“মনসায়রী”
পর্ব-৩২
সারা ঘর অন্ধকার। চোখ দুটো সিলিং ফ্যানে আবদ্ধ। ঘটঘট করে ঘুরছে ফ্যানটা। যতোটা আওয়াজ করছে তার এক অংশও বাতাস নেই। পড়নের জামাটা অর্ধভেজা হয়েছে ঘেমে। হাতের পিঠ দিয়ে কপালটা মুছে নিলো দুপুর। টানটান হয়ে শুয়ে আছে সে। হাত পা ব্যাথা করছে। অফিস থেকে লম্বা ট্যুর দিয়ে আসার পর অনেকক্ষণ পরিবারের সবাই তাঁকে ঘিরে বসেছিলো। রাত অনেক হয়েছে, ক্লান্ত শরীরে চোখটা একটু বুঁজে এসেছিলো। হঠাৎ বাজে একটা দুঃস্বপ্নে
ঘুম ভেঙে গেলো দুপুরের। স্বপ্নে দেখলো, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। দুপুর কোথা থেকে যেনো দৌড়ে আসছে। বাঁচাতে চাইছে ব্যাক্তিটিকে। পথ যেনো আগাচ্ছেই না। এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো। এরপর থেকে কোনো ভাবেই ঘুম ধরা দিচ্ছে না৷ ছোটো ফোনটা হাতড়ে সময় দেখে নিলো। রাত তিনটা চল্লিশ। ফোনটা সাইডে রেখে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলো দুপুর। আবারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো। কী শুরু হলো! সবাই কী ষড়যন্ত্র করছে! তাঁর ঘুমকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র। ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলো। কর্কশ গলায় বললো,
‘কী চাই?’
ঘনঘন নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ শোনা গেলো না। কয়েকবার হ্যালো বলার পরও যখন কোনো শব্দ এলো না৷ তখন ফোন কেটে দিতে নিলো, তখনই শব্দ এলো,
‘একটু নিচে নামতে পারবেন দুপুর?’
ঘুম ছুটে গেলো দুপুরের। চোখ কচলে তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো৷ কন্ঠটা চিনতে এক মিনিটও লাগেনি। এটা যে সায়রের কন্ঠ! এতো রাতে কী চায় সে! আর নামতে বললো কেনো! দুপুর বিস্মিত হয়ে বলল,
‘মানে কী! নামবো কেনো! আর তুমি বা কোথায়?’
সায়রের কন্ঠে ঘোর,
‘বাহিরে আসুন। আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। ‘
‘এসব কী বলছো?তুমি কী পাগল হয়ে গেছো? বাসায় ফিরে যাও। এতো রাতে বের হতে পারবো না। ‘
‘ঠিক আছে, আপনার আসতে হবেনা। আমি ভেতরে আসছি। ‘
চমকে যায় দুপুর। বুকে ওড়না জড়িয়ে ধমকের গলায় বলে,
‘দাঁড়াও আমি আসছি!’
লাইন কেটে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয় দুপুর। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। যদি কেউ এসময় তাঁকে বের হতে দেখে তাহলে খবর আছে। মেইন দরজার লক খুলে পা টিপে বের হয় দুপুর। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখলো সায়র দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সামনে। মনে মনে বিচ্ছিরি কিছু বকা দিলো। এতো রাতে কীসের ভূতে পেয়েছে কে জানে!
সায়র গেট খোলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকালো। বিরবির করে কীসব যেনো বলছে মেয়েটা। সায়র বুঝতে পারলো তাঁকেই বকছে। পুতুলের মতো একটা শরীর। দেখতে এতো মিষ্টি! হাসলে সায়রের বুকের গতি বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে সায়র ভাবে, পুতুলের মতো এই মেয়েটাকে বিয়ের পর সায়র পুতুলবউ বলে ডাকবে। কোনো কষ্ট করতে দেবে না। সারাদিন সাজিয়ে গুজিয়ে চোখের সামনে বসিয়ে রাখবে।
এসব ভাবতে ভাবতে হা করে তাকিয়ে আছে সায়র।
দুপুর কিছুক্ষণ সায়রের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। অস্বস্তিতে গা কেঁপে উঠলো। ছেলেটা এমন করে কী দেখছে! সায়রের চোখের ওই দৃষ্টিতে কী যেনো আছে।
তবে সেই দৃষ্টিতে কোনো কামনা নেই, নেই কোনো অসভ্যতা। পবিত্র ওই দৃষ্টি শুধু যে ভালোবাসার মানুষের দিকেই দেওয়া যায়। দুপুর বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এমন করে কী দেখছো? ডাকলে কেনো এতো রাতে? কী সমস্যা? ‘
‘আপনি আমার সমস্যা। ‘
চোখ দুটো বড় করে দুপুর বলল,
‘আমি মানে! কী বলতে চাও তুমি? ‘
সায়র কিছু বললো না। হেঁটে গাড়ির কাছে গেলো। দরজা খুলে ভেতর থেকে কিছু বের করলো। একটা লাল রঙের ব্যাগ। গম্ভীর গলায় বলল,
‘এটা ধরুন। ‘
‘কী এটা?’
দুপুর ধরলো ব্যাগটা। খুলে দেখতে নিলেই সায়র বাঁধা দিয়ে বলল,
‘এখন না। পরে খুলে নিয়েন। ‘
দুপুর কিছু বললো না। নীরবতার সাথে কাটলো মিনিট দুয়েক। হঠাৎ সায়র এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দুপুরকে । মাখনের মতো শরীরটা মিশে গেলো সায়রের সুবিশাল বুকে। দুপুর হত-বিহবল হয়ে গেলো। সায়র নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো তাকে। হুঁশ ফিরে আসতেই ছেড়ে দিলো। কোনো কথা না বলে গটগট করে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে গেলো। কী একটা ভেবে আবার দুপুরের সামনে দাঁড়ালো। দুপুর তখনও ঘোরে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। সায়র দুপুরের দিকে ঝুঁকে বলল,
‘অনেক হয়েছে, আর না। এখানে আর থাকতে দিচ্ছি না আপনাকে। শীঘ্রই আপনি আমার বধূ হবেন। হবেন আমার মনসায়রী। ‘
চলবে-