“মনসায়রী”
পর্ব-৩৯
গালে হাত দিয়ে কান্নারত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। কিছুক্ষণ আগেই সায়রের হাতের কষানো থাপ্পড় খেয়েছে সে। সায়র চায়নি থাপ্পড়টা দিতে। কিন্তু মেয়েটা এতো জোড়াজুড়ি করছিলো তার সাথে, যে সে আর সহ্য করতে পারেনি। মেয়েটি হচ্ছে নিতু। সায়ন্তীর বান্ধবী। কয়েক দিন আগে হঠাৎ করেই নিতু এসে প্রেমের প্রস্তাব দেয় সায়রকে। সায়র খুব অবাক হয়েছিলো। নিতুকে কখনো সে তেমন চোখে দেখেনি। বরং সায়ন্তীর মতোই আরেকটা বোন ভাবতো। সায়র খুব ধীরে সুস্থে তাঁকে বুঝিয়েছে, তাঁর পক্ষে নিতুকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। নিতু প্রথমে খুব কান্নাকাটি করলেও পরে চুপ হয়ে গেছিলো। সায়র ভেবে নিয়েছিলো নিতু বুঝেছে। বেশি কিছু বলেনি এই ভেবে যে, এটা তো আবেগেরই বয়স। ছোট একটা মেয়ে। বয়স ষোল নাহয় সতেরো।
আজ হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসেছে নিতু। সায়র বিরক্ত হয়ে বলল,
‘সমস্যা কী তোমার নিতু? আমি তোমাকে তো আগেও বুঝিয়েছি। আমার বাড়িতে আজ গায়ে হলুদ। আগামীকাল বিয়ে। তুমি এই মুহূর্তে এমন সিন ক্রিয়েট করছো কেনো? আর তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি মানে? ‘
নিতু কান্না করতে করতে বললো,
‘আপনাকে আমি ভালোবাসি সায়র। আমি সবসময় দেখে এসেছি আপনি আমার খেয়াল রাখেন। সায়ন্তীর জন্য কোনো জিনিস আনলে আমার জন্যও নিয়ে এসেছেন। যদি আমাকে না ভালোবাসেন তাহলে কেনো এতো খেয়াল আমার প্রতি?’
সায়রের ইচ্ছে করলো নিজের কপাল চাপড়াতে। এইটুকু মেয়ে ভালোবাসা কী তা-ই বোঝেনা অথচ প্রেম নিবেদন করতে আসে। সায়র ধমক দিয়ে বলল,
‘এই মেয়ে, তোমাকে কখনো আমি নিজে থেকে বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি! আর আমি তোমার আলাদা কোনো খেয়াল রাখিনি। তোমাকে সায়ন্তী খুব ভালোবাসে, তাই কোনোকিছু চাইলে তোমার জন্যও তা আনতে বলে। ব্যস এটুকুই। আরে তোমার দিকে তো আমি ভালো করে কখনো তাকিয়েও দেখিনি। ‘
নিতু ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। সায়রের হাত ধরে বলল,
‘আমি সহ্য করতে পারছিনা, আপনাকে তো সবসময় আমি নিজের ভেবে এসেছি। এখন কীভাবে আপনার বিয়েটা দেখি বলেন তো! ‘
বলতে বলতেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো নিতু। হাঁপিয়ে উঠলো যেনো। সায়র বুঝলো এই মেয়ে তার প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। তাই কোনো কথা না বাড়িয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো। নিতু তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বিরস নয়নে মাটিতে বসে পড়লো। বিলাপ করতে করতে বলল,
‘আমি কিছুতেই এই প্রত্যাখ্যান মেনে নেবোনা সায়র। আমাকে আপনার ভালোবাসতেই হবে। এরজন্য যা করতে হয় আমি করবো। ‘
–
‘আপনার কী খুব গরম লাগছে? আমি বাতাস করবো?’
তনয়া শোয়া থেকে উঠে বসে বললো শিহাবকে। সারাদিনের ব্যস্ততা আর ক্লান্তির শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তনয়া। কিন্তু, তনয়া খেয়াল করলো শিহাব বারবার এদিক ওদিক নড়াচড়া করছে। তাদের ঘরের ফ্যানটা প্রায় নষ্টের পথে। ঘরের সবকিছুর খরচ তো দুপুরই দেয়। ওকে আর কতোই বা বলা যায়! তনয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আজ যদি শিহাব সুস্থ থাকতো তাহলে তো আর তাঁকে এতো কষ্ট করতে হতো না। শিহাব কম রোজগার করলেও কোনো দুঃখ থাকতোনা। নিজের স্বামীকে যেভাবে সব প্রয়োজনের কথা বলা যায় সেভাবে তো আর অন্য কাউকে বলা যায়না।
আলমারি থেকে একটা তালপাখা বের করে খাটে এসে বসলো তনয়া। ঘর অন্ধকার। বাহির থেকে হালকা আলো এসে ঘরকে আবছা আলোকিত করছে। নিভু নিভু আলো আঁধারির মাঝে বালিশে হেলান দিয়ে শিহাবকে বাতাস করছিলো তনয়া।
হঠাৎ তনয়ার মনে হলো, শিহাব কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। তনয়া চমকে হাত দুটো শিহাবের গালে রাখলো।
‘আপনি কাঁদছেন শিহাব!’
শিহাব চমকালো না। তনয়ার হাতটা বুকে চেপে বলল,
‘এখানটায় খুব জ্বলছে তনু! মনে হচ্ছে আমি মারা যাবো। ‘
তনয়া অস্থির হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে আপনার? কোথায় খারাপ লাগছে?’
শিহাব আচমকা তনয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ভাঙা গলায় বলল,
‘জানো তনু, এই মাথায় আজ অনেক দিন কেউ হাত বুলিয়ে দেয়না। তুমি একটু মাথায় হাতটা রাখবে? আজকের রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের
রাত। ‘
চলবে –
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।