“মনসায়রী”
২৫.
‘আপনার নাম্বারটা পাওয়া যাবে?’
বন্ধুদের আড্ডার মাঝে হঠাৎ একটা মেয়ের অযাচিত আগমন এরপর বিব্রতকর একটা প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকালো শিহাব। বলা নেই, কওয়া নেই। কোথা থেকে এসে এসব প্রশ্নে করছে! ভারী বেয়াদব তো! শিহাব মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকালো। পোশাক -আশাক দেখেই আদরের ঘরের দুলালী মনে হচ্ছে। বিরক্ত হলো শিহাব। দুপুর কৈশোরের ভালোবাসা হলেও, প্রণয়ের সম্পর্কটা তখন সাত মাসের। ততোদিনে দুপুরও শিহাবকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ভালোবাসতে শুরু করেছে। একই বাড়িতে হওয়ায় সময় অসময়ে বাহিরে গিয়ে ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া, ভবিষ্যতের জন্য দেখা মিষ্টি কিছু স্বপ্ন বোনা সবই তখন বিদ্যমান। শিহাব তখন দুপুর ব্যতীত অন্য কোন মেয়েকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছুক নয়। বন্ধুরা সবাই মুখ টিপে হাসছে। ওরা কেউই দুপুরের সম্পর্কে অবগত নয়। তাই কয়েকজন শিহাবকে ধাক্কাচ্ছে নাম্বার দেয়ার জন্য। শিহাব বিরক্ত হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার নাম্বার জেনে কী করবে তুমি?’
‘আই লাভ ইউ!’
‘হোয়াট!’
অকপট স্বীকারোক্তিতে মুখ হা হয়ে গেলো শিহাবের। কোনো মেয়ে যে এসে এভাবে আই লাভ ইউ বলতে পারে তা জানতো না শিহাব। মেয়েটা শিহাবকে অবাক হতে দেখে নিজেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি হেঁসে বলল,
‘আমি তনয়া ইসলাম। আপনাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে। প্রথম ধাক্কায় ইষ্কওয়ালা লাভ! ‘
এতো চঞ্চলতা নিয়ে কথাগুলো বলল তনয়া, সুন্দরী গড়নের এই মেয়েকে দেখে অন্য কেউ হলে অবশ্যই প্রেমে পড়ে যেতো। কিন্তু শিহাব চেহারাটাতেও মনোযোগ দিলো না। সে রাগী কন্ঠে বলল,
‘তনয়া হও ফনয়া, আমার জেনে লাভ নেই। কোন ইয়ার তুমি?’
‘কোন ইয়ার বললে আপনি খুশি হবেন?’
তনয়ার মুখে দুষ্ট হাসি৷ স্বভাবতই ভীষণ চঞ্চল আর জেদি সে। কোনো কিছু ভালো লাগলে তাঁকে না পাওয়া পর্যন্ত থামেনা তনয়া। শিহাবকে আরো রেগে যেতে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
‘আচ্ছা সরি! আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। আপনারটা জানি, আপনি মাস্টার্স করছেন। সব খোঁজখবর নেয়া আমার শেষ। আপনি সৌরভ মাহবুব ও ফারজানা বেগমের একমাত্র ছেলে। যৌথ পরিবার। পরিবারে মা বাবা ছাড়াও আরো আছে চাচা চাচী আর দুটো চাচাতো বোন। আপনার বাবার একটা মেশিনারিজ কোম্পানি আছে। দুটো বাড়ি আছে কল্যাণপুরে। আপনি ভীষণ ভদ্র ছেলে। কোনো মেয়েলী ব্যাপার স্যাপার নেই। এবার আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আপনার পরিবারটা কমপ্লিট করে ফেলুন৷ ‘
শিহাব তনয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘এই মেয়ে তোমার মাথায় কী গন্ডগোল আছে নাকি?’
তনয়া নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘আগে ছিলো না, কিন্তু আপনার সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে দেখা দিয়েছে। সত্যি আই লাভ ইউ! ‘
শিহাব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘বাট আই ডোন্ট। আমি তোমাকে পছন্দ করিনা। উল্টো পাল্টা কথা নেক্সটে এসে বললে আমি কী করতে পারি তোমার ধারণাতেও নেই। ‘
তনয়ার বান্ধবী শ্রেয়া ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। তনয়া যেতে যেতে চিৎকার করে বলল,
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি শিহাব। আপনি আমারই হবেন, আমি কিছু চেয়েছি আর তা আমার হয়নি এটা কখনো ঘটেনি আর আমি ঘটতে দেবোও না! ‘
তনয়াকে নিয়ে গেলো শ্রেয়া। শিহাব বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। পাশ থেকে রাফি শিহাবকে বলল,
‘দিয়েই দিতি নাম্বারটা! সুন্দরী একটা মেয়ে। মানাবে কিন্তু তোর সাথে। ‘
শিহাব পকেট থেকে মোবাইল বের করে দুপুরকে কল দিতে দিতে বলল,
‘চুপ থাক, মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে। ‘
–
দুই বছর অতিক্রম হলো। এমন কিছু বাদ যায়নি যা করেনি তনয়া শিহাবকে পাবার জন্য। একদিন তো তনয়া শিহাবের বাড়িতে চলে আসলো। শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে। দরজা খুলে ফারজানা বেগম পুরো হতভম্ব। মিরা বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন কে তুমি।
তনয়া ফারজানা আর মিরাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,
‘আমি আপনাদের ছেলের বউ! ‘
ফারজানার মাথায় হাত। মিরা বেগম চমকে তাকিয়ে আছেন। ফারজানা বেগম গগনবিদারী চিৎকার করে শিহাবকে ডাকলেন। শিহাব তখন দুপুরের ঘরে বসেছিলো। সম্পর্কটা প্রণয়ের হলেও শিহাব যথেষ্ট শাসন করে দুপুরকে। বসে বসে অঙ্ক করাচ্ছিলো দুপুরকে দিয়ে। দুপুর হাই তুলে আলসে ভঙ্গিতে বসে লিখছে। এমন সময় ফারজানা বেগমের চিৎকারে দুজনেই কেঁপে উঠলো।
শিহাব উঠে হলরুমে গেলো। ওর পিছু পিছু দুপুরও। তনয়াকে এমন বেশে দেখতে পেয়ে মুখ হা হয়ে গেলো শিহাবের। দুপুর চিন্তে না পেরে শিহাবকে ফিসফিস করে বলল,
‘ও শিপুদা! এটা কে গো?’
শিহাব বুঝতে পারলো না কী বলবে। তনয়া সবার আড়ালে শিহাবের দিকে চোখ টিপ দিলো। শিহাব আগে থেকেই ভড়কে ছিলো। এখন ঘাম ছুটে গেলো তার। ভার্সিটিতে তো প্রতিদিনই এসে উদ্ভট সব কাজকর্ম করে। আজ সোজা বাড়ি চলে এসেছে।
তনয়া শিহাবের কাছে এসে বলল,
‘শিহাব,আপনি না বলেছিলেন বাড়ির সবার সাথে একদিন আমার পরিচয় করাবেন। সবাইকে আপনি কেনো এখনো বলেননি, আমাদের গত দুই বছরের প্রেম আছে। ‘
ফারজানা বেগম তেড়ে আসলেন শিহাবের কাছে,
‘এসব কী সত্যি শিপু? এইসব করছিস তুই!’
শিহাব না না করে কিছু বলার আগেই দুপুর টলমল চোখে তাকালো। শিহাব অস্থির হয়ে বলল,
‘বিশ্বাস করো মা, বিশ্বাস কর দুপু আমি এসব কিছু করিনি। এই মেয়ে একটা মিথ্যাবাদী। ‘
তনয়া কান্নার নাটক করে নাক টেনে বলল,
‘শিহাব, তুমি আমাকে অস্বীকার করতে পারো না। তুমি আজ সকালেও আমাকে কল করে বলেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো।’
শিহাব এবার ভীষণ রেগে গেলো। কারণ, পরিবারের সামনে এমনভাবে অপমানিত সে কখনো হয়নি। এতোদিন ব্যাপারটাকে গায়ে না লাগালেও এবার কিছু না করলেই নয়। তনয়ার কাছে এসে শিহাব সকলকে অবাক করে দিয়ে তনয়ার গালে থাপ্পড় মেরে দিলো। তনয়া ভাবতে পারেনি, শিহাব এমনটা করতে পারে।
শিহাব তনয়াকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়ে বলল,
‘তোমার মতো নির্লজ্জ বেয়াদব মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। তোমার কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে। যা তুমি নিজেও জানোনা। সব কিছুতে জেদ করতে নেই। আজকে যে কথাটা বললাম, তার ফল তুমি একদিন পাবে। আর কখনো আমার সামনে আসবেনা। ‘
তনয়ার মুখের উপর দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো শিহাব। ফিরে এসে দেখলো দুপুর ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। শিহাবকে দেখে অভিমান করে ঘরে ঢুকে গেছে। শিহাব ছুটে গেলো প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাতে।
–
‘খালুজান, ম্যাডাম কিছু খাচ্ছেন না। ‘
‘এখনো ভাঙচুর করছে?’
‘না। এতক্ষণ ঘরের কাঁচের যা ছিলো সব ভাঙলেন। এখন বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছেন৷ ‘
‘ঠিক আছে, তুমি যাও আমি দেখছি। ‘
ফিরোজ ইসলাম পত্রিকা দেখে দৃষ্টি সরিয়ে উঠলেন। তনয়া তার একমাত্র মেয়ে। স্ত্রী নয়না ও তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
আজ অব্দি তনয়া কিছু চেয়েছে আর তা পায়নি, এমন ঘটেনি বললেই চলে। মেয়ের রুমে এসে তিনি নক করলেন। তনয়া জানে এখন একমাত্র তার বাবাই আসতে পারে। ফিরোজ ইসলাম ভেতরে আসলেন। বিছানায় মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘বাবাকে খুলে বলো মা, তোমার কী চাই?’
তনয়া কান্না থামিয়ে উঠে বসলো। বাবার হাত ধরে বলল,
‘আচ্ছা বাবা, ভালোবাসা কী অপরাধ? ‘
‘না মা,ভালোবাসা অপরাধ হবে কেনো?’
‘তাহলে সে বোঝেনা কেনো আমি তাঁকে কতো ভালোবাসি! ‘
ফিরোজ ইসলাম হাসলেন। নয়না আর তার প্রেমের বিয়ে। তিনি হাসিমুখে বললেন,
‘তুমি সেই ছেলের বাড়ির ঠিকানা দাও। আমি দেখবো কে আমার মেয়ের হৃদয়ের এই হাল করেছে! ‘
তনয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ইউ আর দা বেস্ট ফাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড! ‘
চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।