“মনসায়রী”
পর্ব-৩৬
দুপুর রাজী হলো। সবকিছু প্রায় ঠিকঠাক। দুপুরের মা চাচী সবাই মোটামুটি মত দিয়েছে। সায়রের পাশেই শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দুপুর বসে আছে। মুখ নতজানু হয়ে লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে। সায়র একটু পর পর ভয়াবহ লজ্জা দিচ্ছে তাঁকে। কান, গাল লাল হয়ে টুকটুক করছে। চোখ রাঙিয়ে দিলেও সায়র দুষ্ট হাসি ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিচ্ছিলো। বিয়ের দিনকাল ঠিক করা নিয়ে গল্প করছিলো বড়রা। এরইমধ্যে সেখানে হুইলচেয়ার চালিয়ে ধীরে ধীরে শিহাব উপস্থিত হলো। সবাই শিহাবের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়রের মা বাবার দিকে তাকিয়ে সে সালাম দিয়ে কুশলবিনিময় করলো। দুপুর তাকালো শিহাবের দিকে। হঠাৎ করেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো দুপুরের। শিহাবের চোখমুখ কঠিন মনে হলো ওর। এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেনো শিপুদা! দুপুরের চোখ ভিজে উঠলো। আজ বোধ হয় সেইদিন, যেদিনটা দুপুরের জীবনেও এসেছিলো। এমনই একটা সন্ধ্যা ছিলো যেদিন শিহাব আর তনয়ার বিয়ে হয়েছিলো। দুপুর জানে শিহাবের কষ্ট হচ্ছে। শিহাব যে তাঁকে এখনো ভুলে উঠতে পারেনি। এই বিয়েটা দুপুর করতে চায়, যদিও শিহাবকে সে অন্য চোখে আর দেখতে চায়না। তবুও দুপুর শিহাবকে একেবারে মন থেকে মুছে ফেলেনি। শিহাবকে সে এখনো ভালোবাসে, কিন্তু এটা কোনো প্রেমিকার ভালোবাসা নয়। কিছু ভালোবাসায় শুধু মঙ্গল কামনা করা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকেনা। দুপুরের ভালোবাসাও একইরকম। শিহাবের মঙ্গলের জন্য হলেও দুপুর চায় বিয়েটা হোক।
শিহাব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘মা, ছোটমা আমি কী এতোটাই অক্ষম যে দুপুরের বিয়ে ঠিক হচ্ছে অথচ আমাকে একটাবার বলা হলো না?’
দুপুরের মা বিব্রতবোধ করলেন। সত্যিই, শিহাব হুইলচেয়ারে বসার পর কোনো কাজেই ওর সাথে খোলামেলা আলোচনা করা হয়না। যদিও কেউই শিহাবকে ছোটো করার জন্য তা করেনা। শিহাব বেশিরভাগ সময় ঘরে একা বসে থাকে বলেই হয়তো এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। তিনি স্নেহের কন্ঠে বললেন,
‘বাবা, আমরা তোর সাথে আলোচনা অবশ্যই করতাম। মেহমান গেলেই তোকে বলা হতো। তুই তো ঘরেই থাকিস বেশিরভাগ সময়,এজন্যই বলা হয়নি। ‘
শিহাবের কন্ঠে এবার রাগ দেখা গেলো,
‘তাই বলে তোমরা আমাকে না জানিয়ে বিয়ের দিনকাল ঠিক করে ফেলবে! ‘
‘শিহাব! তুই এমন করে বলছিস কেনো? আচ্ছা, তুই কী এই বিয়েতে রাজী না?’
‘ছোটমা, এরকম হটকারিতায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবেনা। আমি শুনলাম সায়র দুপুরের চেয়েও বয়সে ছোটো। আমার মনে হয় আমাদের আরেকটু ভাবা উচিত। সায়রের বয়সে ছেলেরা আবেগে পড়ে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়, পরবর্তীতে আফসোস করে। আমি চাইনা, দুপুরকে কোনো অবহেলায় পড়তে হোক। ‘
মুহুর্তেই হাসিঠাট্টায় ভরা ঘরটা থমথমে হয়ে উঠলো। সায়রের মা বাবা খানিকটা অপমানিত বোধ করলেন। দুপুর বুঝতে পারছেনা কী বলবে। এমন পরিস্থিতিতে সায়র উঠে দাঁড়ালো। শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘দেখুন, আমি মোটেও আবেগে পড়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। দুপুর আমার আবেগ নয়, আমার ভালোবাসা। যাকে বিয়ে করে আমি বৈধ করতে চাই। ‘
শিহাব একবার সায়রের দৃঢ় চোখ দুটোর দিকে তাকালো। এক মুহুর্তের জন্য সে থমকে গেলো। সায়রের দিকে তাকিয়ে সে যেনো কয়েক বছর আগের নিজেকেই দেখতে পেলো। যে নির ভালোবাসাকে পাবার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে। আজকের সায়র যেনো অতীতের শিহাবকে পুনরাবৃত্তি করছে। তাদের লড়াইটাও একজনের জন্যই ছিলো। তা হলো দুপুরকে নিজের করে পাওয়া। শিহাবের মনে হলো, তাদের মধ্যে শুধু একটাই পার্থক্য তা হলো সায়রের ভেতর যে সাহসটা আছে সেই সাহসটারই অভাব ছিলো শিহাবের মাঝে। সায়রের চোখেমুখে দুপুরকে পাওয়ার জেদ তো আছেই সাথে নির্ভয়ে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার সাহস আছে। শিহাবের মনে একটাই প্রশ্ন জেগে উঠলো -‘আচ্ছা, এই সাহসের অভাবটুকুর কারণেই কী দুপুরকে হারাতে হয়েছিলো! ‘ হয়তো তাই। যদি পরিবারের ভয়ে দুপুরকে ভালোবাসার কথাটা সে গোপন না করতো তাহলে তো আর আজ এই পরিণতি হতো না।
খুব গোপনে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো শিহাব। সে এখন অনুভব করতে পারছে, দুপুর কতোটা কষ্ট পেয়েছিলো যখন সে তনয়ার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো।
শিহাব সায়রকে উপেক্ষা করলো। সায়রকে কিছু না বলে, দুপুরকে বলল,
‘দুপু, তুই আমার সাথে আয়। আমার তোর সাথে প্রয়োজনীয় কথা আছে। ‘
দুপুর পাথরের মূর্তির ন্যায় উঠে শিহাবের পেছনে গেলো। সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো। শিহাব কী এমন বলবে দুপুরকে! সায়র উপরে শান্ত থাকলেও ভেতরে অনেকটা অস্থিরতা অনুভব করলো। আর কেউ না জানুক। সায়র তো জানে শিহাবের সাথে দুপুরের কী সম্পর্ক ছিলো। সে দুপুরকে খুব বিশ্বাস করে। চিন্তাটা হলো, শিহাব যদি এমন কিছু বলে যার কারণে দুপুর বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে রাজি না হয়। উফ! চিন্তা করতেই মাথা নষ্ট হবার জোগাড় সায়রের। সে মনে মনে বলল,
‘একবার শুধু বিয়েটা হোক। শালাবাবু, তোমার ধারের কাছেও আমার পুতুলবউকে যেতে দেবোনা। ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।