#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৬)
সন্ধ্যা থেকেই তুমুল বৃষ্টি। আর বৃষ্টি হলেই অভি’র হৃদয়ে উষশী এসে ঝড় তোলে। সে নিজের মনকে আটকাতে পারে না কিছুতেই। তার শরীর কিছুটা সুস্থ হয়েছে। লাবণ্য এত যত্ন নিয়েছে যে কঠিন রোগ ও হার মেনে নিয়েছে। বৃষ্টির এই আবহাওয়ায় স্যুপ নিয়ে এল লাবণ্য। গরম গরম স্যুপ মুখে দিচ্ছে অভিরাজ।
“লাবণ্য তুই কি আজকাল খাবারে কম লবণ দিচ্ছিস?”
“না তো।”
“এত পানসে লাগছে কেন?”
“ঔষধের প্রভাব আর শারীরিক অসুস্থতার জন্যেই খাবারের স্বাদ পাচ্ছিস না।”
“উহু। ভুল বললি।”
“ভুল?”
“হুম। বৃষ্টির রাতে উষশীর এঁটো স্যুপ না পেলে আমার মন ভরত না। আজও তেমনি লাগছে। এখনো তাজা সব অনুভূতি।”
হতাশ হয়ে তাকাল লাবণ্য। অভিরাজের প্রতিটা বাক্যে উষশী। সে এই বিষয়ে আলাপ করল না আর। সুস্থতার জন্যেই কি না সবটুকু স্যুপ শেষ করল অভিরাজ। তারপর বারান্দায় এসে বৃষ্টি দেখতে লাগল।
অতীত
হসপিটালের কাজ শেষ করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। বাইরের পরিবেশ ও ভালো নয়। বৃষ্টির কারণে বেশ ভোগান্তি গিয়েছে। লাবণ্য নিজের আগে অভিরাজের মাথা মুছতে লাগল।
“তোর এত কেয়ারের জন্যেই সবাই ভাবে আমাদের মাঝে কিছু আছে।”
“ভাবুক।”
“উষশী কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“সবে দশটা বাজে। মেয়েটা এত দ্রুত ঘুমাবে না।”
“ওকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিস। একটা জিনিস আছে।”
সোফায় শুয়ে আছে কোকো। এই আবহওয়ায় ঘুমটা বেশ ভালো হয়। কোকো কে কোলে তুলে নিল অভি।
“তোর বন্ধুকে রেখে ঘুমাচ্ছিস কোকো! তুই তো ভারী দুষ্টু।”
মিউ মিউ করে উঠল বিড়ালটি। পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অভিরাজ। আগে থেকেই কোকোর খাবার তৈরি করা ছিল। সেটা খেতে দিয়ে নিজ ঘরে এসেছে ফ্রেস হতে। ওমন সময় একটা হুলস্থুল লেগে গেল। বাড়িতে নেই উষশী। নেই ঈশান ও। দারোয়ানের সাথে কথা বলে জানতে পারল সন্ধ্যার দিকে দুজনে বেরিয়েছে। বাড়ির সবাই ছোঁয়া’র বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। তাই কেউ খেয়াল করে নি। অভিরাজের ললাটে চিন্তার রেখা। লাবণ্য ঈশানকে কল করেও পাচ্ছে না। বার বার লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে অভিরাজের শরীর কাঁপছে। মেয়েটিকে একদমই আড়াল করতে চায় না সে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ঈশানের ফোনে কল লাগল। খুব একটা কথা বলতে পারল না। যতটুকু বুঝল ওরা বৃষ্টিতে আটকে গেছে। গাড়ি নিয়ে বের হয় নি আর আশেপাশে এখন গাড়িও নেই। ঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অভিরাজ তখুনি বের হতে গেল।
“এখন কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“রাত এগারোটা বাজে মা।”
“ড্রাইভার কে পাঠাচ্ছি। তুই শান্ত হয়ে বোস।”
“না মা। আমি না গেলে হবে না।”
“অভি, বাবা শোন।”
“ওকে যেতে দাও বড়ো আম্মু। জানোই তো কেমন জেদি।”
এই ঝড়ের মধ্যে উন্মাদের মতো গাড়ি চালাচ্ছে অভিরাজ। এরই মধ্যে রেডিওতে বিপদ সংকেত দেওয়া হচ্ছে। উত্তরের হাওয়া ভীষণ অশান্ত। হুট করেই উঠেছে ঝড়টা। আধ ঘন্টার পথ দশ মিনিটেই পৌছে গেল অভিরাজ। এসে দেখল ভিজে একাকার উষশী। তার শরীরে লেপ্টে আছে পাতলা ফ্রকটি। ঝড়ের রাতে সোডিয়ামের আলোতে উন্মুক্ত হাঁটু অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। তার বাদামি রঙা চুল যেন পিনাট বাটার। এই সময়ে অভি’র ভেতরটা রাগে উত্তপ্ত হলেও সে কিছু বলল না। দুজনকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপর সোজা চলে গেল নিজ ঘরে। একটা কথাও বলে নি। উষশী অতশত না বুঝলেও ব্যাপারটা ধরতে পারল ঈশান। তার ধারণা সঠিক হলে বিষয়টা মন্দ হয় না।
আটচল্লিশ ঘন্টা উষশী’র সাথে দেখা হয় নি অভিরাজের। ইচ্ছে করেই দুটো দিন বাড়ি ফিরে নি সে। লাবণ্য’র কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেও বিব্রত বোধ হচ্ছে। কোকোকে নিয়ে সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে সে। ঘুমিয়ে থাকে নয়ত বারান্দায় বসে দোলনায় দোল খায়। এই দুইদিনে উষশী’র শারীরিক সৌন্দর্য কিছুটা কমে এসেছে। তার চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। সেদিন রাতের পর অভি’র অভিমান,রাগ কিছুই স্পষ্ট ছিল না ওর নিকট। তবে আটচল্লিশ ঘন্টায় উপলব্ধি করেছে এক নীরব ঝড়। ছেলেটা তার উপর রেগেই এমনটা করেছে। অভিকে না দেখতে পেয়ে উষশী’র সময় যাচ্ছে না। ছেলেটার সাথে একটু কথা বলার জন্য মন আনচান করছে। অথচ একটা সময় পর কারো সাথেই দেখা হবে না তার। সবাই এত আপন হয়ে যাচ্ছে যে উষশী পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। লুকিয়ে কান্না করল কিছু সময়। নিচে নেমে এসে দেখল ছোঁয়া’র শশুর বাড়ি থেকে লোক এসেছে। অন্য পাশে পাঞ্চিং ব্যাগে লাগাতার পাঞ্চ করছে ঈশান। তার এই দুঃখের কারণ খুব করে অনুভব করল উষশী।
“পাঞ্চ করলে দুঃখ কমে?”
“সবারটা তো জানি না। তবে আমার কমে।”
“আমি ট্রাই করতে চাই।”
“তোমার এই নরম তুলতুলে হাত আমার পাঞ্চ ব্যাগে পড়লে পাঞ্চ ব্যাগ ও লজ্জায় মুখ লুকাব।”
“এমন করে কেন বলো?”
“জানোই না আমার উপর কি ঝড় উঠেছে।”
“ঝড়?”
“ইয়াহ, ঝড়। লেট মি টেল ইউ। ব্রো দুদিন ধরে বাড়ি নেই। কারণ আমি তোমাকে রাতে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আর বৃষ্টির রাতে তোমাকে নিয়ে বাইরে ছিলাম। ব্রো আমাকে চোখের ইশারাতেই সব বুঝিয়ে দিয়েছে।”
“কি বুঝিয়েছে?”
“এই যে তোমাকে ব্রো কতটা ভালোবাসে।”
একেবারে ধক করে উঠল উষশী’র বুক। সে সাথে সাথে আশেপাশে তাকাল। ঈশান মৃদু হেসে বলল,”কাউকে বলবে না। একটা সিক্রেট বলি।”
“হুম।”
“ব্রো ইজ ইন লাভ উইথ ইউ। ইউ নো হোয়াট এটা আমি আর ব্রো ছাড়া কেউ জানে না। ইট ইজ ভেরি সিক্রেট। মনে রাখবে কিন্তু।”
মাথা দুলাল উষশী। সে পনের বছর বয়সী একটি কিশোরী। বাংলাদেশের সংস্কৃতির মধ্যে বড়ো হয় নি এখানকার মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়। তবে এই মুহূর্তে তার ও মনে হচ্ছে অভি তাকে ভালোবাসে। আসলেই কি তেমন?
একান্ন তম ঘন্টায় এসে অভিকে দেখতে পেল উষশী। ছেলেটার গাড়ি দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছে সে। সরাসরি চোখাচোখি হলো দুজনার। খুব ভোর এখন। ওর ফোলা দুটি চোখ, নরম তুলতুলে গাল, আর এলোমেলো চুল উপেক্ষা করার মতো শক্তি কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই অভিরাজের। সে মৃদু হেসে বলল,”কেমন আছ উষশী?”
এ প্রশ্নের উত্তর দিল না মেয়েটি। উল্টো প্রশ্ন করল। “আপনি রাগ করেছেন?”
“রাগ করেছি? কে বলেছে?”
“না হলে বাড়ি কেন ফিরেন নি?”
“অনেক চাপ ছিল বাবা। জানোই তো হসপিটাল সামলানো মুখের কথা নয়।”
“এর আগেও তো চাপ ছিল। তখন তো এমন করেন নি।”
“সত্যিই এবার বেশি চাপ ছিল।”
উষশীকে বোঝানো গেল না। সে ভীষণ আদুরে একটি মেয়ে। হাতে থাকা ব্যাগপত্র টেবিলে রেখে মেয়েটির গাল স্পর্শ করল অভিরাজ।
“কি হয়েছে জেদি মেয়ের?”
“মিস্টার রাগী রাগ করেছে।”
“তাহলে তো জেদি মেয়ের জেদ করার কথা। কিন্তু জেদি মেয়ে তো কান্না করছে।”
“কারণ জেদি মেয়ে এখন ভালো হয়ে গেছে।”
“ভালো মেয়েরা বুঝি কান্না করে?”
“না। ভালো মেয়েরা শুধু কষ্ট পায়।”
উষশী নাক টেনে উত্তর করছিল। অভিরাজের বেশ খারাপ লাগছে। মেয়েটির কপালে থাকা চুল গুছিয়ে দিল সে।
“আচ্ছা বাবা আর রাগ করছি না।”
“সেদিনের জন্য সরি। আর কখনো যাব না।”
“যাওয়া তো সমস্যা নয় উষশী। সমস্যা হচ্ছে ঝড়ের রাতে বাইরে থাকা। জানো তো কত রকমের সমস্যা অপেক্ষা করে।”
“সরি।”
“দুঃখ প্রকাশের কিছু নেই। আমি ভুলে যাই তুমি একটা বাচ্চা।”
“বাচ্চা না। আমি বড়ো মানুষ।”
“ঠিক আছে বড়ো মানুষ এবার আমার সাথে আসেন তো।”
মেয়েটিকে সাথে করে নিজের রুমে এল অভিরাজ। ঈশানের বলা কথা গুলো খুব করে মনে হচ্ছে উষশী’র। সেই থেকে সে খুব বেশিই উতলা হয়ে আছে। তার আচরণে ও কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে। অভিরাজের সামনে বাচ্চাদের মতো করতে ইচ্ছে করছে। অভি গায়ের কোটটা খুলে রেখে বলল,”তুমি কি কান্না করেছ?”
উষশী এবার স্বীকার করে নিল। সে সত্যিই খুব কেঁদেছে। অভি কিছুটা ঝুঁকে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
“কান্না করার কিছু হয় নি বোকা। তোমার জন্য একটা গুড নিউজ রয়েছে।”
“গুড নিউজ?”
“হুম। তোমরা যেই লোকের আন্ডারে ঢাকা সিটিতে এসেছ তার ঠিকানা পাওয়া গেছে।”
এটা সত্যিই দারুণ একটা সংবাদ। অথচ বিন্দুমাত্র খুশি হতে পারছে না উষশী। তার মনে হচ্ছে যত দিন পেরোচ্ছে অভি’র থেকে তত দূরে সরতে হচ্ছে। এভাবে চললে সে সত্যিই ম রে যাবে সে। তার ভেতরে যে অনুভূতি কড়া নাড়ছে তা ক্রমশই ভয়ঙ্কর হচ্ছে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি