বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৭)

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৭)

গুণী মানুষের গুণের শেষ নেই। লাবণ্যকে চোখ বন্ধ করে গুণবতী বলা যায়। উষশী হা হয়ে লাবণ্য’র মাছ রান্না দেখছে। সকালেই জলাশয় থেকে মাছ ধরা হয়েছে। সেই মাছ কে টে ছে বাড়ির বউরা। আর রান্না করছে রত্না, লাবণ্য। ইরা অবশ্য এসব কাজ পারে না। সে হা হয়ে দেখছে উষশী’র মতো। লাবণ্য দুদিন হলো সুস্থ হয়েছে। এর মধ্যেই কেমন কাজে নেমে গিয়েছে। সে ভীষণ আগ্রহে মাছ রান্না দেখছিল। ওমন সময় অভিরাজ এসে ইশারা করল। এত গুলো মানুষের সামনে থেকে উঠতে বেশ ভোগান্তি হলো তার।
“এই সময়ে ডাকছেন কেন? দেখছেন না মাছ রান্না দেখছি।”

“দেখে কি করবে?”

“কি করব মানে। শিখব, সবাই কে ইমপ্রেস করা লাগবে না?”

“আমার সুন্দরী বউ দেখে সবাই এমনিই গলে যাবে। এসব রান্না করে ইমপ্রেস করা লাগবে না। আমাকে আদর করলেই হবে।”

“ছি,একদম বেহায়া হয়ে গেছেন।”

“স্বাভাবিক। তুমি কি ভাবো, বিদেশীরাই শুধু বেহায়া হতে পারে? ট্রাস্ট মি, বাঙালিরা যতটা পারে তার এক ভাগ পারে না ওরা।”

ঠোঁট টিপে হাসল উষশী। একটু উঁচু হয়ে অভিরাজের গালে স্পর্শ করে বলল,”আপনি যে এতটা বাজে সেটা জানা ছিল না।”

“বাজে তো শুধু তোমার জন্যেই হব বউ।”

মন খোলা হাসল উষশী। অভিরাজের কণ্ঠে এই ডাকটা বড়ো মধুর শোনাল। উষশী এক মনে তাকিয়ে আছে। তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অভি। আকাশ মেঘলা। বর্ষার সময়ে গ্রামে বক শাপলা বেশ পরিচিত একটা নাম। উষশী বক শাপলা দেখে নি কখনো। তাই তাকে নিয়ে বিলে এসেছে অভিরাজ। আগে থেকেই নৌকা ভাড়া করে রেখেছে সে।
“আবার নৌকা ভ্রমণ। ওয়াও, থ্যাংক ইউ সো ভ্যারি মাচ মিস্টার রাগি।”

“ইটস মাই প্লেজার জেদি মেয়ে।”

গাল ভরাট করে হাসল অভিরাজ। ওর বাহু চেপে ধরেছে উষশী। তার চোখে মুখে এক রাশ মুগ্ধতা। জলে থৈ থৈ করছে চারপাশ। বিলের একটু গহীনে বক শাপলা দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর শুভ্রতা দূর থেকেই অনুভব করতে পারছে উষশী। খোলা নৌকা নিয়েছে ওরা। মাঝি হিসেবে আছে নয় দশ বছরের একটা ছেলে। তার বয়স কম হলেও নৌকা চালনায় ভীষণ দক্ষ সে।
“এই টুকু ছেলে বেশ ভালো নৌকা চালায় তো।”

“হুম। অনেক টেলেন্টেড, তোমার মতো।”

“আমার মতো!”

“হুম। এই যে তুমি, পনের বছরের এক কিশোরী হয়ে সাতাশ বছরের এক যুবককে জল খাওয়াচ্ছ। মনে হচ্ছে তোমাকে না পেলে ম রে ই যাব। তাহলে বলো টেলেন্টেড না?”

“হুম বেশ গুণবতী অনুভব হচ্ছে এবার।”

অভিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ানোয় মাথায় হাল্কা করে চ ড় দিল অভিরাজ।
“বাচ্চা বাচ্চাদের মতো থাকবে।”

“আচ্ছা। আমি বাচ্চা?”

“হুম। তা নয় তো কি?”

“তাহলে তুমি বুড়ো। এই তোমার লজ্জা হয় না এমন বাচ্চা এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করতে?”

“হয় না তো।”

“কেন হয় না?”

“ভালোবাসায় বয়স কোনো বিষয় হলো?”

“সমাজ তো অন্য কিছু বলে।”

“যায় কি আসে তাতে? তুমি আমি একে অপরের এটাই আসল কথা।”

উষশী অভি’র সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। চারপাশে নেমে এসেছে আঁধার। ওরা বিলের মাঝে এখন। এক হাতে মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরল অভিরাজ। অন্য হাতে শাপলা তুলতে লাগল। দু এক বিন্দু জল শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আনন্দ হচ্ছে উষশী’র। অভি’র মুখটা ওর ঘাড়ের কাছে। একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। মেয়েটির বাদামি রঙা চুল থেকে মুখ উঠিয়ে অভিরাজ বলল,”কি মুগ্ধতা আছে তোমার মাঝে,যা আমায় এত কাছে টানে?”

এই প্রশ্নের জবাবে উষশী কেবল হাসল। তার হাসির সাথে মিশে যেতে লাগল বৃষ্টির জল। একটা শীতল অনুভূতিতে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। তাদের ভালোবাসা যেন বৃষ্টির সাথে আলাপন শুরু করেছে। এক বৃষ্টিভেজা আলাপন।

লাবণ্য যে দুপুরে ভাত খেল না তা কেউ ই জানল না। তার ভেতরটা যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। উষশী আর অভিরাজকে একসাথে দেখলেই মন কেমন করছে। সে নিজেকে সংযত করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সব ধ্বং স করে দিতে। তার এই বিষন্নতা কিছুটা অনুভব করতে পারছিল ইরা।
“কোনো বিষয়ে আপসেট আছ?”

“না তো। তুই কখন এলি?”

“অনেকক্ষণ। অথচ তুমি খেয়াল ই কর নি।”

“মাথা ব্যথা একটু।”

“সাথে মন ও?”

এমন প্রশ্নে বিব্রত হলো লাবণ্য। কথা ঘুরিয়ে বলল,”বোকার মতো কথা বললি। মন আবার ব্যথা করে কেমন করে?”

“করে রে আপু। আমার করে।”

“তোর আবার কি হলো?”

“একটা সম্পর্কে আছি সেটা তো জানোই। প্রচন্ড ঝামেলার ছেলেটা। অথচ ছাড়ার কথা ভাবলেই মনের মধ্যে ব্যথা হয়। ভালো লাগে না আর।”

“থাক এত টেনশন করিস না। সময় নে।”

“হুম। আচ্ছা তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? সবাই তো চায় ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হোক। কিন্তু তোমরা চাও না। অন্য কাউকে পছন্দ কর?”

এ প্রশ্নের জবাবে লাবণ্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ইরাও আর ঘাটাল না। হাজার হোক লাবণ্য তার বড়ো বোন। দুজনের বয়সেও বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা প্রয়োজন।

মেয়েদের চুলে অন্যরকম আকর্ষণ বোধ করে পুরুষ মানুষ। কথাটি উষশী আর অভিরাজের ক্ষেত্রে খুবই সত্য। ওরা যখনি কাছে এসেছে তখনি সমস্ত কিছু ভুলে কিশোরী’র চুলের ঘ্রাণ মেখেছে অভি। সেই কারণেই একটা চুল গলার কাছে আটকে গেছে। সেটা চোখে পড়ল ইরার। সে চেচিয়ে উঠল প্রায়।
“ভাইয়া,তোমার গলায় এটা কার চুল! ব্রাউন কালার ও মাই গড।”

ইরার বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই সকলের চোখ চলে গিয়েছে অভিরাজে দিকে। লাবণ্য সবে ভাতের লোকমা তুলেছে। পূর্ণ নজরে দেখল সে। বাদামি রঙা চুলটি যে উষশী’র এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অভি নিশ্চুপ। একদমই শান্ত পাহাড় যেন। ওর নীরবতা দেখে ইরাও আর ঘাটে নি। তবে লাবণ্য ঠিক ই ঘাটল। এত রাগ হচ্ছিল ওর। ঘরে এসে জামা কাপড় ফেলতে শুরু করেছে। বারান্দার দুটো টব ভেঙেছে। মিররের কোণ করেছে চৌচির। তার এত রাগ ক্ষোভ সব গিয়ে পড়ল উষশী’র উপর। সে জানত উষশী’র ত্বক বেশ নাজুক প্রকৃতির। প্রসাধনী ও মেপে ব্যবহার করে। পরিবেশের সাথে কোনো মতে খাপ খাইয়েছে। এমতাবস্থায়,গ্রামের মেলা থেকে আনা সাধারণ জিনিস গুলো একেবারেই সইবে না,সেটা জানা সত্ত্বেও সেগুলো উষশীকে দিল। উষশী মেকাপ ব্যবহারে সচেতন। তবে তাড়াহুড়ো করে ঘোরার প্ল্যান করায় তাকে সেই জিনিসেই সাজতে হচ্ছে। বিকেলটা বড়ো আনন্দে পার হলেও সন্ধ্যাটা বেশ করুণ হলো কিশোরী’র জন্য। মুখ ঘাড় হাত চুলকোতে শুরু করল। ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করেছে। ওর কান্না পাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। র‍্যাশ উঠে যা তা অবস্থা। এটা সবার পূর্বে নজরে এল লতিফার। তিনি লাবণ্য’র জন্য দুধ নিয়ে এসেছিলেন। এসে লাবণ্য কে না পেলেও দেখতে পেলেন উষশী’র করুণ অবস্থা।
“একি, মুখে কি হয়েছে উষশী?”

কথা বলতে পারছে না কিশোরী। অস্বস্তি হচ্ছে তার। হাঁসফাঁস করছে সে। ওকে ধরে উঠালেন তিনি।
“কি করে হলো?”

“জানি না।”

“খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মা?”

“ভালো লাগছে না আন্টি। এটা কি হলো।”

তিনি বিস্তর চিন্তায় ডুবে গেলেন। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। অভিরাজ নাকি লাবণ্যকে নিয়ে বেরিয়েছে। কেউ বুঝতে পারছিল না কি করবে। সাধারণ টোটকায় যদি হিতে বিপরীত কিছু হয় তাই সেটাও লাগানো হচ্ছে না। কিছু সময় পর বাড়ি ফিরল ঈশান। উষশী’র অবস্থা দেখে বলল,”এটা কি করে হলো?”

উষশী উত্তর দিচ্ছে না। ওর চোখ টলমল করছে।
“মা,ওকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। এভাবে বসে থাকলে সমস্যা হবে।”

“এই সন্ধ্যায় কোন হসপিটালে যাবি?”

“শহরে গেলেই ভালো হয়।”

কোনো কিছু চিন্তা না করেই রওনা হলো ওরা। ওদের সাথে গেল রত্না। উষশীকে ধরে রেখেছে সে।
“একটু পানি খাও উষশী।”

কিশোরী’র চোখ মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে। ফুলে উঠেছে চারপাশ। ঈশান এর মধ্যেই অভিরাজকে কল করেছে। সে জানিয়েছে এখনি আসছে। ড্রাইভিং এ মনোযোগ থাকছে না ঈশানের। বার বার তাকাচ্ছে তুষারের ন্যায় ফর্সা মেয়েটার পানে। সুন্দর মুখটা কেমন মলিন হয়ে উঠেছে। তার সমস্ত সৌন্দর্য যেন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

ভীষণ প্রিয় আর যত্নে লেখা ‘বিয়ে থা’ গল্পটি যারা পড়েন নি। পড়ে ফেলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here