ভাবী_যখন_বউ
পর্ব_১৩
Syed_Redwan
পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে নিজের সাথে সাথে রাইফাকেও বিবস্ত্র অবস্থায় আবিষ্কার করি। মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ে যায় গতরাতের কথা। আমি গতরাতের সব ঘটনাই আবছা আবছা মনে করতে পারছি। আমার এই মুহূর্তে প্রচন্ড রাগ উঠছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না যে রাগটা ঠিক কার বা কীসের উপর হচ্ছে। খালি এইটুকুই বুঝতে পারছি যে আমার প্রচুর রাগ উঠছে। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি যে রাগটা রাইফার উপর উঠেনি। কারণ ওর উপর আমি সচরাচরই রেগে যেতাম। তাই এখনও রাগটা ওর উপর উঠলে আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু ওর প্রতি আমি রাগ অনুভব করছি না। তাহলে কি রাগটা আমার নিজের প্রতিই?
আমি এবার রাইফার মুখের দিকে তাকালাম। আমার বুকে একেবারে গুটিসুটি মেরে বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ লাগছে ওকে দেখতে! কে বলবে যে এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটাই গতরাতে কী তুলকালাম কান্ডটাই না করেছে! আমি জানি না কী হলো আমার ঠিক, আমি সম্পূর্ণভাবে ওর উপর রাগতেও পারছি না।
আচ্ছা, গতরাতে যা হয়েছে, সেটার জন্য কি রাইফাই একমাত্র দায়ী, একমাত্র দোষী? আমার কি কোন ভূমিকাই নেই সেটাতে? আমি কি চাইলে পারতাম না সেটা রোধ করতে? জানি, সে পানির সাথে হয়তো কিছু উল্টাপাল্টা মিশিয়েছিল। কিন্তু তবুও আমার মনে হয় যে আমি চাইলে ওকে আটকাতে পারতাম। কিন্তু কীভাবে? আমার নিজেরও কি মন চাইছিল ওকে কাছে পেতে? ধুর! এত সকালে এসব চিন্তায় মেজাজ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আর তাছাড়াও এতকিছু এখন আর ভেবে বিশেষ কোন লাভ নেই। কারণ গতরাতের ঘটনা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। সেটাকে মেনে নিতেই হবে, হোক সেটা আমার ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়।
কিছুক্ষণ পরই রাইফার ঘুম ভেঙে গেল। ও আমার জাগ্রত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। পরক্ষণে যে-ই ওর মনে পড়লো আসল ব্যাপারটা, ওর মুখ লজ্জায় একেবারেই লাল হয়ে গেল। ও এক লাফে আমার বুক থেকে উঠে বিছানার ওপর থেকে নিজের কাপড়গুলো নিয়ে যে-ই নামতে যাবে, ওমনি আমি খপ করে ওর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে পুনরায় নিজের বুকে নিয়ে আসলাম। ব্যাপারটা কিন্তু অনেক সিরিয়াস। তবুও আমার কেন জানি হাসি পাচ্ছে। কোনমতে নিজের মুখে এক কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে তুলে ওকে কড়া গলায় বললাম,
“গতকাল রাতে যা করেছ তুমি, সেটার কিন্তু কোন ক্ষমাই নেই। তাহলে কীভাবে তুমি ভাবলে যে শাস্তি না পেয়েই এভাবে পালিয়ে যেতে পারবে তুমি?”
প্রথমবারের মতো রাইফা কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বলল,
“আমি কী করতাম বলো? তুমি জানো না আমি তোমাকে কত বছর ধরে ভালোবাসি? জানো না কতটা ভালোবাসি তোমায় আমি? শেষমেশ তোমায় পেয়েছি আমি বহু সাধনা করে। কিন্তু মাঝখানে বেঁধে যায় ঝামেলা; আমাকে তুমি খুনী ভেবে বসো তুমি। এরপর তোমার কথামতোই আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করি। শর্ত মোতাবেক কথা ছিল আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে তুমি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে। কিন্তু তুমি সেটা করোনি, শর্তভঙ্গ করেছ। তাই আমি বাধ্য হয়েছি এমনটা করতে।”
আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম,
“আর কিছুটা দিন অপেক্ষা করতে পারতে না তুমি? গতকাল ভাইয়ার খুন যেই ট্রাকচালক করেছে, তাকে ধরতে পেরেছি। আমার ভাইয়ার আসল খুনীকেও তো ধরে ফেলবো আমি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ততদিন অপেক্ষা করলে কী হতো, যে গতকালই সবকিছু জোর করে করেই ফেললে?”
আমার কথায় এবার রাইফা আরো ভয় পাবার বদলে উল্টো নিজে রেগে গিয়ে আমার গলা হালকা চেপে ধরে বলে উঠে,
“যথেষ্ট হয়েছে! কী ভাবো তুমি নিজেকে? তুমি নিজেই কি সবকিছু পারো, বুঝো, এটাই? আমি কিছু করি না, কিছুই বুঝিনা, এমনটাই কি ধারণা তোমার আমার প্রতি? হা হা হা! যদি তাই ভেবে থাকো তুমি, তাহলে আমি বলব, তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ মিস্টার রেড!”
ওর কাছ থেকে আচমকাই এরকম রেসপন্স আমি আশা করিনি। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে আরো বলল,
“ভুলে যাবে না যে তোমার ভাই মানে আমার ভাসুর শুধু একাই খুন হননি, বরং আমার প্রাণের বান্ধবী, আমার বেস্টফ্রেন্ড, আমার বোন সমতুল্য একজনও কিন্তু খুন হয়েছে। তোমার কী মনে হয়, সেসব আমি এমনি এমনি ভুলে যাব? আমার নিজের মধ্যেও কি প্রতিহিংসাপরায়ণতা কাজ করে না? এতটাই অকর্মণ্য ভাবো তুমি আমাকে?”
“হিসাবটা তুমি নিজেই সহজ করে দিলে। রিফাত ভাইয়া ছাড়াও তোমার বান্ধবী, অর্থাৎ স্নিগ্ধা ভাবীকেও কেও খুন করেছে। তাহলে তুমি এতকিছুর মধ্যেও কীভাবে ফিজিক্যাল ইন্টারকোর্সের কথা ভাবতে পারো? তুমি কি সাইকো, নাকি অন্যকিছু? স্বাভাবিক মানুষ মনে হচ্ছে না আমার তোমাকে এই মুহূর্তে।”
আমার কথা শুনে রাইফা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“তুমি কি এটা খেয়াল করেছ যে আমি গতকাল রাতে আগেভাগেই বুঝে গিয়েছিলাম যে তুমি কিছুটা আহত?”
“হুম।”
“একবারও জানতে ইচ্ছে হয়নি কি যে আমি কীভাবে এসব জানলাম আগেভাগেই?”
“না, খেয়াল ছিল না। কীভাবে জানলে তুমি?”
“সেটা আমি আর বলব না। তাছাড়া আরো অনেককিছুই আছে যেটা তুমি জানো না। হয়তো তুমি ভালো ছাত্রই খালি। কিন্তু বুদ্ধির দিক দিয়ে আমি নিঃসন্দেহে তোমার চেয়ে অনেক বেশিই এগিয়ে আছি🙂।”
আমি এবার ওকে চেপে ধরে বললাম,
“তাই, না? তাহলে সবকিছু যে আমিই করি আর তুমি খালি বাসায় বসে থাকো, সেটা কী? সবকিছু আমি নিজে ভেবেচিন্তে করে যাচ্ছি, বুঝলে? তোমার কোন অবদানই নেই এসবকিছুতে। তুমি খালি পারো বাসায় বসে থাকতে হাত-পা গুটিয়ে, আর জোর করে আমার কাছ থেকে অধিকার খাটিয়ে নিতে। আমি গতরাতের জন্য তোমার সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করিনি বলে এটা ভেবো না যে আমিও নিজেও খুব উপভোগ করেছি। নিজের স্ত্রী আমাকে কাছে পেতে চেয়েছে আর এই কারণে আমি তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি, তার গায়ে হাত তুলেছি, এটা নিতান্তই একটা কাপুরুষের কাজ বলে মনে হয় আমার কাছে। তাই কিছু বললাম পর্যন্ত না তোমাকে। তবে আশা করব এমনটা আর জোর করে কখনো তুমি করবে না।”
আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই রাইফা বাথরুমে ঢুকে পড়ে কাপড়চোপড় নিয়ে। দরজা আটকানোর আগে বলে,
“ওই খুনী ট্রাকচালকের মৃত্যুদণ্ড আগামী ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই কার্যকর হবে। আমি তো যাবোই নিজের বান্ধবীর খুনীর শাস্তি নিজের চোখে দেখতে। তুমি যদি আসতে চাও, আসতে পারো।”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
“তুমি এতসব কীভাবে জানো?”
বিনিময়ে রাইফা কোন উত্তর না দিয়ে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বাথরুমের দরজা আটকে দিল।
সত্যি তো! ও কীভাবে এতসব জানে? আমার মাথায়ই আসছে না এসবের কিছুই। ও নিজেও কি আমার মতই নিজের প্রিয় বান্ধবীর জন্য একই খুনের ঘটনার তদন্ত করছে? কিন্তু কীভাবে আর কখনই বা করছে? আমি তো খেয়াল করিনি। ওকে জিজ্ঞেস করা লাগবে এই সম্পর্কে।
আমি সেদিন ওকে অনেকবারই জিজ্ঞেস করি যে ও এইসব কীভাবে জানে। কিন্তু বিনিময়ে ও এমন কথাই বলে,
“এতদিন যেহেতু জানতে চাওনি কিংবা ভাবতেও পারোনি যে আমি কী কী করতে পারি, তাই আপাতত আর তোমার কষ্ট করে এটাও জানা লাগবে না। তুমি নিজেই তদন্ত করতে থাকো। আর আমি নিজের রাস্তা তো দেখছিই।”
আমিও আর কথা বাড়াইনি এই ব্যাপারে। মেয়েটা কতদিন আর লুকোবে নিজের রহস্যটা আমার কাছ থেকে সেটা আমিও দেখে নিব।
কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ও ঘুমিয়ে গেলে আমি ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ওর ফোনের লক খুলে গ্যালারি, ম্যাসেজ, কললিস্ট, মেসেঞ্জার সবকিছু ঘেঁটেও কিচ্ছুটি পাই না ওর ব্যাপারে আলাদা করে কিছু জানার। সব জায়গায় ওর নিজের বান্ধবীদের নম্বর কিংবা পরিবারের লোকজনদের নম্বর, তাদের সাথেই সকল আলাপ তার এবং ম্যাসেজ কিংবা ফোনকলেও সন্দেহজনক কোন কথা বলার রেকর্ড ওর ফোনে নেই। হয়তো এই ধূর্ত মেয়েটা সন্দেহজনক নম্বর কিংবা ম্যাসেজ কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই ডিলিট করে দেয়।
আমি রাতেও ওর প্রতি খেয়াল রেখে দেখেছি যে ও কার সাথে কথা বলে কিংবা আসলে ঠিক কী করে এটা জানার জন্য কিন্তু বিধি বাম! ওর কোনকিছুতেই সন্দেহজনক কিছু পাই না আমি। হয়তো একান্তই আমার আড়ালে ও কোনকিছু করে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে। নয়তো এতসব কীভাবে জানে ও?
এভাবে প্রায় তিনদিন চলে যায় কিন্তু আমি না নিজের ভাই-ভাবীর খুনের আসল আসামীকে ধরার কোন ক্লু পাই, না রাইফার রহস্যের কোন কিনারা পাই। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে যাই। তাই ঠিক তিনদিনের মাথায়ই নিজের ব্যর্থতার দরুনই হোক বা রাগের বশেই হোক, রাতে খাওয়া শেষ করে রুমে আসার পর হুট করে রাইফাকে শক্ত করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরি। বেশ শক্ত করেই ধরি। ও আমার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করার পরও কোন কাজ না হওয়ায় শান্ত হয়ে যায়। তবে আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি যে ওর চোখে ব্যথা পাওয়ার দরুন পানি চলে এসেছে। তবুও মনটাকে কিছুটা পাথর বানিয়ে ওকে বলি,
“অনেক ভালোভাবে কথা বলেছি তোমার সাথে কিন্তু তুমি মানলে না। এবার ভালোয় ভালোয় একটা ভদ্র মেয়ের মতো বলে ফেলো দেখি তোমার এতকিছু জানার উৎসটা ঠিক কী? নয়তো তোমার সাথে আমি কী থেকে কী করে ফেলি রাগের মাথায় আমি নিজেও কিছু জানি না।”
আমার কথা শুনে রাইফা ব্যথা পাওয়ার মাঝখানেও উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“তুমি এছাড়া আর করতেই বা কী পারবে বলো তো? আমাকে সর্বোচ্চ আরো কষ্ট দিবে? ধরে নিলাম যে মেরেই ফেলবে আমাকে একেবারে জানেই। এর চেয়ে বেশি আর কিছুই কিন্তু তুমি আমার করতে পারবে না। মরার ভয় আমার নেই। আমাকে নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালোভাবেই চিনে গিয়েছ, বিশেষ করে আমার জেদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি সম্পূর্ণভাবে অবগত। আমি আজ পর্যন্ত যা যা চেয়েছি সবই হাসিল করে নিয়েছি, যেগুলোর মধ্যে তুমি নিজেও আছো। নিশ্চয়ই এটা অস্বীকার করতে পারো না তুমি। ঠিক একইভাবে আমাকে হাজারবার মেরেও তুমি আমার মুখ থেকে তোমার কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো এই মুহূর্তে বের করতে পারবে না।”
আমি রাইফাকে ছেড়ে দেই ওর কথাগুলো শুনে। তারপর নিম্নস্বরে বলি,
“বলো না আমাকে তোমার সিক্রেট কথাগুলো।”
“ছেড়ে দিলে কেন? এতটুকুতেই মন গলে গেল নাকি তোমার হুম?”
“প্লিজ বলো।”
“এসব তোমার জেনে কাজ নেই, বুঝলে? দরকার পড়লে সময় হলেই আমি তোমাকে সবকিছুই সময়মতো জানিয়ে দিব, কেমন?”
ওর সাথে আমার সম্পর্ক যতই গভীরতার দিকে ধাবিত হোক না কেন, এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি কোনদিনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারবো না। ওর কাজের কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। ও এমন কেন? আমার সাথে কেন সবকিছু শেয়ার করতে পারছে না। মানে চাচ্ছে না, কিন্তু কেন? আমি না ওর স্বামী হই? কিন্তু আমি নিজেও তো আমার তদন্তে ওকে আলাদা করে রেখেছি কোন কারণ ছাড়াই। ও যদি দোষী হতো বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তবে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু ও তে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে দিয়েছেই। তবুও তো ওর সাথে আমি ঘনিষ্ঠ হতে চাইনি, নিজের সবকিছু এমনকি তদন্ত পর্যন্ত আমি চালিয়ে গিয়েছি ওকে ছাড়াই। তাহলে এখন ও নিজেও যদি এমন করে আমার সাথে, তবে আমার মনে হয় না যে আমার ওকে আলাদা করে এই ব্যাপারে কোনকিছু বলার অধিকার আছে। কারণ ও তো কাছে আসতে চেয়েছিলই, আমিই তো ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম প্রথমে। সেই রাতে যা হয়েছিল সেটা সম্পর্কে কিছুই ভাবতে চাই না। জানি না কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে।
আমি বললাম,
“আচ্ছা। তবে আশা করি হানিকর কিছুই করবে না তুমি।”
রাইফা মুচকি হেসে বলল,
“সেই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো তুমি।”
“আই অ্যাম স্যরি। একটু আগে আমি তোমার সাথে খুবই বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি। আমি নিজেই তো তোমাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে সবকিছু বলি না। সেখানে তোমার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমার জানা আগ্রহ প্রকাশ করাটা অনধিকার চর্চাই বটে!”
“তুমি যদি চাও, তবে বাকি আট-দশটা স্বাভাবিক এবং সুন্দর সুখী দম্পত্তির মতো আমরাও ইন্টিমেট হতে পারি। তোমার সময় লাগবে আমি জানি, বিশেষ করে এই পরিস্থিতিতে। তবুও, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। আমার সাথেই তো তোমার নিজের জীবনটাকে চিরটা কাল কাটাতে হবে। তদন্তের ব্যস্ততার জন্য ধীরে ধীরেই না হয় হোক, তবে শুরুটা তো করতেই পারো এখন থেকে। তো, করবে কি?” বলে আমার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি খানিকক্ষণ ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে সবদিক ভেবে দেখলাম। ওর কথা সত্যিই বটে। তাছাড়া তদন্ত চলুক না নিজের মতো। ওকে কাছে পেলে তো আর তদন্তের কাজেরও কোন ক্ষতি হচ্ছে না। উপরন্তু ওর সাথেই আমাকে জীবন কাটাতে হবে। আমি যদি তদন্তের কাজের পাশাপাশি ওকেও সময় দেই, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি, তবে দোষটা কোথায়? এমনিতেও ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়ই হোক, ওকে আমি স্ত্রীর অধিকার দিয়ে দিয়েছি।
একমাসের কিছু সময় পরের ঘটনা,
আজ আমি আর রাইফা ওই ট্রাকচালক, আমার ভাইয়া আর ভাবীর ঘাতকটার মৃত্যু নিজেদের চোখে দেখে এলাম। নিজের ভেতরটাতে অনেক ভালো লাগছে। সত্যিই এমনই হয় বুঝি। নিজেদের প্রিয় মানুষের খুনীকে শাস্তি পেতে দেখলে সত্যি একরাশ এবং অবর্ণনীয় প্রশান্তি বয়ে যায় রুহের মধ্য দিয়ে। আমি আমার ভাইয়ের একজন খুনীর শাস্তি দেখতে পেলাম। এখন আমাকে এর মূল হোতার শেষ দেখে ছাড়তে হবে।
এই একমাসে আমি আর রাইফা অনেকটাই একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছি। জানি না ভালোবাসতে পেরেছি কিনা। তবে ওর প্রতি আর ঘৃণা কাজ করে না এখন আমার। সেদিনের পর থেকেই আমি আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করি। শারীরিক সম্পর্ক করার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, কথাটা হাস্যকর নয় কি? অবশ্যই, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ যারা এমন পরিস্থিতির মাধ্যমে যায়, তারাই কেবল বুঝতে পারে তাদের অবস্থাটা। বাকি দুনিয়ার মানুষের কাছে তাদের এই অবস্থার কথা চিরকালই হাস্যকর রয়ে যায়। তাদের এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি বোঝার সাধ্য অন্য কারো নেই বললেই চলে।
ও যে আমাকে ভালোবাসে, এতে আমার কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু আমি এখনও ঠিক জানি না ওকে কতটা ভালোবাসতে পেরেছি। তবে অন্তত আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি সেদিনের পর থেকে।
ও প্রতিদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। নয়তো আমি নিজেই নিজেকে সকালে ঘুম থেকে জেগে ওর বুকে আবিস্কার করি। ও আমার কাছে আসতে চাইলে আমি আর বাধা দেই না। নিজেরও মাঝেমধ্যে ওর কাছে যেতে ভালো লাগে, ওর স্পর্শ পেতে ভালো লাগে। আমরা এই একমাসে আরও দু’বার শারীরিকভাবে অন্তরঙ্গ হয়েছি। তবে জানি না যে এর মধ্যে ভালোবাসা ছিল ঠিক, নাকি ছিল ভালোবাসাহীন যৌন চাহিদাই শুধু। তবে ওর সংস্পর্শে আসতে আমার পরবর্তীতে যে আর খারাপ লাগেনি, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এখন মন থেকে ওর জন্য শুধুমাত্র ভালোবাসার উপলব্ধি আসাটাই বাকি।
এই একমাসেও আমি শত চেষ্টা করেও আসল খুনীকে বের করতে পারিনি। ওই খুনী ট্রাকচালকটাও মৃত্যুর আগেও বলতে পারেনি যে তাকে কে অর্ডার দিয়েছিল ভাইয়া-ভাবীকে খুন করার জন্য। তদন্তের কাজে অবশ্য আমি রাইফার কোন সাহায্য নেইনি জেদের বশেই। কারণ আমাদের মধ্যে বাকি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও এই একটা ব্যাপারে রেষারেষিটা রয়েই গিয়েছে। কারণ আমি যেমন জেদি, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি জেদি ও। ও কিছুতেই নিজের জ্ঞানের উৎপত্তি সম্বন্ধে মুখ খুলবে না।
তবে আমি আশ্বাস দিতে পারি, ওর জন্য কিংবা ওর সাথে আমি অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য আমাদের তদন্তের কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। আমি এগুতে পারছি না শত চেষ্টার পরও শুধুমাত্র একটা সূত্রের অভাবে, যেটা ধরে সামনে এগুতে পারি। অনেক চেষ্টা করেও পাচ্ছি না কোন সুরুক। তবে আমার বিশ্বাস, একজন খুনী যখন ধরা পড়ে শাস্তি পেয়েছে, আমার বিশ্বাস, বাকি খুনীও ধরা পড়বে এবং কৃতকর্মের শাস্তিও পাবে।
দু’দিন পর মাঝরাতে,
আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজ সারাদিন ভার্সিটিতে অনেক কাজ ছিল আমার। সেগুলো শেষ করে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। গতরাতেও অনলাইনে অনেক কাজ করতে হয়েছিল আমার বিধায় আমি আজ অনেক পরিশ্রান্ত। বিছানায় শুয়ার সাথে সাথেই ঘুমের সাগরে তলিয়ে যাই আমি।
এমন সময়ই আমার ফোনটা বেজে ওঠে। ব্যাপার কী? এতরাতে তো আমাকে কেউ ফোন দেয় না। আমি ঘুমকাতুর চোখে তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে দেখি স্ক্রিনে রিহান ভাইয়ার নাম ভাসছে। আমি নিজেকে রাইফার থেকে আলতো করে ছাড়িয়ে উঠে বারান্দায় গেলাম তার সাথে কথা বলতে।
“হ্যালো রিহান ভাইয়া, আপনি এতো রাতে?
“হ্যাঁ। আসলে, খুব জরুরি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য তোমাকে এত রাতে ডিস্টার্ব করলাম। বিষয়টা কীভাবে বলব বুঝে পাচ্ছি না।”
“সমস্যা নেই ভাইয়া, বলে ফেলেন।”
“সিমি দেশে ফিরেছে কিছুদিন আগেই।”
“তাতে কী হয়েছে? আপনার পূর্বের বক্তব্য অনুযায়ী তো সিমি দোষী নয়। তাহলে ওর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার কী? তাছাড়া আপনিই বা ওর আগমনের কথা জানলেন কীভাবে?”
এরপর আমি রিহান ভাইয়ার কাছ থেকে যা শুনলাম, সেগুলো শোনার জন্য মনে হয় না যে আমি কোনকালেও প্রস্তুত ছিলাম।
রিহান ভাইয়ার কথা শুনে আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বারান্দা হতে নিজের রুমের দিকে আসতে লাগলাম। অনেক হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছি আমি এখন। আমাকে যে মিলাতেই হবে, তাও আবার অতি শীঘ্রই। কিছুটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে প্রবেশ করতেই দেখি রাইফা জেগে আছে, খাটের উপর বসে আছে মাটিতে পা দিয়ে। আমার দিকে মুখ করে আছে। চোখগুলো একেবারেই লাল টকটকে মনে হচ্ছে ওর।
চলবে