#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১২)
“তুই এমন কেন করছিস অভি? বাড়ি ফিরে গেলে কি এমন হবে?”
অভি একই ভঙ্গিতে বসে রইল। তার শক্তপোক্ত দেহটা কাঁপছে। লাবণ্য ফের এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়াল।
“বাড়ির সবাই কষ্ট পাবে অভি।”
“ফিরতে চাই না লাবণ্য। মানসিক অশান্তি কার ভালো লাগে?”
“তোর কি মনে হয়,এরপর ও ওসব বলবে?”
“না বলার কোনো কারণ দেখছি না।”
“আমরা দুজনেই জানি বিয়েটা সম্ভব নয়। তাই কারো কথায় আমাদের কিছু যায় আসে না। সবাই একটা ডিসিশন নিয়েছে আর আমরাও একটা ডিসিশন জানিয়েছি। সব তো এখানেই শেষ, তাই না?”
“উষশীর কথা ভেবেছিস?”
“ওকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাব।”
“অত মানুষের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে ও?”
“কেন পারবে না?”
“জানি না। ভালো লাগছে না। যা ইচ্ছে কর।”
মাথায় হাত চেপে রাখল অভিরাজ। তার ফর্সা গাল লাল হয়ে এসেছে। ফ্যাকাশে চোখের দৃষ্টি। উষশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কোকো ক্ষিধের চোটে মিউ মিউ করছে। আয়নায় ওকে দেখতে পেল অভি।
“ভেতরে এসো।”
“কোকোর ক্ষিধে পেয়েছে।”
“আসো,খাবার দিচ্ছি।”
নিচু হয়ে এল মেয়েটার মুখ। সে অভিরাজ আর লাবণ্য’র কথা গুলো শুনতে পেয়েছে। নিজেকে বড়ো অদ্ভুত প্রাণী বলে মনে হচ্ছে তার। আসাদ সাহেব ফোনে কথা বলছিলেন। অভি আর উষশীকে নেমে আসতে দেখে কল রেখে দিলেন। উষশী তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
“এদিকে এসো।”
নরম পায়ে এগিয়ে এল উষশী। আসাদ সাহেব ইশারায় বসতে বললেন।
“কি নাম তোমার?”
“উষশী পল।”
“ওকে বেটা, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খুব দ্রুতই তোমার ফ্যামিলিকে খুঁজে পাব আমরা।”
“জী।”
কোকো’র খাবার দিয়ে অভিরাজ বলল,”ঘরে গিয়ে যা যা দরকার গুছিয়ে নাও। দরকার হলে লাবণ্যকে ডেকে নিও।”
উষশী চলে যেতেই আসাদ বললেন,”আগের মতো স্বাভাবিক হও অভি। তোমাদের সর্বদা স্বাধীনতা দিয়েছি। এত বছর দুজন একসাথে আছ, এরপরও কি একে অপরের প্রতি ভালোবাসা হয় নি!”
“লাবণ্য আমার খুব ভালো বন্ধু আব্বু। এর বেশি কিছু কখনোই ভাবি নি। একজন ভালো বন্ধু যেভাবে খেয়াল রাখে আমিও তাই করেছি। এক সাথে থাকা মানেই অন্য দৃষ্টি হবে এমন কোনো কথা নেই।”
“বন্ধুকে জীবনসঙ্গী বানানো তো শখের বিষয় বেটা।”
“ইরা আর লাবণ্য’র মধ্যে ফারাক দেখি না আমি। লাবণ্য আমার কাজিন সিস্টার হলেও সে আমার চোখে ভীষণ ভালো বন্ধু। আমার চোখে লাইফ পার্টনার বড়ো দৃষ্টিকটূ লাগে।”
“তোমাদের সিদ্ধান্তই বহাল তবে?”
“জী আব্বু।”
আসাদ সাহেবের দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে গেল পুরো বাড়িতে। লাবণ্য উষশীকে তৈরি করে নিয়ে এসেছে। মেয়েটাকে জিন্স প্যান্ট আর লং শার্টে দারুণ লাগছে। পুরো রাস্তায় উষশী কারো সাথে কথা বলে নি। তার এই অনিশ্চিত জীবনটা যেন ক্রমশ দ্যুতি হারাচ্ছে।
ছোঁয়া হলো অভিরাজের ছোট কাকার একমাত্র মেয়ে। বয়সের দিক থেকে ইরার কিছু বড়ো। মেয়েটার প্রণয় ছিল নিজ মামাতো ভাইয়ের সাথে। এদিকে বাড়ির বড়ো মেয়ে লাবণ্য অবিবাহিত। সবাই চাইছিল অভির সাথে বিয়েটা হোক। তবে ছেলে মেয়ে কেউ ই রাজি হয় নি। এইচ এস সির পর দুজনকে শহরে পাঠানো হলো যাতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা জমে। কিন্তু তেমন কিছুই নাকি ঘটে নি। তাই বাধ্য হয়েই ছোঁয়ার বিয়েটা আগে দিতে হচ্ছে! বাড়ি ভরাট হয়ে আছে মেহমানে। আত্মীয় স্বজনে কিলবিল করছে। উষশী কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করল।
“একদম ভয় পাবে না। আমার সাথে আসো।”
অভিরাজের বড়োসড়ো হাতের মাঝে উষশীর নরম তুলতুলে ছোট্ট হাতটা গলে গেল। সে খুব সাবধানে সকলের আড়ালে ভেতরে নিয়ে গেল ওকে। লাবণ্য’র সাথেই থাকতে দেওয়া হলো মেয়েটিকে। লাবণ্য উষশীর কাপড় গুলো ক্লোজেটে গুছিয়ে রাখছে।
“এ বাড়িতে কতদিন থাকব আমরা?”
“অনেকদিন সোনা।”
“তাহলে তো মমকে খুঁজেই পাব না।”
“খোঁজ পাবে উষশী। বড়ো আব্বু তার বন্ধুর সাথে কথা বলবেন। সে পুলিশের বড়ো বিভাগে আছেন। তোমার বিষয়টা খুব আড়ালে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কে তোমার ভালো চায়,না চায় এটা তো আমরা জানি না বাবু।”
বিষয়টা বুঝতে পেরে ‘হু’ উচ্চারণ করল মেয়েটি। কোকো দারুণ প্রাণী। তার জন্য ছোট্ট বিছানার ব্যবস্থা করেছে লাবণ্য। দুপুরের নরম রোদ পেয়ে ঘুমাচ্ছে সে।
“গোসল করে এসো। একটু পরই ছোঁয়াকে দেখতে আসবে।”
“ছোঁয়া কে?”
“আমার কাজিন সিস্টার। খুব মিশুক। ফ্রেস হও সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিব।”
উষশী’র গোসল শেষ হলে ছোঁয়া’র রুমে এল ওরা। ইরা আগে থেকেই সেখানে বসে ছিল। মেয়েটা এবার ইন্টারের পার্ট চুকিয়েছে। হাতে অফুরন্ত সময় থাকায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে।
“লাবণ্যপু” বলেই জড়িয়ে ধরল ছোঁয়া। এ বাড়ির তিন মেয়েরই বেশ ভাব। ইরা চকলেট খাচ্ছে।
“সাইড দেও আমায়।”
“না না সাইড দেওয়া যাবে না।”
“ছোঁয়াপু সরো তুমি।”
“পাগল মেয়ে। দুজনেই আয়।”
ওদের কান্ডে হেসে ফেলল লাবণ্য। দু বোনকে জড়িয়ে বলল,”এখন এত ভালোবাসা না? অথচ আপুকে একটি বার কল ও করিস না।”
“কলে কথা বললে মন খারাপ হয় আপু।”
“এখন অজুহাত দিচ্ছিস?”
“সত্যি বলছি। ইরা আর আমি কত বার কল করতে গিয়েও ফিরে এসেছি।”
“থাক আর মন খারাপ দেখাতে হবে না।”
উষশীকে দেখতে পেয়ে ইরা বলল,”ও কে?”
“ও হচ্ছে উষশী। আমাদের আরেকটা বোন বলতে পারিস।”
কয়েক মিনিটেই উষশীকে নিজেদের সাথে মিশিয়ে নিল ছোঁয়া আর ইরা। ওদের এই কান্ডে খুশি হলো লাবণ্য। ঘর থেকে বের হয়ে অভি’র রুমে এল। এই বাড়িতে অভির রুমে আসার পূর্বে সবার অনুমতি লাগলেও লাবণ্য’র কখনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পরে না।
“কি করছিস?”
“তোর বিয়ের আয়োজন।”
“ধ্যাত।”
“উষশী কোথায়?”
“ছোঁয়ার রুমে আছে। বেশ ভাব জমেছে।”
“মানিয়ে নিতে পারলেই শান্তি।”
“তুই শুধুই টেনশন করছিলি। আমাদের পরিবার কেমন তুই জানিস না?”
“হুম।”
কিছু কথা বলল ওরা। ওদের মাঝে কিছু খুনশুটি চলছিল। সেসব দেখে আমিনা হাসলেন। লাবণ্যকে ছেলের বউ হিসেবে তিনি বেশ পছন্দ করেছেন। ওনার ধারণা একটা সময় দুজনের বন্ধুত্ব প্রণয়ে রূপ নিবেই।
বাড়ির ছোট ছেলে ঈশান। লাবণ্য’র ভাই। বরাবরই ডানপিটে স্বভাব তার। এই তো সকাল থেকে কোথায় কোথায় ঘুরে এল।
“সারাদিন টইটই করে ঘুরলে হবে ঈশান?”
“ঘুরাঘুরি ছাড়া কিছু করার তো নেই ছোট আম্মু।”
“ওমা বোনের বিয়ের আয়োজন চলছে আর তুই বলছিস কোনো কিছু করার নেই।”
“তোমাদের মেয়ের বিয়ে তো সেই গবেটের সাথেই দিচ্ছ। এত আয়োজন করে কি হবে?”
ছোঁয়া রেডি হয়ে এদিকেই আসছিল। ওর কথা শুনতে পেয়ে বলল,”তোমার এত জ্বলে কেন হু? অলক কে গবেট বলবে না।”
“গবেট কে গবেট বলব না তো কি বলব? গাঁধা।”
একদল মানুষ হেসে উঠল। ছোঁয়া রেগে আগুন। এই মুহূর্তে ঈশানের গ লা টি পে ধরতে পারলে হয়ত শান্তি মিলত। রাগ ক্ষোভ নিয়ে পথ চলতে গিয়ে উষশীর সাথে দেখা। বাচ্চা মেয়েটাকে পুতুলের মতো লাগছে। সুন্দর একটা স্কার্ট পরেছে সে।
“বাহ এই লুকে তো দারুণ লাগছে তোমায়।”
“থ্যাংক ইউ।”
“ড্রেসটা খুবই সুন্দর।”
“হুম। আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।”
“আসো আমার সাথে। কিছু খেয়ে নিবে।”
পেছন পেছন এল উষশী। ছোঁয়া ওকে স্ন্যাকস এনে দিল। এখন সাড়ে বারোটার মতো বাজে। এই বাড়িতে এসেছে প্রায় দেড় ঘন্টার মতো। উষশী’র কাছে সবটা অন্যরকম লাগছে। এই টুকু সময়েই মানুষ গুলোকে এত আপন কেন অনুভব হয়?
ছাদে যেতে চায় উষশী। তাই এদিক সেদিক ঘুরছিল। তখুনি ঈশানের সাথে দেখা। দুজনার পরিচয় নেই। উষশী একটু ভরকে গেল।
“নাম কি তোমার?”
“উষশী।”
“ভাইয়ার সাথে এসেছ?”
“জী।”
“গুড। জানো তো এই বাড়িতে আমার কথাই সব।”
“আচ্ছা?”
“ডোন্ট ইউ বিলিভ মি?”
“নো,নো আই বিলিভ ইউ আ লট।”
“হুম গুড গার্ল। কোথায় যাচ্ছ?”
“ছাদে।”
“ওকে আমার সাথে আসো।”
ঈশানের পেছন পেছন আসতে লাগল উষশী। সত্যি বলতে ছেলেটার ভাব ভঙ্গিমা পছন্দ হয়েছে মেয়েটির। সে এগিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ছাদে এসে অভিরাজকে দেখতে পেল। অভি দুজনকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল।
“কি করিস তোরা?”
“ব্রো এই বাচ্চাটা তখন থেকে কান্না করেই যাচ্ছে। তোমাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না।”
ঈশানের কথার প্রতিবাদস্বরূপ বলল উষশী,
“আমি কখন….?”
“তুমি চুপ।”
উষশী চুপ করে গেল। ঈশান আরো দু চারটে রঙ মেশানো কথা বলে চলে গেল। উষশী হাবুলের মতো তাকিয়ে। ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে অভি হাসল।
“আসলেই কান্না করেছ?”
“আপনার তেমনটা মনে হলো!”
“না হওয়ার কি আছে?”
“শুনেন।”
“হু?”
“উষশী পল ইজ আ ব্রেভ উইমেন। সে মোটেও অসহায় নয়। ডোন্ট বি গেট স্মার্ট।”
উষশীর নাক ফুলানো দেখে আসলেই হেসে উঠল অভিরাজ। তার মসৃন বাদামি রঙা চুল গুলো মুঠো ভরাট করতেই একরাশ ভালো লাগা এসে স্পর্শ করল মেয়েটির সর্বাঙ্গে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো পৃথিবীর সব সুখ রয়েছে এই মুঠোতে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি