’

সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে দুপুরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই বাস এমনভাবে হেলতে দুলতে যেতে লাগলো দুপুরের পক্ষে কোনোভাবেই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। আবার, সায়রের পাশে বসতেও মন চাচ্ছে না। সায়র হঠাৎ-ই দুপুরের একটা হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আচমকা বসে হকচকিয়ে তাকালো দুপুর। সায়র দুপুরকে বলল,

‘সব জায়গায় এতো আত্মসম্মান দেখাতে নেই। ‘

দুপুর মুখ ভেঙিয়ে অন্য দিকে বসে রইলো। কক্সবাজার থেকে অনেকটা পথ দূরে চলে এসেছে বাস। সিটে মাথা রেখে দুপুর নানান চিন্তা ভাবনা করছিলো। হঠাৎ করেই মাথায় চিন্তা আসলো, গতকাল রাতে যে ডায়েরীটাতে মনের জমানো এতো কথা লিখলো। সকালে উঠে বেঞ্চে উঠে তো ডায়েরিটা দেখলো না! সারা গায়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো দুপুরের। সাত আসমান যেনো চুরচুর হয়ে মাথার উপর পড়লো। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো দুপুর। চিৎকার করে বলে উঠলো,

‘আমার ডায়েরী! আমার ডায়েরী!’

বলেই বাস থামাতে উঠে দাঁড়ালো দুপুর। সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে দুপুরের কান্না দেখে। সায়র পেছন থেকে দুপুরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। দুপুর একনাগাড়ে কাঁদছে। দুপুরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে সায়র ফেলে আসা সমুদ্রের পথের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘পিছুটান রাখতে নেই দুপুর, সেটা বস্তুর হোক কিংবা মানুষের। ভালো থাকতে হলে পিছুটান ভুলতে হয়। নতুন করে জীবনকে সুযোগ দিন। আমি তো আছি আপনার পাশে! ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here