#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৫)
নরম তুলতুলে পেঁজা তুলোর মতো ছোট্ট উষশী বিছানায় শুয়ে আছে। তারই পাশে ললাট ভরা চিন্তা নিয়ে বসে আছে অভিরাজ। লাবণ্য একটু আগে এসে দেখে গেছে। মেয়েটির শরীরের জ্বর হু হু করে বাড়ছে। লাবণ্য পানি আর টুকরো করা কাপড় নিয়ে এসেছে। জলপট্টি দিতে দিতে বলল,”তুই ও বাচ্চা হয়ে গেলি অভি। ও জেদ করল আর মেনে নিলি!”
অভি নিরুত্তর। সে বড়ো চিন্তিত হয়ে আছে। মেয়েটার শরীর কতটা নাজুক সেটাও জানা নেই। এদিকে বাড়িতে তেমন পাওয়ারফুল ঔষধ ও নেই। যা আছে তা অতি সাধারণ। এদিকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। খানিক পর পর বাজ পড়ছে। লাবণ্য কফি এনেছিল। সেটা অনাদরে টেবিলের কোণে ঠায় পেয়েছে।
“তুই ঘুমাতে যা অভি।”
“না,ঠিক আছি।”
“সকাল সকাল তোকে বের হতে হবে। একটু ঘুম এর প্রয়োজন আছে না?”
“সমস্যা নেই।”
“তবু..।”
“ঠিক আছি লাবণ্য। ওর জ্বর কত?”
থার্মোমিটার উঠাল লাবণ্য। ১০৩ ছুঁই ছুঁই। অভিরাজের ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে আগের ভঙ্গিতেই বসে রইল। মাঝ রাতে দেখা গেল উষশীর জ্বর আরো বেড়ে গেছে। অসহ্য রকমের যন্ত্রণা ফুঁটে উঠেছে মেয়েটার শ্বেত রঙা মুখশ্রীতে। লাবণ্য পাশে বসেই ঝিমুচ্ছে। অভি সময় নিতে চাইল না।
“লাবণ্য।”
“হুম বল, শুনছি।
“কি কি ঔষধ লাগবে লিখে দে।”
“এখন লিখে কি হবে?”
“আনতে যাব।”
“কি!”
লাফিয়ে উঠল লাবণ্য। অভি গায়ের উপর কোট জড়িয়ে নিয়েছে। লাবণ্য ব্যস্ত হয়ে শুধাল,”পাগল হলি? এই ঝড় বৃষ্টির রাতে কোথায় যাবি? রাস্তা ঘাট ঠিক আছে কি না সেটাও জানি না। নিউজ চ্যানেল গুলোতে বারবার সর্তক বার্তা দিচ্ছে।”
“তাই বলে একটা মানুষ জ্বরে কাতরাচ্ছে এটা মেনে নিতে পারব না।”
“সকাল হোক,তারপর যাস। এমনিতেও এখন কাছের ফার্মেসী খোলা পাবি না।”
“জানি। তুই ঔষধ লিখে দে।”
“অভি! মাথা খারাপ হয়েছে?”
“আমি ঠিক আছি। কথা বাড়াস না। লিখে দে না হলে আমি অন্য কাউকে খুঁজে নিচ্ছি।”
ঔষধ লিখে দিল লাবণ্য। অভিরাজ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বুকটা শূন্য হয়ে এল। ছেলেটা এই ঝড়ের মাঝেই ছুটে চলেছে। কোনো বিপদ না হলেই হয়।
অসুস্থ দেহের উষশীর পাশে বসে মিউ মিউ করছে কোকো। অথচ সাড়া নেই কোনো। বিড়ালটি যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। উষশীর জামা ধরে টানাটানি করছে। অথচ মেয়েটা প্রায় চেতনাহীন। লাবণ্য পুনরায় তাপমাত্রা মাপল। এক চুল ও কমে নি। ওর নিজেরই ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। এদিকে রাত প্রায় দুটো বাজে। দেড় ঘন্টা হলো অভিরাজ বের হয়েছে। লাবণ্য দু বার কল করেও হদিস পেল না। ঝড় বৃষ্টির রাতে শহরেও নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়। চিন্তা ভরা নয়নে বার বার ট্রেরেসে ঘুরে যাচ্ছে। আসে নি অভিরাজ। চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উষশী”র বড়ো তৃষ্ণা পেয়েছে। চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছে সে। এতেই ভয়ে দিশেহারা কোকো। সে এসে লাবণ্যর জামা টেনে ধরেছে।
“কি হয়েছে কোকো?”
প্রাণীটি কথা না বলতে পারলেও লাবণ্যকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। লাবণ্য একটু পানি খাওয়াল। এতে তৃষ্ণা মিটে নি মেয়েটির। ওর হৃদয় এখন ভীষণ উত্তপ্ত। ভীষণ যন্ত্রণা বইছে শরীরে। লাবণ্য কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে বেশি সময় হাত রাখা যাচ্ছে না। জ্বরের প্রকোপে একদমই নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। খানিক বাদে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। বুকের ভেতর ছ্যঁত করে উঠেছে। লাবণ্য দ্রুত নেমে এল। অভিরাজের শরীর ভিজে একাকার।
“একি,তুই তো পুরো ভিজে গেছিস।”
“এক কিলো পায়ে চলতে হয়েছে। রাস্তা ব্লক হয়ে আছে।”
“চেঞ্জ কর দ্রুত।”
“হুম। উষশী’র জ্বর কতটুকু?”
“আগের মতোই।”
“ঔষধ গুলো ধর। খাইয়ে দে আমি আসছি।”
লাবণ্য ঔষধ নিয়ে উপরে উঠে গেল। অভিরাজ ক্লান্ত হয়ে গেছে। এদিক সেদিক ছুটেও যখন ঔষধের দোকান খোলা পাচ্ছিল না তখন বেশ অসহায় লাগছিল। কতটা পথ ছুটেছে হিসেব নেই। উষশীকে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে লাবণ্য। মেয়েটার ছোট্ট শরীর এখন কম্বলের নিচে জুবুথুবু হয়ে আছে। পাতলা গড়নের মেয়েটাকে দেখলে যে কারো মায়া হওয়ার কথা। লাবণ্য’র ঠোঁটে একটু হাসি এল। মেয়েটা তার থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও রূপ লাবণ্য’র দিক থেকে ঢের এগিয়ে।
ঘামে ভিজে গেছে উষশী’র দেহ। অভিরাজ পাশে বসেই কাজ করছিল। একটু পর পর নজর বুলাচ্ছিল। তখনি দেখতে পেল কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। লাবণ্য ঘুমিয়ে জল। অনেক ক্লান্ত সে। তবু ডাকল অভিরাজ। লাবণ্য বেশ ছটফট করে বলল,”কি হয়েছে অভি? সব ঠিক আছে তো। উষশী’র শরীর” বাক্যটি শেষ না করেই উষশী’র কপালে হাত রাখল সে। দেখতে পেল ঘাম দিয়ে জ্বর নেমেছে। কিছুটা স্বস্তি পেল। এদিকে প্রায় ভোর নেমে এসেছে।
“তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে আমি ওর শরীর মুছিয়ে দিচ্ছি।”
লাবণ্য উষশীকে ডেকে তুলল। মেয়েটা বেশ ক্লান্ত। নিজে থেকে কিছুই করতে পারছে না। তবু যখন লাবণ্য জামাটা খুলতে গেল বাঁধা দিল। একটা লজ্জা কাজ করছে তার। ওর কান্ডে হেসে ফেলল মেয়েটি। ওর নজর বুঝে বলল,”অভি চলে গেছে।”
জামা বদলিয়ে গোসল করে এসেছে উষশী। শরীরে শক্তি নেই এক বিন্দু। কোকো চাদরের নিচে ঘুমাচ্ছে। লাবণ্য’র ও বেশ ঘুম পাচ্ছে। যদিও কাল ডিউটি নেই তবু এখন ঘুমানোর জন্য চোখ তাড়া দিচ্ছে। পাশেই শুয়ে পড়েছে সে। কিছু সময় পর ভালো লাগল উষশী’র। শরীরে একটু জোর পেতেই কোকো কে কোলে তুলে নিল। মিউ মিউ করল কোকো।
“ক্ষিধে পেয়েছে?”
সম্মতি জানাতেই বোধহয় বিড়ালটি আবারো মিউ মিউ করল। লাবণ্যকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। এত সময় ধরে ওর যত্ন নিয়ে সবে ঘুমিয়েছে। সে নিজেই বেরিয়ে এল। ড্রয়িং পেরিয়ে কিচেনে যেতেই দেখতে পেল সুঠাম আর বিশাল দেহের অভিরাজকে। তার উদাম পিঠের সৌন্দর্য দেখে উষশী’র কিশোরী হৃদয়ে কম্পন ধরে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে নজর ঘুরিয়ে নিল। ড্রয়িং এ এসে অপেক্ষা করতে লাগল। খানিকক্ষণ যেতেই অভিরাজের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। কোকো ক্ষিধের চোটে ডেকে চলেছে।
“শুনেন।”
নজর না ঘুরিয়েই কথাটা বলল উষশী। তার বাচ্চা কণ্ঠে এমন ডাক বড়ো অদ্ভুত শোনাল। অভিরাজ একটু অবাক হয়ে পড়ল,”তুমি নেমে এলে যে?”
“কোকোর ক্ষিধে পেয়েছে।”
“দিচ্ছি। শরীর কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”
“কিছু খাবে?”
“অল্প কিছু।”
“স্যুপ?”
“আচ্ছা।”
ইনস্ট্যান্ট স্যুপ আর ক্যাট ফুড নিয়ে হাজির হলো অভিরাজ। জানালার মিররে অভিরাজকে দেখতে পেল উষশী। এবার তার দেহ অনাবৃত নয়।
“কোকো এদিকে আয় তো।”
কোকো কে নিয়ে গেল অভিরাজ। খাবার খেতে দিয়ে উষশীর জন্য স্যুপ আনল।
“থ্যাংক ইউ।”
“বাহ,তুমি আজকাল হুটহাট থ্যাংক ইউ বলছ!”
“আজকাল কি,আপনার সাথে দেখাই তো হলো গত পরশু। মাঝে একটা দিন গিয়েছে।”
“হু এই সময়েই যতটুকু চিনেছি এতে করে ছোট বিষয়ে থ্যাংক ইউ বলার মতো বাচ্চা তো নউ।”
“আমি বাচ্চা নই।”
“তো মিস বুড়ি অপনার বয়স কত?”
“পনের।”
হো হো করে হেসে উঠল অভিরাজ। একটা পনের বছরের বাচ্চা মেয়ে নিজেকে বড়ো বলে দাবি করছে!
“ইউ নো হোয়াট আমার তিনটা ফ্রেন্ড লিভ ইন করে। তাহলে আমি কি বাচ্চা?”
লিভ ইন এর কথা শুনে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল অভিরাজের। উষশী স্যুপ খেতে খেতে বলল,”আপনি আর আপু কত বছর ধরে লিভ ইন এ আছেন?”
প্রথম কথাটা যতটা আশ্চর্য করেছিল তার থেকে বেশি বিরক্ত করল শেষ কথাটি। অভি বেশ শক্ত কণ্ঠে জবাব দিল,”আমরা লিভ ইন এ নেই।”
“তো?”
“লাবণ্য আমার কাজিন।”
“ও আচ্ছা। আমি ধরতে পারি নি।”
উষশী পুনরায় এক চামচ স্যুপ মুখে নিল। অভিরাজ হতাশ হয়ে বলল,”মাত্র পনের বছর বয়সে লিভ ইন ও বুঝে গেছ!”
“এটা স্বাভাবিক। আমাদের কান্ট্রিতে মেন্সট্রুয়েশনের পর পরই লিভ ইন শুরু হয়ে যায়। আট নয় বছর থেকেই এসব বিষয়ে বেশ জ্ঞানী হয়ে উঠে।”
কিছুটা বিস্মিত হলো অভিরাজ। গত দুদিন এতটা খোলামেলা কথা বলেনি মেয়েটি।
“তুমি বাংলাদেশের নউ?”
“না। আমি বাই ব্রর্ন ইউরোপিয়ান। আমার পাপা স্লোভেনিয়ার আর মম বাংলাদেশি।”
এত সময় পর কথা গুলো বুঝে এল অভি’র। সে বেশ মনোযোগী হয়ে বসল।
“তুমি দেখতে তোমার মায়ের মতো হয়েছ?”
“জানি না ঠিক।”
“এত ভালো বাংলা পারো কি করে?”
“মম আর পাপা দুজনেই বাংলায় কথা বলত।”
“তোমার পাপা না, স্লোভেনিয়ার?”
“হুম। কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলাদেশে ছিল,তাই বাংলায় কথা বলতে পারত।”
“বুঝলাম। তোমরা বাংলাদেশে কবে এসেছ?”
“নয় দশদিন হবে। প্রথমবারের মতো এসেছি অথচ হারিয়ে গেলাম।”
“সমস্যা নেই। তুমি যদি তোমার পাসপোর্টের ইনফর্মেশন দিতে পারো তাহলে আমি তোমার ফ্যামিলিকে খুঁজতে পারব।”
“ঠিক আছে।” বলেই মুখটা মলিন করে ফেলল মেয়েটা। অভিরাজ এগিয়ে এসে বলল,”মম পাপাকে মনে পড়ছে?”
“উহু।”
“তাহলে?”
“আপনাদের সাথে আমার আর দেখা হবে না।”
এই বাক্য পুরো সকাল জুড়ে যন্ত্রণা দিল অভিরাজকে। কেন দিল জানা নেই। তবে কথাটা মাথা থেকে যাচ্ছিলই না। বার বার মনে হচ্ছিল, নরম তুলতুলে পেঁজা তুলোর মতো তেজি মেয়েটির সাথে আর কখনো দেখা হবে না। যেমন করে হুট করে এসেছিল আবার হুট করেই চলে যাবে। স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে শুধু বৃষ্টিভেজা আলাপন।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি