মনসায়রী’ ১৮.

‘মনসায়রী’

১৮.
অন্ধকারে পুরনো আমলের শালীন ঘরটি ড্রিম লাইটের আলোয় টিমটিম করছে। ঝড়ের বেগ বেড়েছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু পানিতে বারান্দার ফ্লোর ভিজে গেছে। ঘরেও একই অবস্থা। বাড়িতে আজ দুপুর আর শিপু ছাড়া কেউ নেই। সবাই এক আত্মীয়র বাড়িতে গেছে। মৃত্যুশয্যার মতো অবস্থা।

কেউই এই বৃষ্টির ভেতর ফিরে আসতে পারবেনা। দুপুর জানতো না, শিপু বাড়িতে থাকবে। নাহলে, সেও পরিবারের সাথে যেতো। জানতো না বলে সামনে পরীক্ষার বাহানা দিয়ে বাসায় রয়ে গেছে। দুপুর ভাবতেই পারেনি, শিপু এই রাত বারোটায় দুপুরের দরজার লক ভেঙ্গে ভেতরে চলে আসবে। গত এক মাস শিপুর সামনেই পড়েনি দুপুর। শিপু ডানে থাকলে দুপুর বাম দিক দিয়ে পালিয়ে গেছে। শিপু প্রতিদিনই সরি বলেছে নানানভাবে। দুপুর অভিমান করে কোনো কথাই বলেনি।

দরজার লক ভেঙে নিচে পড়ে আছে। সেটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে দুপুর। শিপু বুকে হাত ভাজ করে গম্ভীর গলায় বলল,
‘এতো পালিয়ে কী লাভ হলো? এক বাড়িতে থেকে লুকোচুরি খেলিস!’

দুপুর আমতাআমতা করে বলল,
‘কোথায় পালিয়েছি শিপুদা! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ‘

শিপু দুই কদম এগিয়ে আসলো। দুপুর কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। শিপুও পিছু পিছু সেদিকে গেলো। কাচুমাচু মুখ করে বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শিপু ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো। দুপুরের মুখ নিচু করে রাখা। শিপুর এগোনো পা দেখে ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে রাখলো। শিপু দুপুরের দুই পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালো। দুপুর কোথায় সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ খুললো। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো দুপুরের। শিপুর বলিষ্ঠ দেহের মধ্যে ছোট্ট শরীরের দুপুর ভিজে বিড়াল। শিপুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুপুর ভয় পেয়ে গেলো। ঐ দুই চোখে সবসময়ের রাগ, গম্ভীরতা আর কঠোরতার ছাপ নেই। চোখে ভাসছে একসমুদ্র মুগ্ধতা। শিপুর অপলক চাহনি দুপুরের ভয়ার্ত মুখের দিকে। এই তো সেদিন চোখের সামনে ছোটোমা একটা পুতুল নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। ধীরে ধীরে পুতুলটা বড় হয়ে হাঁটা শিখলো, স্কুলে গেলো, কখনো কখনো শিপুর হাত ধরে নিয়ে যেতো স্কুলে। কোনো ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে শিপুকে বিচার করতে বলতো। আদরের দুপুরকে কেউ ফুলের টোকাও দেয়ার সাহস পায়নি। সবাই স্কুলে জানতো, দুপুরের একটা শিপুদা নামক ঢাল আছে। সকল আবদার, স্নেহর প্রধান জায়গাটাই শিপু। এই নোনির পুতুলকে নিজ হাতে বড় করতে করতে হঠাৎ একদিন শিপু অনুভব করেছিলো, ছোটো পুতুলকে অন্য কারো অধীনে করা সম্ভব না৷ পুতুলকে নিজের বুকেই সমাহিত করে নিবে সে।

দুপুরের ভীতু মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে শিপু ভারী আদুরে ভঙ্গিতে বলল,

‘এই দুপি! তুই বুঝিসনা কেনো কিছু!’

দুপুর মুখে বলল,

‘কী বুঝবো শিপুদা!’

মুখে তা বললেও দুপুর একটু না অনেকটাই বুঝেছে। যা বুঝার বাকী ছিলো এতোদিন তা-ও বুঝেছে। শিপুর কাছে আসা, চোখেমুখে আছড়ে পড়া উত্তাল মুগ্ধতার কারণ সবটাই টের পেয়েছে। দুপুরের মনে যে কিছু নেই, তা বললে ভুল হবে৷ স্কুলে যখন শিপুদাকে নিয়ে দুপুর আসা যাওয়া করতো তখনই বান্ধবীসহ কলেজের বড় আপুরা পর্যন্ত দুপুরের কাছে এসে নাম্বার চাইতো। মোটেও ভালো লাগতো না ওর৷ মন চাইতো সবার চোখ উঠিয়ে দিতে। এরপর আর শিপুকে সঙ্গে নিতে চাইতোনা সে। একা একাই আসা যাওয়া করতো। শিপুর ঘরে সময়ে অসময়ে গিয়ে বসে থেকে ওর জন্য অপেক্ষা করা, সবটাই এক অদ্ভুত অনুভূতির বশে। শিপুকে এসব বলার কখনো সাহস পায়নি দুপুর। মন খুশিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো দুপুরের। তারমানে, শিপুও তাঁর জন্য কিছু অনুভব করে! লজ্জায় দুপুর শিপুকে ছাড়িয়ে ঘরে চলে যেতে চাইলো। শিপু পেছন থেকে এক হাত ধরে রেখেছে। ভ্রু কুচকে বলল,

‘জবাব দিলি না যে?’

দুপুর অস্বস্তি আর লজ্জায় লাল হয়ে বলল,

‘শিপুদা, প্লিজ ছাড়ো। মা, বাবা কেউ মানবেনা এই সম্পর্ক। ‘

শিপু নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলল,

‘দুপি, আমাকে বাহানা দিস! আমাদের পরিবার একটা স্বচ্ছল পরিবার। আমি অনার্স শেষ করবো এবার। একটা ভালো চাকরি খুঁজবো। তুই কলেজে উঠলেই আমি চাচা চাচীর সাথে কথা বলবো। ‘

দুপুর কোনো জবাব দিলো না। কন্ঠ দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না কোনো। এখানে থেকে কোনোরকমে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। শিপু করুণ স্বরে বলল,

‘তুই আমাকে ফিরিয়ে দিবি, দুপি?’

দুপুর পেছনে ফিরে মুচকি হেসে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে যেতে যেতে নীরব সম্মতি দিয়ে বলল,

‘হ্যা শিপুদা,দিলাম। ‘

পায়ের নুপুরের ঝনঝন আর খিলখিল হাসিতে শূন্য বাড়ি সরব হলো। শিপু দুপুরের পেছনে দৌড়াতে লাগলো। ধরা দিলো না দুপুর। কে জানতো, সত্যিকারেই শিপু আর ধরতে পারবেনা ঐ রহস্যময়ীকে!

নিজেকে উঁচু কোনো জায়গা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অনুভব করতেই লাফ দিয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসলো দুপুর। ওড়না দিয়ে মুখ মুছলো। জানালা খোলা ছিলো। ঠান্ডা বাতাসে ঘরের পর্দা নড়ছে। পুরনো কতক স্মৃতি মাথায় অনবরত ঘুরপাক খায় বলেই প্রায় প্রায় দুপুর ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায় সেথায়। পর্দা লাগিয়ে দিতে দিতে দুপুর মনে মনে ভাবলো, স্বপ্নের ভেতরেই যদি আজীবন বসবাস করা যেতো তাহলে আর কখনো এই নির্মম বাস্তবতার জীবনে ফিরে আসতোনা দুপুর। একটা ভরসার হাত আর একটুখানি ভালোবাসার জন্য কাঠফাটা রোদে মানুষের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতো না। এক সময় তো সবই ছিলো তাঁর। সময়ের স্রোতে সেসব এখন মরীচিকা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলো দুপুর। এক ঘন্টার মতো ঘুম হয়েছে। অথচ,কতো বড় স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলো।

দরজা খুলে ফারাহ ভেতরে আসলো। দুপুরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে চিন্তিত মুখে বলল,

‘তুমি এখানে বসে আছো কেনো? সবাই তোমার অপেক্ষা করছে।’

দুপুর অবাক হয়ে বলল,

‘সবাই আমার অপেক্ষা করছে!’

‘আরে আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি! ‘

দুপুর নিচুকন্ঠে বলল,

‘আপু,তুমি যাও আমার ভালো লাগছেনা। কতো রাত অব্দি আড্ডা হবে! আমি এসবে অভ্যস্ত নই। ‘

‘অভ্যস্ত নও, সামনে হয়ে যাবে। প্যারা নাই। চলো তো এখন। ‘

নাছরবান্দা ফারাহ। একবার যা বলবে তা করিয়েই ছাড়বে। দুপুর ফারাহর সাথেই নিচে গেলো। একটা আলাদা জায়গায় সবাই গোল হয়ে বসেছে। ফারাহ জানালো, ওখানে ট্রুথ ডেয়ার গেম চলছে। সায়র মাথা নাড়িয়ে বারবার কিছু একটা না করছে। কিন্তু, সবাই মিলে সায়রকে জোর করছে। দুপুর দূর থেকে আসায় বুঝতে পারছেনা। ফারাহ সাথে কথা বলতে বলতে সামনে আসলো দুপুর। বোঝার চেষ্টা করছে, সায়রকে কী করতে বলা হচ্ছে। অফিসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হৃদয়। সে বেশ হাসিঠাট্টার মানুষ। সায়রকে বলল,

‘দেখো ছোটো ভাই, আমাকে দিয়ে একটু আগে সবাই মিলে তোমাদের ভাবীকে কল করে উল্টো পাল্টা বলিয়ে ডেয়ার কমপ্লিট করিয়েছো। এবার তোমার যা চিরকুটে এসেছে, তাই করতে হবে। ‘

সায়র হেঁসে না না করছিলো। হঠাৎ নজর গেলো দুপুরের দিকে। স্তব্ধ চোখে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলো সে। দুপুরকে ফারাহ ফিসফিস করে বলল, সায়রকে টাস্ক দেয়া হয়েছে এখানের মধ্যে কাউকে প্রপোজ করতে হবে। দুপুর সায়রকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো। সায়র রোবটের মতো হেঁটে দুপুরের সামনে এসে হাঁটুতে ভর করে বসে পড়লো। দুপুরকে আশ্চর্য করে দিয়ে একটা অর্কিডের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘মিস দুপুর, সবাই তো গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করে আমি নাহয় আপনাকে অর্কিড দিয়েই করলাম। সবাই তো প্রেমিকাকে এক আকাশ সমান ভালোবাসে। আমি নাহয়, আপনাকে এক গ্যালাক্সি সমান ভালোবাসলাম। আপনি আমার গ্যালাক্সি হবেন দুপুর?’

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here