বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২)

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২)

সোডিয়ামের আলোতে ইটের রাস্তাটাকে বড়ো সুন্দর লাগছে। চারপাশ বৃষ্টির জলে পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে। গাছের পাতা গুলো যেন প্রাণ ফিরে পেল। হাল্কা বাতাসে দু এক বিন্দু পানি পড়ছে। তারই পাশে চুপচাপ বসে আছে উষশী। কোকো পাশেই খেলছে। ভীষণ মন খারাপের চোটে উষশীর শুভ্র মুখটা বির্বণ হতে শুরু করেছে। টানা দুটি চোখ যেন প্রাণহীন। এদিকটা পুরোপুরি নির্জন। অনেক সময় পর পর দু একটা মানুষ চলছে। বৃষ্টির চোটে কিছু গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। ভয়াবহ অবস্থা। রাতের আঁধারেও আকাশের মেঘলা অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। খানিক বাদে বোধহয় আরো শক্তিশালী বৃষ্টি নেমে যাবে। শরীরের কাপড় শরীরেই শুকিয়ে এসেছে। এখন আর অত শীত লাগছে না। সয়ে গেছে। মাথাটা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। এ সময় একটা ডাক ভেসে এল।
“উষশী!”

নিজের নাম শুনতে পেয়ে আগন্তুকের পানে তাকাল মেয়েটি। অভি দ্রুত পায়ে ছুটে এসেছে।
“ঠিক আছ? এমন করলে কেন বলো তো। পুরো দু ঘন্টা ধরে খুঁজে যাচ্ছি।”

উষশী একটা কথাও বল‍ল না। এমনকি রাগ ও দেখাল না। কোকো মিউ মিউ করছে। অভি বিড়ালটি কে তুলে নিল।
“বৃষ্টি নেমে আসবে। আসো আমার সাথে।”

উষশী উঠল না। আগের মতোই বসে রইল। একটু এগিয়ে এসে অভিরাজ বলল,”আসো, লেট হয়ে যাচ্ছে।”

এবার ও উঠল না মেয়েটি। অভিরাজের রাগ হলো না। সে মেয়েটির হাত ধরে উঠিয়ে নিল।
“সরি।”

হুট করেই সরি বলাটা আশা করেনি উষশী। সে বিস্ফোরণ নিয়ে তাকাল। অভিরাজ হেঁটে চলেছে। আকাশ ডেকে উঠল। কোকো মিউ মিউ করছে। চলতে চলতে লাবণ্যকে কল করল। লাবণ্যর সাথে কি কথা হলো জানে না উষশী। এই মুহূর্তে তার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আসলেই কি যাওয়া ঠিক হবে?

বাচ্চাটিকে দেখতে পেয়ে লাবণ্য যেন প্রাণ ফিরে পেল। দু হাতে জড়িয়ে বলল,”এত রাগ করলে চলে বাবু? জানো কি ভয় পাচ্ছিলাম।”

“সরি।”

“ঠিক আছে। মন খারাপের কিছু নই। অভি’র কথায় কিছু মনে কোরো না।”

প্রথমবারের মতো মানুষটার নাম জানতে পারল উষশী। অভি কোকো কে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল। তারপর লাবণ্যের সাথে কিছু বলতে লাগল। উষশী ফিরেও তাকাল না। তার পেটের ভেতরটা ভীষণভাবে লাফাচ্ছে। ক্ষুধায় ম রে যাবে যেন।
“উষশী,বাবু উঠে এসো।”

অন্যমনস্ক উষশী শুনতে পেল না। অভি নেমে এসে বলল, “গাড়িতে উঠ।”

কোকো গাড়ির ভেতর উষ্ণতা পেয়ে পরম যত্নে শুয়ে আছে। হাত বুলিয়ে দিল উষশী। হঠাৎ উষ্ণতা পেয়ে তার ও ভীষণ ভালো লাগল। ক্ষিধে পেটেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

উষশী’র ঘুম ভাঙল হর্নের শব্দে। অভিরাজ বিরক্ত হয়ে বলছে,”এই মানুষ গুলোও না। এভাবে জটলা কেন করছে!”

“এ ক্সি ডে ন্ট হয়েছে সম্ভবত।”

“দেশের ট্রান্সপোর্টের যা অবস্থা। দিনকে দিন দূর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।”

“হুম।”

অভিরাজ গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল উষশী। একটা ট্রাকের সাথে প্রাইভেট কারের সং ঘ র্ষ ঘটেছে। কে জানে গাড়িতে থাকা মানুষ গুলোর কি অবস্থা।

মৃদু বাতাসে উষশীর কাঁধ অবধি চুল গুলো উড়ে যাচ্ছে। হা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে বাংলাদেশে এসেছে সে। বাইরেটা সেভাবে বের হওয়া হয়নি। সকালে কোকো কে নিয়ে খেলছিল। কোকো কোনো ভাবে হারিয়ে গেল। মেয়েটির কি যে কান্না। তারপর দুপুরের দিকে এক সংবাদ মাধ্যমের নিউজে দেখতে পেল কোকোকে। বিড়াল ছানাটা কি করে যে হসপিটালে পৌছাল কে জানে। কোকো আবার হারিয়ে যেতে পারে এই ভয়েই লোকেশন নিয়ে বৃষ্টির জল মাথায় করে ছুটে এসেছিল সে। কিন্তু কে জানত সে নিজেই হারিয়ে যাবে। একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। হর্ন বাজাতেই মেইন গেট খুলে গেল। অভিরাজ গাড়ি পার্ক করে বলল,”তোরা যা আমি আসছি।”

“কোথায় যাবি?”

উষশী’র দিকে ইশারা করে বলল,”সম্ভবত দুপুর থেকে না খাওয়া। তাছাড়া আমরাও তো ডিনার করি নি। খাবার নিয়ে আসছি।”

“আচ্ছা,সাবধানে যা।”

উষশীকে নিয়ে ভেতরে এল লাবণ্য। সুন্দর পরিপাটি বাসাটা। কোকো লাফিয়ে নেমে গেল কোল থেকে।
“কোকো,দুষ্টুমি করবে না একদম।”

“থাক,ওকে খেলতে দাও।”

উষশী মৌন থেকে সম্মতি দিল। ওর আচরণে লাবণ্য একটু হেসে বলল,”আমি ড্রেস দিচ্ছি,গোসল করে আসো।”

লাবণ্য দেখল উষশী লম্বায় তার সমান সমান। তবে তার থেকেও রোগা পাতলা। সে তার টি শার্ট আর প্যান্ট এনে দিল। শাওয়ার নিয়ে ফিরল মেয়েটি। দীর্ঘসময় ভেজা থাকাতে কেমন যেন লাগছে এখন। কোকো পাশেই খাবার খাচ্ছে। অভিরাজ ফোনে কিছু করছিল। উষশীকে দেখে বলল,”লাবণ্য খাবার সার্ভ করে দে।”

উষশী ড্রয়িং এর পাশে থাকা বিশাল জানালার কাছে এল। বাইরে তুমুল বর্ষণ। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। সোডিয়ামের আলোয় চকচক করছে রাস্তাটা। আকাশ মেঘলা হলেও ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রূপালি চাঁদ।
“উষশী,চলো খাবার খেয়ে নাও।”

খাবারের গন্ধটা নাকে আসতেই উষশী’র মনে হলো সে মা রা যাবে। প্রচন্ড ক্ষুধায় এখন তার চলতেও কষ্ট হচ্ছে। ডাইনিং এ বসে যথাসম্ভব দ্রুত খেল সে। প্রচন্ড ক্ষিধে থাকলেও বেশি খেতে পারল না। লাবণ্য কিছু মেডিসিন খাওয়াল। সারাটা দিন মেয়েটা ভেজা শরীরে,জ্বর না এলেই হয়।

সব কিছু গুছিয়ে রাখতে রাখতে এগারোটা বেজে গেল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর লাবণ্য যেন একটু বেশিই নেতিয়ে পড়ল। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।
“কাজ কাজ করে মাথা নষ্ট করে ফেলবি।”

“এগুলো না দেখলে দুদিনেই বিজনেস লাটে উঠবে।”

“তাই বলে রেস্ট নিবি না?”

“রেস্ট নেই তো।”

“দেখি তো,সারাক্ষণ এটা ওটা করতেই থাকিস। কফি খাবি?”

“আমি বানিয়ে নিব। তুই ঘুমা।”

“আচ্ছা।”

“উষশী ঘুমিয়েছে?”

“হ্যাঁ। একদমই কিউট মেয়েটা।”

“সাথে তেজ ও আছে।”

“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”

“কি জানি। যাই হোক,তুই ঘুমা,কাল ভোর থেকে ইন্টার্নশিপ তোর।”

“হুম।”

কাজের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবণ্য। ডাক্তারি পেশাটা মোটেও সহজ নয়।

সকালের মিষ্টি রোদটা ঘুম ভাঙিয়ে দিল উষশী’র। পাশেই ঘুমোচ্ছে কোকো। তার জ্বর আসে নি। মেডিসিনটা কাজে লেগেছে। ঘুম ভালো হওয়াতে শরীরটাও বেশ চাঙা লাগছে। আড়মোড়া ভেঙে কোকো কে ডাকল সে।
“কোকো, উঠ সোনা।”

মিউ মিউ করে উঠল কোকো। ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসল উষশী। কোকের লোমে ভরা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”সোনা বাচ্চা।”

ড্রয়িং রুমেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল অভিরাজ। কাল অনেক রাত অবধি কাজ করেছে। এলার্মের শব্দে ঘুমটা ছুটে গেল। হাই তুলতেই দেখল সিঁড়ি বেয়ে নামছে উষশী। কোকো মিউ মিউ করছে।
“চুপ থাকো কোকো,আমরা অন্যের বাসাতে।”

কোকো ধীরে ধীরে মিউ মিউ করে থেমে গেল। ওর ভদ্র সভ্য আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে হাত বুলিয়ে দিল উষশী। নিচে নামতেই অভিকে দেখতে পেল সে। গতরাতে খাওয়ার সময় একবার দেখা হলেও কথা হয় নি।
“গুড মর্নিং উষশী।”

“গুড মর্নিং।”

অভিরাজ এগিয়ে এল। উষশী’র থেকে কোকো কে কোলে তুলে বলল,”ওর নাম কী?”

“কোকো।”

“কে রেখেছে?”

“আমি।”

অভিরাজ এবার পরিপূর্ণ নজরে তাকাল। তারপর বলল,
“স্পেসেফিক কোনো ক্যাট ফুড খাওয়াও?”

“না। সব ধরনের ক্যাট ফুড খেতে পারে কোকো।”

“আচ্ছা। গত রাতেরটাই দিচ্ছি তাহলে।”

উষশী হা না কিছুই করল না। অভিরাজ কোকো কে ক্যাট ফুড দিল। ততক্ষণে চার পাশে নজর বুলাল উষশী। বাড়িটার আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারল না। শুধু মনে হলো এই বাড়িতে নিয়মিত থাকে না কেউ।
“কফি খাও তো?”

“হুম।”

গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক বসাল উষশী। তার চাঙা শরীর আরো বেশি চাঙা হয়ে এল।
“ঐ আপুটা কোথায়?”

“বেরিয়েছে।”

“এত সকালে?”

“হুম।”

মন খারাপ করে ফেলল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে কোকোর কাছে এল। কোকো মজা করে খাচ্ছে। ওকে দেখেই মিউ মিউ ডাকতে লাগল।
“কাল আপনি ওকে গোসল করিয়েছেন?”

“হুম।”

“থ্যাংক ইউ।”

একটু বেশিই অবাক হলো অভিরাজ। এই তো কালকের সেই অহংকারী,ব দ মা শ মেয়েটাও থ্যাংকস বলতেও জানে!

“কোকো, কি করছো তুমি?”

উষশী’র জিন্স ধরে টানছে কোকো। সে বাহিরে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। উষশী তখনি তাকে কোলে তুলে বলল,”এমন করছো কেন?”

মিউ মিউ করে ডাকল কোকো। উষশী বুঝল বাইরে যেতে চাচ্ছে। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে। ভীষণ কাজ তার। উষশী এক পলক তাকিয়ে হেসে বলল,”চলো।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here