‘মনসায়রী’
১৪.
হতভম্বতার ছাপ এখনো কাটেনি বন্ধু মহলের মুখ থেকে। একেক জনের হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো সায়র। ব্রিজের নিচের ছোট্ট পুকুরে পরিষ্কার টলটলে জল। রাতের সঙ্গে ঠান্ডা বাতাসও বাড়ছে। সবাই একসাথে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে আর সায়র ব্রিজের উপরের রেলিং-এ। পা দুলিয়ে সে ভাবনায় মত্ত। বাতাসের দমকায় কোঁকড়া চুল গুলো দুলছে। চোখের চশমা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে সায়র চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছে। নিজের ছোটো চুলে হাত বুলিয়ে নিপা সায়রকে বলল,
‘আমি একটা ব্যাপার না বুঝিনি! আঙ্কেলকে বলে তুই আপুকে চাকরি দিয়েছিস, এরপর আঙ্কেলকে বলে আবার কক্সবাজার যাচ্ছিস৷ আঙ্কেল তোকে সন্দেহ করেনি?’
সায়রের মুখ গম্ভীর হলো। সে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ওটা তুই ভুল বললি নিপা। ওনাকে আমি চাকরি দেইনি। আমি শুধু বাবাকে বলেছিলাম, তাঁর ইন্টারভিউ নিয়ে দেখতে। যদি যোগ্য হয় তাহলেই যেনো চাকরি দেয়। তিনি নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন। আর বাকি রইলো কক্সবাজার যাওয়ার কথা। বাবার সন্দেহ করার মতো কিছুই হয়নি। আমি বাবাকে তাঁর ব্যাপারে সেই প্রথম দিনই বলে দিয়েছি। ‘
নিপা কথাটায় সামান্য হোঁচট খেয়ে বলল,
‘মানে কী! তুই আঙ্কেলকে বলে দিয়েছিস!’
সায়র হাই তুলে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘হ্যা। ‘
‘আঙ্কেল কিছু বলেনি তোকে!’
ইশিকা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো। সায়র প্রতুত্তরে মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। রেলিং থেকে নেমে হাত ঝেড়ে উল্টো পথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘তোরা যার যার বাসায় যা। অনেক রাত হয়েছে। আমিও যাচ্ছি। তোরা ভালো থাকিস। ‘
সবাই সমস্বরে বলল,’হ্যাভ এ সেফ জার্নি! ‘
অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো সায়র। সেই আলোআঁধারির রহস্যময়তা ভেদ করতে পারলো না কেউই। নীরব, ফাহাদ, ইশিকা আর নিপা মিনিট খানেক ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নীরবতা ভেঙে ফাহাদ বলল,
‘তোদের কী মনে হয়? সায়ু কী সিরিয়াস?’
নিপা উত্তরে বলল,
‘সায়ু নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে সবসময় সিরিয়াস। আর এটা তো মানুষ! ‘
–
দক্ষিণ দিকের এই জানালাটা শিপুর খুব পছন্দের। কত নির্ঘুম রাত সে এই জানালার দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে হিসাব নেই।
এইযে সেদিনই তো, তনয়ার সাথে ঝগড়া করে সে হুইলচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো জানালার পাশে। অবশ্য ঝগড়াটা সে ইচ্ছে করেই লাগিয়েছিলো। শিপু চায়না তনয়াকে। সে চায় তনয়া চলে যাকে তাঁকে ছেড়ে। তনয়াকে এখানে মানায়না। সারাদিন গাধারখাটুনি খেটেখুটে এরপর রাতে ওর সাথে ঝগড়ায় হেরে রাতটা কাঁদতে কাঁদতে কাটে। তবুও যে বেলাজ মেয়েটা কেনো এখানে পড়ে আছে বোকার মতো কে জানে! হাতে একটা বই নিয়ে সাত নম্বর পৃষ্ঠাটা উল্টিয়ে পড়তে শুরু করলো।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুপুর। যতবার সে এই ঘরের সামনে আসে ততবারই সঙ্কোচে ভেতরে ঢোকা হয়না। এখন বাজে সকাল আটটা। একটু পরই দুপুর বেরিয়ে যাবে অনেক দূরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সবার সাথেই কথা বলে দোয়া নিয়েছে। বাকি শুধু শিপুদা। ঢুকবে কী ঢুকবে না, ভাবতে না ভাবতেই ভেতর থেকে শিপু বলল,
‘ভেতরে আয়। ‘
দুপুর খানিকটা চমকে উঠলো। ওড়নাটা আঙুলের কোণায় মোড়ামুড়ি করতে করতে ভেতরে আসলো। মুখ নিচু করে আছে দুপুর। হাঁটুগেড়ে শিপুর সামনে বসলো। আমতা আমতা করে বলল,
‘শিপুদা, আমি যাচ্ছি। তুমি ঔষধপত্র ঠিক মতো খেয়ো। ‘
শিপুর দৃষ্টি বইয়ের দিকে। মুখ তুলে চাইলো না সে। দুপুর আবারো বলল,
‘নিজের খেয়াল রেখো। ‘
‘আর?’
‘শরীরের যত্ন নিয়ো। ‘
‘আর?’
‘কারো সাথে ঝগড়া করো না। ‘
শিপু আর বলতে গিয়েও থেমে গেলো। দুপুর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শিপুর ডানহাতে হাত রেখে বলল,
‘আর তনয়া ভাবির সাথে একটু মানিয়ে নাও শিপুদা। সে আর যা-ই করুক। তোমাকে ছেড়ে যাবেনা। ভালোবাসে তো তোমাকে খুব। তুমিও চেষ্টা করো তাঁকে ভালোবাসতে। ভালোবাসা আবার আসবে। ‘
শিপু বই বন্ধ করে ফেললো। দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর কী মনে হয় ভালোবাসা বারবার আসে?’
দুপুর থেমে থেমে বলল,
‘হ্যা, তা নয়তো কী!’
‘তুই ভুল জানিস দুপুর। ভালোবাসা মানুষের জীবনে শুধু একবার হয়। প্রেম বারবার আসে। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। প্রেম সর্বোচ্চ তিন মাস থাকে। আর ভালোবাসা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। ‘
দুপুর কী বলবে বুঝতে না পেরে নির্বাক হয়ে উঠে গেলো। কাঁধ থেকে পড়ে যাওয়া ওড়নাটা আবারো কাঁধে টেনে নিঃশব্দে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। তবুও একবার পেছনে ফিরে বলল,
‘মায়া দিয়ে ঘর বাঁধা যায়না শিপুদা!’
শিপু হাসলো কিঞ্চিৎ পরিমাণ। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘যায় তো। মানুষ এক মায়ার টানে কতকিছু করে ফেলে! ‘
‘তোমার মায়া লাগে না তনয়া ভাবির জন্য! ‘
‘লাগে তো। ‘
‘তাহলে, তার সাথে অমন ব্যবহার করো কেনো?’
‘সব মায়ায় জড়াতে নেই। কিছু মায়ায় শুধু দায়িত্ব থাকে। ‘
দুপুর যেতে যেতে বলল,
‘সে তোমায় ছাড়বে না। ‘
শিপু কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলো,
‘কার! তোর মতো!’
দুপুর থমকে যায়। চোখ টলমল করে ভিজে যায়। চোখ লুকিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
‘পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ো না। ‘
শিপু গলা উঁচু করে হাসলো। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে পড়লো। নোনাজল কীসের জন্য তা জানে দুপুর। এড়িয়ে যায় খুব পারদর্শীতার সাথে। শিপুর গলা হঠাৎ করে বেড়ে গেলো। হাতের পাতলা বইটা খাটের উপর ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘তোর ক্ষত আছে দুপুর! শুধু তোর ক্ষত থাকে! আমার থাকে না! তোদের সবার অনুভূতি থাকে। শুধু আমার থাকে না! ‘
দরজার পাশে ঠোঁট চেপে কান্না গিলে হজম করে নিলো দুপুর। এখানে আসাই উচিত হয়নি। এমন একটা দিনে কেনো আসলো!
শিপু আবার নিস্তেজ হলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘তুই বেইমান দুপুর! তুই অনেক নিষ্ঠুর!’
দুপুর পেছনে ফিরে ফিচেল হাসলো। চোখে থৈ থৈ জল। পড়নে সাদা একটা থ্রিপিস। আধখোলা খোঁপা করা চুলে সেই মুখের হাসি বড়ই অদ্ভুত দেখালো। নিজের নিষ্ঠুরতা বজায় রেখে বলল,
‘আমি জানি। ‘
–
হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠছে সবাই। যদিও সবার সিটই বুক করা।
আগে থেকেই নির্ধারিত কে কোথায় বসবে। তবুও কেউ কেউ হন্তদন্ত হয়ে উঠছেন৷ দুপুর নিজের ব্যাগটা নিয়ে এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। এতো ভীড় ঠেলে কীভাবে উঠবে তা-ই ভাবছে।
ফারাহ নিজের লাগেজটা বক্সে পাঠিয়ে দুপুরের কাছে আসলো।
এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘কী হয়েছে? তুমি এমন করে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’
দুপুর অসহায় চোখে বলল,
‘এতো ভীড়!’
ফারাহ বুঝতে পেরে বলল,
‘ওওহহ! দাঁড়াও এক মিনিট। ‘
বলেই হাতের ইশারায় সবাইকে একপাশে সরতে বললো। ফারাহ যেহেতু ম্যানেজারিং এর পদে আছে, তাই তাঁকে সবাই কমবেশি মেনে চলে। দুপুর মুচকি হেসে বাসে উঠলো। নিজের সিটে বসে হেলান দিয়ে রইলো। ফারাহকে দুপুর আগেই বলেছে ওর সাথে বসতে। ফারাহও বলেছে ওর সাথে বসবে। ফারাহ এসে বসলো। বাস ছাড়বে কিছুক্ষণ পরই। সবাই নাস্তাপানি করছে টুকটাক। হিয়ান বাসে উঠে ফারাহ আর দুপুরকে হাত নাড়িয়ে হেলো বললো। ওদের পেছনেই হিয়ান বসলো। সবাই একে একে বসার পর বাস ছেড়ে দিলো। বাসে অনেকক্ষণ বসলে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আছে দুপুরের। এক ঘন্টা পাড় হতেই দুপুর ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভেঙে যখন উঠলো তখন ঘুমঘুম চোখে দুপুর দেখলো, ফারাহ পাশে নেই। ফারাহ পরিবর্তে একটা ছেলে বসে চিপস খাচ্ছে। ফারাহ সিট ছেড়ে হিয়ানের কাঁধ জড়িয়ে হাসিতে ফেটে পড়ছে। পিলে চমকে চিৎকার করে উঠতে নিলেই পাশের ছেলেটা দুপুরের মুখ চেপে ফিসফিস করে বলল,
‘একদম চুপ! একটা আওয়াজ মুখ থেকে বের হলে,জানালা দিয়ে ফেলে দিবো। ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।