মনসায়রী” পর্ব-৩১

“মনসায়রী”
পর্ব-৩১

‘দুপু, চল আমরা কাজী অফিসে গিয়ে গোপনে বিয়েটা সেরে আসি! ‘

শিহাবের কথায় দুপুর খানিকটা বিরক্ত হলো। একবার শিহাবের হাতের মুঠোয় নিজের হাতজোড়া দেখে নিলো। শিহাবের বাবা নিজের বন্ধুর মেয়ে তনয়ার সাথে শিহাবের বিবাহ ঠিক করেছেন। সবার জন্যই ঘটনাটা খুবই অবাক করার মতো। শিহাবের বাবা খুবই কঠোর একজন মানুষ। একবার কোনো কথা বললে তা না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পান না৷ শিহাবের উপরে একপ্রকার চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি তার সিদ্ধান্ত, বাবার মুখের উপরে সে টু শব্দ করার সাহস পায়নি। দুপুর নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘কেনো! এখন লুকিয়ে বিয়ে করতে যাবো কেনো! বড় বাবা যখন তোমাকে বললো বিয়ের কথা তখন তোমার এই বড় বড় কথা কোথায় ছিলো?’

শিহাব অনুনয়ের কন্ঠে বলল,

‘তুই এটা কী বললি! বাবাকে তুই কী চিনিস না? তখন আমি আমাদের সম্পর্কের কথা বললে মেনে নিতো?’

‘মেনে না নিলে আর কী করার? তুমি বিয়ে করে সংসারী হও, আর আমি সন্যাসী। ‘

রাগে, দুঃখে ফুপিয়ে উঠলো দুপুর। তাঁর কী কষ্ট হচ্ছে না! বাড়ির সবাই নতুন সদস্যের আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিতিয়া এসে একটু আগে দেখিয়ে গেলো মেয়েটার ছবি। কী যেনো নাম? ওহ হ্যা তনয়া। সেদিন বাড়িতে এসে কীসব আবোল তাবোল বলছিলো। ভাবতেই গা জ্বলছে দুপুরের৷

শিহাব অসহায়ের মতো দুপুরের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর দুপুরের গালে হত রেখে বলল,

‘দুপু, সোনা আমার। কাঁদেনা! আমি আছিনা! দেখিস আমি একটা ব্যবস্থা করে এই বিয়ে ভাঙবোই। সবাইকে জানিয়ে আমাদের বিয়ে হবে। তবে আর যাই হোক আমার জীবনে যতো মানুষই আসুক, তোর জায়গা আমি কাউকে দেবোনা। ‘

ভরসার ওই চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে দুপুর দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। দুপুর তখনো জানতো না, ভাগ্যে কী আছে!

রাত একটা পয়ত্রিশ। এই পর্যন্ত দুইবার অজ্ঞান হয়েছেন শিহাবের মা৷ শিহাব লাপাত্তা। কোনো বন্ধু, আত্মীয় কেউ তার খোঁজ খবর জানেনা। পরিবারের সবাই চিন্তায় মুখ কালো করে বসে আছেন। দুপুর এক কোণায় বসে নক কামরাচ্ছে। সে জানে শিহাব কোথায়। কিন্তু বলতে পারবেনা, কারণ শিহাব তাকে নিজের কসম দিয়েছে। মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকাই তাঁর জন্য শ্রেয়।

শিহাবের বাবা ও দুপুরের বাবা দুজন কথা বলছিলেন শিহাব কোথায় যেতে পারে তা নিয়ে। এসময় শিহাব কল করলো নিজের বাবাকে। এতক্ষণ নিজের ফোন, আইডি সব অফ করে রেখে দিয়েছিলো সে।

সবাই ফোনের দিকে মনোযোগী হলো। শিহাবের বাবা ফোন স্পিকারে দিলেন। তিনি প্রচন্ড ধমকের গলায় বললেন,

‘তোমার এই বেলাল্লাপনা আর সহ্য করবো না আমি। চুপচাপ বাসায় আসো। ‘

শিহাব প্রথম বার বাবার মুখের উপর কথা বলল,

‘বাবা, আমি বাড়ি ফিরবো না। ‘

‘আশ্চর্য! কী হয়েছে তোমার?’

‘আমি এই বিয়ে করবো না। ‘

‘বেয়াদবের মতো কথা বলবেনা৷ কোথায় তুমি? ‘

‘আমি সিলেটে বন্ধুর বাড়িতে আছি। এখানেই থাকবো। তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরবোনা। ‘

কল কেটে দিলো শিহাব। ঠিকানা জানার পরই শিহাবের বাবা দুপুরের বাবার সাথে বের হয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য শিহাবকে জোরপূর্বক নিয়ে আসা। শিহাবের বাবা শিহাবকে জোড় করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে নিয়ে আসছিলেন শিহাবকে।

তখন মধ্যরাত পেরিয়ে সকাল হতে চললো। গাড়ি চলছিলো নিজ গতিতে। শিহাব ফোনে দুপুরের সাথে কথা বলছিলো। হঠাৎ একটা ট্রাক এসে গাড়ির সাথে প্রচন্ড জোরে সংঘর্ষ ঘটালো। বিকট শব্দে তছনছ করে গাড়ি উল্টে গেলো। বিধ্বস্ত হলো সম্পূর্ণ গাড়ি। সঙ্গে বিধ্বস্ত হলো কয়েকটা মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্খা। শেষ হলো দুটো জীবন।

এরপরই নেমে এলো অন্ধকার। জীবনের সব আলো বুঝি এখানেই শেষ। একটা এক্সিডেন্ট পুরো পরিবারটাকে শেষ করে দিলো যেনো। এক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গে দুপুরের বাবা মারা গেলেন। শিহাব চলে গেলো কোমায়। আর শিহাবের বাবার জ্ঞান ফিরলো সাত ঘন্টা পর। দুপুরের মা আর চাচী দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷ জ্ঞানে ছিলো শুধু দুপুর। তিনি দুপুরকে ডাকলেন। দুপুর কাঁদতে কাঁদতে বসেছিলো তার শিয়রে। তিনি অস্পষ্ট কন্ঠে বললেন,

‘তুই আমার শেষ ইচ্ছে রাখবি মা?’

দুপুর না বুঝেই মাথা নাড়লো। তিনি দুপুরকে অবাক করে বললেন,

‘শিহাবকে ভুলে যা মা৷ ‘

দুপুর কাঁদতে ভুলে গেছিলো। অবাক চোখে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।

‘আমি আমার বন্ধুর থেকে তিন কোটি টাকা লোন নিয়েছিলাম ওই লোন পরিশোধ করা সম্ভব নয় আমাদের কোম্পানির পক্ষে। কোম্পানি অনেক কোটি টাকা লস খেয়েছে। অনেক অনুরোধের পরও তা ঘোচানো গেলো না। দুঃসময়ে বন্ধুও আসল রূপ দেখায়। এর শাস্তিও হয়তো সে পাবে ভবিষ্যতে। কিন্তু আমি নিরূপায়, সে নিজের মেয়ের সঙ্গে শিহাবের বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি প্রস্তাবে রাজি না হলে আমাদের সবাইকে জেলে যেতে হবে। আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু শিহাব জেলে গেলে আর নিস্তার পাবেনা। ওর ভালোর জন্য তুই ওকে ভুলে যা। তনয়ার সাথে ওর বিয়ে হলে শিহাব ভালো থাকবে। আমাকে কথা দে তুই শিহাবকে ভুলে যাবি।’

দুই এক মুহুর্তের মধ্যেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। দুপুর কাঁদতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো,

‘ভুলে গেলাম আমি, আমাদের সব স্বপ্নকে, ভালোবাসাকে। তোমার কথা আমি রাখলাম বড় বাবা। তুমি ওপারে ভালো থাকো। ‘

চলবে-
(অনেকেই অতীত বিস্তারিত জানতে চাচ্ছিলেন৷ অতীতের গল্প এখানেই শেষ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here