#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১০)
অনেক অদ্ভুতভাবে দিনটা শুরু হলো। আজ আকাশে ভীষণ রোদ উঠেছে। বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। টানা বৃষ্টি ছিল গত কিছু দিন। ভোর হতেই কোকো কে দেখতে পেল উষশী। অত্যন্ত খুশি হয়ে ছুটে এল মেয়েটা। মৃদু হাওয়ায় উড়ছে তার বাদামি রঙা চুল। তাকে দেখতে অনেকটা পিনাট বাটারের মতো লাগছে। সুন্দরী, লাস্যময়ী এই কিশোরীর পানে তাকিয়ে হেসে ফেলল অভিরাজ। পুরো দমে সুস্থ হয়ে ফিরেছে কোকো। দুদিন আগেও তার চেহারায় বয়সের উত্তাপ ছড়িয়ে ছিল। আজ তেমন কিছু নেই। অনেকটা সুন্দর আর হাস্যউজ্জ্বল লাগছে কোকো কে। বড়ো বড়ো লোমশ পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে উষশী।
“কেমন আছ কোকো? নিশ্চয়ই দুদিন কষ্টে ছিলে। দেখলে তো,তুমি কোনো কথা শুনতে চাও না। এভাবেই নিজের ক্ষতি করে ফেলো। তোমার কিছু হলে আমি কি করে থাকব রে কোকো?”
শেষ বাক্য বলার সময় উষশীর গলা ধরে এসেছিল। তার দু চোখ টলটলে। একটু হলেই যেন কেঁদে ফেলবে।
“জেদি মেয়ের ও বুঝি মন খারাপ হয়?”
ঝটপট চোখের জল আড়াল করল উষশী। ইষৎ হাসিতে অধর রাঙিয়ে বলল,”তা কেন হবে? আমি তো আমার কোকো কে পেয়ে খুব খুশি।”
“তাই? এই যে আমি ভোর বেলায় মাইলের পর মাইল পেরিয়ে কোকো কে নিয়ে এলাম। এর জন্য তো আমায় কিছু গিফ্ট দিতেই পারো।”
“কি দিব? আমার কাছে এখন কিছুই নেই। এই আমি আর কোকো টা ছাড়া।”
“ও হো, আবার মন খারাপ করছো কেন?”
“মন খারাপ না। আপনাদের অসুবিধায় ফেলে দিয়েছি।”
“এসব কেন বললে?”
“আপনার ফ্যামিলি আপনাকে ফিরে পেতে চাচ্ছে। আমার জন্য যেতে পারছেন না। খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি আপনাদের।”
“এসব কে বলল উষশী?”
“বলে নি,শুনেছি। আপু ফোনে বলছিল আর কিছু দিন সময় দিতে।”
উষশী’র মন খারাপ দেখে উষ্ণ শ্বাস ফেলল অভিরাজ। ধীরে মেয়েটি’র কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
“বোকা। এসব নিয়ে মন খারাপ করবে না। আমি এমনিতেই এখন বাসায় যেতাম না। নিজেকে এভাবে দোষারোপ কোরো না তো।”
উষশী পুনরায় কিছু বলল না। কোকোর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে কাউচে বসল।
“কোকো খাবার খাবে তো?”
“হুম। ক্ষিধে পাবার ই কথা।”
“এদিকে নিয়ে আসো। খাবার দিচ্ছি।”
“আপনি ক্যাটদের বিষয়ে এত জানেন কি করে?”
“আমি ছোট থেকেই প্রাণী ভালোবাসি। এর মধ্যে বিড়াল ছানা অন্যতম।”
“বুঝলাম।”
“জানো,আমার চারটে বিড়াল ছিল।”
“এখন নেই?”
“উহু। একবার মারাত্মক রোগে ধরেছিল। তারপর শেষ হয়ে গেল চোখের সামনে।”
ঘটনা শোনার পর কেমন করে উঠল উষশী। তার দু চোখে ভয়। আরেকটু কাছে টেনে নিল কোকোকে।
“ভয় নেই। কোকোর কিছু হবে না।”
“হুম।”
“ওকে দাও আমার কাছে।”
কোকো সায় পেয়ে লাফিয়ে নামল। অভিরাজ পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কোকো তার লেজ নাড়িয়ে ক্যাট ফুড খাচ্ছে।
“নাস্তায় কি খাবে?”
“একটা হলেই হবে।”
“কেমন কথা এটা?”
“হু।”
“মন খারাপ করেছ?”
“কোকো আমার ভীষণ প্রিয়। ওর কিছু হলে আমি বড়ো একা হয়ে যাব।”
“তোমার মা,বাবা তো আছে।”
“হুম।” বলেই চুপসে গেল মেয়েটা। পরিবারের কথা মনে পড়লেই বুকটা কেমন হু হু করে। এদিকে অভিরাজ আর লাবণ্য’র প্রতি অন্যরকম টান অনুভব হয়। দোটানায় ভুগতে থাকা মেয়েটির বাহুতে স্পর্শ করল লাবণ্য। মাত্রই ঘুম ভেঙেছে তার।
“বাবু,কি হয়েছে?”
“কোকোর কথা ভাবছিলাম।”
“বাহ,কোকো কে নিয়ে এসেছে! অভি, রাতে তো বললি না।”
“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।”
“হুম। উষশী নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে।”
“সাথে মন খারাপ ও করে ফেলল।”
“ওমা কেন?”
“তাকেই জিজ্ঞাসা কর।”
“উষশী, বাবু কি হয়েছে?”
মেয়েটির থুতনি ধরে উঁচু করল লাবণ্য। তার ঘুম থেকে উঠা মুখটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। টানা দুটি চোখ আর চিকন ঠোঁটটা যেন সব থেকে সুন্দর।
“কোকোর কিছু হলে কি করে থাকবে সেটাই ভাবছিল।”
“এটা নিয়ে মন খারাপ?”
উষশী একটা কথাও বলল না। অভি হাত মুছে বলল,”ওর মস্তিষ্ক খুব এডভান্স চিন্তা করে।”
“এটা তো ভালো দিক।”
“বাট ওর ক্ষেত্রে নেগেটিভ চিন্তা বেশি।”
“তাই? দেখি তো আমার দিকে তাকাও তো উষশী।”
উষশী’র মুখটা নিজেকে ঘুরাল লাবণ্য। এই পনের বছরের কিশোরীটিকে অত্যন্ত সুন্দরী বললেও কম মনে হবে। তার বাহ্যিক সৌন্দর্য লাবণ্য’র চোখ দুটোকে নামিয়ে দিল। উষ্ণ শ্বাস ফেলল সে।
“এসব নিয়ে ভাববে না। একটা বিষয় তো জানোই, কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না।”
কথা শেষে অভিরাজের দিকে তাকাল লাবণ্য। এই কথাটা অভিই শিখিয়েছে তাকে। ইতোমধ্যেই জুস বানিয়ে ফেলেছে অভিরাজ। সে কাজ করতে পছন্দ করে। তবে বাড়িতে থাকতে খুব বেশি করা হতো না। লাবণ্য অভি’র বানানো স্পেশাল ফলের জুস খেতে খুব পছন্দ করে। সে কোনো মতে ফ্রেস হয়ে জুস ঢেলে নিল।
“কি করছিস টা কি।”
“এটা অস্থির। তোর হাতের জাদু,উফ।”
“পাগল।”
“উষশী খেয়ে দেখো, যদি প্রেমে না পড়ো তবে আমার নাম বদলে ফেলবে।”
ওর কথায় মুচকি হাসল অভিরাজ। কিছুটা মন ভালো হয়ে এসেছে উষশী’র।
“সত্যিই খুব মজা?”
“হুম। সেরা, অভি’র মতো কেউ বানাতে পারবে না।”
লাবণ্য মিথ্যে বলি নি। সত্যিই খুব মজা এটা। উষশী এক গ্লাস শেষ করে আরেক গ্লাস নিল। লাবণ্য ইশারায় কিছু বলল অভিকে। ছেলেটা হতাশ কণ্ঠে জানাল।
“ওর ফ্যামিলির কাউকেই পেলাম না।”
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে উষশী। লাবণ্য এখনো হসপিটালে আটকে আছে। মেয়েটির ইন্টার্নশিপের দিন গুলো বড়ো ঝামেলায় পার হয়। সে একজন ডাক্তার হলেও বেশি সময় হসপিটালে থাকতে পারে না। কিছু সময় যেতেই বাইরে চলে আসে। এই নিয়ে অভি’র কাছে অভিযোগ ও এসেছে। ছেলেটা লাবণ্যকে ভীষণ রকমের ভালোবাসে। তাই কিছু বলেও না। তবে একটু বেশিই করে ফেলছে লাবণ্য। এভাবে তার ডাক্তার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। মনে মনে ঠিক করল লাবণ্য’র সাথে কথা বলবে। খাবার হাতে নিয়ে উষশী’র রুমে ঢুকতেই অভি’র মন লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলল সে। উষশী দূরন্ত কিশোরী। হাঁটুসম জামা কাপড় পরে থাকে। তবে চট করেই তার মসৃন পায়ের দিকে চোখ পড়ায় অস্বস্তিতে পড়ল অভিরাজ। নিজের বুকের ভেতর হাত থেকে বলল,’এটা স্বাভাবিক অভি। নিজের মনকে সামলাও। এতটাও অ্যাসট্রে নও তুমি।’
দু বার শ্বাস নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল সে। ফুল ভলিউমে এসি ছেড়ে রেখেছে। উষশী শীত প্রধান দেশে বড়ো হয়েছে। সেই সুবাধে বাংলাদেশের সামান্য গরম তার সহ্য হয় না। কিছুটা কুকরে গিয়েছে মেয়েটা। চাদর টেনে দিল অভিরাজ। সবে দেড়টা বাজে। এখুনি ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। সে টেবিলে দুপুরের খাবার রেখে পাশে বসল। কোকো জেগে গিয়েছে। লেজ নাড়িয়ে ক্ষুধার কথা জানান দিচ্ছে।
“কোকো, আমার সাথে আয়। কথা বলবি না। তোর বন্ধু ঘুমিয়ে আছে।”
আশ্চর্যজনক ভাবে কোকো ‘টু’ শব্দটিও করল না। প্রাণীদের বোধহয় বিশাল ক্ষমতা থাকে। এরা যাকে ভালোবাসে তার সব কিছুই যেন বুঝতে পারে। কোকোর পিঠময় শ্বেত রঙা পশম গুলোতে গাল ছোঁয়াল অভিরাজ। তার ভেতরটা নরম তুলতুলে শরীর পেয়ে গলে গেল যেন। উষশী’র তুলতুলে হাতের কথা মনে পড়তেই নিজের উপর বিরক্তবোধ হলো। নিজের থেকে বারো বছরের ছোট এক কিশোরী তার মনের ভেতর এ কেমন উত্তাপ ছড়াচ্ছে!
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি