বর্ষার এক রাতে,পর্ব-৬,৭
সাদিয়া
৬
তূবার মন টা আজ ভালো। কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে সে আজকের জন্যে। আজকের ছুটিটা দরকার ছিল। কাকতালীয় ভাবে হয়েও গেল। খুব ভালো লাগছে তার। মন টা ফুরফুরে। রিকশা না নিয়ে হেটেই চলছে একা পথে। দোকান থেকে সে তুসির ঔষধ আর ভালো কিছু খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরল। আজো ফিরার পথে গলির আনাচেকানাচে কাঙ্ক্ষিত লোকটা কে খুঁজেছে। পায় নি।
তূবা গিয়ে তুসির কাছে নিচে বসল। তার গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“দেখ আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।”
তুসি হাসল।
“দেখবি আমরা খুব তাড়াতাড়ি এক সাথে হাটব। তোর পায়ের চিকিৎসা করব আমি।”
“সত্যি আপা?”
“একদম সত্যি। তোর পা ঠিক হয়ে গেলে আমরা এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ওখানে একটা বুটিক শপ খুলে জীবন চালাব।”
“আপা তুমি সত্যি বলছো।”
“হুম। আল্লাহ চাইলে হবে।”
তুসি খুব খুশি হলো। শিরিন খাবার দিয়ে গেল দুই বোনের সামনে। তূবা তুসি কে নিজ হাতে খায়িয়ে দিল।
আজ সে ঘুমায় নি। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে। শহর থেকে অনেক দূরে একটা গ্রামের মতো জায়গায় এসেছে তূবা। নীরব শান্তির পরিবেশ সেখানে। তূবার মন টা ভালো হয়ে গেল। আগেও আসার মতোই শান্তি লাগছে। তূবা একটু হেসে হাটতে লাগল। অনেক দূর চলে এসেছে। আর একটু দূরেই এতিমখানা টা। তূবা বুকে শান্তি পুষে রেখে এগিয়ে গেল সেখানে।
ভেতরে যেতেই বাচ্চারা এসে তাকে ঘিরে ধরল। তূবা হাসি মুখে তাদের মাথায় হাত রাখল। ম্যাম তূবা কে দেখে হেসে ভেতরে চলে যায়। তাদের নিয়ে তূবা বড় বটগাছ টার নিচে গেল। শত বছরের বট গাছ টার পাশ ঘিরে সুন্দর পাকা করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তূবা ব্যাগটা রেখে বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে লাগল। কিন্তু কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। কে কি বলছে তা বুঝার উপায়ই নেই। সবাই এক সাথে পাখির মতো কিচিরমিচির করছে। তূবা খিলখিল করে হেসে সবাই কে শান্ত করল হাত উঁচু করে।
“বাচ্চারা সবাই চুপ। চুপ কোনো কথা নেই।”
তূবা আবার বললো।
“কেমন আছে আমার মিষ্টি বাচ্চারা?”
সবাই এক সাথে জবাব দিল “ভালো।” কেউকেউ বলল “তুমি কেমন আছো মিষ্টি?”
তূবা কে তারা মিষ্টি বলে ডাকে। সে প্রতি বছর এই দিনটায় এখানে আসে। এই এতিম বাচ্চাদের সাথে বিকাল পর্যন্ত কাটায় সে। এতিম হয়ে এতিম এই বাচ্চাদের সাথে দিনটা কাটালে ভালো লাগে তার। এতিম হওয়ার জ্বালাটা সে বুঝে। আজ তার মার মৃত্যু বার্ষিকী। তাই বছরে এই দিনটা সে এমন মানুষদের সাথে থাকে। এদের জন্যে সামান্য খাবার নিয়ে আসে।
তূবা জবাব দিল “আমিও ভালো আছি আমার বাচ্চারা।”
তূবা ব্যাগ থেকে চিপস, কেক আর চকলেট বের করল। এই টাকা গুলি তার হালাল পথে রোজগার করা টাকা। জমা ছিল তার কাছে। আগে যেই চাকরিটা করত তার থেকে জমা করত সামান্য করে। এটাই সে টাকা।
তূবার হাত থেকে বাচ্চারা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিতে লাগল ওগুলি। আর তূবা মন খুলে খিলখিল করে হাসছে।
হঠাৎ আহফিন সজোরে ব্রেক কষল। পাশের গ্লাস টা নামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তূবার দিকে। আজই তূবা কে হাসতে দেখছে সে। তার হাসি যেন মধুর। হাসলে তূবার চোখ গুলি ছোট হয়ে যায়। সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলে তার হাসি। আহফিন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তূবার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। ভেতরে উতালপাতাল কলরবময় ঢেউ শুরু করে দিয়েছে। আহফিনের শিরায় শিরায় শিহরণ জাগছে। বুক ধরাক ধরাক প্রতিধ্বনি তুলছে।
তূবা বাচ্চাদের কে খাবার দিয়ে তাকে আদর করতে বলল। একে একে সবাই তূবার গালে চুমু দিয়ে দিয়ে যেতে লাগল। তূবার মুখে সে কি হাসি।
আহফিনের চোখে পলক পড়ছে না। ইচ্ছে করছে এখনি গিয়ে জড়িয়ে ধরতে তূবা কে। তার ভেতরের এমন অনুভূতির সাথে সে নতুন পরিচিত। এমন অনুভূতি, শিহরণ, প্রশান্তি এর আগে সে পায় নি জীবনে। আহফিনের গলায় এসে অশ্রু আটকাল। তূবা কে তার জন্যেই বানিয়েছে সৃষ্টিকর্তা।
“তূবা আরো আগে কেন আসো নি আমার জীবনে? কেন প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলো নি আমায়? তোমার জন্যে আমি হাজারো বার মরণ পথে হাটতে রাজি।”
বিকেল হয়ে গেল তূবা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চুপচাপ বাথরুমে চলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।
খাবার মুখে দিতে যাবে তার আগে ফোন বেজে উঠল। তূবা বিরক্তি নিয়ে ফোন নিতেই ঘাবড়ে যায়। আরো বিরক্ত হয়ে কল ধরল। সে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে শুনা গেল।
“৮ টার আগে চলে আসবে।”
তূবা রাগে দাঁত কিড়িমিড়ি করে উঠল। রাগ সংযত রেখে বলল,
“আপনি না বলেছিলেন আজ আসতে হবে না।”
“আগে আসতে না করেছি এখন আসতে বলছি। তাই আসবে।”
“আজ আমি পারব না। যাবো না আমি।”
“তাহলে কি আমি যাবো?”
“মানে?”
“মানে আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”
তূবার রাগ এবার চরম হলো।
“আপনি কিন্তু বেশি করছেন।”
তূবা গলার আওয়াজ নিচু করে দাঁত কেটে বলল “আপনি কিন্তু আমায় কিনে নেন নি। যে যখন বলবেন তখনি আসতে হবে।”
“টাকা তো পাও?”
“আজ লাগবে না আমার টাকা।”
“তোমার টাকা লাগবে না কিন্তু আমার তোমাকে লাগবে।”
“দেখুন ভালো লাগছে না কিন্তু। আজ আমি আসতে পারবো না।”
“তবে আমিই যাচ্ছি।”
তূবা রাগে বলল “আমি আপনার এখানে কোনোদিন যাবো না। আমার কোনো দায় পড়ে নেই ওখানে। আমি শুধু না পেরে টাকার জন্যে যাই। আপনার কাছে যাবো না। লিলা কে কল দিলে আমার টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।”
“…
“হ্যালো।”
তূবা আরো কয়েকবার ডাকল সাড়া নেই। খেয়াল করল কল কেটে গেছে। রাগে বিদ্বেষে তূবা ফোন রেখে মাথা উপর দিকে তুলে নিশ্বাস ফেলে দিল। একবার চাইল ভাতে হাত ধুয়ে নিবে। কিন্তু খিদেও লেগেছে খুব। ঠিক করল খাবে।
তুসি হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এলো তূবার ঘরে।
“আপা কার সাথে ঝগড়া করছিলে?”
“কোথায় কারো সাথে না তো।”
“আমি শুনলাম কি কি বলছিলে তুমি। কোথায় যাবে না বললে, টাকার কথাও কি যেন শুনলাম। কি হয়েছে আপা?”
তূবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তুসি এতটাও ছোট নয় যে যা তা বলে বুঝ দিবে। ১৬ বছরের মেয়েকে আর যাই হোক বাচ্চা বলা সাজে না। তূবা আমতাআমতা করে বলল,
“আরে চাকরি টা ভাবছিলাম করব না।”
“কেন আপা তোমার খুব কষ্ট হয়?”
তুসির কথা শুনে তূবার বুক টা ভারি হয়ে আসল। চোখে পানি হুট করেই চলে আসে। তুসি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলল তূবা।
“না রে বোন আমি তোর জন্যে সব করতে পারি। তোর ভালোর জন্যে নিজেকে আগুনেও দিতে পারি রে তুসি।”
বোনের কান্না দেখে তুসিরও চোখে পানি চলে এলো।
“আপা তোমার বেশি কষ্ট হলে চাকরি টা ছেড়ে দাও। আমি হাটতে চাই না আপা। খেয়ে যেতে পারলেই হবে। না খেয়েও থাকতে রাজি আছি আপা।”
তূবা তাড়াতাড়ি উঠে তুসির গালে হাত দিয়ে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল,
“একদম না এসব কথা একদম বলবি না। তুই হাটবি। আমি আর তুই একসাথে হেটে অনেক দূর যাবো। অনেক পথ হাটব। এসব কথা বলতে নেই সোনা। আমার কোনো কষ্ট হয় না। আমি ভালো আছি তুসি। আর চাকরিটাও ছাড়ব না। তোকে সুস্থ হতে হবে বোন। আমার সাথে হাটার জন্য হলেও তোকে সুস্থ হতে হবে।”
তুসি তখনো কেঁদে চলছিল। তূবার চোখ দিয়ে গরগর করে পানি ঝরছে। শিরিন বেগম আড়াল থেকে দুই বোনের কান্না দেখে চলে গেলেন। তূবা কে কথা শুনাতেও উনার ভালো লাগে না। মেয়ে টা তাদের জন্যে নিজের জীবনটা কেই শেষ করে দিচ্ছে। শিরিন নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন।
আহফিনের নাম্বার থেকে দুইবার কাল চলে এসেছে এর মধ্যে। তূবার কেন যেন আজ যেতেই মন চাইছে না। তাই চুপচাপ বসে আছে ফোন টা সাইলেন্ট করে। একটুপর একটা ম্যাসেজ এলো। তূবা দেখতে পেলে আহফিনের নাম্বার থেকে আসা ম্যাসেজ।
“৫ মিনিট সময় দিলাম গলির মুখে আসবে। নয়তো আমি ঢুকব তোমার বাসায়।”
তূবা চিন্তা করল। এমনিতেই সমাজে তাদের পরিবার কে কত কিছু শুনতে হয়। কত কথা তাকে নিয়ে। কেউ দেখতে পারে না। এখন এমন হলে আরো অনেক বাজে কথা ছড়াবে। আর বড় কথা তার জন্যে এখন টাকার দরকার। তূবা নিজের রাগে পানি ঠেলে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
গলির মুখে যেতেই আহফিন কে দেখতে পেল। ল্যাম্পপোস্টের সামনে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু আলোয় খোঁচা দাঁড়িতে লোকটা কে বেশ সুদর্শন লাগছিল। তূবা এগিয়ে যেতে যেতে ভাবতে লাগল আজ তিনি নিজে এসেছেন কেন?
তূবা যেতেই আহফিন চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। তূবা তখনো দাঁড়িয়ে ভাবছিল। আহফিন পাশের দরজা ঠেলে দিয়ে দুইবার হর্ন বাজাল। তূবা ভাবনা রেখে গাড়িতে উঠে বসল।
আহফিন খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু কোনে কথা বলছে না। বোরটের মতো চালিয়েই যাচ্ছে। তূবা বারবার তাকাচ্ছে লোকটার দিকে। খুব অসুবিধা হচ্ছে তার। সিটবেল না বাঁধায় বারবার হেলে পড়ছে। তবুও আহফিনের সেদিকে খেয়াল নেই। যন্ত্রের মতো ড্রাইভ করছে।
তূবা বিরক্তিকর চোখ মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। এটাকে মানুষ ভাবতেই ভুল হচ্ছে তার। সে ভাবছে এত নীরব কেন লোকটা? আজ কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। কথায় আছে ঝড়ের পূর্বে পরিবেশ শান্ত থমথমে হয়। তবে কি তাই? তূবা ঘনঘন চোখের পাতা ফেলল।
চলবে♥
#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
৭
আহফিন গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। তূবা নেমে যেন একটু স্বস্তি পাচ্ছে। এতক্ষণ শরীরের হাঁড় নেচেছে। তূবা আস্তেআস্তে ভেতরে ঢুকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে আহফিন কে দেখতে পেল না। হয়তো ঘরে আছে। তূবা সিঁড়িতে পা দিল। মনে মনে বলছে “লোকটা কি রেগে আছে? হঠাৎ এমন ব্যবহার। কি অদ্ভুত!”
তূবা রুমে ঢুকতেই আহফিন বাঘের থাবার মতো তার বাহু দুটি আঁকড়ে দেওয়ালের সাথে চেঁপে ধরল। ভয়ে তূবার তরাস অবস্থা। সে খেয়াল করল লোকটা ভয়ংকর রেগে আছে। চোখ গুলি লাল হয়ে আছে। সাপের মতো ফুঁসছে। তূবা বলল
“ছাড়ুন আমায়।”
আহফিন রেগেমেগে তূবা কে দেওয়ালের সাথে ঝাঁকি দিল। পিটে খানিক লেগেছে তূবার সেদিনের মতো।
আহফিন একহাতে তূবার গাল চেঁপে ধরল। দাঁত কেটে বলতে লাগল “ফোনে কি বলেছিলে তুমি?”
“…
“এখন বলো কি বলেছিলে ফোনে?”
“ছাড়ুন আমায়।”
আহফিন চিৎকার করে বলল “বল কি বলেছিস?”
ভয়ে এবার তূবার নাজেহাল অবস্থা। গুটিয়ে গেছে একদম, চোখ টলমল করে উঠছে।
আহফিন বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তূবার ঠোঁট স্লাইড করতে করতে বলল “এই ঠোঁট দিয়েই তো বলেছো তুমি অন্য ছেলের সংস্পর্শে যাবে। কি বলেছিলে যেন? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। এটাই বলেছিলে তো তুমি?”
“….
আহফিন তূবার ঠোঁট ছেড়ে তার গলায় ধরল। জোরালো ভাবেই ধরল। তূবার কপালের চামড়া কুঁচকে এলো এতে। গলায় লাগছে খুব।
“কি করে বলতে পারলে তুমি?”
“…
“এত বড় সাহস তোর হলো কি করে বল?”
আপনাআপনি আহফিনের হাত রাগের বশে আরো শক্ত হয়ে এলো। দম আটকে আসছে তূবার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু লোকটার রাগ কমার কিংবা হাত ঢিলে করার নাম নেই। লোকটা কি তাকে মেরেই ফেলবে নাকু আজ। এবার বুঝি দমটাই বের হয়ে যাবে। তূবার চোখ উল্টে আসছে দেখে আহফিন ছেড়ে দিল। রাগে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে তার। একটু দূরে গিয়ে সে দেওয়ালে হাত রেখে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো। ওদিকে তূবা কাশছে অনবরত। গলাটা খুশখুশ করছে। ব্যথা হচ্ছে।
আহফিন এসে তূবা কে আচমকা একটা চর মেরে দিল। তাল সামলাতে না পেরে সে নিচে পড়ে যায়। তূবার কানের পোকা নড়ে গিয়ে পুপু একটা শব্দ হচ্ছে। জোরটা বেশিই ছিল। তার গালে যেন কেউ লবণ মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে।
আহফিন এসে তূবা কে নিচ থেকে উপরে তুলল। তূবার চোখ পানি তে টুইটুম্ভুর। আহফিন দেখেও না দেখার ভান করে তূবার বাহু চেঁপে ধরল।
“তোকে কয়েকবার বলেছিলাম না আমার মুখের উপর কথা বলবে না। আর সেখানে তুই কি করে বলতে পারলি ভাত ছড়ালে..! তোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে আমার। এতটুক বাজে..!”
কথাটা শেষ করতে ইচ্ছা হলো না তার আগেই আরেকটা চর পড়ল তূবার গালে। এবার তূবা কেঁদে দিল। আহফিন দেখছে তূবার চোখ দিয়ে পানির পর পানি পড়ছে। তার কি করা উচিৎ সে জানে না। ভেতরের রাগও কমছে না। তূবার উপর তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। সে জানে তার সামনে থাকলে রাগ আরো বাড়বে তাই দরজা বন্ধ করে সে চলে গেল।
কয়েক গ্লাস ড্রিংক আর সিগারেট খেয়ে আহফিন রুমে ফিরে এলো। তূবা তখনো সেখানে বসে কাঁদছে। আহফিন দৌড়ে গেল সেখানে। “তূবা তূবা” বলে ডাকতে লাগল তাকে। তূবা কেঁদেই চলছে। আহফিন চেষ্টা করছে তূবার মুখ নিজের দিকে ফিরাতে কিন্তু তূবা তাকে ছুঁতেও দিতে চাইছে না। জোরাজোরির পর আহফিন সফল হলো। তূবা দুই গালে হাত রেখে তার দিকে মুখ করাল। কিন্তু তূবা তাকাল না।
“তূবা, তূবা তাকাও আমার দিকে।”
“….
“তূবা তাকাও। তূবা আমার ভীষণ রাগ উঠে গিয়েছিল। তূবা আমি বুঝতে পারি নি। তূবা এমন করব না। তোমার লেগেছে খুব তাই না?”
তূবা ছিটকে হাত সরিয়ে দিল তার। লাল লাল পানি ভর্তি চোখ নিয়ে সে আহফিনের দিকে তাকাল। চোখ আর নাল একদম রক্তের মতো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। যেন রক্তজবা।
কান্না জড়িত কন্ঠে তূবা বলল “আপনি আমাকে ছুঁবেন না। আপনি কেন আমার গায়ে হাত তুলবেন? সেই সম্পর্ক আপনার সাথে আমার নেই। আপনার সাথে আমার শুধু টাকার সম্পর্ক। আর আপনার কোনো অধিকারও নেই আমাকে মারার। সেখানে আপনি..” শব্দ করে কেঁদে উঠল তূবা।
আহফিন শান্ত হয়ে বলল
“অধিকার তো থাকতেও পারে।”
“কিসের অধিকার? কোনো অধিকার নেই আপনার।”
“সব অধিকারের কি নাম হয় তূবা?”
“….
তূবা আরো কাঁদতে লাগল। আহফিন খেয়াল করল তূবার গালে তার আঙ্গুলের ছাপ পড়ে গেছে। চাঁদের গায়ে এক টুকরো দাগ। গলাতেও দাগ পড়ে গেছে। আহফিন ফ্যালফ্যাল করে দেখছে সেগুলি। হঠাৎ তূবার পাশ দিকের দেওয়ালে আহফিন ঘুষি মারল। চমকে গেল তূবা। কান্না বন্ধ করে পাশ ফিরে তাকাল। ততক্ষণে দুই তিন টা দেওয়া হয়ে গিয়েছে আহফিনের। অনবরত দিতেই লাগল ঘুষি। তূবার এবার ভয় হয়। ভীত নয়নে সে লোকটার দিকে তাকাল। কি ভয়ংকর দেখতে লাগছে। তূবা না করল এমন করতে। শুনল না আহফিন। তূবা আহফিনের হাত ধরলে সে থেমে যায়। তূবা ঢোক গিলে আহফিন কে দেখল। হাতের দিকে তাকালে দেখতে পেল আঙ্গুলের হাঁড়ের সাথে লেগে থাকা চমড়ায় লাল বর্ণ ধারন করেছে। লাল বর্ণ বের হয় বলে। তূবা কান্না বন্ধ করে দিল।
আহফিন তূবা কে শান্ত স্বরে বলল
“তূবা আজ আমি আমার দরকারে তোমাকে এখানে ডাকি নি। বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ডেকে ছিলাম। তোমাকে আমি আজ এতিমখানায় দেখে ছিলাম। তাই ডেকেছি।”
“….
ভ্রুকুঞ্চন করল তূবা। এই লোক বদ্ধ উন্মাদ।
আহফিন তূবার দাগ পড়া গালে হাত দিতে গেলে সরিয়ে নিল সে।
“বলেছি না আপনি আমাকে ছুঁবেন না। আমি আপনার কাছে আর আসতে চাই না।”
“….
“দূরে সরুন যেতে দিন আমাকে।”
“…
“সরুন বলছি।”
কাঁদতে কাঁদতে বলল তূবা। আহফিন সরে গেল। গিয়ে দরজা লক করে তূবা কে দেখিয়ে চাবি তার প্যাকেটে ভরে নিল।
“সরেও এসেছি, বাঁধাও দিচ্ছি না যেতে পারো।”
রাগে তূবার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
“আপনি এসব করতে পারেন না। দরজা খুলে দিল।”
“….
“কি হলো দরজা খুলে দিন।”
তূবার চিৎকারও শুনে না আহফিন। সে শান্ত। তূবা এগিয়ে গেল আহফিনের কাছে।
“কেন এমন করছেন আপনি? চাবিটা দিন।”
“চাবি আমি দিতে পারব না। এ ছাড়া কিছু বলার থাকলে বলো।”
“…
রাগে তূবা কিটমিট করছে। মেজাজ চড়া হয়ে যাচ্ছে তার।
তূবা আরো কয়েক বার বললেও আহফিন সারা দেয় নি। চাবি বালিশের নিচে রেখে সেখানে শুয়ে পরল সে। তূবা বিছানায় উঠে চাবি নিতে গেলেও আহফিন হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। তূবা ফের গেল এবার আহফিন তার হাত ধরে তূবা কে শুয়িয়ে দিল। নিজে তার উপরে উঠে হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার থেকে স্যাভনল মলম টা নিল। তূবা নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করছিল। আহফিন মলম বের করে তূবার গালে দিতে চাইলে সে আহফিনের পিট খামছে ধরে মাথা নাড়াতে থাকল। আহফিন ধমক দিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলল “শুহহ। শান্ত হয়ে থাকো তো।” আহফিন তূবার গালে ও গলায় মলম লাগিয়ে দিল। তূবা ঠান্ডা অনুভব করল। জ্বালাটা কমছে বোধহয়। সেও শান্ত হলো। আহফিনের পিট থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল।
আহফিন তূবার ভিজে চোখের দিকে অলপক দেখছিল। তূবা কঠিন গলাা বলল সরুন। সে উঠে পিটে হাত দিয়ে বলতে লাগল “উফফ আমার পিট থেকে তো তুমি রাক্ষসীর মতো রক্ত বের করে ফেলেছো।”
“…
তূবা সুযোগ পেয়ে যেই হাত বাড়াল বালিশে ওমনি খপ করে ধরল আহফিন।
“আজ বলবে তারপর এখান থেকে যাবে। কাল সারাদিন যদি না বলো তো আটকে থাকবে।”
“….
“কেন আপনি এমন করছেন বলুন না। আর আমার কথা শুনলে আপনার কি এমন হবে?”
“কিছু হবে না। তবুও আমি শুনতে চাই।”
“….
“বলো।”
“হবে না যেহেতু শুনার কি দরকার?”
“তা জানি না। আমি শুনতে চাই।”
তূবা এই টুক বুঝেছে এই লোক বড্ড ঘাড় ত্যাড়া তেমনি উন্মাদ, অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। না বললে হয়তো যেতেও দিবে না। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছা করছে না। আবার ভাবছে মনের চাঁপা কথা গুলি তো গাছের সামনে বললেও হাল্কা লাগে আর এ তো নিজ থেকে শুনতে চাইছে জলজ্যান্ত মানুষটা। তূবা স্থির হলো। ধীর পায়ে গিয়ে সোফায় বসল। আহফিন বিছানায় পা হেলিয়ে তূবার দিকে ঝুঁকে বসল। তূবা বলতে শুরু করছে..!
চলবে♥