মনসায়রী
পর্ব-৩৫
ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে দুপুর। মা, চাচী কয়েক বার এসে খুলতে বলে গেছে। কিন্তু, ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সায়রের পরিবারও কিছুটা আচঁ করতে পারছে। দুপুরের চাচী রাগে হিসহিস করে বললেন,
‘দেখলি তোর মেয়ের কাণ্ডজ্ঞান! বাহিরে মেহমানকে বসিয়ে রেখে জমিদারের বেটির মতো ভেতরে গিয়ে বসেছে। ‘
দুপুরের মা দিশেহারা বোধ করলেন। অনুরোধের স্বরে আরেকবার মেয়েকে বের হতে বললেন। দুপুরের সাড়া না পেয়ে তিনি সায়রের কাছে গেলেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। সায়র ছেলেটাকে তাঁর ভালোই মনে হলো। কী সুন্দর করে হাসে ছেলেটা! চেহারায়ও ভীষণ মায়া। চোখ দুটো দেখলেই শান্তি লাগে। বয়স বেশ কম হলেও খুব বুঝদার। শুধু বয়সেই একটা ঝামেলা হয়ে গেলো।
সায়রকে দুপুরের কথাটা জানাতেই সায়র তাঁকে আশ্বস্ত করে বললো,
‘আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি। ‘
‘আচ্ছা বাবা, দেখো। বুঝতে পারছি না মেয়েটার কী হলো। ‘
সায়র উঠে আসলো দুপুরের রুমের সামনে। দুইবার নক করলো। বুঝতে পারলো দুপুর এমনিতে খুলবে না। সে খেয়াল করলো আশেপাশে কেউ নেই আপাতত। সবাই তাঁর পরিবারের আপ্যায়নে ব্যস্ত। সায়র একটু জোরে বলল,
‘দুপুর, আপনি কী জানেন আপনি একটা তুলোর বস্তা! আপনাকে কালকে জড়িয়ে ধরার পর আমার কেমন যেনো লাগছিলো। ইচ্ছে করছিলো আরেকটু সময়..’
সায়রের আর বলতে হলো না। দুপুর দরজা খুলে হেঁচকা টানে তাঁকে ঘরে ঢুকিয়ে নিলো। দরজাটা আঁটকে দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘থাপ্পড় দিয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেবো আমি! এতো নির্লজ্জ কেনো তুুমি! একে তো আমার বাসায় চলে এসেছো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তার উপর আবার এমন উল্টো পাল্টা কথা বলছো। ‘
সায়র হাসলো। রাগ করলো না। উল্টো দুপুরের গাল টেনে দিয়ে বললো,
‘আমি এরকম করে না বললে আপনি কী দরজা খুলতেন? ‘
‘না, খুলতাম না। তুমি কেনো এমন করছো সায়র?’
‘কী করেছি আমি!’
‘মশকরা করবেনা আমার সাথে। তুমি কী জানো না, যে আমি বিয়ে করবোনা। তারপরও কেনো এমন জেদ করছো? ‘
সায়র দুপুরের হাত দুটো ধরলো, তারপর খাটে বসালো জোর করে। কোমল গলায় বলল,
‘কী সমস্যা দুপুর? সমস্যা কোনটা যে আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোটো? নাকি আমি সুন্দর নই? আমি জানি আপনি অনেক সুন্দর, আমি হয়তো আপনার যোগ্য নই। কিন্তু কী করবো বলুন, আপনাকে অনেকটা ভালোবাসি আমি। ছাড়তে পারবো না আমি। প্লিজ, আপনি এতোটা নিষ্ঠুর হবেন না। ‘
খানিকটা কেঁপে উঠলো সায়রের কন্ঠ। সেই কন্ঠে মিশে আছে অনেকটা ভালোবাসা, সাথে হারানোর ভয়। দুপুরের চোখে জল চলে আসলো। সায়র এতো বেশি ভালোবাসে তাঁকে! এতোটা! দুপুর নিজেই সায়রের হাতটা আঁকড়ে ধরলো।
‘মোটেও তুমি আমার অযোগ্য নও সায়র। বরং আমি তোমার যোগ্য নই। আমার দিকে একবার ভালো করে তাকাও। গায়ের কাপড়টা থেকে শুরু করে জুতোটা পর্যন্ত সস্তা। এই সংসারের দায়িত্বগুলো পালন করতে করতেই আমার যৌবনের প্রথম ভাগটা পেরিয়ে গেছে। আমি এখন আর আমি নেই। আমাকে বিয়ে করলে তুমি কিছুই পাবেনা। তুমি আমার থেকে অনেক সুন্দর কাউকে ডিজার্ভ করো। কেনো নিজের জীবনটা নষ্ট করতে চাও বলো তো! ‘
‘আপনি আমার জীবনে আসলে আমার জীবনটা মোটেই নষ্ট হবেনা দুপুর! আপনি কী চান না, আমাদের সুন্দর একটা সংসার হোক, সেই সংসারে রোজ আমি আপনার প্রেমে পড়বো। আপনাকে প্রতি দিন সংসারের খরচ নিয়ে কষ্ট করতে হবেনা। কষ্ট গুলো আমি করবো। আপনি শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কষ্ট গুলো দূর করে দেবেন। ‘
‘এমন একটা সংসার সবাই চায় সায়র। কিন্তু, আমি কীভাবে এতোটা স্বার্থপর হই বলো!আমার নতুন সংসার মানে এই সংসারটা ভেসে যাওয়া। শিপুদার বিয়ের পরে কখনো তাঁকে নিয়ে অন্য চিন্তা করিনি। কিন্তু তাঁর আর তনয়া ভাবির মঙ্গল চেয়েছি। আমার ছোটো বোনটার পড়াশোনা, সংসারের কতো খরচ। তার উপর আবার শিপুদার চিকিৎসার জন্য বাহিরের দেশে পাঠাতে হবে। ‘
সায়র দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘দুপুর, আমি যদি এই সবগুলো সমস্যার সমাধান আপনাকে দেই আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’
দুপুর অবাক হয়ে বলল,
‘মানে? ‘
‘মানে, আমি এই সংসারের দায়িত্ব নেবো। আপনাকে বিয়ের পর আমি সমস্ত খরচ চালাবো। ‘
‘তুমি কী আমাকে করুণা করছো? ‘
‘ছি দুপুর! আপনি আমার করুণার পাত্র না। আমার ভালোবাসার জায়গা। আমি ভালোবেসে আপনার সব কষ্ট গুলো দূর করতে চাই। আচ্ছা, আপনি নাহয় বিয়ের পরও চাকরি করবেন। যেমনটা এখন সংসারটা চালাচ্ছেন, তখনও চালাবেন। ‘
দুপুর আনমনেই সব চিন্তা করছে। সায়র দুপুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘দুপুর আপনি এরপরও আমায় ফিরিয়ে দিবেন! ‘
দুপুর সায়রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলো। ফুপিয়ে বললো,
‘আমাকে তোমার সংসারে কবে নিয়ে যাবে বলো?’
চলবে-