“মনসায়রী”
পর্ব-৩৩
লজ্জায় লাল হয়ে কিছুক্ষন সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইলো দুপুর। সম্বিত ফিরে আসতেই দেখলো সায়র আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। গাড়ি ছুটে চলে গেছে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে। চিন্তিত মনে ঘরে চলে আসলো দুপুর। দরজা আটকিয়ে হাতের ব্যাগটা খুলে দেখলো নিজের ডায়েরিটা। আঁতকে উঠল দুপুর। সে নিজেও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। ডায়েরিটাতে শিহাব ও তার প্রণয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করা আছে। তাদের সম্পর্কের মধুর স্মৃতি, ঝগড়া, মান অভিমান এমনকি দুপুর সেদিন কান্নাকাটি করেছিলো শিহাবের বিয়ের সময়টাতে। সবকিছুর সূক্ষ্ম বর্ণনা আছে। দুপুর যখন ডায়েরীটা লিখেছিলো তখন সে জানতোনা তাদের সম্পর্কে পরিণতি কী হবে।
ডায়েরীটা যেহেতু সায়রের হাতে পড়েছে তারমানে সে সবটুকুই পড়েছে। এজন্যই সায়র এতো রাতে এসে পাগলামি করছিলো। দুপুর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগটা থেকে একটা চকলেট বক্স বের করলো। সঙ্গে একটা চিঠি। দুপুর আন্দাজ করতে পারছিলো কিছু একটা দিয়েছে সায়র। চিঠিটা খুললো দুপুর। এক নিশ্বাসে সবটা পড়ে ফেললো,
প্রিয় অপ্রেমিকা,
হ্যা আপনি আমার অপ্রেমিকা দুপুর! অবাক হবেন না প্লিজ। অবাক হওয়ার মতো কী আমি কিছু বলেছি? বলিনি তো। আপনি জানেন আমি আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু এটা জানেন না, আপনি যতটুকু জানেন তারচেয়েও আমি বেশি ভালোবাসি। ডায়েরিটা নিশ্চয়ই এতক্ষনে পেয়েছেন। বুঝতেও পেরেছেন আমি সেটা পড়ে নিয়েছি। এজন্য আমি একটুখানি দুঃখীত। আপনার ব্যাক্তিগত জিনিসে হাত দিয়েছি সেটাই একটু দুঃখজনক। আমি টের পেয়েছিলাম, আপনার একটা অতীত আছে। যা নিয়ে আপনি এখনো কষ্ট পান। আমি কিন্তু সাধু পুরুষের মতো বলতে পারবোনা, শিহাবকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা আছে এবং অনেক বেশি সমস্যা। এই যে আমার বুকের বা পাশে জ্বলছে! আমি একটুও সহ্য করতে পারছিনা। এই জ্বলুনি শুধু আপনি কমাতে পারবেন। সেই ব্যবস্থাই আমি করবো। আমি আমার জিনিস বেশিদিন অন্যের কাছে রাখতে পছন্দ করিনা। আমি জানি আপনি মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, ছেলেটা পাগল। সত্যি দুপুর, আমি আপনার জন্য ভীষণ অস্থির ও পাগল। এই অস্থিরতা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছেনা।
আমি কারো কাছে কখনো কিছু চাইনি দুপুর। চাওয়ার আগেই সব পেয়েছি। কিন্তু এবার আমি চাইবো। সৃষ্টিকর্তার কাছে আপনাকে চাইবো। কারণ, আপনার অভাবে আমি অভাবী। পৃথিবীর আর কোনো অভাব আমাকে দুঃখী করতে পারেনি।
আপনার সায়র-
বহুদিন পর দুপুরের চোখে জল। সেই জল গাল বেয়ে ঝড়ছে। কতো ভালোবাসা দিয়ে, আবেগ দিয়ে চিঠিটা লিখেছে সায়র! তা অনুভব করতে পারছে দুপুর। এই লেখা গুলো শব্দ হয়ে কানে ঝনঝন করে বাজছে দুপুরের কানে। অনেক অনেক দিন পর দুপুরের আবার ইচ্ছে করছে কাউকে একটু ভালোবাসতে। নতুন করে মায়ায় জড়াতে। আচ্ছা এটা কী সম্ভব! দ্বিতীয় বার কারো প্রেমে পড়া! নতুন কাউকে ভালোবাসা। প্রথম প্রেমের বীজ এখনো যেখানে গেঁথে আছে। চিঠিটা বুকে চেপে নিজের অজান্তেই দুটো চুমু খেলো দুপুর। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে সায়র। জানিনা, এই সমাজ আমাদের মেনে নিবে কিনা। বাস্তব যে খুব কঠিন। কিন্তু আজ আর বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছেনা সায়র। খুব ক্লান্ত আমি। কষ্ট সহ্য করতে করতে ক্লান্ত। আমার এবার একটুখানি ভালোবাসার প্রয়োজন। ‘
–
আকাশের অবস্থা ভালোনা। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। তনয়ার মনটাও আকাশের মতোই অন্ধকার হয়ে আছে। যদিও প্রতিটা দিনই এমন থাকে। খুব একটা পার্থক্য নেই। যেমনটা চেয়েছিলো জীবনটা হবে, তেমন কিছুই তো হলোনা।
যে মানুষের জীবনে ভালোবাসার মানুষটা কাছে থেকেও নেই সেই জীবন কতোইবা সুন্দর হবে! এই জীবন আর ভালো লাগে না তনয়ার। ভালোবেসে তনয়া ঘরবাড়ি, সুখ,আহ্লাদ সব ত্যাগ করেছে। খুব জেদ ছিলো শিহাবকে সে জয় করবেই। ভেবেছিলো পুরুষ মানুষের মন, বিয়ে হলে এক ঘরে থাকলে, পাশাপাশি ঘুমালে শিহাব তাঁকে ভালো না বেসে যাবে কোথায়! কিন্তু, সে বুঝতেই পারেনি যার মনের ভেতরে আস্তো একটা মানুষ বাস করে তার পাশে থাকলেও মনের কাছে যাওয়া যায় না।
তনয়াও বুঝতে পারে শিহাবের মনের মধ্যে কেউ একজন আছে। যাকে কোনো ভাবেই টপকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেনা। এই দেয়ালে কার নাম লেখা আছে সেটা রহস্যের মতো হয়ে গেছে তনয়ার কাছে। সে অনেক বার শিহাবকে জিজ্ঞেস করেছে, শিহাব চোখমুখ কঠিন করে শুধু বলে,
‘কেনো! এখন আর সহ্য করতে পারছো না! যা অঘটন ঘটানোর তা তো ঘটিয়েই ফেলেছো। এটাই তোমার শাস্তি। তুমি এভাবেই সারাজীবন কষ্ট পেতে থাকবে। ‘
কথা শুনলে রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলে তনয়া। সবসময় এমন খারাপ ব্যবহার করে মানুষটা। আজ পর্যন্ত দুটো ভালো করে কথা অব্দি বললোনা। ছোটো বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলো সে। কী ভেবে তনয়া উঠে দাঁড়ালো। বাড়িতে এখন কেউ নেই। দিতিয়া স্কুলে, দুপুর অফিসে আর মা ও ছোট মা শিহাবকে নিয়ে গেছে হসপিটালে চেকআপ করাতে। আজ বাসা ফাঁকা। শিহাব ঘরে থাকে বিধায় সে কিছু খুঁজে দেখতে পারেনা। এর আগে একদিন শিহাব যখন ঘুমিয়েছিলো তখন, চেষ্টা করেছিলো কিছু জানার। শিহাবের অতীত নিয়ে কোনো না কোনো প্রমাণ তো অবশ্যই আছে। কিন্তু, তখন শিহাব ঘুম থেকে উঠে যাওয়ায় আর পারেনি। আজ সুযোগ আর হাতছাড়া করবেনা সে। আলমারিতে তেমন কিছুই পেলো তন্নতন্ন করে খুঁজেও। এরপর খাট, তোশক, শোকেস সবই খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেলোনা। হয়রান হয়ে বসে পড়লো। হঠাৎ মনে পড়লো, সানসেটে তো অনেক গুলো ট্রাঙ্ক রাখা আছে। কিছু না কিছু পাবেই!
চেয়ার দিয়ে উঠে দুটো ট্রাঙ্ক নামালো তনয়া। প্রথম টাতে হাবিজাবি জিনিসপত্র। কয়েকটা ট্রফি, খাতা বই। এরপরেরটা খুলে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো তনয়ার। একটা এলবাম। কেনো জানি মনে হচ্ছে এটায় কিছু আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলতেই আকাশ ভেঙে পড়লো তনয়ার মাথায়। অস্ফুটস্বরে বললো-
‘তারমানে দুপুরই শিহাবের প্রাক্তন! ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।