“মনসায়রী”
২১.
সকালের ঠান্ডা বাতাসেও পুরো শরীর ঘেমে গেছে দুপুরের। বুকের হৃৎস্পন্দনের গতি দশগুণ বেড়েছে। সায়রের অবাধ্য হাত তখন দুপুরের পাতলা কোমরে। ঠোঁট গিয়ে থেমেছে কপালে। সায়রের মন পড়তে পারছে যেনো দুপুর। অসার হয়ে আসা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। নড়ার চেষ্টা করার করার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। সায়রের সাথে তাঁর দূরত্ব মাত্র এক ইঞ্চির মতো। মাথা ঝিমঝিম করছে। দুপুরের মনে হচ্ছে, সে আর এই দুনিয়াতে নেই। তার আত্মাপাখি বেরিয়ে কোন দূরদেশে অবস্থান করছে। এখানে শুধু পড়ে তার নির্লিপ্ত দেহখান। সায়রের ওষ্ঠদ্বয় তখনও দুপুরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সম্বিত ফিরে এলো দুপুরের। এই ভয়ই পাচ্ছিলো সে। সায়রের মাতাল করা চাহনি, অস্থিরতা, রহস্যময় কথা সবকিছুতেই সন্দেহ হচ্ছিলো। মন বলছিলো, শীঘ্রই এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। আর তা-ই হলো। দুপুরের ভয় শুধু সায়রের জন্য ছিলোনা। নিজের অবাধ্য মন নিয়েও ছিলো। সবকিছু অস্বীকার করে এড়িয়ে যাওয়া গেলেও, এড়ানো যায়না শুধু নিজের মনকে। দুপুর জানে, শিপুদার পর যদি কারো জন্য মনের কোণে কিছু অনুভব হয়ে থাকে সেটা একমাত্র সায়র নামের এই অদ্ভুত ছেলেটার জন্য। বাসে যেদিন সায়র তাঁকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচালো সেদিনই মনে একরাশ মুগ্ধতার বিন্দু জমা হয়েছিলো। তখন যদিও সায়রের চেহারা দেখতে পায়নি তবুও, টান অনুভব করেছিলো। বারবার প্রার্থনা করছিলো, তার সাথে আবার দেখা হোক। ধন্যবাদ দেয়ার উসিলায়েই নাহয় আরেকবার দেখা হয়ে যাক। এরপর যখন অফিসে গিয়ে জেনেছিলো এটাই সে, তখন গালমন্দ করে বসেছিলো। আচার-আচরণ তেমন একটা পছন্দ হয়নি। তবু্ও কথায় আছে, প্রেমের স্রোত কখনো বলে কয়ে আসেনা৷ আর একবার আসলে সব ভেঙেচুরে নিয়ে চলে যায়। এই ঝড়ের কবলে পড়তে চায়না সে। এই ঝড় শুধু ভাঙতে জানে তার জীবন। অনেক কষ্টে এই ঝড় কাটিয়ে ঘর বানিয়েছে দুপুর। সেই ঘরে ঝড়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সায়রকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে সরিয়ে দিলো দুপুর। আকস্মিক ধাক্কায় দুই কদম পিছনে চলে গেলো সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দুপুরের ছলছল করা রাগী মুখে। কান্না আর রাগ মিশে মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। এই সেই মুখ যা দেখে এক ভয়ঙ্কর নদীতে ঝাপ দিয়েছিলো সে। যেদিন নিজের গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হওয়ায় ভার্সিটিতে বাসের ভীড় ঠেলে উঠছিলো সে। কপালোর ঘাম মুছে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে একটা স্ট্যান্ড ধরে ঝুলে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কিছুক্ষণ পরই বাস আরো যাত্রী উঠানোর জন্য বাস থামালো। খুব বিরক্তবোধ হচ্ছিলো। এমনিতেই বসার জায়গা নেই তার উপর আরো মানুষ উঠাচ্ছে। আর মানুষও গরু ছাগলের মতো আঁটাআঁটি করে উঠছে৷ আশ্চর্য মানুষজন! এরইমধ্যে বাসে উঠে একটা মেয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো। দাঁড়ানোর মতো জায়গা না পাওয়ায় চেপে একটা কোণায় দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকম। প্রথমে পাত্তা না দিলেও যখন খেয়াল করলো, একটা মধ্যবয়সী লোক পাশে দাঁড়াবার ছুতোয়, নানাভাবে মেয়েটার কোমরে হাত রাখার চেষ্টা করছে। মেয়েটা সরে গেলেও লোকটা থামছেনা। এক পর্যায়ে মেয়েটা রাগ চেপে অসহায় চোখে কান্নামাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তারপর অবশ্য ঐ লোকটাকে সায়র খুঁজে বের করে, উত্তমমাধ্যম দিয়েছিলো। সরকারি কর্মকর্তা অথচ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে বেরায়। নিজের বাবাকে দিয়ে লোকটাকে চাকুরীচ্যুত করাতেও ভোলেনি সে৷ সেসব পুরোনো কথা। আজ শুধু সেই প্রথম দিনের মুখটার কথা মনে পড়ছে। দুপুরের সামনে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনা। তাঁর হাতপায়ে অসম্ভব কাঁপুনি চলে। আর অন্তর্মুখী স্বভাবের সায়রের পক্ষে নিজের মনের কথা খুলে দুপুরকে বলা বেশ কঠিন৷ দুপুরকে সে কীভাবে বোঝাবে, সে চায়নি এই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে। নিজের বয়সের চেয়ে বড় একজন মেয়েকে ভালোবাসা অবশ্যই ভয়ানক কাজ। রাতের পর রাত নিজেকে বুঝিয়েও কোনো কাজ হয়নি। কখনো কখনো সামনে থাকলেও কথা বলতে চায়নি। দূর থেকেই ভালোবেসে যেতে চেয়েছিলো। তাই তো, দুপুরের মুগ্ধতা যেখানে যেখানে কাজ করতো সেগুলো সে দুপুরের বলার আগেই কোনো না ভাবে পাঠিয়ে দিতো। বন্ধুরা যখন দুপুরের কাছে ক্ষমা চাইতে যাবে বললো,তখন সায়রই কৌশলে বলেছিলো ফুল দিয়ে ক্ষমা চাইলে তিনি খুশি হবেন। কিন্তু, যেদিন দুপুর পুকুরে পড়ে গেলো। সেদিন দুপুরের জন্য বুকে যে অসীম শূন্যতা সে টের পাচ্ছিলো, তাতেই সায়র বুঝেছিলো আর যাই হোক দূর থেকে দুপুরকে দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একতরফা ভালোবাসার মতো যন্ত্রণা সে নিতে পারবেনা। সে সবক্ষেত্রে নিজের ধৈর্য রাখলেও, অধৈর্য হয়ে পড়ে শুধু দুপুরের জন্য। এই ব্যাকুলতা কাটিয়ে চলে যেতে পারবেনা কোনো ভাবেই। তাই তো, দুপুরের চাকরির সিভি নিজের বাবার কাছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে মনের কথা খুলে বলেছিলো সায়র। তিন একটু আপত্তি করলেও, পরবর্তীতে খুশিই হন৷ কারণ, সায়র প্রথম বার তার কাছে কিছু আবদার করছে। যেহেতু ফারাহকে সায়র অনেক আগে থেকেই বড় বোনের মতো সমীহ করে,তাই ফারাহকে বলেছিলো দুপুরের সব খবরাখবর তাঁকে দিতে। মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা করার নামে দুপুরকে দেখে যেতো। কিন্তু দুপুর নিজের কাজ নিয়ে এতোই ব্যস্ত থাকতো, যে চারপাশে ভূমিকম্প হলেও সে নিজের কাজ চালিয়ে যাবে। অফিস থেকে কাউকেই মোবাইল, ল্যাপটপ দেয়া হয়না। দুপুরকে দেয়া হয়েছে কারণ এগুলোর প্যামেন্ট করেছে সায়র। বাবাকে অনুরোধ করেছিলো, যাতে দুপুরকে বলা হয় এগুলো অফিস থেকে দেয়া হচ্ছে। এমনকি দুপুরের আর্থিক অবস্থা জানার পর, সায়র দুপুরের বেতন সাধারণের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে এই পোস্টের বেতন পনেরো থেকে আঠারো হাজার, সেখানে দুপুর প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ হাজার টাকা পাচ্ছে। এর কারণটা হচ্ছে, এখানের সবারই পারিবারিক অবস্থা ভালো। শুধু অভিজ্ঞতার জন্য তারা এখানে পার্ট টাইম জব করে। কিন্তু দুপুর, এতগুলো মানুষের খরচ, সংসার খরচ সবকিছুর ভার বহন করে।
বিজনেস ট্রিপে সায়রের আসার কথা ছিলোনা। এসেছে শুধু দুপুরকে কয়েকটা দিন কাছ থেকে দেখার জন্য। গতকাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। দুপুর কোন কারণে তার উপর রেগে আছে, শুধু এইজন্য এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুম আসেনি। শরীরে অনেক জ্বর। চোখ ঘোলা হয়ে আসছে সায়রের। দুপুর চেচিয়ে উঠে বলল,
‘তুমি কী ভেবেছো, মালিকের ছেলে দেখে তোমাকে আমি কিছুই বলবো না! বয়সে তুমি আমার ছোটো একদম ভুলে যাবেনা। ‘
সায়র কপালে আঙুল ঘষলো৷ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে দাঁড়িয়েই থাকবে বলে ঠিক করলো। দুপুরকে আজ মনের সব কথা বলে সে বিদায় নেবে।
‘আমি ভুলে যাইনি। শুধু বারবার মনে করতে চাচ্ছিনা। ‘
‘মানে কী? মাথায় গন্ডগোল আছে নাকি তোমার? ‘
সায়র হাসলো। জ্বরে সত্যিই সে পাগল হয়ে গেছে। তার এখন মনে হচ্ছে, পৃথিবী থেকে অনেক দূরে যেতে পারতো দুপুরকে নিয়ে। এমন মুখভঙ্গি দেখে ভ্রু কুচকে আসলো দুপুরের। সায়র হঠাৎই মাতালের মতো দুপুরের হাতটা নিয়ে নিজের গালে চেপে চুমু খেয়ে বলল,
‘অনেক গন্ডগোল আছে দুপুর। আপনি ছিলেন না বলে দেখাতে পারিনি, এখন আপনি আছেন আমাকে ঠিক করে দিন। আমি কত রাত ঘুমাইনি!’
দুপুর চমকে উঠলো। সায়রের গাল মাত্রাতিরিক্ত গরম। নিজের হাত টেনে সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘তোমার তো ভীষণ জ্বর! ‘
‘হ্যা, দেখেছেন। আমাদের কতো মিল! আপনার কালকে জ্বর হলো, আর এখন আমার হচ্ছে। এগুলো হলো ভালোবাসার জ্বর। সুন্দর জ্বর। ‘
‘যতসব ফালতু কথা। ঔষধ খাওনি কেনো?’
সায়র শরীরের ভার ধরে রাখতে পারলো না। দুপুরের উপর ঠাস করে শরীর ছেড়ে দিলো। দুপুর হতভম্ব হয়ে অনেক কষ্টে পড়তে গিয়ে বাঁচলো। সায়র তখন হুঁশে নেই। সে তখনও হাসতে হাসতে বলছে,
‘আমি আপনাকেও জ্বরের মতোই ভেবেছিলাম। ১০০ ডিগ্রি বলে, ভেবেছিলাম ফুরিয়ে যাবে। কখন যে ১০৪ ডিগ্রি হয়ে গেলো, বুঝিনি। কারণ আমি তো আপনাকে ভুলে যাওয়ার ঔষধ নেইনি।’
চলবে –
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।