#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২৮,২৯
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৮)
“”ব্রেকফাস্টে কি খাবে? নিশ্চয় অভুক্ত পেটে বেরিয়েছো?””
মহসীনের বর্তমানভরাট কন্ঠে রিপ্তির পুরোনো স্মৃতিগুলো মিলিয়ে গেলো। মহসীন দরজাতে দাড়িয়ে আর সে বিছানায় বসে। রিপ্তি সোজা হেঁটে মহসীনের কাছে এসে দাড়ালো। ওকে অবাক করে বুক পকেটে হাত দিলো রিপ্তি। চোখে চোখ রেখে কলমটা নিজের আয়ত্ব নিয়ে মহসীনের বৃদ্ধা আঙুলটাতে লিখলো,,
“”কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে সেদিন?””
মহসীনের শান্তদৃষ্টি আঙুলপত্রে! কিছু সেকেন্ড নিষ্পলকে লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরো মুখমন্ডলে আধার নেমে এসেছে। অপ্রকাশিত কারণটা অপ্রকাশ রেখেই বললো,,
“” বললে নাতো কি খাবে। একটু পর আমাকে বেরোতে হবে। জলদি বলো। আজ আমার হাতের রান্না খাওয়াবো তোমায়।””
রিপ্তির দৃঢ়কন্ঠ,,
“” এড়িয়ে যেতে চাচ্ছো মসহীন? কিন্তু আমি যে তোমায় এড়িয়ে যেতে দিবোনা। উত্তর তো তোমাকে দিতেই হবে আর সেটা এখনি।””
রিপ্তির অনড় আচরণে কিছুটা চমকিয়েছে মহসীন। তার আশেপাশে ঘুরঘুর করা সরল রিপ্তি বুঝি জেদও ধরতে পারে? এইটা তো তার জানা ছিলো না। মহসীন একগাল হাঁসলো,আড়ালে। যেটা শুধু চোখে ভেসেছে,গালেও নয় ঠোঁটেও নয়! কিন্তু রিপ্তি তো দেখে নিয়েছে। কেননা রিপ্তির চোখদুটো তো মহসীনের চোখেই স্থির। রিপ্তির তেজোদৃপ্ত চোখপানে তাকানোর সাহসটা হঠাৎ করেই মিইয়ে গেলো মহসীনের। দ্রুত চোখ সরিয়ে উল্টোপথে পা বাড়াতেই রিপ্তি পথরোধ করে বললো,,
“” আমার উত্তর না দিয়ে একচুলও নড়তে পারবেনা তুমি। তোমার ফিরিয়ে দেওয়া রিপ্তি আর এখনকার রিপ্তির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।””
মহসীন সামান্য বিরক্ত ঢেলে বললো,,
“” অতীত অতীতেই থাকনা,বর্তমানে কেন আনছো?””
“” অতীত যদি অসম্পূর্ণ হয় তাহলে তো বর্তমানে আসতে চাইবেই। পৃথিবীর সবসৃষ্টিই তো চাই নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণা করতে। তাহলে আমার অতীত কেন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে? তাকেও সম্পূর্ণ হতে হবে তারজন্য শুধু বর্তমান কেন ভবিষ্যতেও টেনে আনবো।””
“” কিসের অসম্পূর্ণ? তোমাকে এমনি এমনি ফিরিয়ে দেইনি,সাথে কারণগুলোও বলে দিয়েছিলাম।””
“” মিথ্যে বলেছিলে। সব মিথ্যে।””
“” কিছু মিথ্যে নয়,রিপ্তি!””
রিপ্তি এক কদম পিছিয়ে গেলো। কন্ঠে চঞ্চলতাভাব চলে এসেছে। উগ্র হয়ে বললো,,
“” সত্যিই যদি হয় তাহলে এখনো বিয়ে করো নি কেন? আমাকে যদি ভালো নাই বাসো এখনো তোমার ঘরনী আসেনি কেন?””
“” বিয়ে করা না করার সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই। সময় হলে ঠিক বিয়ে করে নিবো।””
রিপ্তি দ্রুত মহসীনের সান্নিধ্যে চলে এলো,চোখে চঞ্চলতাদৃষ্টি নিয়ে বললো,,
“” কবে? কবরে পা দেওয়ার পর? আমার তো বয়স বাড়ছে তোমার বুঝি কমছে? কত হলো?””
“”বিয়ের সাথে বয়সের কি সম্পর্ক? আমার ইচ্ছে হয়নি তাই করেনি,যখন ইচ্ছে হবে তখন করবো।””
“” বিয়ের সাথে যে বয়সের সম্পর্ক নেই সেটা তুমি ত্রিশে পা দিয়ে বুঝতে পারলে? আমি তো পনেরোতে পা দিয়েই বুঝেছিলাম মহসীন!””
“” তুমি আর আমি এক নই,তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলে।””
“” সেটা বিয়ের নাম নেওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলে? তার আগে?””
মহসীন খানিকটা ঘাবড়ে বললো,,
“” মানে?””
“”পরীক্ষায় ফেল করিয়ে তোমার কাছে টেনে নেওয়ার মিথ্যে ছলনা করার সময় মনে হয়নি আমি একটা বাচ্চা মেয়ে?””
“” ছলনা?””
“” হ্যা, ছলনা! আমি খুব মেধাবী না হলেও ফেল করার মতো ছাত্রী ছিলাম না। আর পরীক্ষায় আমার সব কমন পড়েছিলো। ঘন্টা পড়ার আগেই খাতা জমা দিয়েছিলাম,তবুও আমি কি করে ফেল করলাম? তুমিই ফেল করিয়েছিলে তাইনা? নিজের বানানো জালে বন্দী করবে বলে!””
চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে মুখটা যেমন তামাটে বর্ণে রাঙিয়ে যায় মহসীনের মুখটাও তেমনি রূপ ধরেছে তবে কিছুটা চমকানো আর অনেকটা অবাকের লাবন্যও ছুয়েছে। রিপ্তি খানিকটা দম ছেড়ে আবার বললো,,
“” পড়ানোর নামে আমার মনে নতুন অনুভূতি জাগানোর সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা? নানা রকম ইঙ্গিত ইশারায় আমাকে আবেগী করে তোলার সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা? আমার হাতে প্রেমবাক্য লেখার সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা?””
মহসীন কিছু বলতে চাইলে রিপ্তি দ্রুত বললো,,
“” তুমি সবটা জেনেশুনেই তো আমাকে নিজের দিকে টেনেছিলে,তাহলে হঠাৎ করে কেন পিছিয়ে গেলে? আমার অবুঝ হৃদয়টাতে ভালোবাসার ফুল ফুটিয়ে কেন মাটিতে ফেলে দিলে? তোমার বুকটা একবারও কাঁপেনি? কেন এমন করেছিলে মহসীন? কেন? মিথ্যে বলে আমায় দুরে ঠেলে দিয়েছিলে কেন?””
“” সবটাই কি মিথ্যে ছিলো?””
রিপ্তি কান্নার কোলে ঢলে পড়তেই মহসীনের সংকোচহীন প্রশ্নে পূর্ণদৃষ্টি রাখে মহসীনের উপর।
“” মানে?””
“” আমি যে তোমার আকর্ষণ ছিলাম সেটা তো প্রমাণ হলো। তুমি নিজেই করেছো!””
মহসীনের কথা বোধগম্য হচ্ছেনা রিপ্তির। বুঝার জন্য মহসীনের মুখপানে চেয়ে আছে। যেন এই মুখের দিকে আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সব বুঝতে পারবে। মহসীন ঠোঁট একদিকে প্রসারিত করে বললো,,
“” আমার ভালোবাসা মিথ্যে নাকি সত্যি সেটা নাই বা তুললে। যে ভালোবাসার দোহায় দিয়ে অতীতকে বর্তমানে টেনে আনছো সেটা কি আদৌ বেঁচে আছে? যদি বেঁচে থাকে তাহলে তুমি আজ পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা হতে না! আমি যদি তোমার ভালোবাসাই হতাম তাহলে অনুভবের ছোঁয়ায় তুমি কেঁপে উঠতেনা। নিষিদ্ধ অনুভূতিতে পা রাখতে না। মাত্র তিনটে বছরে তোমার হৃদকম্পনে অন্যকারো নাম কম্পিত হতো না!””
রিপ্তির শরীরটা অসার হয়ে আসছে। অজান্তেই কয়েক কদম পিছিয়ে যাচ্ছে। মহসীনকে কাঠগড়ায় দাড় করাতে গিয়ে কি নিজেই আসামী হয়ে গেলো? নিজের অজান্তে নিজেকেই জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ফেললো? এখন সে কি করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে? কি করে? এত বড় ভুল কি করে ঘটে গেলো? সত্যিই তো আমার ভালোবাসা তো মহসীন তাহলে তাকে ছাপিয়ে অনুভবের কাছে কি করে পৌছুলাম? তাও এতো অল্প সময়ে? এতো গভীরে! যে গভীরতার শেষ সীমানাটাও অনুভব স্পর্শ করে ফেলেছে।
রিপ্তি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এক চাপা অপরাধবোধ তাকে ঝাপটে ধরেছে। কলঙ্কটা তাহলে শুধু শরীরে না অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা হৃদযন্ত্রণেও লাগিয়ে ফেলেছে! বাহিরের কলঙ্কটা ধুতে গিয়ে যেভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে,পদে পদে জীবনের মর্ম বুঝতে হচ্ছে সেভাবেই কি ভেতরেরটাও ধুতে পারবে? নাকি আরো বেশি ভুগতে হবে। শেষমেষ কলঙ্কহীন হতে পারবে তো? ভেতর ও বাহিরে?
মহসীন রিপ্তির পাশে বসলো। নরমসুরে বললো,,,
“” এভাবে ভেঙে পড়োনা,রজনীগন্ধা! আমার বুকে যে খুব লাগে। উঠো,তুমি একটু বিশ্রাম করো,আমি তোমার জন্য হালকা-পাতলা কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।””
রিপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দিলো মহসীন। এমন হৃদয়ঘাত কথাগুলো বলতে চায়নি সে তবুও কেন বলে ফেললো? তবে কি সে ঈর্ষিত? কিন্তু কেন? আজ এই দিনটার জন্য কি সেই দায়ী নয়? বেশ তো ছিলো ছোট্ট রিপ্তি,কেন গেলো তার জীবনে বিশেষ পদক্ষেপ ফেলতে? ঐটুকু মেয়ে,ঐটুকু মেয়ে বলে নিজের মনটাকে কত বোঝাতে চেয়েছিলাম,কিন্তু মন! সে কি কারো কথা শোনে? তার ধর্মই হলো অবাধ্য হওয়া। যদি কষ্ট করে বেধে রাখতে পারতাম তাহলে হয়তো মেয়েটার জীবন আজ পুর্ণতা পেতো! ভিন্নরঙে! ভিন্ননামে!
রান্নাঘরে ঢুকার আগে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে মহসীনের। প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। সকাল শেষ হয়ে দুপুর নামবে। এতো বেলা অবধি মেয়েটা না খেয়ে আছে। আর কতক্ষণ এভাবে রাখবে? এখন তো আর সে একা নয়,তার অভ্যন্তরে আরেকটা সত্তারও বসবাস। আর দেরি করা যাবেনা। যত দ্রুত সম্ভব কিছু খাওয়াতে হবে। মহসীন বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ফ্রিজে হাত দিলো। দুধের প্যাকেট বের করেছে। চুলায় আগুন ধরিয়ে দিলো। দাড়িয়ে থেকে উচ্চতাপে দুধটা ঠিক মতো ফুটিয়ে নিলো। মগের মধ্যে ঢেলে একটা কাঁচা ডিম ভেঙে দিয়েছে গরম দুধে। কাঁটা চামচে ঘনঘন নাড়িয়ে মিশিয়ে নিলো। ডিম মিক্স করা গরম দুধের সাথে কয়েক পিস পাউরুটি নিয়ে হাঁটা ধরলো রিপ্তির রুমের দিকে। স্বল্প সময়ে এর থেকে ভালো কিছু মাথায় আসেনি মহসীনের। এখন মেয়েটা খেলেই হয়।
~~~
বিছানার এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে রিপ্তি। চোখের দৃষ্টি ক্লান্ত। হবেইনা কেন? আর কত কাঁদবে এই চোখ দুটো? যখন সে কথা বলতে শিখেছিলো তখন মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়েছে,যখন একটু বড় হলো,প্রেমনামক পোকাটা কামড়ে দিলো তখন মহসীনের জন্য বুক ভাসিয়েছে আর এখন?
“” খেয়ে নাও!””
মহসীনের কন্ঠে রিপ্তি দুর্বল দৃষ্টিতে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।
রিপ্তির সামনেই বসলো মহসীন। নিজেই দুধের মধ্যে রুটি ভিজিয়ে বললো,,
“” হা করো।””
রিপ্তি আরেক পলক তাকালো মহসীনের দিকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলেও সামনে এগিয়ে এসে খাওয়া শুরু করেছে। মহসীন দ্বিতীয়বারের মতো রুটি ছিড়তে নিলে রিপ্তি শান্তস্বরে বললো,,
“” আমি খেতে পারবো। তুমি এখন যাও।””
“” আমি এমনিতেও চলে যাবো। তবে খাবারটা শেষ হোক তারপর।””
রিপ্তি খাচ্ছে আর ভাবছে। পুরো ভাবনায় অনুভব আর মহসীন। একসাথে দুজনকে সংমিশ্রণ করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলছে তবুও ভাবনা কাটছেনা। কাটার মতো কি? ভালোবাসার জন্য সে দুটো ঝুকিপূর্ণ কান্ড ঘটিয়েছে। প্রথমবার বাড়ি ছেড়েছিলো দ্বিতীয়বারও বাড়ি ছেড়েছে। দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন মানুষের কারণে। কিন্তু দুটোই তো ভালোবাসা ছিলো! কিন্তু এতো অল্প সময়ে স্বল্প বিস্তরে দুটো মানুষ করি করে একমনে জায়গা নিলো? তাহলে কি মহসীন সত্য! ও শুধুই আমার আকর্ষণ ছিলো?
রিপ্তির ভাবনার সুতো কাটে মহসীনের হাতের স্পর্শে। মহসীন কিছু লিখছে,রিপ্তির মধ্যমা আঙুলে। লেখা শেষে বললো,,
“”আমার জরুরী কাজ আছে। যেতেই হবে। আসতে দেরি হতে পারে। সাবধানে থেকো।””
“” বাসায় আর কাউকে দেখছিনা যে!””
“” আমি একাই থাকি।””
“” তোমার বাবা-মা?”‘
মহসীন পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো। রিপ্তির সামনে রেখে বললো,,
“” ফোনটা সাথে রেখো!””
মহসীন চলে যাচ্ছে। রিপ্তি পেছন থেকে আগের প্রশ্নটাই আবার বললো,,
“”তোমার বাব-মা?””
“” নেই! আমি অনাথআশ্রমে বড় হয়েছি।””
~~~
মহসীন চলে যেতেই রিপ্তি গোসল সেরে নিলো। মাথার ভারটা কমেছে। শরীরের ক্লান্তভাবটা দুর হয়েছে। কিন্তু মনের? মনের ক্লান্ত আর ভারটা তো আগের চেয়ে বেড়েছে। কি থেকে কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে সবকিছুকে এখন দুর্বিষহ লাগছে। কেন এমন হলো? কেন তার সাথেই হলো? উফ! আর ভাবতে পারছেনা রিপ্তি,কিন্তু না চাইলেও বারবার একি ভাবনাগুলো মাথার পুরো অংশজুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কি করে মুক্তি পাবে সে? রিপ্তি ভেজা চুলগুলো ছেড়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। অন্যমনস্কতায় চোখ পড়লো হাতের অঙ্গুলিতে। এখানে তো কিছু লিখেছিলো মহসীন! পড়াই তো হলো না। পানিতে ধুয়ে যায়নি তো? রিপ্তি শোয়া থেকে বসে পড়ে। গভীরদৃষ্টি রাখে আঙুলে। ধুয়ে এসেছে অনেকটায় তবে আধোআবছা রয়ে গিয়েছে। রিপ্তি একটার সাথে আরেকটা অক্ষর জুরে জুরে শব্দ বানাচ্ছে। বেশ সময়ের ব্যবধানে একটি লাইন জুড়তে পারলো,,
“” তুমি অনুভবকে নয়,আমার অনুরূপকে ভালোবেসেছো!””
রিপ্তি খানিকটা সময় স্তব্ধতায় কাটালো। মহসীন এটা কি লিখেছে? এর মানে কি? অনুরূপ বলতে কি বুঝিয়েছে? রিপ্তি চোখ বন্ধ করে দুজনের মুখটাকেই কল্পনা করছে,কই! কারো চেহারার তো কোনো মিল নেই। তাহলে কেমন অনুরূপ? দুজন কি জমজ ভাই? সেটা কি করে সম্ভব? দুজনের বয়সের ব্যবধান তো প্রায় পাঁচ বছর হবে। তাহলে? রিপ্তি আবারও অস্থির হয়ে উঠলো। এক জঘন্যতম অস্থিরতা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গিয়েছে সে। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবে তো কিছুক্ষণ বসে বসে। শুয়ে বসে আরাম না পেয়ে দাড়িয়ে ভাবে,মাঝে মাঝে রুম ছেড়ে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে হাঁটাহাঁটি করে। পৃথিবীর সকল অশান্তি বুঝি আজ তার দখলে!
ভাবনা ভাবনায় যখন সে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তখনি এক পুরুষের ভরাট গলার হাঁসির শব্দ। ঘুমন্ত রিপ্তির চোখের পাতা কাঁপছে। অস্পষ্ট সুরে বললো,,
“” এমন লাল পাগড়িতে তোমাকে খুব বিশ্রি লাগছে,মহসীন!””
“” তাতে কি? লাল যে আমার পছন্দের রঙ,তোমার মতো। আমাদের বিয়েতে তুমি লাল বেনারশী পড়বে আর আমি লাল শেরওয়ানি সাথে লাল পাগড়ি পড়বো।””
মহসীন আরেকদফা হেঁসে নিয়ে মোটা গলায় গান ধরলো,,
বাবরি কাটা তার চুলের বাহার
মুচকি হাসি,হাসিটা যে তার
বাবরি চুলওয়ালা
ঐ লাল কুর্তাওয়ালা
দিলে বড় জ্বালা রে
পান্জাবীওয়ালা(গান)
রিপ্তির ঘুম ভেঙে গেলো। শুকনো গলা ভেজাতে ভেজাতে চারপাশটা চোখ বুলাচ্ছে। মহসীন নেই কোথাও নেই। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিলো? এতোগুলো বছরে একটিবারের জন্যও তো মহসীন স্বপ্নে আসেনি তাহলে আজ কেন আসলো? রিপ্তির চোখ চকচক করছে,সে উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মহসীনকে ছেড়ে আসার পর স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কোনো কাজেই সে বাইরে বের হতো না। অপরিচিত তো দুর পরিচিতদের সাথেও কথা বলতো না তাহলে অনুভবের সাথে কেন বললো? অনুভব তো তার সাথে কথা বলতে আসেনি সে নিজে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছে। কেন? কারণ তার শরীরের লাল রঙটা তাকে টেনেছে,তার গানগুলো তাকে বারবার বাধ্য করেছে তার নিকটে যেতে কেননা মহসীনও হাঁটাচলায় সারাক্ষণই গুনগুন করতো। তবে হ্যা,সেদিকে রিপ্তির বিশেষ খেয়াল ছিলোনা। তাই হয় তো তার স্মৃতির পাতায় মহসীনের এই আচরনটি আচড় কাটেনা।
প্রিয় মানুষের দীর্ঘ অনুপস্থিতে তার বিশেষ কোনো গুন,বৈশিষ্ট্য অথবা অভ্যাসগুলো ভিন্ন কোনো মানুষের মধ্যে থাকলে তার প্রতি বিশেষ খেয়াল চলে আসে। এবার হোক সেটা বুঝে অথবা না বুঝে। রিপ্তিরও তাই হয়েছে। কিন্তু অনুভব কি জেনেশুনেই মহসীনের অনুরূপ সেজে তার সামনে দাড়িয়েছিলো? নাকি কাকতালীয়ভাবেই তার স্বভাব-চরিত্র মহসীনের সাথে মিলে গিয়েছে? রিপ্তির কপালে গাঢ় চিন্তার ভাজ পড়তেই কলিং বেলের শব্দ। ভাবনা জগতের এতোটাই বিভোর ছিলো যে রিপ্তি বেশ চমকে উঠেছে। নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিয়ে দরজার দিকে এগুলো। দরজার অপরপাশে মহসীনের মুখটা ভেসে উঠতেই রিপ্তি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,,
“”অনুভব তোমার কি হয়?””
চলবে
#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৯)
প্রিয় মানুষের দীর্ঘ অনুপস্থিতে তার বিশেষ কোনো গুন,বৈশিষ্ট্য অথবা অভ্যাসগুলো ভিন্ন কোনো মানুষের মধ্যে থাকলে তার প্রতি বিশেষ খেয়াল চলে আসে। এবার হোক সেটা বুঝে অথবা না বুঝে। রিপ্তিরও তাই হয়েছে। কিন্তু অনুভব কি জেনেশুনেই মহসীনের অনুরূপ সেজে তার সামনে দাড়িয়েছিলো? নাকি কাকতালীয়ভাবেই তার স্বভাব-চরিত্র মহসীনের সাথে মিলে গিয়েছে? রিপ্তির কপালে গাঢ় চিন্তার ভাজ পড়তেই কলিং বেলের শব্দ। ভাবনা জগতের এতোটাই বিভোর ছিলো যে রিপ্তি বেশ চমকে উঠেছে। নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিয়ে দরজার দিকে এগুলো। দরজার অপরপাশে মহসীনের মুখটা ভেসে উঠতেই রিপ্তি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,,
“”অনুভব তোমার কি হয়?””
মহসীন স্বাভাবিক চাহনি আঁকলো রিপ্তির সন্ধানী মুখটার দিকে। এমনভাব যেন,এমন প্রশ্ন শুনতেই সে দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে। মহসীন বাঁকা হেঁসে বললো,,
“” ভেতরে ঢুকতে দেবে না?””
রিপ্তির খেয়াল এলো নিজের উপর। দরজাটা সামান্য মেলেছে সে। অনেকটা উঁকি দেওয়ার মতো। তার উদ্দেশ্য তো তাই ছিলো। কে কলিংবেল বাজাচ্ছে তাকে দেখতে চেয়েছিলো। এ বাসায় সে নতুন,তার জন্য সবাই অপরিচিত। তবুও চেনা মানুষের মুখটাকে খুজার ইচ্ছেই দরজা খোলা। সেটাই হলো। মহসীনকে দেখে ভেতরের অনুসন্ধানীটা টুপ করে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলো। মানুষটা বাইরে নাকি ভেতরে তা বুঝার সময়টুকুও যেন নেই। তার সময় এখন তৃষ্ণার্ত। রহস্য ভেদের তৃষ্ণা!
মহসীনের ঠোঁটের হাঁসিটা গালে ছড়িয়ে চোখে এসে জমেছে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই বাসাটা তার নয়,রিপ্তির। সে অপরিচিত কেউ। কাউকে খুঁজতে এসেছে। যাকে খুজতে এসেছে সে রিপ্তি নয়,অন্য কেউ। হতে পারে রিপ্তির বাবা। তিনি রুমের ভেতর বিশ্রাম নিচ্ছেন অথবা বাসায় নেই। সেই খবরটা জানাবে দরজার আড়ালে থাকা রূপসী মেয়েটি। কিন্তু এই খোজা আর জানানো তথ্য আদান-প্রদানের সাথে আরেকটি অদৃশ্য ঘটনা ঘটবে। ছেলেটি মেয়েটির বুলি তোলা ঠোঁটের প্রেমে পড়বে,মিহি কন্ঠের প্রেমে পড়বে,চোখের পলক ফেলা ঘনপাপড়ির প্রেমে পড়বে,সন্দেহীভাবে ফুটে উঠা ভ্রূযুগলের বাঁকা হয়ে যাওয়ার প্রেমে পড়বে!
“” না। আগে বলো অনুভবের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?””
রিপ্তি প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই মহসীন বিড়বিড় করলো,,
পিছলে গেলাম আবার
প্রেমের পুকুরে
আরেকবার কি রাখবো পা
তোর মনের শহরে?!(রোকসানা)
রিপ্তির অধৈর্য্য কন্ঠ,,
“” কি হলো?””
“” তোমার মতো অনুভবও আমার স্টুডেন্ট ছিলো।””
“” স্টুডেন্ট?””
রিপ্তি দরজার থেকে হাত সরাতেই মহসীন ভেতরে ঢুকে গেলো। গলা থেকে টাই খুললো। হাতের ঘড়ি খুললো। পকেট থেকে মানিব্যাগটা খুলে শার্টের বোতামে হাত রেখে বললো,,
“” হুম। অনুভব তো তোমাদের পাশের গ্রামেই থাকতো। আমি ওর ইংলিশ টিউটর ছিলাম। বেশ মেধাবী ছিলো। তাই আমি যখন ঢাকা চলে এলাম ওকেও আমার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। এডমিশন টেস্টের জন্য আমারি এক কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলো। ওর ফ্যামিলি তখনো গ্রামেই। তবে তোরজোর চলছিলো ঢাকায় আসার। আমার সাথে ছিলো দুইমাস। তারপর…””
“” তারপর?””
“” বেশ গরম লাগছে গোসল করে আসি।””
মহসীন গোসলখানার দিকে পা বাড়ালে রিপ্তি পথ আগলে দাড়ালো। শক্তগলায় বললো,,
“”আগে কথা শেষ করো তারপর যা খুশি তাই করবে।””
মহসীন ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,,
“” এভাবে যখন তখন দৌড়াদৌড়ি করছো কেন? এখন তো গুনে গুনে পা ফেলা উচিত। পিঁপড়ের মতো চলা শিখো। পা পিচলে পড়ে গেলো তো,তোমার সার্টিফিকেট শেষ!””
রিপ্তি সরুচোখে বললো,,
“” তারপর কি?””
“” তারপর কিছুই নেই। হঠাৎ করে হাওয়া।””
“” কেন?””
“” সেটা আমি কি করে বলবো?””
“” তোমার স্টুডেন্ট তুমি বলবে না তো কে বলবে? তুমি খোঁজ নেওনি?””
“” খোঁজ নেওয়ার মতো কোনো উপায় আমার জানা ছিলোনা। আমি ওর প্রয়োজন ছিলাম,ও আমার প্রয়োজন ছিলোনা। তাই ওর ফোন নাম্বার,নতুন বাড়ীর ঠিকানা কিছুই জানতাম না। গ্রামের বাড়ীতে তখন কেউ নেই। শুনেছিলাম স্বপরিবারে ঢাকা চলে এসেছে।
“” তারপর আর কখনো দেখা হয়নি?””
মহসীন সরাসরি চোখ রাখলো রিপ্তির চোখে। অস্ফুটে বললো,,
“”হয়েছিলো। তোমাদের অন্তরঙ্গ মুহুর্তে!””
মহসীনের কথাটার তাৎপর্য বুঝার সময়টুকু নিতে নিতে রিপ্তিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো মহসীন। ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকেই পানিটা ছেড়ে দিলো। তার মনের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলছে,ঈর্ষার আগুন। এই আগুন কি নিভবে এই পানির জলকণায়? চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার,পৃথিবী কাঁপানো চিৎকার। ভিন্নপুরুষের সাথে নিজের প্রাণপ্রিয়ার উন্মাদনার সাক্ষী হতেই কি সে কাকভেজা হয়ে হাজির হয়েছিলো রিপ্তিদের বাড়ী? তাদের উন্মাদনার অতৃপ্তকে তৃপ্তি করার সুযোগ দিতেই যে দরজা ভিড়িয়ে দিয়েছিলো সে।
~~~
রিপ্তির দিকে ভাতের থালাটা এগিয়ে দিলো মহসীন। রিপ্তি উদাসমনে বসে আছে মহসীনের পাশের চেয়ারটায়। ভাবনারাজ্যের কিছু জায়গাটায় মহসীনও বিরাজ করছে। নিজের বাড়ীর দিকে একবার চোখ বুলালো সে,পরক্ষণেই রিপ্তির উদাসীন মুখটার উপর। অতঃপর বেগুনি রঙের জামাটা দিয়ে ঢেউ হয়ে থাকা পেটটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,,
“” কোথায় যাবে ঠিক করেছো?””
রিপ্তির দিক থেকে কোনো উত্তর নেই। মহসীন এবার গলার স্বরে হালকা জোর এনে বললো,,
“” রজনীগন্ধা!””
রিপ্তি খানিকটা নড়ে বললো,,
“” কিছু বলছো?””
“” আমার এক কাছের মানুষের বাসায় তোমার থাকার বন্দোবস্ত করেছি। সম্পর্কে আমার বন্ধু হয়। বিবাহিত। স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার। একটা মেয়েও আছে। পাঁচ-ছয় বছর হবে। খুবই বিশস্ত। তুমি যতদিন না ভবিষ্যৎ কোনো সিদ্ধান্তে পৌছুচ্ছ ততদিন…””
মহসীনের কথার মাঝেই দাড়ি টেনে দিলো রিপ্তি। দৃঢ়কন্ঠে বললো,,
“” আমি কোথাও যাচ্ছিনা।””
“” যাচ্ছো না মানে?””
টেবিলে সাজিয়ে রাখা মাছ ভাজা সবগুলো নিজের পাতে ঢাললো রিপ্তি। লবণ দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে সহজ গলায় বললো,,
“”আমার জীবনের প্রেমপোকাটা তুমিই জন্ম দিয়েছিলে। তার বিষের জ্বালা আমাকে এতোদুর বয়ে এনেছে। আরো কতদিন বয়তে হবে তাও ভাবনাদুর! যতদিন না বিষ নিঃশেষ হচ্ছে ততদিন আমি এখানেই থাকবো, তোমার বাড়ীতে।””
মহসীন চকিত কন্ঠে বললো,,
“” পাগলের মতো কি বলছো? আমি এখানে একা থাকি,রিপ্তি। আমি একটা ছেলে তাও অবিবাহিত। সেখানে তুমি কি করে থাকবে? লোকসমাজের কথা তো ভাবো।””
মহসীনের কথায় রিপ্তি মাছের মচমচে মাথায় কামড় বসালো। যেন সে মাছ নয়,মহসীনের কথাকে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। খাওয়ার মাঝেই অস্পষ্টগলায় বললো,,
“”সেবার ছোট ছিলাম বলে ফিরে গিয়েছি এবার কিন্তু তা হবে না। কারণ রিপ্তি এখন বড় হয়েছে। যে বড় হওয়ায় পাপ কাজ করা যায়!””
মহসীনের নিরবদৃষ্টি রিপ্তির উপর স্থির হতেই রিপ্তির সন্দেহীগলা,,
“” অনুভবকে তুমি পাঠাওনি তো? আমাকে পরীক্ষা করার জন্য?””
মহসীন নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিজের প্লেটে ভাত নিচ্ছে। কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,,
“” না তোমার ভালোবাসার উপর আমার অনাস্থা ছিলো,না আমার ভালোবাসায়। তাহলে সেখানে পরীক্ষা শব্দটা আসাটা অন্যায়!””
মহসীন সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে তাই বুঝার চেষ্টা করছে রিপ্তি। সন্দেহের কিছুটা অংশ এই মানুষটার উপর ঢালবে নাকি সেই দ্বিধাহীনতায় ভুগছে। মহসীন ভাতের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে রিপ্তির দিকে সরলদৃষ্টি রাখলো। আদ্র গলায় বললো,,
“”যদি পরীক্ষা হতো তাহলে তো অনুত্তীর্ণই হতে!””
রিপ্তির কথার ধরন বুঝেই মহসীন আর কথা বাড়ায়নি। নিজের বাসার একটা রুম তার দখলে দিয়ে দিলো। আসলেই কি রিপ্তির জেদের জন্যই তাকে রেখেছে? নাকি মেয়েটাকে চোখের আড়াল করতে অবাধ্য মনটা চাচ্ছিলো না! মনকে সায় দিতে গিয়ে আবার কোনো ভুল করে বসছে না তো? হলে হবে,ভুল হওয়ার আগ পর্যন্ত তো রক্তমাংসে গড়া রজনীগন্ধার সুবাস নিতে পারবে। বুকের ভেতর জমাতে পারবে আরো কিছু প্রেমময় তাজা নিশ্বাস!
~~~
রিপ্তির প্রেগন্যান্সির বয়স আট মাস পার হতে চললো। মহসীন যতটা বুঝছে,যতটা পারছে দেখভাল করে যাচ্ছে। মহসীন যতটুকু সময় ইউভার্সিটিতে কাটাতে চলে যায় সেই টুকু সময়ের জন্য একজন বুয়া রাখা হয়েছে। মহসীনের পরিচিত। দীর্ঘচেনা। তার বড় হয়ে উঠা অনাথআশ্রমেই নিয়োজিত ছিলো।
রিপ্তির পেটের সাথে হাত,পাও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়েছে। হাঁটাচলা করতে খুব বেশিই কষ্ট হয় তার। কিন্তু ডক্টরের কড়া নির্দেশ দু-ঘন্টা অন্তর অন্তর যেন কিছু সময় হাঁটাচলা করে। সেই আদেশ মেনেই রুমের ভেতর দুই/তিন রাউন্ড সেরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলো রিপ্তি। দুর্বলতায় চোখে ঘুম লেগে আসতেই দরজায় খটখট শব্দ। রিপ্তি চোখ না মেলেই বিরক্ত নিয়ে বললো,,
“” তোমাকে কতবার বলেছি আমার রুমে আসার সময় দরজার মধ্যে এই বিশ্রী শব্দ বাজাবে না। আমার মাথায় লাগে। বুক ধরফর ধরফর করে।””
সবসময়ের মতো মহসীনও সামান্য হেঁসে বললো,,
“” এটাকে ভদ্রতা বলে রিপ্তি।””
রিপ্তির কপাল কুঁচকে গেলো। চোখের পাতা মেললো। ধীরুস্থে উঠে বসে খিটখিট মেজাজে বললো,,
“” আমাকে বিরক্ত করে,আমার সামনেই ভদ্রতা সাজা হচ্ছে?””
মহসীন রিপ্তির কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“” তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।””
“” সারপ্রাইজ?””
মহসীন চোখের পাতা ফেলে হ্যা সম্মতি বুঝালো। রিপ্তির দিকে চেয়ে থেকেই কাউকে ডাকলো,,
“” ভাবী?””
মিন্মি মহসীনের পেছন থেকে সামনে আসতেই রিপ্তির বিস্ময়মাখা চাহনি। অস্পষ্ট গলায় বললো,,
“” ভাবী!””
মিন্মি দ্রুতপদে রিপ্তির কাছে এগিয়ে গেলো। বুকের সাথে ননদের মাথাটা চেপে ধরে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে। রিপ্তির চোখও বুঝি ভিজে উঠছে। রিপ্তির মাথাটা বুক থেকে আলগা করে কপালে চুমু আঁকলো মিন্মি। ভেজাগলায় বললো,,
“” চিঠিতে কিন্তু লেখা ছিলো,আমি যেদিন তোর সামনে আসবো আমায় শুধু ‘মা’ বলে ডাকবি।””
রিপ্তি ছলছল নয়নে ভাবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আছে। সময় শেষে হুট করেই মিন্মিকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠে। কান্নাজড়িত কন্ঠেই বললো,,
“” মা!””
~~~
খাবার টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছে মিন্মি। আজ মহসীনকে রান্না করতে দেয়নি সে। নিজ হাতে যত্ন করে মেয়ে আর মেয়েকে যত্নে আগলে রাখা মানুষটার জন্য রান্না করেছে।
মহসীনের পাশের চেয়ারে রিপ্তি,তার পাশেই মিন্মি। নিজের হাতে রিপ্তিকে খায়িয়ে দিচ্ছে। আড়চোখে মহসীনকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ অনুসন্ধান চালিয়ে রিপ্তির দিকে খানিকটা চেপে এলো সে। কন্ঠখাদে এনে বললো,,
“” ইনিই কি তোর সেই লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন?””
রিপ্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই মিন্মি উৎসাহ নিয়ে বললো,,
“” আজ সারারাত তোর গুপ্তধনের গল্প শুনবো!””
~~~
মহসীন নিজের শোয়ার আগের খুটিনাটি কাজ শেষ করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তারমধ্যেই মিন্মির গলা পেলো দরজার আড়াল থেকে।
“” ভেতরে আসতে পারি?””
মহসীন দ্রুত একটা টি-শার্ট পড়ে নিয়ে নিজেই দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। সংশয় নিয়ে বললো,,
“” এতোরাতে? এখনো ঘুৃমাননি?””
মহসীনের দিক থেকে অনুমতির প্রয়োজনবোধ করলোনা মিন্মি। ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,,
“” নতুন জায়গা তো তাই ঘুম আসছেনা।””
“” রিপ্তি ঘুমিয়েছে?””
মিন্মি পেছন ঘুরলো। মহসীনের উদ্বিগ্নছায়ায় ঢাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। শানিত দৃষ্টি রেখে উদাস গলায় বললো,,
“” হুম। ঘুমিয়েছে।””
সাথে সাথে মহসীনের মুখ থেকে উদ্বিগ্নে ঘেরা ছায়াটা মুছে যাচ্ছে। যা মিন্মির প্রখরদৃষ্টিকে স্পষ্ট ধরা পড়ছে। মহসীন সরল গলায় বললো,,
“” হঠাৎ আমার কাছে এলেন যে?””
মিন্মি চোখ সরিয়ে নিলো। আন্তরিকতার ভঙ্গিমায় বললো,,
“” আমি আপনার চেয়ে অনেকটায় ছোট। তুমি করে বলতে পারেন।””
মহসীনের দ্রুত উত্তর,,
“” সম্পর্কের দিক দিয়ে তো অনেক উচুতে আছেন।””
মিন্মি সামান্য হাঁসলো। মহসীনও তার সাথে যোগ দিয়েছে। ঠোঁটে হাসির রেশ ধরেই মিন্মি প্রশ্ন করে বসলো,,
“”রিপ্তির এতো বড় একটা অন্যায়কে আপনি এতো স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন কিভাবে? আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো..””
“” অস্বাভাবিক আচরন করার জন্য একটা সম্পর্কের প্রয়োজন ছিলো যেটা আমাদের মধ্যে নেই।””
“” আসলেই কি নেই? ‘রিপ্তি ঘুমিয়েছে’ প্রশ্নটা করার সময় আপনার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু ছিলো সেটা আমি মেপে নিয়েছি। সেই কিশোর বয়সী রিপ্তিকে ঠিক যতটা ভালোবাসতেন এখনো ততটাই। এক বিন্দুও কমেনি। তারপরেও বলবেন কোনো সম্পর্ক নেই?””
মহসীন খানিকটা চমকেছে। বিচলিত দৃষ্টি এদিকওদিক পড়ছে। মিন্মি বিছানায় বসতে বসতে বললো,,
“” রিপ্তির মুখে আপনাদের অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্পটি শুনেছি। তবে সেটা অসম্পূর্ণ। গল্পটাকে সম্পূর্ণ করতেই আপনার কাছে আসা।””
মহসীনের শুকনো গলার ছোট্ট সংকোচময় প্রশ্ন,,
“”মানে?””
মিন্মি আর কথা না বাড়িয়ে মূল প্রসঙ্গে চলে এলো,,
“” সেদিন রিপ্তিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেন?””
মহসীন কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়েছে। তবে সেটাকে দ্রুত সামলে নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মিন্মি বলে উঠলো,,
“” আমি প্রতিজ্ঞা করছি,আপনার মতো আমিও কারণটি গোপন রাখবো! আপনার গোপনীয়তা আপনি না চাইলে কখনোই প্রকাশ করবো না।””
মহসীন নিরব। নিষ্পলকে চেয়ে আছে মিন্মির দিকে। তার এখন ঠিক কি বলা উচিৎ তাই নিয়ে প্রচন্ড দ্বন্দের খেলা চলছে মস্তিষ্কে। মিন্মি আরো বেশি উৎকন্ঠী হয়ে বললো,,
“” আপনার আর রিপ্তির মধ্যে তো আমার আসার কথা ছিলো না। তবুও কেন এলাম? হয় তো সৃষ্টিকর্তা চান আপনার আড়ালে থাকা অপ্রকাশিত কারণটা কেউ জানুক। আর সেটা আমি!””
মহসীন দুর্বলতা অনুভব করছে। এক অদৃশ্য দুর্বলতা। সামনে থাকা এই মেয়েটির উপর। বয়সে রিপ্তির কাছাকাছি হবে কিন্তু!
মহসীন আর নতুন ভাবনায় ডুব দিতে পারল না। পেছন ঘুরে দাড়ালো। এককদম সামনে এগুলে,অজান্তেই কন্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে এলো,,
“” আমি একজন অসম্পূর্ণ,অসামর্থ্য,ত্রুটিপূর্ণ পুরুষ!””
মিন্মির দ্রুত উৎসুকপূর্ণ প্রশ্ন,,
“” আমি বুঝতে পারছিনা। আপনার মধ্যে কিসের ত্রুটি?””
মহসীন চোখ বন্ধ করে দম আটকে বললো,,
“” আমি কখনোই জন্মদাতা হতে পারবো না।””
চলবে