মনসায়রী” ২২.

“মনসায়রী”

২২.
দুপুর দুই সেকেন্ড ঐ অবস্থাতেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়রের মতো লম্বা চওড়া একজন মানুষের ভার, দুপুরের মতো চিকন মানুষের পক্ষে নেয়া বেশিক্ষণ সম্ভব না। সায়র এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। বিড়বিড় করে আবোল তাবোল বলছে। দুপুরের একবার মনে হলো, কল করে ফারাহকে ডেকে নিবে। আবার, এতো সকালে ফারাহ তো ওঠেওনি৷ ধ্যাত, কেন যে ছাদে আসতে গেলো! সায়রের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এই যে, শোন। চলো তোমাকে রুমে দিয়ে আসি। হাঁটার চেষ্টা করো, আমার হাত ধরে। ‘

সায়র দুপুরের মুখের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

‘আপনি আমাকে কোলে নিন তো! ‘

দুপুর ছিটকে পড়ার মতো চেচিয়ে উঠে বলল,

‘কীহ! মাথা খারাপ নাকি? আমি তোমাকে কোলে নেবো মানে! ‘

সায়র মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘কেনো, কালকে যেভাবে আমি আপনাকে কোলে নিয়েছি সেভাবে নেবেন! ‘

‘আমার ওজন আপনার মতো ছিলোনা বলে নিতে পেরেছেন৷ আপনাকে কোলে তুললে কোমর ভেঙে এখানেই পড়ে যাবো আমি। ‘

সায়র অভিমান করে বলল,

‘আমি মোটা নই দুপুর! আপনি এভাবে বলতে পারেন না৷ ‘

‘পারি, আর আমি বলবোও। এবার আমার মাথা না খেয়ে চুপচাপ হাঁটুন। ‘

সায়র ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপচাপ দুপুরকে ধরে হাঁটতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে ওর ওড়না টেনে নিজের মাথায় দিয়ে দুষ্টুমি করছে। দুপুর অন্য পরিস্থিতিতে থাকলে হেঁসে ফেলতো। কিন্তু এখন হাসতে পারছেনা। অনেক কষ্টে লিফট পর্যন্ত নিয়ে গেলো টেনেটুনে। লিফটে ঢুকে উল্টো পাল্টা বাটনে চাপ দিচ্ছে সায়র। দুপুরের ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো। শেষমেষ ওকে থামাতে, নিজের দিকে ফিরিয়ে হাত চেপে ধরে রাখলো। জ্বরের ঘোরে যে মানুষ এমন মাতালের মতো করে, তা এই প্রথম দেখলো সে। একবার তো মনে হচ্ছিলো ইচ্ছে করেই নাটক করছে কিনা। তারপর আবার ভাবলো, আসলেই অনেক জ্বর। এতো জ্বর নিয়ে নাটক করবেনা নিশ্চয়ই। কোনো মতে সায়রের রুমে এসে ওকে শুইয়ে দিলো। সায়র শুতে চাচ্ছে না। উঠে বসার জন্য হাত পা ছুড়ছে। দুপুর না পারতে ধমক দিলো,

‘আর একবার এমন করলে গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেবো! ‘

সায়র ধমক খেয়ে ঠোঁট উল্টে শুয়ে পড়লো। দুপুর ওর গায়ে লেপ চাপিয়ে দিয়ে, হোটেল সার্ভিসে কল করলো। জ্বরের মেডিসিন আর স্যুপ দিয়ে যেতে বললো। সায়র দুপুরের হাত টেনে নিয়ে আনমনে কীসব বলছে। কোনো কথাই বুঝতে পারছেনা। একজন লোক এসে খাবার আর মেডিসিন দিয়ে গেলো। অনেক জোরজারি করে স্যুপ খাইয়ে ঔষধ খাওয়ালো। এরপর রুম থেকে চলে যেতে নিতেই সায়র দুপুরের হাত টেনে ধরে বলল,

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আমার রুমে। তোমার জ্বর এখন অনেকটাই কমেছে। ঘুমিয়ে পড়ো। ‘

‘না, আপনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে আমি ঘুমাবো না।’

দুপুর চোখ বড়সড় করে তাকালো। ছেলে বলে কী! নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে চিৎকার দিয়ে বলল,

‘চুপচাপ ঘুমাও!’

‘না না না! আমি কিন্তু আপনার নামে বাবার কাছে বিচার দেবো। ‘

দুপুর ভড়কে গেলো । বিচার দিবে মানে কী! এসব কথা যেয়ে আবার সত্যিই স্যারকে বলবে না তো! ছি ছি স্যার কী ভাববে। দুপুর নিরুপায় হয়ে সায়রের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একসময় নিজেই ঝিমতে শুরু করে দিলো। সায়র তখনও ঘুমায়নি। দুপুর একপর্যায়ে হেলান দেয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেলো। সায়র দুই একবার দুপুরের মুখের সামনে হাত নাড়ালো। দুপুরের সাড়াশব্দ না পেয়ে মুচকি হেসে উঠে বসলো। দুপুরের কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে, নিজের হাতের মুঠোয় থাকা দুপুরের হাতটাতে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলল,

‘আপনাকে পেতে হলে যদি দুই একটা নাটকই করতে হয়, তাহলে আমি তাই করবো দুপুর। ‘


খানিকটা কালো জিরার তেল গরম করে এনে শিপুর পায়ে মালিশ করে দিচ্ছে তনয়া ৷ শিপু এসব পছন্দ করে না। তার পায়ে কেউ হাত দিবে, এ নিয়ে ঘোর আপত্তি তার ৷ কিন্তু, তনয়া ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। সে অত্যন্ত ভালো একজন অভিনেত্রী। কান্না করে সে যে কোনো কাজ করিয়ে নিতে জানে। শিপু আপত্তি করায়, শ্বাশুড়ির কাছে সে কান্নাকাটি করেছে। যেহেতু, ফারজানা লোভী প্রকৃতির মহিলা। তাই তনয়ার সাথে সে কখনোই ঝগড়াঝাটি করেন না। তনয়া নিজের জন্য কখনো বাবা মার কাছে না চাইলেও, মাঝে মাঝে তনয়ার মা বাবা নিজেই হরেক রকমের জিনিসপত্র পাঠান। যার অধিকাংশই ভোগ করেন ফারজানা।
তনয়ার কান্নাকাটিতে ফারজানা এসে শিপুকে রাজি করিয়ে গেলেন। শিপু বিরক্ত মুখে বসে আছে। তনয়া হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে তেল মালিশ করছে। ডাক্তার বলেছিলো, এভাবে সপ্তাহে দুই তিন বার মালিশ করলে পা ঠিক হওয়ার সম্ভবনা বাড়বে৷ তনয়া একবার বলেছিলো, তার বাবাকে বলে শিপুর ট্রিটমেন্ট করাতে। বাবার একটামাত্র মেয়ে সে। আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। কিন্তু, শিপু কোনো ভাবেই রাজি হলোনা৷ সে নিজের মাকেও কখনো কারো কাছে চাইতে দেয়না।

শিপু বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রেখেছে। তনয়া আপনমনে তেল লাগাচ্ছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেনো আর পৃথিবীতে একটাও নেই। শিপু গম্ভীর গলায় বলল,

‘এতো নাটক করে কী মজা পাও?ক্লান্ত লাগেনা অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে ভোগ করতে?’

তনয়া কথাটা গায়ে মাখলো না। মুচকি হেসে বলল,

‘জিনিসটা আমার ছিলো বলেই আমি পেয়েছি। এটাই ভাগ্যে লেখা ছিলো। ‘

‘এটাকে ভাগ্য বলেনা। এটা স্বার্থপরতা। ‘

তনয়ার হাতটা থেমে গেলো। চোখ জ্বালাপোড়া করে উঠলো। উহু, আবারো চোখে জল আসতে চাইছে। নাক টেনে জল সংবরণ করে নিলো সে। শিপু তাচ্ছিল্য হাসলো। খোচা মেরে বলল,

‘একটাই কাজ পারো, নাক মুখ টেনে কান্না করতে। এই করেই তো আমাকে বন্দী করেছো। ‘

তনয়া ফুপিয়ে উঠলো। শাড়ির আঁচলে হাত মুছে উঠে দাঁড়ালো। সে চায়না কান্না করতে। কিন্তু, শিপুর কথা শুনে সে সহ্য করতে পারেনা। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলে। বিয়ের আগে কখনো কেউ এমন করে কথা বলেনি তার সাথে। তেলের কৌটা হাতে চলে যেতে যেতে বলল,

‘যদি জানতাম পাখির মালিক অন্য কেউ, তাহলে পাখিটাকে ভালোবেসে নিজের খাঁচায় বন্দী করার মতো ভুল আমি করতাম না শিহাব!’

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here