“মনসায়রী”
২৪.
ওড়নাটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো দুপুর। সায়র এমনভাবে ঝুঁকে আছে, দুপুরের মুখের উপর তাঁর উত্তপ্ত নিশ্বাস পড়ছে। সায়রের চোখে ঘোর দেখতে পাচ্ছে দুপুর। সায়রকে পাশ কাটিয়ে নিশ্চুপ হয়ে চলে গেলো দুপুর। সায়র দুপুরের চলে যাওয়ায় দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। দুপুর তাঁকে কী একটুও বোঝেনা!
–
জামা কাপড় গুছানো শেষ করে লাগেজে ভরে রাখলো দুপুর। আজকের রাতটাই শেষ রাত কক্সবাজারের। কাল সকালেই রওনা হবে সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে। ক্লায়েন্টের সাথে পরপর আটটা মিটিংএ প্রেজেন্টেশন দিয়েছে দুপুর। এজন্য প্রচুর খাটতে হয়েছে। তবে, এর মধ্যে একটা ব্যাপার খুব ভালো লেগেছে ওর। প্রতিটা মিটিং এ সায়র এসে তাকে সাহস যুগিয়েছে। গতকালকে একটা শেষ মিটিং ছিলো। অর্থাৎ সবকিছু ফাইনাল হওয়ার দিন৷ অনেক নার্ভাসও ছিলো। সারারাত বসে কাগজপত্র রেডি করেছিলো। সকালে হোটেল সার্ভিস থেকে কফি দিয়ে গিয়েছিলো। অসাবধানতার বশে কফির মগটা গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লো কাগজের পাতায়। পুরো নোটটাই ভিজে গেলো। এতো হতাশ হলো দুপুর। যে আর বেরই হলো না। সারারাতের পরিশ্রম এভাবে শেষ হতে দেখায়, সোফায় বসে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। সায়র দুপুরের কামরার পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো। প্রথমে ভেবেছিলো দুপুর হয়তো আগেই চলে গেছে। কিন্তু, রুমের দরজা আধখোলা দেখে ভেতরে আসলো। দুপুরকে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠলো। একপ্রকার দৌড়ে এসে দুপুরের কাছে আসলো। দুপুর একবার মুখ তুলে সায়রকে দেখে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। সায়র দুপুরের পাশে বসে দুপুরের মাথাটা জোর করে উপরে তুললো। সায়র আঁতকে উঠলো দুপুরের মুখ দেখে। কান্না করায় সারামুখ লাল হয়ে গেছে। চোখের পাপড়ি ভিজে জুবুথুবু। ঠোঁট কামড়ে রাখায় একপাশে কেটে গেছে। দুপুর মাথা সরিয়ে নিতে চাইলো। সায়র দুপুরের চোখের পানি মুছে দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
‘আপনি কাদছেন কেনো দুপুর? কী হয়েছে? ‘
দুপুর ফুপিয়ে উঠলো। সদ্য মোছা গাল আবারো ভিজে উঠলো।
সায়র অধৈর্য হয়ে কিছু বলার আগেই দুপুর ভাঙা গলায় বলল,
‘আমি আসলেই গুড ফর নাথিং! এবার স্যার খুব রাগ হবেন আমার উপর। চাকরিটাও হয়তো থাকবেনা। ‘
বলেই থুতনি বুকে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। সায়র টেবিলের দিকে তাকিয়ে ভেজা কাগজগুলো দেখলো। এবার বুঝতে পারলো। আর এক ঘন্টা আছে। সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই সামান্য বিষয় নিয়ে কাঁদছেন আপনি!’
দুপুর চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
‘এটা সামান্য নয়। কিছুক্ষণ পরই মিটিং শুরু হবে। তখন আমি প্রেজেন্টেশনে কিছু বলতে পারবো না।আর এরপর এতোদিনের সব পরিশ্রম বৃথা যাবে। তারা অফিসের সব ডিল ক্যান্সাল করে দেবে। স্যার কতো ভরসা করে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন!’
সায়র কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর দুপুরকে বলল,
‘আচ্ছা, আপনি সারারাত বসে যেগুলো লিখেছেন সেগুলোর অর্ধেক হলেও তো আপনার মনে আছে তাই না! আমি ল্যাপটপে তুলছি আপনি বলুন। ‘
দুপুর একবার ভাবলো না করবে কিন্তু যদি এটাতে কিছু হয়। লম্বা শ্বাস ছেড়ে যা মনে আছে সেসব ধীরে ধীরে একের পর এক বলছে দুপুর। আধাঘন্টার মতো সময় লাগলো। আর বাকীটা সায়র নিজের আইডিয়া দিয়ে লিখে কমপ্লিট করলো। দুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আসলেই, এতো সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে কতোটা চিন্তায় পড়ে গেছিলো সে। আনমনে হেঁসে ফেললো। সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘দেখলেন তো, হয়ে গেছে। এবার নিশ্চিন্ত মনে প্রেজেন্টেশনের প্র্যাকটিস করুন। ‘
দুপুর কৃতজ্ঞতা নিয়ে বলল,
‘তুমি না থাকলে আজ আমি কী করবো বুঝতে পারতাম না। থ্যাঙ্কিউ। ‘
সায়র মুচকি হেসে চলে যেতে যেতে বলল,
‘আপনার হাসির জন্য সবকিছু করতে পারি আমি দুপুর। ‘
দুপুর হেঁসে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু থমকে গেলো সায়রের কথায়। তাকিয়ে দেখলো ততক্ষণে সায়র মোবাইল দেখতে দেখতে বেরিয়ে যাচ্ছে। মুখে নিমিষেই হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দুপুর ভাবলো, যে মানুষ গুলো তাঁর ভাগ্যেই লেখা নেই তারাই কেনো জানি মনের দরজায় কড়া নাড়ে। তখন নিজের ভাগ্যের উপর হাঁসা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।
–
‘আমি ভালো আছি বাবা। ‘
‘তা তো প্রতিবারই বলিস মা। কিন্তু, আমি জানি ঐ অভাবীর ঘরে তুই কতো ভালো থাকিস। চলে আয় না মা! ‘
‘আমি যে আসবোনা,তা জেনেও কেনো একই কথা বলো?’
ফিরোজ ইসলাম দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। মোবাইলের অন্য পাশ থেকে তা টের পেলো তনয়া। বাবাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘প্লিজ বাবা, তুমি মন খারাপ করো না৷ আমি তো বলেছিলামই, শিহাব একদিন না একদিন ঠিকই আমাকে মেনে নেবে। দেখো তুমি সব ঠিক হবে। ‘
‘সেই একদিনটা কবে আসবে তনু?’
‘জানিনা বাবা৷ কিন্তু আমি আল্লাহকে ভরসা করি। তিনি নিশ্চয়ই আমার এতো ধৈর্যের ফল শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। সবকিছুর মাঝে শুধু একটা জিনিসেরই আফসোস হয় বাবা। ‘
‘কীসের আফসোস তনু?’
তনয়া ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
‘যাকে পাবার জেদ ধরে তোমার কাছে আবদার করেছিলাম। তারও যে কোনো মনের মানুষ থাকতে পারে তা আমি বুঝতে পারিনি৷ ‘
ফিরোজ ইসলাম আঁতকে উঠলেন। বুকের পুরোনো ব্যাথাটা আবারো চিনচিন করে উঠলো। এতোদিন শুধু তিনি জানতেন শিহাব তনয়াকে পছন্দ করেনা কোনো ব্যাক্তিগত কারণে। কিন্তু, এ-ই যদি আসল কারণ হয় তাহলে এতগুলো দিন তনয়া কতোটা কষ্টই না পেয়েছে! শিহাবের যদি কোনো ভালোবাসার মানুষ থেকেও থাকে, তাহলে শিহাব তনয়াকে অনেক ভাবেই তাড়াতে চেয়েছে নিশ্চয়ই। কারণ বিয়েটা তো শিহাবের বাবা সৌরভ করিয়েছিলো শিহাবকে দিয়ে জোর করে। ফিরোজ ইসলাম শুধু জানতেন, এতো তাড়াতাড়ি শিহাব বিয়ে করবেনা বলে রাজি নয়। সবে মাত্র মাস্টার্স শেষ করে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে।
তনয়া বাবাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
‘আমি জানলে কখনো জেদ ধরে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করতাম না বাবা। কাউকে পাওয়ার জেদ ধরতে নেই। আমি তারই শাস্তি পেয়ে আসছি। ‘
ফোন রেখে তনয়া বারান্দায় এসে বসলো। মাঝে মধ্যে কিছু কর্মের ফল অনেক লম্বা শাস্তি হয়। আজও আফসোস হয় তনয়ার। চোখ বন্ধ করতেই দুই ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে এক কুয়াশা মাখা সকালের কথা-
মোবাইলে অরিজিৎ সিং এর একটা গান শুনতে শুনতে তনয়া ঘুমিয়ে পড়েছিলো গাড়িতেই। ড্রাইভারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। হাই তুলতে তুলতে ভার্সিটিতে ঢুকলো। পড়নে লেডিস জিন্স শার্ট ।
তনয়াকে দেখতে পেয়ে, দূর থেকে বান্ধবী শ্রেয়া এগিয়ে আসলো।
দুই বান্ধবী ক্লাস করার জন্য ভবনের ভেতরেই ঢুকছিলো। হঠাৎ করেই তনয়ার ধাক্কা লাগলো একটা ছেলের সঙ্গে। হাতে প্রচুর ব্যাথা পাওয়ায় বিরক্তি আর রাগ নিয়ে তাকালো তনয়া। অথচ, সে কিছুই বলতে পারলো না। সামনে দাঁড়ানো মায়াবী চেহারার তরুণ একটা ছেলেকে দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। যা তনয়া প্রকাশ করতে পারলো না। ছেলেটা মোবাইলে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলো, অসাবধানতার বশে ধাক্কা লেগে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা বলল,
‘আই আম সো সরি! আসলে আমি ফোনে কথা বলছিলাম। আপনার কী বেশী লেগেছে? ‘
তনয়া সেই মুহূর্তে অনুভব করলো, সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে যেভাবেই হোক তার লাগবেই। আচ্ছা, ভালোবাসা কেনো বলে কয়ে আসেনা? তাহলে নিশ্চয়ই তনয়া শিহাবের প্রেমে পড়তো না!
এটাই বুঝি জীবন! তনয়ার এখন মনে হয় কানের পিঠে কেউ ফিসফিস করে বলছে,
‘আহারে জীবন! আহারে!’
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।