মনসায়রী” ২৬.

“মনসায়রী”

২৬.
খাবার টেবিলে রাখা দুকাপ ধোয়া ওঠা চা। একটা কাপ হাতে নিয়ে সৌরভ মাহবুব টেবিলে বসলেন৷ অপর প্রান্তে দুপুর ও দিতিয়ার বাবা জুবিন মাহবুব। সকালের নাস্তায় দুজনের চা না হলে চলে না একেবারেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজন গল্পে মেতে উঠলেন। মিরা বেগম রুটি আর সবজি এনে প্লেটে সাজাচ্ছিলেন। কাজের লোকের অভাব নেই। তবুও, মিরা বেগমের নিজের হাতে রান্না করতে ভালো লাগে।

দিতিয়াকে ঘুম থেকে তুলে এনে দুপুরও এসে বসলো। একটু পর শিহাব আসতেই, দুপুর আড়চোখে একবার তাকালো। গতকাল তনয়া যাওয়ার পর থেকেই দুপুর রেগে আছে শিহাবের উপর। রাগ নয় বরং অভিমান বেশি। শিহাব দুপুরের পাশেই চেয়ার টেনে বসলো। দুপুর একবারও সরাসরি তাকালো না।

শিহাব কথা বলার উসিলায় দুপুরকে বলল,

‘দুপু, সবজির বাটিটা এদিক দে তো। ‘

যেহেতু সবাই সামনে আছে। তাই, দুপুর না করতে পারলোনা। চুপচাপ বাটি এগিয়ে দিয়ে খেতে থাকলো। শিহাব বাটি থেকে সবজি নিতে নিতে হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সৌরভ মাহবুব দুপুরকে বললেন,

‘দুপুর মা, আজকে কলেজ নেই?’

দুপুর খেতে খেতে বলল,

‘আছে চাচ্চু, একটু পরই বের হবো। ‘

‘তাহলে, শিহাবই নাহয় তোমাকে কলেজে নিয়ে যাবে। ওর ভার্সিটিও তো সামনেই। ‘

শিহাব মিটিমিটি হেঁসে দুপুরের দিকে তাকালো। মনে মনে বাবাকে ধন্যবাদ দিলো। এবার অন্তত সুযোগ পাওয়া যাবে দুপুরের মান ভাঙানোর। দুপুর প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু মিরা বেগম বলায় আর কিছু বলতে পারলোনা।

তৈরি হয়ে এসে বের হলো দুপুর। শিহাব বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। দুপুর আসতেই ওর দিকে হেলমেট এগিয়ে দিলো। দুপুর তা নিলো না। অন্য দিকে মুখ করে বাইকে বসলো। শিহাব হাসলো ওর কান্ড দেখে। দুপুর যেহেতু হেলমেট পড়েনি, তাই অনেক আস্তে আস্তে বাইক চালাচ্ছে শিহাব। দুপুর গম্ভীর গলায় বলল,

‘এতো আস্তে বাইক চালালে আজকে আর পৌঁছাতে হবেনা। ‘

শিহাব কোনো কথা বলল না। সে বাইক নিয়ে কলেজের পথে না গিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে। দুপুর তা দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। শুধু চুপচাপ দেখতে লাগলো,শিহাব ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর একটা নদীর সামনে এনে বাইক থামালো। হেলমেট খুলতে খুলতে বলল,

‘নাম তো! ‘

দুপুর চুপিসারে নামলো। শিহাব ওকে দাঁড় করিয়ে বাইকটা এক সাইডে রাখলো। এরপর দুপুরকে নিয়ে পাশের একটা দোকানে বসলো। শিহাব দোকানে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটাকে বলল,

‘ময়না চাচা, দুটো মালাই কুলফি দাও তো ৷ অনেক দিন হলো আসা হয়না।’

বৃদ্ধ লোকটা সুন্দরমতো হেঁসে বললেন,

‘শিপু বাপজান নাকি, আইয়া বসো এইখানে বাপ। ‘

শিহাব হেঁসে দুপুরকে বসতে বললো। দুপুর চুপ করে বসলো। ময়না চাচা দুটো মালাই কুলফি বানিয়ে শিহাবকে দিলেন। শিহাব একটা দুপুরকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘খেয়ে দেখ। ভালো না লাগলে ফেলে দিস৷ ‘

দুপুর কিছু না বলে অল্প খানিকটা মুখে নিলো। এতো চমৎকার স্বাদের কুলফি যে দুপুর হেসে বলল,

‘আরে, এটা তো অনেক মজা! ‘

শিহাব খেতে খেতে বলল,

‘কুলফির দুটো উপকারীতা!’

দুপুর প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল,

‘কী কী?’

‘এক, গরমে শান্তি দেয় আর দুই, প্রণয়িনীর মান ভাঙানো যায়। ‘

কথার এহেন ভঙ্গিতে দুপুর উচ্চশব্দে হাসলো। শিহাবও হেসে বলল,
‘তো, প্রণয়িনীর মান ভেঙেছে? ‘

দুপুর দুষ্ট হেঁসে বলল,

‘উহু! তবে রোজ এই জাদুর কুলফি খাওয়ালো ভেবে দেখবো। ‘

শিহাব দুপুরের গাল টেনে বলল,

‘ওরে দুষ্ট! ‘

‘দুপুর! এই দুপুর! কোথায় হারালে?’

চমকে উঠলো দুপুর৷ আচানক ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় কিছু ঠাওর করতে পারলো না। তৎক্ষনাৎ আশেকে খেয়াল করে হুঁশ ফিরলো। নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে দুপুর বলল,

‘আসলে, কাল তো চলে যাচ্ছি এজন্য মনটা অন্যমনস্ক। এতগুলো দিন সবাই একসঙ্গে থাকলাম। বাকী শুধু আজকের রাতটা। ‘

ফারাহ জুসের গ্লাসটা নিতে নিতে বলল,

‘হ্যা, তা যা বলেছো। সবাই একসঙ্গে অনেক আনন্দ করলাম। ‘

দুপুর ছোট করে হুম বলে খেতে থাকলো। সবাইকে আনন্দ করে একসাথে বসে খেতে দেখে দুপুরের মনে পড়ছিলো, বছর কয়েক আগে এভাবেই পুরো পরিবারের মানুষ মিলে গল্প করতে করতে নাস্তা করতো। শিহাব আর তাঁর মাঝে চোখাচোখি হতো, যা পরিবারের সকলের অগোচরে। কেউ জানতো না, কলেজের ছুটির পর প্রায়ই শিহাব তাঁকে ঘুরতে নানান জায়গায় নিয়ে যেতো। কখনো রাগ হলে শিহাব যেভাবেই হোক ময়না চাচার দোকান থেকে কুলফি এনে খাওয়াতো। অনেক সুন্দর ছিলো দিন গুলো। মাঝে মাঝে মনে পড়লো কলিজাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে আসে দুপুরের। অনেক কষ্টে বাকী খাবারটুকু গিলে উঠে গেলো দুপুর।
সায়র পাশেই বসে ছিলো। দুপুরের খেতে বসার পর থেকে অন্যমনস্কতা। এরপর অনেকক্ষণ কোনো ভাবনায় ডুবে থাকা। চোখের জল মুছে খাবার কোনো রকম পানি দিয়ে গিলে উঠে যাওয়া। কোনোটাই দৃষ্টি এড়ালো না। দুপুর উঠে যাওয়ার পর সায়র দীর্ঘক্ষণ ভাবনায় ডুবে রইলো। মনে মনে ভাবলো,

‘কিছু একটা আছে দুপুর, যা আপনি কাউকে বলছেন না। যদি আমি যা ধারণা করছি তা-ই সঠিক হয়, তবে আমি তা সহ্য করতে পারবো না। ‘


ঘর থেকে নিজের নিত্যসঙ্গী ডায়েরিটা নিয়ে হোটেলের বাইরে চলে আসলো দুপুর। আজ বহুদিন হলো ডায়েরীটা নিয়ে বসা হয়না। বাহিরে প্রচুর বাতাস। কক্সবাজারের এই জায়গাটাতে মাঝেমধ্যেই ঝড় তুফান হয়। রাতের সমুদ্রের জায়গাটাতে এজন্য অনেক বেশি বাতাস থাকে। খানিকটা সময় চোখ বন্ধ করে বসে রইলো দুপুর। চোখ বন্ধ করতেই বুকে চেপে রাখা আর্তনাদ গুলো জল আকারে বেরিয়ে যেতে লাগলো চোখ বেয়ে৷ চোখ মুখ মুছে লম্বা শ্বাস টেনে ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করলো –

‘আজ বহুদিন হলো লেখা হয়না। নাহ, আর জমিয়ে নিজের মনকে ভারী করা সম্ভব হচ্ছে না। আগে ডায়েরির প্রতি তেমন টান অনুভব করিনি কারণ ডায়েরির চেয়েও বেশি একজন মানুষকে আমি ভরসা করতাম। সেই মানুষটা ‘শিপুদা’। হ্যা শুধু আমার শিপুদা! যতদিন সে শিপু ছিলো ততোদিন সে আমারই ছিলো৷ ওহ হ্যা, এখন সে আর শিপুদা নেই। সে কারো শিহাব হয়েছে। এই শিহাবের উপর আমার কোনো অধিকার নেই। নেই কোনো দায়বদ্ধতা। এখন শিহাবের উপর অধিকার শুধু তনয়া ভাবির।

আচ্ছা, শিপুদা তুমি আমাদের ভাগ্যটা কেনো এতো খারাপ বলো তো! যদি সেদিন চাচ্চু তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের জেদ না ধরতো আর তুমিও জেদ করে বাড়ি ছেড়ে সিলেটে তোমার বন্ধুর বাসায় চলে না যেতে তাহলে তো আর বাবা আর চাচ্চু সিলেটে তোমাকে আনতে যেতো না! আর না গেলে তোমাদের সবার এক্সিডেন্টটাও হতো না!

জানো আজও সেদিনটা আমি ভুলতে পারিনা। পারবোনা কখনো। যেদিন তোমাকে আনতে গিয়ে বাবা চাচ্চুর এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। ট্রাকের ধাক্কায় তোমাদের গাড়িটা খাদে গিয়ে পড়লো। বাবা তৎক্ষনাৎ মারা গেলো। তুমি কোমায় রইলে এক মাস আর তোমার দুটো পা-ই প্যারালাইস হলো! আর চাচ্চুর জ্ঞান ফিরলো সাত ঘন্টা পর৷ আর আমাকে করালেন কঠিন ওয়াদা।

থাক ওসব কথা। আজ বহুদিন পর এসব কথা আবার কেনো যেনো মনে পড়লো। একটা কথা কী জানো শিপুদা? প্রণয়িনী হওয়া খুব সহজ। কিন্তু পরিণীতা হতে ভাগ্য লাগে! যা আমার ছিলো না! ‘

চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here