ভালোবাসায়_ভেজা_সধ্যে,পর্ব (৩৩)

#ভালোবাসায়_ভেজা_সধ্যে,পর্ব (৩৩)
#রোকসানা_রাহমান

প্রচন্ড বল প্রয়োগে দরজা লাগানোর শব্দে খানিকটা কেঁপে উঠে মহসীন। সে এতক্ষণ রুপ্তির রুমেই পাথরের মূর্তি ন্যায় দাড়িয়ে ছিলো। সে চাইলেই রিপ্তিকে আটকাতে পারতো কিন্তু করেনি। ইচ্ছে করেই করেনি। কারণ মেয়েটাকে রাগাতেইতো ক্ষনিকের জন্য অভিনেতা সেজেছিলো। জীবনের প্রথম অভিনয়টা এতো নিখুত হবে ভাবতে পারেনি। রিপ্তি বেরিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলো মহসীন। অন্ধকারে কল্পনাশক্তিতে যেন অনুভবকে আঘাত করার দৃশ্যটা উপভোগ করছিলো। কেমন ছিলো সেই উপভোগ্যতা? কঠিন,নির্মম,নাকি শোচনীয়!

মহসীন আর পাথর হয়ে থাকতে পারেনা। ছুটে যায় বসার রুমে। রিপ্তি কাঁদছে,চিৎকার করে কাঁদছে। তবে সেই চিৎকার ধ্বনিটা একমাত্র মহসীনই কর্ণপাত করতে পারছে। নিজের মনোঃকর্ণ দ্বারা!

মেয়েটা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে অশ্রুধারা বয়িয়ে চলেছিলো। ধীরগতিতে মাটিতে বসে পড়তেই মহসীন সামনে এসে বললো,,

“” তোমার বাবার প্রতি অনুভবের ভক্তি কেমন ছিলো, নিশ্চয় তুমি দেখেছিলে? উনার মতো নাহলেও কিছুটা ভক্তি আমাকেও করে। বুঝলে?””

রিপ্তির কান্নার গতি কমে আসছে। নিজেকে শান্ত করতে যথেষ্ট ব্যস্ত। মহসীনও রিপ্তির সামনে বসে পড়ে। ম্লান হেসে বললো,,,

“” তুমি আসলেই আমার অভিনয়টা ধরতে পারোনি?””

রিপ্তি দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিচ্ছিলো। ভিজে গালদুটো শুকিয়ে নেওয়ার কত তাড়া! সম্পূর্ণ করার মাঝেই মহসীনের দিকে তাকায়। বাধ্য হয়েই তাকিয়েছে। কপালে সন্দেহিভাব ফুটে উঠছে। মহসীনও খানিকটা সন্দেহ নিয়েই বললো,,

“” অনুভবের সম্বোন্ধে তোমার ধারণা কেমন আমি জানিনা। তবে এতটুকু ধারণাতো আছে যে একজন শিক্ষকের শরীরে হাত তুলার মতো চরম বেয়াদবী সে করতে পারেনা তাইনা?””

রিপ্তি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। মহসীন সামান্য হেসে বললো,,

“” আমাকে ব্যবহার করে মনের রাগটা মেটালে। তুমি তো খুব চালাক হয়ে গিয়েছো রজনীগন্ধা!””

রিপ্তি অসস্থিবোধ করছে সাথে লজ্জা। মহসীনের সামনে থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ায়। সামনে দু’কদম রাখতেই বাধা পেলো। ওর ডান হাতটা মহসীনের হাতে বন্দী হয়ে গিয়েছে। রিপ্তি থমকে যেতে বাধ্য। কিন্তু পেছনে ঘুরে মহসীনের চোখে চোখ রাখতে সাহস পাচ্ছেনা। সে যে ধরা পড়েছে!

মহসীন রিপ্তির হাতে অনুভবের দেওয়া চিঠিটা রেখে বললো,,

“” এটা তোমার জন্য। অনুভব দিয়েছে। থাপ্পড়ে থাপ্পড়ে নিজের মধ্যে চেপে রাখা রাগগুলো তো বের করেছো। এবার সন্দেহ আর অভিমান দুর করার পালা।””

রিপ্তির বিস্ময়দৃষ্টি উপেক্ষা করে,নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মহসীন। চলতি পথেই হঠাৎ করে বললো,,

“” তোমার কখনো আমাকে মারতে ইচ্ছে হয়নি,রজনীগন্ধা? আমিও তো তোমাকে ঠকিয়েছিলাম!””

নিজের কথা শেষ করে মহসীন থামেনা। অপেক্ষা করেনা রিপ্তির উত্তরের। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুজে নেয়। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বলে,হয়তো বয়সের মতো তার অনুভূতিগুলোও কিশোরী ছিলো,যা শুধু কষ্ট তৈরী করতে সমর্থন হয়েছিলো রাগনামক শব্দটা তখনো বহুদুরে!

~~~
দেয়াল ঘড়িটার চাপা টিক টিক টিক শব্দটাতেও বিরক্ত হচ্ছে রিপ্তি। এভাবে ঘুমছাড়া চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে থাকা যায়? রিপ্তি উঠে বসে। ঘড়ির দিকে তাকায়,এখন আর শব্দটা পাচ্ছেনা। তবে সময় দেখে নিলো ৩টা বেজে ২০ মিনিট। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ পড়ে পাশের টেবিলল্যাম্পের সামনে পড়ে থাকা ভাজ করা কাগজটির উপর। হ্যা,এটাই অনুভবের দেওয়া চিঠিটা। রিপ্তি এখনো পড়েনি। আর পড়বেওনা এমন দৃঢ় সংকল্প নিয়েই বিছানায় শুয়েছিলো। প্রায় দু’বছর সময় নিয়ে কি এমন চিঠি লিখেছে উনি? যা খুশি তাই লিখুক। আমি পড়বোনা, কখনোই না। এমন ঠকবাজ,বিষাক্ত ব্যাঙের চিঠি পড়া মানে আবার নতুন করে বিষের বিজ বোনা। যেটা আমি করতে চাই না। ইচ্ছে তো করছে চিঠিটাকে ছিড়ে ফালা-ফালা করে অনুভবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতে,গুনে বলো তো কত টুকরো করেছি!

মানবজাতীর দুটো অদ্ভুত রোগ হলো,করবেনা-করবে না করেও করে ফেলা। আর করবো-করবো করে মুখে ফ্যানা তুলে করতে না পারা! এই দুটো রোগকে শুধু অদ্ভুত নয়,সাধারণ রোগের মধ্যেও ফেলা যায়। কারণ এমনটা প্রায় লোকের মধ্যেই বিদ্যমান। তাদের মধ্যে অন্যতম রোগি হিসেবে রিপ্তিও আছে। এই মুহুর্তে সে করবে না-করবেনা-করেও-করে ফেলা রোগে ভুগছে। নিজের গাঢ় সংকল্পকে ভুলে গিয়ে অনুভবের চিঠিটা তুলে নিলো। ল্যাম্পের আবছা আলোটা পছন্দ হলো না তাই রুমভর্তি সাদা আলোয় আলোকিত করতে পারা লাইটটা জ্বেলে নিলো। চিঠি খুলার আগেই বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গিয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ,চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ছে। একটা অদৃশ্য বাধা পাচ্ছে সাথে উত্তজনার প্রবল আগ্রহ। কোনটা কোনদিক থেকে ধেয়ে আসছে সেটা বুঝার ক্ষমতাটাও রিপ্তি হারিয়েছে। সময় নিয়ে বেশ কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিলো। তবুও কাগজের ভাজ খুলতে পারলো না। এভাবে আর কতক্ষণ? এই চিঠি না পড়া পর্যন্ত তার যে ঘুম আসবে না এটা সে নিশ্চিত। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে ছুট লাগায় মহসীনের রুমের দিকে। তাকে সাথে পেলে সাহসটা তরতর করে বেড়ে যাবে।

~~~
আজ ঘুমের রাজ্যে যে মহসীনেরও পা পড়েনি। তবে ঘুমানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলো। রিপ্তিকে দৌড়ে আসতে দেখে মহসীন তড়িঘড়িতে উঠে পড়ে। সঙ্কিতকন্ঠে বললো,,

“” কি হয়েছে,রিপ্তি? ভয় পেয়েছো? খারাপ স্বপ্ন…””
“” আমি পড়বো, তুমি শুনবে।””
“” মানে?””

রিপ্তি মহসীনের কাছ ঘেষে বসে। দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললো,,

“” না,তুমি পড়বে আমি শুনবো।””
“” আমি কিছু বুঝতে পারছিনা রিপ্তি!””

রিপ্তির মুঠোয় থাকা চিঠিটা মহসীনের কোলে ছুড়ে মারে। দ্রুত বলে,,

“” পড়তে সাহস পাচ্ছিনা। কেমন জানি আতঙ্ক অনুভব করছি। মনে হচ্ছে..””

মহসীন রিপ্তির পাশ থেকে উঠে পড়ে। এ বাসায় দুজন একসাথে থাকছে একবছরেরও বেশি। কিন্তু এই প্রথম নিজের রুমে রিপ্তির পদস্পর্শ পেলো। কার জন্য? নিজের মনের প্রশ্ন হেলায় ফেলে আপত্তির সুর ছাড়ে,,

“” ওটা তোমার জন্য। তোমার ব্যক্তিগত চিঠি আমি কেন পড়বো?””
“” আমি তো বলেছি পড়তে।””
“” এটা দৃষ্টিকটু রিপ্তি।””

রিপ্তির মন খারাপ হয়। মুখটা ছোট করে চলে যেতে চায়। কিন্তু যায় না। মৃদুসুরে বলে,,

“” তোমার পাশে থেকে পড়ি?””

মহসীনের থমকানো দৃষ্টি। মৃদু হেঁসে বললো,,

“” আচ্ছা। তবে মনে মনে!””

রিপ্তির মুখের আধার কেটে যায়। মহসীনকে টেনে বিছানায় বসিয়ে নেয়। একপলক মহসীনের দিকে তাকিয়ে চিঠির ভাজ খুলতে শুরু করেছে। কৌতুহলিদৃষ্টি সাদা কাগজে কালো রঙে বিন্যাসিত লেখার উপর।

মায়াকন্যা,

চিঠির শুরু করার নাটকীয় সংলাপগুলো কেটে নিচ্ছি। তোমাকে অনেককিছু বলার আছে। যে বলা শেষ হওয়ার নয়। আর এই ‘শেষ হওয়া নয় বলা’ কথাগুলো কি এক পৃষ্ঠার কাগজে লিখে শেষ করা যায়? ইচ্ছেতো করছে তোমাকে সামনে বসিয়ে আমার জমিয়ে থাকা,মরিচা পড়া ট্যাপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দেই!

প্রথমেই তোমার সামনে দুটি ঘটনা তুলে ধরছি। ধর্মীয় ঘটনা। তুমি হয়তো এগুলো শুনেছো অথবা ইসলামিক কিতাবে পড়েছো। মনোযোগ সহকারে পড়ো,প্লিজ!

ঘটনা এক-১ঃ পৃথিবীর মানবজাতির মধ্যে শুধু একজনই ছিলেন,যিনি নিজের মৃত্যুকাল সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি হলেন আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)। উনার পৃথিবীতে আয়ুষ্কাল ছিলো এক হাজার বৎসর। আল্লাহরসহিত কথপোকথনের এক পর্যায়ে উনি জানতে পারেন,উনার পুত্র দাউদ (আঃ) এর পৃথিবীতে মাত্র চল্লিশ বছরের আয়ুষ্কাল নিয়ে আসবেন। এটা জানার পর উনি খুব হতাশ হোন ও আকুল আবেদন জানান,তাঁর জীবিতকাল থেকে ষাট বছর যেন উনার পুত্র দাউদ (আঃ) কে দিয়ে দেন। এই ঘটনার বহুবছর পর,যখন আদম (আঃ) এর জীবনকাল নয়শত চল্লিশ বছর শেষ হয়,তখন মালাকুল মাউত আসেন উনার রূহ নিতে। কিন্তু আদম (আঃ) সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন রূহ দিতে। বলেন,তাঁর জীবনকালের আরো ষাট বছর বাকি আছে। আল্লাহ তা’আলা তো তাকে এক হাজার বৎসর দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমাদের আদিপিতা পূর্বে সন্তানকে দেওয়া ষাট বছরের ঘটনা ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই আমরা তাঁর বংশধর হিসেবে দৈনন্দিন জীবনে হাজারও ঘটনা ভুলে যায়।

ঘটনা দুই-২ঃ হযরত ইউসুফ (আঃ) জুলেখা সম্পর্কিত এক নির্মম কারণে কারাগারে বন্দী হোন। সেখানে উল্লেখযোগ্য দুজন কয়েদি ইরানুস ও আপুপিসের সাথে তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। এক রাত্রিতে কয়েদি দুজন একি সময়ে দুটি ভিন্ন খোয়াব দেখে। তাদের সেই খোয়াবের ব্যাখ্যা দিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)। বলাবাহুল্য খোয়াবের ব্যাখ্যা দেওয়ার এক অলৌকিক ইলমের অধিকারী ছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)। তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যাসহিত হুবহু মিলে যায় কয়েদি দুজনের বাস্তবতার। কারাগার থেকে মুক্তিলাভ ও ইউসুফ (আঃ) এর খোয়াবের ব্যাখ্যায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ইরানুস একটি ওয়াদাবদ্ধ হয়। ইউসুফ (আঃ) কে আশ্বাস করে,তৎকালিন বাদশা আমেন হোতেমের কাছে তাঁর কথা বলবে। জানাবে তার নির্দোষতার কথা। কিন্তু ইরানুস নিজের ওয়াদার কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। মনে পড়তে সময় লাগে প্রায় সাত বছর। এর বিশেষ ব্যাখ্যা অনেকটা এমন রূপ,ঐ সাত বছর কারাগারেই ইউসুফ(আঃ) এর প্রয়োজন ছিলো। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিলো কোনো এক শুভক্ষণে উনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করবেন। পরবর্তীতে এমনই হয়েছিলো।

এবার আসি মূল কথায়,

রিপ্তি,আমি তোমার চিঠি পড়েছি। ঐ কয়েকটি লাইনে তোমার তীব্র ঘৃণার থেকেও গাঢ় অভিমানির গন্ধটা বেশি পেয়েছি। তুমি আমার ভালোবাসায় ভেজা সন্ধ্যেকে ভুলের সন্ধ্যা বলে আখ্যায়িত করেছো সাথে অন্যায় দাবী করে আমাকে প্রতারক,ঠকবাজ বলে সম্বোধন করেছো। এটা কতটুকু যথার্থ আমি তা বলবো না। তবে একটা কথা বলবো,তোমার কথিতবাক্য ছিলো,পৃথিবীর সবথেকে সুখকর মুহুর্তটা উপভোগ কখনোই অচেতনে হয়না। এই ব্যাপারেও আমার কোনো বিপরীত কথা নেই। তবে একটা ছোট্ট লাইন বলছি,সেই মুহুর্তটা আমার কাছে হঠাৎ পাওয়া লোভনীয় ছিলো যার সামনে আমি ঝুকতে বাধ্য হয়েছি। কারণ পৃথিবীর একমাত্র তুমিই সে মেয়ে যাকে সর্বদা আমার কাছে লোভনীয় মনে হয়েছে আর হবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত!

সেদিনের সেই আকস্মিক,অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর তুমি ক্যাম্পাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলে। কেন? লজ্জাকর পরিস্থিতি স্বীকার হওয়ার ভয়ে? কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি প্রতিদিন ইউনিভর্সিটির মূল ফটকে তোমার অপেক্ষারত ছিলাম। আমার দুচোখ শুধু তোমাকে দেখার পণ করেছিলো। তুমি আমার পণ ভেঙে দিলে,দেখাই দিলেনা। একদিন,দুদিন,তিনদিন পার হওয়ার পরও যখন তুমি এলেনা তখন ঠিক করলাম,তোমার বাড়ি গিয়ে লজ্জা ভাঙবো। ট্রেণেও উঠে পড়ি। তবে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এসেছিলাম। আমার মনে অন্য ঘন্টার ধ্বনি বাজছিলো। মনে হচ্ছিলো শুধুই কি লজ্জায় আমার সামনে আসছো না,নাকি অন্যকিছু? ঠিক তখনি ঠিক করে ফেলি তোমার লজ্জা এবং অন্যকিছুকে একত্রে পিষে দিয়ে একদল বয়যাত্রী নিয়ে তোমার হাজির হবো। দুঃখের বিষয়, ভাগ্য আমার সহায় হলোনা। ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেলো লিনার দিকে।

লিনা আমার ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো বলতে পারো। আমাদের বাড়িতে ওর খোলামেলা যাওয়া আসা ছিলো। আর সেই সুবাদে আমার ছোট ভাই অনিকের সাথে ওর সম্পর্ক হয়। তবে সেটা প্রেমের দিকে চলে যায়। পুরোটাই আমার অগোচরে চলছিলো। ওদের সম্পর্কটা যখন আমার সামনে আসে তখন লিনা তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা! সংবাদটা পেয়ে আমার মাথা পুরো নষ্ট। কারণ,অনিক তখন দেশে নেই। পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে। লিনার প্রসঙ্গে কথা তুললে ও সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে। কড়া করে বলে,তাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আমি পুরো দিশাহারা। ভাইকে বিশ্বাস করবো নাকি বন্ধুকে। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিলো। একদিকে তুমি আরেকদিকে লিনা। দুদিক সামলিয়ে উঠতে আমি হিমশিমিয়ে উঠছিলাম। তারমধ্যেই লিনা আমার হাতে-পায়ে ধরে বলে,”অনুভব কিছু করো নাহলে আমায় কিছু করতে হবে!” ততদিনে ওর পরিবার,আমার পরিবারও জেনে গিয়েছে। যেহেতু ওর আর আমার মেলামেশা অনেকটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো সেই সুত্রধরে দুই পরিবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার উপর আঙুল তুলছে। অনিক তো আমার সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দিলো। দিনকে দিন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপধারণ করছিলো। একসময় বাধ্য হয়ে লিনাকে বিয়ে করি। কারণ,আমার অনিকের সাথে সামনাসামনি কথা বলার প্রয়োজন ছিলো। লিনার যে অবস্থা ওকে তো সাথে করে নিতে পারবো না আর রেখেও যেতে পারবো না। শুধুমাত্র লিনার সিকিউরিটির জন্য বিয়ে করেছিলাম। পরবর্তীতে অনিকের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। কথা কাটাকাটি,শাসন,রাগ সব মিলেমিশে এক হয়ে যেতেই ও সবটা স্বীকার করে। আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই। ভাই আমার ঘাবড়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড ভয় থেকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অস্বীকার করেছিলো। ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ লিনা ওর থেকে তিন বছরের বড়! বাকিটা তুমি বুঝে নিও।

মায়াকন্যা,তোমাকে মিথ্যে বলবো না। লিনাকে নিয়ে আমি এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে,তোমার কথা একটিবারের জন্যও মনে পড়েনি। হ্যা,ঐ চারটা মাস আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন? যে মেয়েটাকে একদিন দেখতে না পেলেই নানা অযুহাত নিয়ে বারংবার তার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছি,সেই মেয়েটাকে পুরো চারটা মাস ভুলে থাকলাম কি করে? কি করে এটা সম্ভব হলো? তখনি আমার সামনে উপরোক্ত দু’টো ঘটনা উত্তর হিসেবে ভেসে আসে। আমিও আদম (আঃ) এর সন্তান তাই হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম। আবার ইউসুফ (আঃ) এর মতো ঐ সময়টা আমাকে লিনার প্রয়োজন ছিলো। সেই সময়ে একবিন্দুও যদি তোমার কথা মাথায় আসতো তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি,আমি একজন কঠিন স্বার্থবাদী মানুষ হতাম। ফিরেও তাকাতাম না লিনার দিকে। আমার কথাগুলো কি হাস্যকর মনে হচ্ছে? হওয়ারই কথা,কোথায় উনারা আর কোথায় আমি। তুলনা তো সমানে সমানে হয়! তবুও এই অযৌক্তিত,কাকতালীয় ব্যাখ্যাটা তোমাকে দিতে ইচ্ছে হলো!

চার মাসবাদে সেদিন হসপিটালে তোমার দেখা পেয়েছিলাম,এক ঝলক। কিন্তু তুমি কি জানো, তোমার সেই একঝলক দেখা আমার সব চুরমার করে দিয়েছিলো? নিজের দুরূহ পরিণতি আমাকে পুরো উন্মাদ করে দিয়েছিলো। হন্ন হয়ে তোমাকে খুজেছি। পাগলের মতো বারবার ছুটে গিয়েছি তোমার বাসায়। একটিবার তোমার সাথে দেখা করবো বলে। কিন্তু তুমি? তুমি আমাকে রেখে পালিয়ে গেলে। যদিও তোমার ভাবী আমাকে বলেছিলো তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি বিশ্বাস করিনি। হয়তো বিশ্বাস করার মতো মিনিমান জ্ঞানবোধটাও আমার ছিলোনা। তোমাকে কোথায় কোথায় খুজিনি বলো,তোমার ফ্রেন্ড রুবিনার পিছুও তো নিয়েছিলাম। তুমি সেখান থেকেও পালালে। কেন এমন করলে? ভুল করি বা অন্যায়,শাস্তিটা কি সামনাসামনি থেকে দিতে পারলে না?

রিপ্তি,তোমার কি মনে হয় না আমি আমার ভুলের শাস্তি পেয়েছি? তোমার বাবাকে আমি কতটা শ্রদ্ধা করতাম তুমি কি জানোনা? সেই মানুষটাকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি। ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ পাইনি,সারাটা জীবন আমি উনার কাছে একজন ঠকবাজ,বিশ্বাসঘাতক হয়ে থাকবো। তোমার ভাই,আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। সেই সম্পর্কটাও এখন আর নেই। আমার আরেকজন প্রিয়শিক্ষক,বর্তমানে তুমি যার আশ্রয়ে আছো তার সামনেও মাথা নত হয়ে থাকতে হবে। আর তুমি? তুমিহীনা দু’টো বছর কাটিয়েও যে এখনো আমি বেঁচে আছি সেটাই কি হেলাফেলা করার মতো? এতোকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে বলবো,তোমার যদি মনে হয় আমার আরো শাস্তি পাওয়া উচিত তাহলে দাও। আমি নিজেকে সমর্পণ করবো। শুধু একটাই অনুরোধ,তুমিহীনা আমাকে আর একটা রাতও কাটাতে দিওনা! আমি হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেহায়া,নির্লজ্জ যে কিনা এতো কিছুর পরও তোমাকে নিজের করে পেতে চাচ্ছে। বাঁচিয়ে নিবে তো আমায়?

ইতি

তোমার অপ্রিয়

পুনশ্চঃ

১. লিনার সন্তান পৃথিবীতে আসার দুই মাসের মাথায় তার জন্মদাতা, আমার ভাই বাংলাদেশে আসে। বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়েই দুজন নতুন সংসাী পেতেছে।
২. আমাদের ভুলের পবিত্র ফুলটি আমার কাছেই সযত্নে আছে। এখনো কোনো নাম ঠিক করিনি।
৩. মহসীন স্যারের অনুরূপ সেজেছিলাম তোমাকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য নয়। যে বিষয়টা লুকিয়ে রেখেও নিজেকে উন্মোক্ত করতে পারছিলে না সেই বিষয়টা তোমার সামনে তুলে ধরে তোমাকে উন্মোক্ত করতে চেয়েছিলাম। যাতে প্রতি পদে পদে অতীতকে টেক্কা দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারো।
৪. আদম (আঃ) ভুলে গিয়ে কিন্তু ষাট বছর বাঁচার সুযোগ পেয়েছিলেন,তাহলে কি আমিও তোমাকে পাওয়ার আশা রাখতে পারিনা? ইউসুফ (আঃ) এর মতো হয়তো আমার জীবনেও স্বর্ণসময় আসবে,আর সেটা তুমি!

চলবে

[ এক চিঠিতে সব রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছি। যদি আরো কিছু বাদ থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে। হয়তো আমি লিখতে লিখতে ভুলে গিয়েছি🙈 উপরোক্ত ঘটনা দুটোতে ভুল থাকলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here