বর্ষার_এক_রাতে,পর্ব-২৪,২৫
সাদিয়া
২৪
আজ বিষাদে ছেয়েছে মন
তুমি হীনা নীল আকাশে
রইব আমি কেমনে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তূবার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সে বাড়ি ফিরতেই শিরিণ বেগম বললেন “হ্যাঁ রে তোর না আরো আগে আওনের কতা আছিলো?”
তূবা চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে কিছু জিনিস ব্যাগে ঢুকাতে লাগল। তখন তুসি এসে বলল “আপা তোমার এত দেরি হলো যে?”
তূবা তখনো জবাব দেয় নি। তুসি এবার বলল
“আপা ভাইয়া আসবে না?”
তূবা গর্জে উঠল।
“না ভাইয়া আসবে না। ভাইয়া। এত ভাইয়া ভাইয়া করার কি আছে? ভাইয়া যখন ছিল না তখন কি আমাদের দিন যায় নি? নাকি যাবে না? তোর ভাইয়া যদি এতই আপন হয়ে থাকে তাহলে তো তোর জীবনে আমার কোনো দরকারই নেই।”
“আপা তুমি রাগ করছো কেন? আমি তো শুধু আসবে কি না জিজ্ঞেস করলাম।”
“না করবি না। আর ভাইয়া ভাইয়া করবি না। আর কখনো উনাকে নিয়ে কোনো কথা বলবি না।”
“….
“তূবা তুই কি জামাইয়ের লগে কাইঝা করছোস?”
“আমি বললাম না মা উনাকে নিয়ে আর কেউ কথা বলবে না।”
শিরিণ বেগম কে আর কিছু বলতে না দিয়ে তূবা ওয়াশরুমে চলে গেল। শিরিণ বেগম আর তুসি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
—-
গাড়িতে বসে তুসি ভয় নিয়ে আবার তূবা কে ডাকল।
“আপা।”
“হুম বল।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
তূবা তুসি কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
“কর সোনা।”
“আপা তোমার কি কিছু হইছে?”
এত কষ্ট করে নিজেকে শক্ত করে নেওয়া মন টাও তুসির কন্ঠে গলে যেতে চাইছে। কিন্তু তূবা আবার নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলল
“তেমন কিছু না সোনা।”
“….
“এসব বাদ দিয়ে তুই আল্লাহ আল্লাহ কর। কাল যেন সব কিছু ঠিকঠাক মতো হয়।”
“আপা আমাকে নিয়ে তুমি খুব চিন্তা করো তাই না?”
“চিন্তা করবো না তো কি? তুই ছাড়া আমার জীবনে আছে টা কে?”
“তুমি আমার সব আপা। তুমি থাকলে আমার আর কিছু লাগবে না। তবুও..”
“তবুও কি?”
“কিছু না আপা। আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরো তো।”
তূবা তুসি কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
তুসি আপন মনে ভাবতে লাগল অনেক কিছু। কয়দিন ধরে ভেতরটা তার ধড়ফড় ধড়ফড় করে। রাতে কত বাজে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সে। তারপর আর ঘুম হয় না। নিজে নিজেই হাজার করে ভাবতে থাকে। তার শুধু মনে হয় সে আর ওখান থেকে ফিরতে পারবে না। সবসময়ই মনে হয় তার জীবনের সময় এতটুকই।
—-
হসপিটাল পৌঁছে তূবা তুসি কে ভর্তি করিয়ে নিল। তারপর যা যা করার সব করল। হসপিটালের একাউন্টে ৫ লাখ টাকা জমাও দিয়ে দিয়েছে। আহফিনের কার্ডটা তার কাছেই ছিল। এটা সে তুসির চিকিৎসা বাবদই দিয়েছিল। এছাড়া কোনো উপায়ন্তরও নেই।
তুসি কে ডক্টর কিছু টেস্ট দিয়েছে। রিপোর্ট পেয়ে ডক্টর যখন তূবা কে ডাকল। তখন সে ডক্টর এর কাছে গেল অনেক টা চিন্তা নিয়ে।
“বসুন।”
“….
“তুসির সব ঠিকঠাক আছে। তবে তাকে আরো সাহস যুগাতে হবে। তার আপসেট থাকলে চলবে না। ভয় পেলে ভিতর থেকে সে দূর্বল হয়ে যাবে। এতে আমাদের কিছু করার থাকবে না। আর আপনারা তাকে সাহস দিবেন। আপনার চিন্তা করবেন না আর ওকেও চিন্তা করতে দিবেন না। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কাল অপারেশন টা করব আমরা। ইনশাল্লাহ সব ভালো মতো হয়ে যাবে।”
“ঠিক আছে ডক্টর আসছি।”
যেতে যেতে তূবা ভাবতে লাগল “এই কয়দিনে নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে তুসির দিকে ঠিক করে নজরও দিতে পারি নি। মেয়ে টা হয়তো ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়ে আছে। নিজেকে নিয়ে হয়তো খুব চিন্তায় আছে। না তুসির কিছু হতে পারে না। তুসি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। ওর কিছু হলে আমার কি হবে? আমার বেঁচে থাকার জন্যে হলেও তুসি কে সুস্থ হতে হবে।”
তূবা গিয়ে দেখে তুসি বেডে শুয়ে আছে। হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে। তাকে খুব ধূসর দেখাচ্ছিল। পাশের সোফায় শিরিণ বেগম বসে আছেন।
তূবা গিয়ে তুসির পাশে বসল। তুসির একটা হাত তার দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিতেই তুসি চোখ মেলে তাকে ডাকল “আপা।”
তূবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
“আপা তুমি কাঁদছো?”
তূবার চোখের বাঁধ এবার আর ঠিক থাকল না। লেগে আসা কন্ঠে বলল
“দূর পাগলি না। তুসি আমার লক্ষ্মী বোন তুই কি ভয় পাচ্ছিস? পাগলি তুই ভয় পাস না। দেখবি কিছুই হবে না তোর। দেখ তুই ছাড়া কে আছে আমার? আমার জন্যে হলেও তো তোকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। আমার পাশে তুই না দাঁড়ালে আমার কি হবে বল তো? আমার লক্ষ্মী সোনা বোন একদম ভয় পাস না। আল্লাহ কে স্মরণ কর। দেখবি উনি সব ঠিক করে দিবে। কাল সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে হবে দেখিস। এসব নিয়ে তুই একটুও ভয় পাস না চিন্তাও করিস না। আমি আছি না তোর পাশে? ইনশাল্লাহ কাল সব ঠিক করে দিবে আল্লাহ। একদম চিন্তা করিস না।”
তুসিও কেঁদে দিল এবার।
“হুম আল্লাহ কাল সব ঠিক করে দিবে আপা। কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একদম কেঁদো না।”
দুইবোনের কান্না দেখে শিরিণ বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে নিলেন। আজকাল তার মন টাও বড্ড খারাপ লাগে। ভেতরটা সবসময় উথাল হয়ে থাকে।
মাঝরাত পর্যন্ত দুই বোন গল্প করেছে। তূবার বুকে মাথা রেখে তুসি যেন একটু শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছিল। তারপর নার্স এসে তুসি কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে গেল। তূবা তুসির পাশে বসে থেকে ভাবনার সাগরে ডুব দিল। তুসি কে নিয়ে সেও ভয় পাচ্ছে। মনে মনে কতশত দানের কথা চিন্তা করেছে সে। তুসি ভালো হয়ে গেলে তিনটা মসজিদে খতম পড়াবে। ৫ টা মাদ্রাসার ছেলেমেয়েকে খাওয়াবে। আরো কত কি। আহফিনের কথা বড্ড মনে হচ্ছে যখন মনে আসছে আহফিন কে ছাড়া এখন থেকে তার থাকতে হবে তখনি দম আটকে আসছে। নিশ্বাস ভার হয়ে আসছে। আহফিন কে ছাড়া বেঁচে থাকবে কি করে সে? লোকটার নিশ্বাস না পেলে তো তার ঘুমই আসে না। আর এই মানুষটাকেই ছেড়ে থাকতে হবে। বুক ফেটে আসে তূবার। আবার যখনি আহফিনের বলা কথা গুলি মনে পড়ে তখনি লোহার মতো নিজেকে শক্ত করে নেয় সে। এসব বলার পরও সংসার করা যায় না। নিজেকে নিজে এতটাও ছোট মনে করে না সে। তূবা চোখের পানি মুছে নিজেকে আরো শক্ত করে নিতে চায়। যেটা হওয়ার হয়ে গেছে এসব নিয়ে আর সে ভাবতে চায় না। আহফিন বর্তমানে তার অতীত।
সকালে ঘুম থেকে তুসি উঠে দেখে তূবা তার পাশেই বসে আছে। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসি দেয় তুসি। তূবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
নার্সরা নিয়ে যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ তূবার বুকে লুকিয়ে ছিল সে। তূবাও বাচ্চা মানুষের মতো আগলে রেখেছিল তাকে। তুসি কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে শ্বাস টেনে নেয় সাথে তূবা গায়ের সেই প্রিয় ঘ্রাণ!
ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে তুসি ডাক্তার কে বলেছে,
“আমার সাথে আমার আপা কে নিয়ে যান না। আপা থাকলে দেখবেন কোনো ভয় আমাকে ছুঁবে না। নিয়ে চলুন না আমার সাথে আপা কে।”
“না মামুনি এটা হয় না। আর তুমি ভয় পেও না। তোমার তেমন কিছুই হবে না। দেখবে খুব তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি।” তুসির মাথায় হাত রেখে বলল ডাক্তার।
“….
তুসি আর কিছু বলে নি। সকাল থেকে একটা কথাও বলেনি তুসি। মাত্র ডাক্তার কে বলা কথাটা ছাড়া। চোখের পাতা না ফেলা দৃষ্টি দিয়ে দেখেছে নিজের মা আর আপা কে। তুসি টলমল করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আপার দিকে। ওই তো পাশেই তার মা কান্না করছে দেখতে পাচ্ছে তুসি। নার্সরা তাকে নিয়ে অন্ধকার গোহার মতো ঘরটায় নিয়ে যেতে লাগল। ওটিতে ঢুকার আগে শেষ বার তুসি ডাকল “আপা।”
তূবা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। আপনাআপনি পানি পড়ছে চোখ বেয়ে। তুসির ডাক শুনে হৃদয় কেঁপে উঠল তার। মনে হচ্ছে কেউ কলিজা টা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে দৌড়ে গিয়ে তুসি কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তার আগেই ওটির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তুসি কে নিয়ে সবাই ওটির ভিতরে চলে গিয়েছে। ওটির বাহিরে তখন লাল বাতি জ্বলে উঠেছে।
আহফিন গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে হসপিটাল যাবে বলে। তুসি কে না দেখে পারবে না সে। নিজের ছোট বোনের মতো করে ভালোবাসে তাকে। তাড়াতাড়ি যেতে চেয়েও পারে নি। কাল রাতে অতিরিক্ত ড্রিংক করে সকালে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাই চেয়েও পারেনি। মাঝ রাস্তায় চলে আসার পর তার ফোনে কল এলো। ম্যানেজার কল দিয়েছে। তাকে এখনি অফিস যেতে বলেছে। কারণ আগামীকালকের মিটিং টা আজ করতে হবে। আগামী কাল তারা নাকি আবার বিদেশ চলে যাবে। আহফিন মিটিং টা কেন্সেল করে দিল। তখন ম্যানেজার বলল
“স্যার প্লিজ এমন করবে না। একটু চিন্তা করুন ২০ কোটি টাকার ব্যাপার। আপনি না এলো মিটিং টা হবে না। কয়েক টা ঘন্টারই তো ব্যাপার। স্যার চলে আসুন না। না হলে কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। প্লিজ চলে আসুন স্যার।”
আহফিন ভাবল মিটিং টা শেষ করে হসপিটাল যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিং শেষ করে চলে যাবে ওখানে।
—-
তূবা হসপিটালে বারান্দায় বসে আছে। পাশেই তার মা কান্না করে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছে। দুই ঘন্টার উপরে হলো এখনো ডাক্তার বের হচ্ছে না। তূবার ভেতরটা ধড়ফড় করছে শুধু। প্রতিটা মুহূর্ত তূবার অস্থির লেগেছে। বারবার মন চাইছে তুসির কাছে চলে যেতে। তার মনে হচ্ছে তুসি এখানে বড্ড একা। নিজেকে নিজের এত টা অসহায় কোনো দিন মনে হয়নি তূবার। ভেতরটা এত অস্থিরতা কোনো দিন করে নি তার। একটুও স্থির থাকতে পারছে না সে। ভেতরটা ছিড়ে কান্না আসছে কেন এত?
প্রায় তিনটা ঘন্টা পার হওয়ার পর তূবা খেয়াল করল ওটির লাল বাতি নিভে গিয়েছে। সে পাখির মতো উড়ে গেল ওটির সামনে। ডাক্তার দরজা ঠেলে বের হলেন। মুখের মাক্স আর হাতের গ্লাভস খুললেন তিনি। তূবা এইটুক সময়ে চার পাঁচবার তুসির কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। তারপর ডাক্তার জানালেন,
“আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তবে তুসি আল্লাহ মেহমানদারি কবুল করে নিয়েছে।”
তূবার পৃথিবী টা মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে এলো। কয়েক পা পিছনে চলে গেল সে। ডাক্তারের দিকে তখনো হ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিল তূবা। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। লেগে আসা কন্ঠে তূবা জিজ্ঞেস করল
“ক কি ব বলছেন ডাক্তার?”
“অপারেশনের মাঝপথেই তুসির পার্লস নিল হয়ে আসছিল। আমরা সব রকম চেষ্টা করলাম কিছু হলো না। কারেন্টের হিট দেওয়ার পর দুইবার শব্দ করেছিল শুধু। তুসি কে আপনারা এখন নিয়ে যেতে পারেন শেষ কাজের জন্যে। এই প্রথম হয়তো কোনো পেশেন্টের কারণে চোখে পানি এসেছে। কারণ তুসির মতো দেখতে আমারও একটা মেয়ে আছে। আমরা খুবই দুঃখিত।” চোখের কোণার পানি মুছে ডাক্তার চলে গেলেন।
শিরিণ বেগম আকাশ ফাটানো এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। উনাকে সবাই ধরাধরি করে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগল। সেদিকে তূবার কোনো খেয়াল নেই। সে পাথরের মতো ওটির ভিতরে তাকিয়ে আছে। সাহস হচ্ছে না ভেতরে যাওয়ার। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। নিজেকে যেন প্রাণ শূন্য লাগছে তার। কয়েক মিনিট পর তুসি কে নিয়ে আসা হলো। তূবা সেখানে তাদের আটকালো। তুসির মুখ থেকে কাপড় টা সরিয়ে দেখতে পেল তুসি কে। কি সুন্দর চোখ বুজে আছে। তুসির সৌন্দর্য যেন এখন দ্বিগুণ দেখাচ্ছে। তূবা চোখের পানি ফেলে দিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। তুসির গালে হাত দিয়ে বলল
“তুসি আমার লক্ষ্মী সোনা দেখ না এরা কিসব বলছে। তুই চোখ খোল না সোনা। দেখ তোর আপা দাঁড়িয়ে আছে। এই তুসি আমি ডাকছি না? তুসি রে তোর আপা তোকে ডাকছে আর তুই শুনতে পাচ্ছিস না? তুসি আমি কিন্তু এখন রেগে যাবো না উঠলে। কিরে চোখ খোল। তুসি চোখ খুলছিস না কেন? তুসি তুই আমার সাথে মজা করছিস তাই না? লক্ষ্মী সোনা বোন আমার এমন মজা করিস না। তোর আপার কষ্ট হচ্ছে তুই দেখতে পাচ্ছিস না?”
তূবার এমন পাগলামি পূর্ণ কথা দেখে আশেপাশে অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তূবার দিকে। ভাবছে মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল নাকি? একটু পর শিরিণ বেগম উঠলেন। মেয়ের কাছে চিৎকার করে বিলাপ পেরে গিয়ে ডাকলেন। কিন্তু তুসি যে সুন্দর করে আরামের ঘুম দিয়েছে। এই ঘুম আর কখনো ভাঙ্গবে না। সারা দুনিয়ার ডাকেও ভাঙ্গবে না। শিরিণ বেগম কান্না করতে করতে আবার জ্ঞান হারাল। তূবা তখনো তুসি কে ডেকে যাচ্ছে উঠবার জন্যে। সবাই তাকিয়ে শুধু তাদের দেখছে। শিরিণ বেগম ঢলে পরা চোখ নিয়ে আবার তাকালের মেয়ের দিকে। উঠতে গিয়ে তিনি আবার পড়ে যান বুকে হাত দিয়ে। কি হলো কে জানে? বুকে হাত দিয়ে কবুতরের মতো ছটফট করতে লাগলেন তিনি। নার্সরা এসে উনাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
“তুসি তুই উঠছিস না কেন? আমার সাথে কি মজা করছিস? তোরা কেউ ভালো না। সবাই আমাকে কষ্ট দিস। এই তুসি উঠ না। এই তুসি একবার আপা বলে ডাক। তুসিরে আমার বোন টা একটু কথা বল না আপার সাথে। তোর আপা এখন থাকবে কি করে রে তুসি? আপা কে ধোকা দিয়ে কেন চলে গেলি? কি করে স্বার্থপর হয়ে গেলি তুসি?”
তুসি তো তার ঝলঝলা মুখ নিয়ে সুন্দর করে শুয়ে আছে। আপার এত ডাকও তার কানে যাচ্ছে না। আর কোনো দিন যাবে না এই ডাক। উঠে মমতা ভরে ডাকবে না “আপা” বলে।
তুসির কান্না আর কথা শুনে আশেপাশের মানুষ করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেউ কেউ নীরবে চোখের পানি ফেলছে। ইচ্ছা করে নয়। এমনিতেই পানি চলে আসছে।
“তুসি। আর উঠবি না তুই? কেন চলে গিয়েছিস আপা কে ছেড়ে? আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবি না তুসি? আমার গায়ের ঘ্রাণ শুকবি না? এতটা নিষ্ঠুর আল্লাহ কি করে বানিয়ে দিল তোকে। আল্লাহ আমাকে কেন দেখল না তুসি? আমার বোনের বদলে আল্লাহ আমাকে নিয়ে যেতো। আমার তুসিরে। আল্লাহ আমার তুসিরে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। ও আল্লাহ এতটা পাষাণ হইও না আমার উপর তুমি। আল্লাহ একটু দয়া করো আমার উপর। আমার তুসি রে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে। আল্লাহ তুমি শুনতে পাচ্ছো না? তুমি শুনতে পাচ্ছো না আল্লাহ? তুসি তুসি কাল না বলেছিলাম আল্লাহ আজ সব ঠিক করে দিবে। তুইও তো বলেছিলি আজ সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাই কি ঠিক? আমার থেকে তোকে কেড়ে নেওয়া এটাই ঠিক তাই না? আল্লাহ তুমি আমার তুসি কে ফিরিয়ে দাও। তুসি উঠ। আপা বলে ডাক একবার। তোর মুখে আপা ডাক শুনার জন্যে কতটা উথাল হয়ে আছি আমি দেখতে পাচ্ছিস না? কি করে চুপচাপ শুয়ে আছিস তুই? আমি কি করে বাঁচব রে? একা থাকতে তোর এখন ভয় করবে না? আমাকে কেন নিয়ে গেলি না স্বার্থপর? তুসি রে আমাকে এখন কে আপা বলে ডাকবে? কাকে চুমু দিয়ে আমি জড়িয়ে ধরব? কে বলবে আমার গায়ের ঘ্রাণ টা তার খুব পছন্দের? কে আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে? তুসি আমার সোনা বোন। তুসি রে….!”
তূবার এত এত ডাক শুনছে না তুসি। তার কান্নায় আশেপাশের মানুষ সহ পরিবেশও কান্না করছে। বাহিরে দুম বৃষ্টি। তূবার কান্নার সাথে সাথে পরিবেশও হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতের গতিতে জানান দিচ্ছে আজ তারাও তার কষ্টের সামিল। তূবা তুসি কে ধরে এখনো কাঁদছে। ডাকছে তুসি কে। কিন্তু তুসি নিজের ঘুমে ব্যস্ত। তূবার ভেতরটা কেমন লাগছে সে কাউকে বুঝাতে পারবে না। তূবার বুক ছিঁড়ে গলা ফাটিয়ে গগন ফাটানো চিৎকার ভেসে আসছে শুধু। চারিদিক হঠাৎ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে তার চিৎকারের আওয়াজে।
“মৃত্যু আজ দুয়ারে দাঁড়িয়েছে
ভয় পাও কেন তুমি?
মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে একদিন
সেটা আমরা সবাই জানি।”
চলবে❤️
#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
২৫
আহফিন ধীরেসুস্থে রেডি হচ্ছে। নিজেকে একটু বিরতি দেওয়ার জন্য সে সিলেট যাওয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়েছে। জীবনের প্রতি একঘেয়েমি অনীহা চলে এসেছে তার। এটা তার জীবন না কি অন্য কিছু সে বুঝতে পারে না। জীবনের স্বাদ বলতে কিছু নেই এখন। চারিদিক ধূসর পূর্ণ অন্ধকার শুধু। আয়নায় তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে গায়ে কোট জড়িয়ে নিল সে।
আজকাল আহফিন কে দেখতে অন্যরকম লাগে। চেহারায় আগের সেই ভাব টা কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের একটা হাসি টেনে নিয়ে সে বাসা থেকে বের হলো। গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।
“স্যার স্টার্ট দিব?”
আহফিন মুখে কিছু বলে নি হাতের ইশারায় যেতে বলল। ড্রাইভারও চুপচাপ স্টার্ট দিল। কারণ জানে সে আহফিন কে এত এত কিছু বলার উত্তর হুম আর নাই হবে। আহফিন খুব কমই কথা বলে।
বাহিরে তাকিয়ে আছে আহফিন। শহরের অলিগলিতে আজো সে তূবা কে খুঁজে ফিরে। তূবা বিহীন তার জীবন টা অন্ধকার গোলকধাঁধা। মনের কোণায় নিভে আসা প্রদীপের মতো আশা রেখেছে তূবা কোনো এক দিন ফিরে আসবে তার জীবনের রঙ নিয়ে। কোনো এক গোধূলি তে আবারও দেখা হবে তাদের।
তূবা কে ছাড়া তার পাঁচ টা বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এই পাঁচটা বছরে এমন একটা দিন নেই সে তূবা কে খুঁজে নি। সেদিন অফিস শেষে আহফিন হসপিটাল ঠিকি গিয়েছিল কিন্তু তূবা তুসি শিরিণ বেগম কাউকেই পান নি। হসপিটাল থেকে যখন জেনেছে তুসি মারা গিয়েছে তখন আহফিন শকড পেয়েছিল ভীষণ। চোখ দিয়ে এমনিএমনি পানি পাড়ছিল। তখনি সে তূবার বাসায় চলে যায়। গিয়ে সেখানেও তূবা কে পায়নি। উপায় না পেয়ে সে তূবার ফোনে কল করে কিন্তু ফোন তো বন্ধ। সে আশেপাশের গোরস্তানে যায়। কিন্তু কাউকেই পায় নি। এর পর থেকে অনেক জায়গায় খুঁজেও তূবার খুঁজ মিলেনি। মনে মনে তূবা কে আজ জীবনের সব টা দিয়ে চায়। এত কিছুর পরও সে ভাবে তূবা কে আর একটু সময় দেওয়া উচিৎ ছিল তার। তূবার দিক দিয়ে হয়তো তূবা ঠিক ছিল। তার হয়তো বা এত টা রাগান্বিত হওয়ার কথা ছিল না। আবার হয়তো সে ঠিক ছিল নিজের জায়গা থেকে। ওমন ভাবে রাগের মাথায় চরিত্র নিয়ে একটা মেয়ে কে না বলায় ভালো ছিল। কিন্তু সব কিছু এক দিকে রেখেও সে তূবা কে বড্ড কাছে পেতে চায়। তার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা প্রতিটা শোণিত কনিকাও জানে সে তূবা কে কত করে চায়। কিন্তু অভিমানের পাহাড় টা? অভিমানের পাহাড় টা আজো এক ফোঁটা কমে নি তার। চুপচাপ ভিজে চোখ নিয়ে আহফিন বাহিরে তাকিয়ে আছে। হয়তো রাস্তার কোণায় কোণায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে চলছে।
—-
ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তূবা। হাতে একটা কফির মগ। দূর থেকে বহুদূরে দৃষ্টি। সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনা তার জীবনে কালো দাগ কেটে গেছে। প্রতিদিন তুসির কথা মনে পড়ে। কয়দিন পর পর সেদিনের ঘটে যাওয়া বিবৎসকর ঘটনা মনে কড়া নাড়ে তার। তুসির সেই মুখ টা ভেসে উঠতেই লোম খায়িয়ে উঠে তূবার। তুসি কে যখন তার নিজের ঘরে রেখে আসা হচ্ছিল তূবা চিৎকার করে নয় নীরবে কাঁদছিল। তুসির সাথে শিরিণ বেগমকেও উনার ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেদিন শিরিণ বেগম হার্ট এট্যাক করেছিলেন। দেখতে দেখতে চোখ বুজে নিয়েছিলেন তিনি। তূবা কে একেবারে একা করে দিয়ে দুজনেই নিজেদের ঠিকানায় জায়গা করে নিয়েছে। জায়গা হয়নি শুধু তার। বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে আবার তুসির কাছে ফিরে যায় সে। গোরস্তান রাতে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল বলে পাশের লেকে গিয়ে বসে একা বিড়বিড় করছিল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতের কথা আজও তার মনে আছে।
চোখ ভিজে উঠে তূবার। চোখের কোণার পানি মুছে ফেলে সে আবারও শূন্যে তাকায়। কফির মগে চুমুক দিয়ে দেখতে পায় বরফ হয়ে গেছে তা। তূবা উদাসীন হয়ে যায়। যার মাঝে সে নিজের অস্তিত্ব কে ফেলে এসেছে তাকে যে ভুলতে পারে না। ভেতরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জানে সে আহফিন নামক মানুষটা কে কতটা মিস করে। কিন্তু অভিমান নামক পাহড়ের পিছনে এখনো তূবা ঠাই মেরে বসে আছে। আহফিনের কথা আজকাল সারাক্ষণ মনে পড়ে। লোকটার মুখটা চোখ থেকে সরতেই চায় না তার। আহফিনের পুরনো স্মৃতি দুষ্টামি ভালোবাসা নিশ্বাসের স্পর্শ পাওয়া সব কিছু মনে হচ্ছে আর বুক টা ভার হয়ে আসছে। তূবার চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে এখন।
“মাম্মাম তুমি কাঁদছো কেন?”
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে হাতে একটা পুতুল নিয়ে ছোট পরীর মতো একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। লাল আভা যুক্ত ফোলা দুটি গাল। খাড়া নাক। কি সুন্দর ডাগরডাগর চোখ। পিঠ ছাড়িয়ে পড়া লম্বা চুল। নেভি কালারের একটা ছোট ফ্রগ গায়ে দেওয়া। চুল ঝুটি করা। সামনের ছোট ছোট কাটা চুল গুলি কপালে এসে পড়ে। দেখতে পুরো আহফিনের ডুবলিকেট মনে হয়। তূবা বুঝতে পারে না এটা কি আহফিন কে সবসময় কল্পনা করার কারণে হয়েছে নাকি সারাক্ষণ তার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা তে।
তাহফিবাকে দেখে তূবা চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
“না মামুনি একদম না।”
“এই যে পানি তোমার চোখে। তুমি কাঁদছিলে মাম্মাম?”
“বললাম তো তাহু মা না।”
“….
“তুমি চলো রেডি হয়ে নাও। স্কুলে যেতে হবে না?”
“আজ আমরা বসে গল্প করি মাম্মাম?”
“ফাঁকিবাজ মেয়ে তুমি স্কুলে যাও। স্কুল থেকে এসে গল্প হবে।”
“তুমিও তো আমাকে ফাঁকি দাও। বলো কাজ আছে কাজের কারণে আসতে পারো নি বলো না এসব?”
“ওরে আমার পাকাবুড়ি রে। ব্রেকফাস্ট হয়েছে তো?”
“ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট।”
“মাই গুড গার্ল। রিমা রিমা কোথায় তুই? তাহু কে রেডি করিয়ে দে তাড়াতাড়ি। আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”
“আসতেছি আপা।”
রিমা এসে তাহফিবা কে নিয়ে গেল। এখানে আসার পর রিমা তার সঙ্গী হয়। রিমা যখন তাকে আপা বলে ডাকে। মনে হয় তুসি ডাকছে।
তাহফিবা কে স্কুলে দিয়ে তূবা নিজের অফিসে চলে যায়। নিজের বুটিকশপে এখন অসহায় ৩০০ জনের উপরে মেয়ে কাজ করে। তার স্বপ্ন একদিন নিজের প্রতিষ্ঠান সবার মুখে উঠবে। তূবা নিজের কথার দ্বারা অনুপ্রেরণা জুগায় ভেঙ্গে পড়া মেয়ে গুলি কে। যাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো কেউ নেই তাদের সে নিজের পরিশ্রমে খেটে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়।
—-
আহফিন ফ্রেশ হয়ে ব্যালকুনিতে এলো। চারিদিকে চা বাগান। তার থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুভাস। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। এতগুলি বছরে আহফিন যেন নিশ্বাস নেওয়ার মতো একটু শক্তি পাচ্ছে। ভেতর থেকে সতেজ ভাব টা যেন ফিরে আসছে। পরিবেশের মুগ্ধতায় আহফিনের মুখ থেকে অল্প হাসি দেখা গেল।
“স্যার আপনার চা।”
মিজানের কথাতে আহফিন পিছন ফিরল। মিজান অবাক হয়ে আহফিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো চা টা দিবে না দাঁড়িয়ে থাকবে?”
মিজান এবার আরো অবাক হলো।
“স্যার আপনি হাসছেন আবার এত সুন্দর করে কথাও বলছেন।”
“মিজান চা টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“ও সরি স্যার।” বলে দৌড়ে এসে চায়ের মগ টা আহফিনের দিকে এগিয়ে দিল। আহফিন মগে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মিজান বলে উঠল
“স্যার আপনাকে না আজ ২৭/২৮ বছরের যুবক লাগছে।”
“হোয়াট দ্যা ননসেন্স। আমি কি বৃদ্ধ হয়ে গেছি নাকি?”
“আরে না স্যার সেটা বলছি না। আপনি এত মন মরা হয়ে থাকেন যে আপনার চেহারা জৌলুশ খুঁজেই পাওয়া যায় না।”
“মিজান তুমি ফালতু কথা রেখে নিজের রুমে যাও তো।”
“স্যার আপনার সাথে আর একটু কথা বলি না? বেশ তো লাগছে!”
এক গাল হেসে মিজান তার দিকে তাকাতেই দেখল তীক্ষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে আহফিন। মিজান চায়ের মগ নিয়ে “আজ যতটুক বলেছে তাতেই এনাফ। বেশি বলে ফেললে মুখ দিয়ে না আগুন ঝরবে” বলে বিড়বিড় করে মিজান চলে গেল। আহফিন দরজার দিকে তাকিয়ে আবার প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিল। তূবা ছেড়ে যাওয়ার পর তার দিন গুলি সহজ যায় নি। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে। দিনের পর দিন না খেয়ে আহফিনের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ম্যানেজার তখন তার জন্যে লোক রাখে। সাথে মিজান কে ড্রাইভার বানায়। মিজান ছেলেটা তার সাথে আছে আজ চার বছর। ছেলেটা সবসময় তার সাথে কথা বলতে চায় তাকে হাসাতে চায়। মাঝে মাঝে করা মিজানের কান্ড গুলি মনে হতেই আহফিন মৃদু আঁচে হেসে উঠল।
চলবে♥