“মনসায়রী”
পর্ব-৪০
লাল রঙ দুপুরের খুব একটা পছন্দ না। কিন্তু, বিয়ের এই লাল বেনারসি পড়ে নিজেকে আয়নায় দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করলো দুপুর। আচ্ছা, সায়র যখন তাঁকে যখন দেখবে তখন কী বলবে! নিশ্চয়ই বেহায়ার
মতো কিছু নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে দুপুরকে বিব্রত করবে।
গহনাগুলো পড়তে পড়তে এসবই চিন্তা করছিলো দুপুর। বেশিরভাগ গহনাই সায়রদের পরিবার থেকে এসেছে। হাতের বালা আর ছোটো একটা হার দুপুরের মায়ের। যেটা দুপুরকে আশীর্বাদ স্বরূপ দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর দুপুর ভেবেছিলো তার বিয়েটা হবে খুবই সাদামাটা। পরিবারের দুই চারজন মিলেই তার বিয়েটা হয়ে যাবে। আর গহনা বলতে মা যা দিবে তা-ই। তাতে যদিও দুপুরের কোনো অসন্তুষ্টি ছিলো না। আল্লাহ ভাগ্যে রেখেছে তাইতো হবে। আল্লাহ যে তার ভাগ্যটা এতো সুন্দর করে সাজাবেন কে ভেবে রেখেছিলো! কে জানতো এতো খারাপ ভাবে সবকিছু ভেঙেচুরে যাওয়ার পরও আবার সব ঠিক হবে! সায়র নামের একটা রাজকুমার সত্যিই এসে আসবে ছোটোবেলার রূপকথার মতো!
দরজা খুলে তনয়া সহ আরো কয়েকজন রুমে ঢুকলো। দুপুরকে সাজানোর জন্য তারা এসেছে। হঠাৎ আয়নায় কাজল আর মিহার প্রতিচ্ছবি দেখে খুশি হলো দুপুর। কাজল আর মিহা এসে একসাথে জড়িয়ে ধরলো দুপুরকে। মিহার আসার কথা দুপুর আগেই জানতো। কিন্তু কাজল বলেছিলো সে খুব সমস্যার মধ্যে আছে সে আসতে পারবেনা। দুজন বান্ধবীকে একসাথে দেখে খুব ভালো লাগছে দুপুরের। গতকাল থেকে মনটা খুব খারাপ ছিলো, নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে নতুন একটা পরিবেশে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিবে সেই চিন্তায়। দুপুর কাজলকে বলল,
‘তুই তো সারপ্রাইজ করে দিলি আমাকে! আমি তো ভাবতেই পারছিনা তুই এসেছিস৷ ‘
কাজল খানিকটা হাসলো। দুপুরকে বলল,
‘আরো একটা সারপ্রাইজ আছে। সেটা পরে বলবো তোকে। ‘
‘আচ্ছা ঠিক আছে। দিহান, আকাশ ওরা কোথায়?’
মিহা বললো ওরা আসবে আরেকটু পর। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভয়, দ্বিধা, উত্তেজনা সব চেপে সাজতে লাগলো দুপুর। সময় আর বেশি বাকী নেই।
—
“বর চলে এসেছে ” শোনা গেলো উচ্চ শব্দে। সবাই উল্লাস করতে লাগলো। কম বয়সী মেয়েগুলো গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। নানারকম আয়োজনের মাধ্যমে বাড়িতে প্রবেশ করলো সায়র। সঙ্গে রয়েছে তার বন্ধু বান্ধব।
ভেতর থেকে দুপুর শুনতে পেলো সবার আনন্দ ধ্বনি।
সে এখন ঘরে একাই বসে আছে। দুপুর কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে একটু বের হয়ে তনয়াকে ডাকলো। তনয়া কাছেই ছিলো। দুপুরের কিছু প্রয়োজন কিনা দেখতে ছুটে আসলো।
দুপুর খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ভাবি, একটা কথা ছিলো। ‘
‘হ্যা বলো। কিছু লাগবে তোমার? কিছু খাবে?’
‘লাগবে ভাবি। কিন্তু খাবার নয়, শিপুদাকে। একটু কথা বলবো। ‘
তনয়া একটু অবাক হলো। পরমুহূর্তেই খানিকটা হেসে শিহাবকে নিয়ে আসতে গেলো। শিহাব সকাল থেকে ঘরেই ছিলো। নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। তনয়া নিজেই চাইছিলো দুপুর একটু কথা বলে তাঁকে স্বাভাবিক করে তুলুক। সারা রাত ঘুমায়নি শিহাব।
তনয়া ঘরে এসে শিহাবকে জানালো দুপুর দেখা করতে চাইছে। শিহাব প্রথম যেতে রাজি হলো না। এরপর ভাবলো যেহেতু আজই দুপুরের এই বাড়িতে শেষ দিন তাই কথাটা রাখা উচিত।
নিজেই হুইলচেয়ার চালিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো শিহাব। দুপুর শিহাবকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শিহাবের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। শিহাব অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলো। হয়তো ঐ দৃষ্টিতে জমেছিলো অভিমান আর অভিযোগ কিছু পাওয়া না পাওয়া। দুপুর সবটাই টের পেলো।
‘শিপুদা, তুমি আমাকে কিছু উপহার দিবেনা?’
শিহাব খানিকটা লজ্জিত হলো। কেমন নিজের কাছে নিজেকে ছোটো মনে হলো। আসলেই তো, তার তো উচিত ছিলো দুপুরকে বিয়েতে কিছু একটা গিফট দেয়া। কিন্তু, শিহাবের কাছে তো কোনো টাকা নেই। আজ চাকরি থাকলে সেও তো কিছু একটা গিফট করতে পারতো। যতোই হোক দুপুরকে তো সে খুব ভালোবাসে। দুপুরের ভালো থাকাটাই তার চাওয়া।
শিহাবের লজ্জা পাওয়া দেখে দুপুর মুচকি হেসে বলল,
‘গিফট আনতে যেহেতু ভুলে গেছো, তাহলে এখন তোমার অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত। তাইনা?’
শিহাব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
‘বল, কী শাস্তি দিতে চাস তুই আমাকে?’
‘আমাকে তোমার একটা কথা দিতে হবে শিপুদা। ‘
‘কী কথা?’
‘আমি যেমন নিজের জীবনে এগিয়ে যাচ্ছি, তুমিও নিজের জীবনে এভাবেই এগিয়ে যাবে। কখনো আর পুরোনো কথা ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করবেনা। তুমি কথা দাও শিপুদা, আজকের পর থেকে আর কখনো তুমি তনয়া ভাবির সাথে খারাপ ব্যবহার করবেনা। বরং তুমি তাকে খুব ভালোবাসবে। যে ভালোবাসাটা সে ডিজার্ভ করে। সেটা তার প্রাপ্য।’
শিহাব খানিকটা রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘তনয়া ভালোবাসা ডিজার্ভ করে দুপুর! যে আমাদের দুজনের জীবনটা একসময় দূর্বিষহ করে দিয়েছিলো। ‘
‘আমাদের ভাগ্যে এটাই লেখা ছিলো শিপুদা। এটাই হওয়ার ছিলো। আমাদের বাস্তব মেনে নিতে হবে। তনয়া ভাবির দোষ কী বলো! সে তো আর আমাদের কথাটা জানতো না। জানলে কখনো এতো জেদ করে তোমাকে বিয়ে করতো না। যে মানুষটা এতো অভাব, অনটনের দিনেও তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে সেই মানুষটা একটু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তো অবশ্যই রাখে। তুমিও নতুনকে গ্রহণ করো। ‘
শিহাব চুপ করে রইলো। এই উপলব্ধি গুলো সত্যিই দরকার ছিলো। সত্যিই তো, আর কতো অতীতকে টেনে সে কষ্ট পাবে।
দুপুর খানিকটা হেসে বলল,
‘শিপুদা, আমি জানি তুমি এতোদিনেও তনয়া ভাবির দিকে এগোওনি এর আরেকটা কারণ হলো তোমার মনে হয়, তুমি তনয়া ভাবির জীবনটা নষ্ট করছো। তুমি চিন্তা করোনা, তোমার পা শীঘ্রই ঠিক হবে। তোমার ভিসা হয়ে যাবে আর দুই মাসের মধ্যে। এরপরই তুমি বাহিরের দেশে যাবে চিকিৎসার জন্য। দেখো, একদিন আমাদের পরিবারটা আগের মতো সুন্দর হয়ে উঠবে। ‘
শিহাবের চোখে কেনো জানি পানি জমলো। সে দুপুরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। দুপুর এই পুরো পরিবারের মানুষগুলোর জন্য কতো কিছুই না করেছে! যে দায়িত্ব গুলো বাবা মারা যাওয়ার পর তার করার কথা ছিলো সেগুলোও দুপুরই পালন করেছে।
—
বিয়ের সব কাজ শেষ হয়েছে। তিন কবুল পড়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো মিনিট কয়েক আগে। এখন বিদায়ের পালা। দুপুর তার মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। পুরোনো সব স্মৃতি মনে পড়ছে বেশি।
পাশে বাকী সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ কান্না করছে। কাজল কান্না করছিলো দেখে দিহান এগিয়ে আসলো। চোখ মুছে দিলো সযত্নে। ওদের কয়েক দিন আগেই বিয়ে হয়েছে। দিহান একপ্রকার যুদ্ধ করে কাজলকে বিয়ে করেছে। আকাশ আর মিহারও বিয়ে ঠিক হয়েছে।
সায়র একটু দূরে দাঁড়িয়েছে। দুপুরকে কান্না করতে দেখে খুব খারাপ লাগছে তার। পাশ থেকে সায়রের বন্ধু ফাহাদ এসে ফিসফিস করে বলল,
‘কীরে বন্ধু, শেষমেষ সিনিয়র আপুকে বিয়ে! ‘
সায়র চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘চুপ শালা, ওকে কখনো আপু ডেকেছি আমি! ‘
‘সেটা ঠিক আছে। আচ্ছা একটা কথা বল তো, তুই কবে থেকে সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম করলি? কখনো তো দেখিনি পেছনে ঘুরতে। ‘
সায়র হাসি দিয়ে বলল,
‘তোরা যে বলদ তাই দেখিসনি, আমি যেদিন প্রথম ভার্সিটিতে গেছি সেদিনই দেখে ভালোবেসেছি। তখনই ঠিক করেছিলাম, বিয়ে করলে একেই করবো। গোলগাল, মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার সিনিয়র হয়, এটা তখন যদিও জানতাম না। ‘
ফাহাদ হাসতে হাসতে বলল,
‘তুই দেখতে যতো ভোলাভালা, ততোটা তুই না শালা। ‘
—
গাড়িতে উঠে বসেছে দুপুর। পাশে বসেছে সায়র। এই গাড়িটাতে ইচ্ছে করেই সায়র আর কাউকে নেয়নি। এখন রাত দশটা বাজে। সায়র চায় সম্পূর্ণ রাস্তাটা দুপুরকে কম্ফোর্ট ফিল করাতে।
দুপুর গাড়িতে বসে জানালা থেকে মুখ বের করে শিহাবের দিকে তাকালো। দুপুরের চোখে ছিলো একটা প্রশ্ন। শিহাব তার কথা রাখবে তো! শিহাব যেনো তা বুঝলো। আস্বস্ত করলো ইশারা দিয়ে। দুপুর স্মিত হেসে বসে রইলো।
গাড়ি চলছে। দুপুরের চোখ দুটো ভেজা। সায়র টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
‘নীরব রাস্তা, পাশে সুন্দরী রমনী, এর সাথে যদি মিউজীক আর দুই কাপ চা থাকে তো জমে যায় তাইনা পুতুলবউ?’
দুপুর বিস্মিত হলো। বিদায়ের সময় কী কেউ কখনো চা খেতে খেতে যায়! আর এতো রাতে তারা চা পাবেই বা কোথায়? দুপুরের দিকে ঝুঁকে সায়র বলল,
‘চা খাবে সুন্দরী? ‘
দুপুর অবাক হয়ে কাঁদতে ভুলে গিয়ে বলল,
‘এতো রাতে চা কোথায় পাবে?’
সায়র গাড়ি থামিয়ে, পেছনের সিট থেকে একটা টি-পট বের করে ওয়ান টাইম দুটো কাপে চা ঢাললো।
একটা দুপুরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা নিজের জন্য নিলো। দুপুর মুগ্ধ হয়ে দেখছে সায়রকে। এক মুহুর্তে যদি কাউকে ভালোবেসে ফেলা যায়, তাহলে বলা যায় দুপুর সায়রকে ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই ভীষণ ভালোবেসে ফেললো।
ঠান্ডা শীতল বাতাস, চলন্ত গাড়ি, গাড়ির ভেতর দুটো সদ্য বিবাহিত স্বামী স্ত্রী। আকাশ বাতাসে আরেকটু রোমাঞ্চ মিশিয়ে দিতেই বুঝি সায়র প্লে করলো-
‘Akdin ap yu hum ko mil jayenge
Humne socha na tha…’
(সমাপ্ত)
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।