“মনসায়রী”
২০.
গলদেশ ভিজে উঠলো শেষ রাতের দিকে। জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। উশখুশ করে এপাশ ওপাশ করতেই ঘুম ভেঙে গেলো দুপুরের। অন্ধকার ঘর দেখে বুঝতে পারলো এখন রাতের শেষভাগ। পাশ ফিরে ফারাহকে দেখে অবাক হলোনা ৷ জ্বরের ঘোরে মনে হচ্ছিল কেউ একজন মাথায় জলপট্টি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিশ্চয়ই এসব ফারাহর কাজ। এছাড়া আর কে আছে তাঁর এতো খেয়াল রাখার। মনে মনে ভীষণ অবাক হয় দুপুর মাঝে মাঝে। দুপুর অফিসের সামান্য এমপ্লয়ি। ফারাহ সেখানে ম্যানেজারের মতো বড় পদে কাজ করছে। হ্যা, ফারাহ হিসেবে অত্যন্ত ভালো। অনেক দায়িত্ববান৷ কিন্তু, সংশয় এক জায়গাতে। দুপুর অফিসে জয়েন করেছে সবে দুই মাস। এর মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। বাকী কর্মীদের সঙ্গে ফারাহ যথেষ্ট গম্ভীর মানুষ। খারাপ ব্যবহার যে করে তা নয়। বাকীরা ফারাহর আড়ালে আবডালে অনেক বাজে কথাই বলে। সেসব গায়ে লাগায় না সে।
সবার সাথের ব্যবহার আর দুপুরের সঙ্গের ব্যবহারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। দুপুর সকালে উঠে কী খেতে পছন্দ করে, কখন ঘুমায়, কখন ক্লান্ত হয় সব যেনো পাই টু পাই মুখস্থ করেছে ফারাহ। সবদিকে খেয়াল রাখে বড় বোনের মতোন। এসব ভাবতে ভাবতে পাশের চাদরটা ফারাহর গায়ে টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চুলে খোঁপা করা হাতমুখ ধুয়ে এসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দার ভিউ বেশ সুন্দর। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় ভালো করেই। আকাশে আস্তে আস্তে আলো ফুটছে। পাখির কলকাতানি শুনতেই মনটা ভালো হয়ে গেছে। মুখে হাসির রেশ নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। ঘুম আর আসছেনা। দেখতে দেখতে দুপুর খেয়াল করলো পাশের রুমের বারান্দায় কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। কোঁকড়ানো চুল দেখে বুঝলো এটা কে হতে পারে। কিন্তু সায়র এতো ভোরে এখানে কী করছে, সকাল সকাল ঘুম ভেঙে উঠার অভ্যাস আছে নাকি তার-ও? মনে মনে কৌতূহল নিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো। সায়র অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ এপাশ ফিরে দুপুরের দৃষ্টি বরাবর তাকালো সায়র। দুটো বারান্দাই লাগোয়া হওয়ায় খুব বেশি দূরত্ব নেই। চোখে চোখ পড়ায় লজ্জা পেয়ে অপ্রস্তুত বোধ করলো দুপুর। সায়র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলকও পড়ছেনা। এতো কী দেখছে! আরো বেশি লজ্জা লাগলো কারণ সায়রের পড়নে শুধু একটা টাউজার। খালি গায়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে! গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো দুপুরের। সায়র নিজেই এগিয়ে আসলো। দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনার শরীর কেমন এখন?’
দুপুর হড়বড়িয়ে তাকালো। গলায় শব্দ গড়মিল পাকাচ্ছে। আঁটকে আঁটকে বলল,
‘ভা ভালো! ‘
‘বেশ। মেডিসিন নিয়েছেন?’
‘কীসের মেডিসিন? ‘
দুপুরের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সায়র কিছু ভেবে বলল,
‘ওওহ, ফারাহ আপু কিছু বলেনি আপনাকে?’
‘না তো!’
সায়র গমগমে গলায় বলল,
‘আপনার শরীর অনেক দূর্বল। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছেন না। রক্তশূণ্যতা আছে। টেবিলের ড্রয়ারে মেডিসিন রাখা আছে। কিছু খাবার খাওয়ার পর, ওগুলো খেয়ে নিবেন। ‘
দুপুর দুবার মাথা নাড়ালো। ঠিক আছে, সে ঔষধ খাবে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে সায়র তার অসুস্থতা সম্পর্কে জানলো কেমন করে। আর যদিও জানে, তাহলেও কী কী ঔষধ খেতে হবে সেটা কীভাবে বলল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করার আগেই সায়রের মোবাইলে কারো কল আসলো। একবার দুপুরের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। দুপুর হা করে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। সে এতোটাও বাচ্চা না। তবে, কী সায়রের মনে অন্যকিছু আছে? তার ভাবনা যদি সঠিক হয়, তাহলে এর পরিণতি কেমন হবে!ভেবেই আঁতকে উঠলো সে।
–
হোটেলের নিয়মগুলো বেশ সুন্দর। বুফের মতো করে খাবার সাজানো। যে যার মতো খাবার নিয়ে নিচ্ছে প্লেটে। হিয়ান আর ফারাহকে এক টেবিলে বসে থাকতে দেখে সেদিকেই আসলো দুপুর। এতক্ষণ ল্যাপটপে বসে অফিসের কাজ করছিলো। বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে আজকে বিকেলেই একটা মিটিং আছে। যা অনেক ইম্পরট্যান্ট। দুপুরকে দেখে ফারাহ মুচকি হেসে বলল,
‘খাবার নিয়ে এখানে এসে বসো দুপুর। ‘
দুপুর মাথা নাড়িয়ে সেদিকেই গেলো৷ প্লেট হাতে নিয়ে খাবারের সাইডে গিয়ে দাঁড়ালো। সব ধরণের খাবারই আছে। অল্প অল্প করে ঝালজাতীয় খাবারগুলো প্লেটে তুলে নিলো। জুসের গ্লাসটা ভরছিলো, তখন পাশে কারো ফিসফিস কন্ঠ আর হাসাহাসি শুনে তাকালো। মেয়েদুটো হাসতে হাসতে বলছে,
‘আরে, আমি তো আগেই বলেছি ফারাহ ম্যাম কেনো দুপুরকে এতো কেয়ার করে। কালকে তো সবাই-ই দেখলাম, বসের ছেলে মানে সায়র স্যার পাগল দুপুরের জন্য। জ্বর আর এমন কী! মনে হচ্ছিল স্যার নিজেই মরে যাচ্ছে। ডক্টর ইনজেকশন দিচ্ছিলো বলে কী বকাটাই দিলো। ঔষধ গুলোর গুনে গুনে নাম পড়ছিলো। ফারাহ ম্যামকে গম্ভীর গলায় বলল, সবগুলো ঔষধ যেনো টাইম টু টাইম খাওয়ানো হয়। ‘
অন্য মেয়েটা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘ভালো লাগছেনা সর। সায়র স্যার আমার ডাইহার্টক্রাশ। পৃথিলার সঙ্গে কিছু হলেও মানা যেতো। ‘
‘তো কী হয়েছে! দুপুর তো পৃথিলার চেয়েও সুন্দর। ‘
‘উঁহু, তাতে কী টিয়া? কম হলেও দুই বছরের বড় হবে স্যারের। আমি বুঝিনা ছেলেরা সেম এজ,জুনিয়র এতো কিছু থাকতে সিনিয়রের প্রেমে কেনো পড়ে!’
টিয়ার আফসোসে ভরা মুখ দেখে সিতারা হাসলো মুখ টিপে। পুরো কথাগুলো শুনে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে চেপে সরে আসলো দুপুর। হাতের প্লেটটা থরথর করে কাঁপছে। চোখে অন্ধকার দেখছে সে। গলা শুকিয়ে গেছে। ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে পাশের চেয়ারটা ধরে বসে পড়লো। কী যেনো একটা বুকের মধ্যে খামচে আছে৷ অস্থির হয়ে ঘেমে উঠলো। ফারাহ আশেপাশে দুপুরকে না দেখে খুঁজতে গেলো। একটা কোণায় বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে এসে বলল,
‘এখানে বসে আছো কেনো? ‘
দুপুর চমকে তাকালো। ঢোক গিলে বলল,
‘ইয়ে, শরীরটা খারাপ লাগছিলো। ‘
ফারাহ দুপুরের কপালে হাত রেখে বলল,
‘জ্বর তো নেই। আচ্ছা এসো আমি তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। ‘
দুপুরকে নিয়ে এসে টেবিলে বসালো ফারাহ। দুপুর তখনও আনমনা হয়ে আছে। চুপচাপ চামচ নেড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।
হিয়ান ফারাহর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ইশারা করলো, দুপুরের কী হয়েছে? ফারাহ ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, সেও এই ব্যাপারে কিছু জানেনা। দুপুর ফারাহর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা আপু, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিলো। ‘
ফারাহ দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কী জিজ্ঞেস করতে চাও দুপুর? ‘
‘গতকাল আমাকে রুমে কে নিয়ে এসেছিলো? ‘
হিয়ান চট করে বলে উঠলো,
‘কে আবার? সায়র!’
ফারাহ ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে দিলো। হিয়ান জিহবা কাটলো। ফারাহ থতমত খেয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘আসলে, তোমার শরীর খুব বেশি খারাপ ছিলো তো। তাই আমার একার পক্ষে দুই তলায় উঠানো সম্ভব হচ্ছিলো না। আমিই সায়রকে বলেছিলাম। ‘
‘ওহহ।’
কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া করলো না দুপুর। এমনও হতে পারে মেয়েগুলো একটু বেশি বাড়িয়ে চরিয়ে কথা বলছিলো। আবার তাঁর সন্দেহ ঠিকও হতে পারে। যা-ই হোক এবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে দুপুর। এরইমধ্যে টেবিলে এসে বিনা অনুমতি নিয়েই বসে পড়লো সায়র। সাহেবের মতো পা তুলে বসলো৷ দুপুর না চাইতেও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ফারাহ হেঁসে বলল,
‘এতক্ষণ পর দেখা মিলল নবাবের। ‘
সায়র চমৎকার হাসলো। দুপুরের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওর প্লেটের দিকে তাকালো। এতো সামান্য খাবার দেখে বলল,
‘এটা তো কাকের খাবারও না। এজন্যই তো দিনদিন পাটকাঠির মতো হয়ে যাচ্ছেন। ‘
তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুচকে আসলো দুপুরের। মানছে, সে অনেক চিকন। কিন্তু তাই বলে পাটকাঠি নয়। আঙুল তুলে ঝগড়ার মুডে কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে গেলো দুপুর। নাহ! বারবার আগ বাড়িয়ে বলার দরকার নেই। এখন থেকে এড়িয়ে চলবে সে। চুপচাপ মুখে মাশরুমটা পুরে নিয়ে খেয়ে উঠে অন্য পাশে চলে গেলো সে। সায়র কিঞ্চিৎ অবাক হলো। এই পর্যন্ত যতবার সায়র ওর সাথে কথা বলেছে, ততবার দুপুর ঝগড়া লাগিয়েছে। আজও দুপুরকে রাগিয়ে দিতেই কথাটা বললো। দুপুর কী তাহলে রাগ করলো!
ফারাহ সায়রের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওর শরীরটা ভালো নেই। তাই হয়তো। ‘
‘না, আপু। দুপুরের শরীর নয়, মন ভালো নেই। ‘
‘তুমি কী করে জানলে? ‘
সায়র হাসলো। দুপুরের মুখ লাগানো গ্লাসটা নিয়ে নির্দ্বিধায় খাওয়া শুরু করলো। হিয়ান একবার সায়রের দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার গ্লাসটার দিকে। সায়রের মনের খবর হিয়ান জানেনা। কিন্তু, এতটুকু বোঝে, কেউ কারো মুখ লাগানো গ্লাসে তখনই খেতে পারে যখন সে তাঁকে প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসে।
–
এই ঠান্ডা পরিবেশে বসেও তরতর করে ঘামছে দুপুর। হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছলো। চিন্তায় হার্টবিট থেমে গেছে মনে হচ্ছে।
একটু আগেই ক্লায়েন্টের সামনে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। ক্লায়েন্টদের চেহারা দেখে কিছুই বুঝতে পারছেনা। এতো বড় দায়িত্ব দুপুর নিতে চায়নি। তবুও,ওকে ভরসা করে পলাশ দেওয়ান এই দায়িত্ব দিয়েছেন। ভয়ে হাত পা কাঁপছে। সামনেই ক্লায়েন্টরা বসে আছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। সবাই তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাইকে চমকে দিয়ে তারা ডিল ফাইনাল করে দিলেন। দুপুর খুশিতে মুখ চেপে ধরলো। কর্নজীবনের প্রথম বড় একটা প্রাপ্তি। চোখ ভিজে আছে। ফারাহ এসে জড়িয়ে ধরে অভিবাদন জানালো। সবার সাথে কথা শেষ হওয়ার পর সায়র এসে মুচকি হেসে বলল,
‘কংগ্রাচুলেশনস! ‘
দুপুর কোনো রকম ধন্যবাদ বলে চলে গেলো। সায়রের মুখ মেঘে ঢেকে গেলো। সায়রের মুখ দেখে কখনো মন পড়া যায়না। তবুও, ফারাহ ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সায়রের খারাপ লেগেছে। দুপুর রুমে এসে নিজেও গোমড়ামুখে বসে রইলো। এভাবে কথা বলায় সায়র কষ্ট পেয়েছে সে জানে। তবুও, পরবর্তীতে যেনো বড় কোনো সমস্যা তৈরি না হয় এজন্যই সে এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রেজেন্টেশন দেয়ার সময় দুপুর হঠাৎ করেই থেমে গেছিলো নার্ভাস হয়ে। তখন দূর থেকে সায়র ইশারা করে বলেছিলো, ঘাবড়ে না গিয়ে নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে। অনেক আস্থা দেখতে পেয়েছিলো সেই চোখদুটোতে। সেই চোখে কিছুক্ষণ আগে কষ্ট দিয়ে এসেছে, ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসলো। রাতে খাবার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। অনেক সময় পর, ঘুম আসলো। সকালে ঘুম ভেঙে বের হলো দুপুর। এখানের ছাদটা বেশ সুন্দর আর অনেক বিশাল। লিফট দিয়ে হোটেলের ছাঁদে উঠলো সে। একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খেয়াল করলো কেউ কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে টানটান বুকে। নিস্তব্ধতায় মোড়ানো চারপাশ। দুপুর কাছে এগোতেই সায়র পিছনে ফিরলো। দুপুরকে দেখে দ্রুত পদে কাছে এসে পড়লো। দুপুর ভড়কে গেলো সায়রের ফোলা লাল বর্ণীয় চোখ দেখে। কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে কেনো? সারারাত ঘুমাওনি?’
সায়র এগিয়ে আসছে অবিরাম । দুপুর বুঝতে পারছেনা সায়রকে। সায়র দুপুরের দুগালে হাত রেখে মুখ উঁচু করে বলল,
‘চোখভর্তি আপনাকে দেখার তৃষ্ণা আর মাথাভর্তি আপনাকে নিয়ে কী ঘুমানো যায় দুপুর?’
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।