বর্ষার_এক_রাতে,২৮ এর (১ম অংশ)

বর্ষার_এক_রাতে,২৮ এর (১ম অংশ)
সাদিয়া

আহফিন উত্তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল ভিতর থেকে। মিজান পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। তার ভেতরেও কষ্ট হচ্ছে। কতটা করুণ নিদারুণ ভালোবাসার কাহিনী। কি অসহনীয় কষ্টই না মানুষটা ভেতরে পুষে রেখেছে। মিজানের খুব রাগ হচ্ছিল তূবার উপর। এত ভালো একটা মানুষকে কতটা কষ্ট দিয়েছে ওই মেয়েটা। হয়তো আহফিন সেদিন ওই কথা গুলি না বললে তূবা যেতো না। কিন্তু এখানে আহফিনের কোনো দোষই দেখতে পাচ্ছে না মিজান। আহফিনের দিক থেকে সে একদম ঠিক করেছে। তার রাগ করে বলাটা স্বাভাবিক। আর তূবা? সেই বা কেন এত দরদ দেখাতে গেল আরেক ছেলের উপর? এত মানবতা দেখানোর কি দরকার ছিল? এতই যখন ভেতরে মায়া তখন আহফিন কে সব টা বলে বুঝিয়ে করল না কেন? ভালোবাসার মানুষের কষ্টের চেয়েও কি আরেক জনের প্রতি মায়া বেশি ছিল? রনির দেওয়া কছমের কথা চিন্তা করলেও মিজানের শুধু মনে হচ্ছে তূবারই দোষ। আহফিনের কষ্টের কথা শুনে তার ভেতরেই এখন কত টা কষ্ট হচ্ছে। না জানি ওই মানুষটার ভেতরে কতটা আগুন জ্বলেছে জ্বলছে এত গুলি বছরে।

আহফিন ব্যালকুনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিজান ঘর থেকে এগিয়ে গেল সেদিকে।
“স্যার।”

“….

“স্যার আপনি একদম ওই মহিলার জন্যে আর কষ্ট পাবেন না। ওই মহিলা কে আপনি ভুলে যান স্যার।”

“সুশশশ। এসব বলো না মিজান। তূবা আমার অন্তরে আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে।”

“কিন্তু উনি তো.”

“তূবা কে আমার বুকে নিশ্বাস থাকা কালিনী আমি ভুলতে পারব না।”

“….

মিজানের চোখের কোণায় পানি চলে এসেছে।

“মিজান তুমি এখন যাও। আমি একটু একা থাকি।”

“স্যার আপনি এখন কাঁদবেন তাই না?”

আহফিন দ্রুত মিজানের দিকে তাকাল। নিষ্পল তাকাল। মায়াভরা কন্ঠ আর চোখ দেখে আহফিন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। হুট করে মিজান কে জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আহফিন। শব্দ করে কাঁদছে সে। মিজানের বড্ড কষ্ট হচ্ছিল আহফিনের কান্না তে। মনে হচ্ছিল আহফিনের কান্নার আওয়াজে এই বুঝি বুকটা ফেটে যাবে। কি কষ্টই না লোকটার ভেতরে জমা। আহহ এতটা যন্ত্রণা মানুষটা পুষছে কি করে।

একাধারে বর্ষণের পর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশের মতো নির্মল লাগছে আহফিন কে। শান্ত গলায় সে মিজান কে বলল
“গাড়ি বের করো পার্কে যাবো।”

মিজানের চাউনি দেখে আহফিন নিজ থেকেই বলল “অপেক্ষা করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা করাটা এমন কঠিন কাজ নয়। মনের কোণায় আশা আছে। হয়তো আমি আমার জীবনের সুখ আবার ফিরে পেলাম।” ঠোঁট প্রসারিত করে বিষাদময় হাসল আহফিন।

—-
ডায়রি নিয়ে সুন্দর করে লিখতে বসেছে আহফিন। খোলা আকাশের নিচে মনের যত কথা, যন্ত্রণা, আবেগ, অভিমান সব ঢেলে দিচ্ছে এখানে। ভেতরে কত কষ্ট অভিমান যন্ত্রণা আছে তা আল্লাহ আর সে ছাড়া শুধুমাত্র এই ডায়রিরই জানে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠল “হিরো আঙ্কেল।”
বুকটা ধক করে বারি দিয়ে উঠল আহফিনের। আচমকা তাকাল ডাকের অনুসারে। তাহফিবা কে দৌড়ে আসতে দেখে ছুটল সেও। তাহফিবা কে কোলে তুলে নিয়ে অসংখ্য চুমু দিতে লাগল সে। তাহফিবাও হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরল।

“কেমন আছো হিরো আঙ্কেল?”

বুক ভারি হয়ে আসে আহফিনের। চোখ গুলি ঝাপসা হতে শুরু করেছে কেন? আহফিন তাহফিবার দিকে তাকিয়ে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দূর থেকে মিজান গার্ডের সাথে চা খেতে খেতে এমন মনোরম দৃশ্য দেখে তৃপ্তির হাসি দিল।

“আমার লক্ষ্মী সোনা কোথায় ছিলে এই তিন দিন?”

“আসলে মাম্মাম খুব বিজি তো তাই আসতে দেয় নি। তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”

আহফিন এবার চোখের পানি ছেড়েই দিল।
“খুব অপেক্ষা করেছিলাম।”

চোখের পানি মুছে দিয়ে তাহফিবা চুমু দিল আহফিনের গালে। তারপর আহফিন বলল
“আমার লক্ষ্মী সোনা পাখি চকলেট খাবে?”

“চকলেট?”

“জানো তিন দিনে তোমার জন্যে কতগুলি চকলেট এনেছি?”

“কই দাও।”

আহফিন তাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসল। গাল ভরা হেসে সে তাহফিবা কে চকলেট দিল। তাহফিবাও মুচকি হেসে খেয়ে বলতে লাগল “মজা।” ফিক করে হাসল আহফিন।

তাহফিবা যাওয়ার সময় আহফিন ব্যাগে আনা চকলেট গুলি দিয়ে দিল তাকে। তাহফিবা যখন চলে যাচ্ছিল তখন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার আন্টি এসে নিয়ে গেছে তাকে। তাহফিবা ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। অথচ আহফিন জানেই না ব্যাগের ভেতর চকলেট ছাড়াও আরেকটা জিনিস চলে গেছে।

আজ একটু শান্তি লাগছে বুকে। ভালো ঘুম হবে বোধহয় আজ। আহফিন এক গাল হেসে বাড়ি ফিরল।

—-
তাহফিবা কাল যাওয়ার সময় তাকে দাওয়াত দিয়েছিল তার মাম্মামের শপের একটা অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু ঠিকানাটাই তো নেওয়া হয়নি। তাহলে সেখানেই চলে যেতো। কিন্তু এখন উপায় না পেয়ে পার্কেই যেতে হবে। তাহফিবা কথা দিয়েছে আজ আসবে। আজ মন খারাপ করে নয়। হাসি নিয়ে সে পার্কে গেছে।

তাহফিবা এখনো আসে নি। আজ আসতে দেড়ি হচ্ছে দেখে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তবে কি আজ আসবে না? কিন্তু সে তো বলেছে আজ আসবেই। তাকে কেন সবাই এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করায়?

আহফিন তখন মন মরা হয়ে বসে ছিল। পিছন থেকে তাহফিবা পা টিপেটিপে এসে আহফিনের চোখ ধরল। ছোট দুটি হাতের স্পর্শ পেয়ে আহফিনের বুঝতে বাকি রইল না এটা তার তাহফিবাই।

“আমার টুনটুনি ময়না পাখিটা বুঝি এতক্ষণে আসল?”

“আমি আবার এখনি চলে যাবো।”

“কেন?” বলে আহফিন তাকে পিছন থেকে সামনে এনে কোলে তুলে বসাল।

“কেন চলে যাবে তুমি? এসে তো বসলেও না আর এখনি..”

“তোমাকে না বলেছিলাম মাম্মামের বুটিকশপের অনুষ্ঠান টায় যেতে।”

“তাহফিবা কি আমাকে ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল?”

তাহু কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর চোখ খুলে বলল “ইশশ মনেই নেই।”

তাহফিবার ভাব দেখে হেসে উঠল আহফিন। নরম তুলতুলে গালে চুমু খেলো সে। কি যেন বলতে যাবে তার আগেই অতিচেনা সেই সুরেলা মধুরকন্ঠ শুনা গেল।
“তাহফিবা।”

আহফিনের বুকে ধরাক করে আওয়াজ হলো। হৃদপিন্ড টা অনবরত কাঁপছে। হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। আসলেই সে ঠিক শুনেছে কি না বুঝে উঠতে পারছে না। ভীষণ ভয় নিয়ে আহফিন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। হঠাৎই তার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে। ঠোঁট গুলি অনবরত কাঁপতে লাগল। চোখের সামনে এত গুলি বছর পর তূবা কে দেখে আহফিন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তাহফিবা কে নামিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ আহফিন কে দেখে চমকে উঠল তূবা। ভেতরে উথালপাতাল ঝড় বইছে। ভেতর থেকে চিৎকার করা কান্না ভেসে আসতে চাইছে। চোখ টলমল হয়ে আসছে তূবার। ভেতরের চাঁপা কান্না যেন উপছে আসতে চাইছে।

তূবা আগের থেকে কত সুন্দর হয়েছে। কি সুন্দর শাড়ী পড়ে গুছিয়ে রেখেছে নিজেকে। একদম পাক্কা মোহনীয় রমনী। আহফিন নিজেকে স্থির করতে চাইল। পাশ ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ফের সামনে তাকাল। না সে সত্যিই দেখছে। তার সামনে তার ভালোবাসা। সেই পরিচিত আর কাঙ্ক্ষিত মুখ। পাঁচ বছর পর তূবা কে দেখে ভেতর থেকে কতশত আবেগ ভেসে উঠছে উথাল সাগরের ঢেউয়ের মতো তা নিজের থেকে ভালো আর কেউ বুঝবে না। মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে তার। কিন্তু নিমিশেই মিলিয়ে যায় সেই হাসি। তাহফিবা দৌড়ে গিয়ে তূবা কে জড়িয়ে ধরে বলল “মাম্মাম।”

তূবা কে দেখে যতটা অবাক হয়েছিল তার চেয়ে হাজারগুন বেশি বিস্মিত হয়েছে মাম্মাম ডাক শুনে। তূবার মেয়ে তাহফিবা? তারমানে তূবা.. আহফিন নির্জীব শরীর টা নিয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল। তার চিন্তা শক্তিতেও আসছে না তূবা.. চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।

“মাম্মাম এটা আমার হিরো আঙ্কেল। আসো পরিচয় করিয়ে দেই।”

তূবার ভেতরটা টা মরিচা পড়তে পড়তে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার মতো লাগছে। আহ কি যে কষ্ট আর জ্বালাপুড়া হচ্ছে ভেতরটায়!

“ও মাম্মাম।”

তূবার চোখ পানিতে টলমল করছে। দৃষ্টি সামনে থাকা কান্নারত সেই অতিপ্রিয় মানুষটার দিকে। ইচ্ছা করছে কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। বুকে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ। তূবা প্রাণশক্তি দিয়ে ঢোক গিলে দাঁতে দাঁত কাটল। তারপর তাহফিবার হাত ধরে হাটতে শুরু করল। অথচ শরীরে এক বিন্দু শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখনি বুঝি ঢলে পড়বে জমিনের বুকে।

তূবা কে চলে যেতে দেখে আহফিন নিজেকে শক্ত করল। ভেতরের সুপ্ত রাগ টা পিন পিন করে নড়তে শুরু করেছে। চোখ মুখ শক্ত করে সে তূবা কে ডাকল। পিছু যেতে যেতে তূবা কে ডাকতে লাগল। তার সব টা জানতে হবে। কি করে তূবা নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারল? একবারও কি তার কথা মনে পড়ল না তার? দ্রুত পায়ে যেতে যেতে আহফিন “তূবা তূবা” বলে ডাকতে লাগল।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here