বর্ষার এক রাতে,পর্ব,২২,২৩

বর্ষার এক রাতে,পর্ব,২২,২৩
সাদিয়া

২২
আহফিন ড্রয়িংরুমে বসে আছে। একা যে বসে আছে এমন নয় সাথে লম্বা ফর্সা একটা মেয়েও বসে আছে। দুজন খানিকটা দূরত্ব রেখে বসলেও হেসেই কথা বলছে বোধহয়। এই দৃশ্য দেখে তূবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল কিন্তু এক চুল পরিমাণও নড়েনি সে। তূবা কে আসতে দেখে আহফিন বলল
“চলে এসেছো? এদিকে এসো পরিচয় করিয়ে দেই। এ হলো লুবনা আমার কলেজের বন্ধু। আগেও এর কথা তোমায় বলেছিলাম তূবা।” কথা শেষে আহফিন বাঁকা হাসল।

তূবা দুই পা পিছিয়ে গেল। আহফিন লুবনার সাথে.. তূবার দম টা সেদিনের মতোই আটকে আসছিল। ঢোক গিলতে পারছিল না তূবা। ঠোঁট গুলি কাঁপছিল সাথে শরীরটাও। পলক কিছুতেই পড়ছিল না আহফিনের বাঁকা ঠোঁটের হাসি থেকে।

“কি হলো তূবা দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

তূবা যুদ্ধ করে যেন ঢোক টা গিলল। চোখের পানিটা মুছে ফেলে দৌড়ে তূবা উপরে উঠে গেল। আহফিনও সঙ্গেসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। লুবনা কে বলল
“তুমি এখন যাও।”

“কেন আহফিন?”

“তোমাকে যেতে বলছি তো যাও।”
আহফিন ধমকে কথাটা বলল।

“এটা ঠিক হয়নি আহফিন। আমাকে আসতে বলে..”

“তুমি কি যাবে?”

আহফিন দৌড়ে উপরে উঠল। কিন্তু রুমে ঢুকার আগেই তূবা দরজা লাগিয়ে দিল। আহফিন হাজারবার ডাকলেও তূবা দরজা খুলেনি। ভেতরে বসে শব্দ করে কাঁদছে।

“দোহাই লাগে তূবা দরজা খুলো। তূবা।”

শতশত ডাক তূবা উপেক্ষা করে গেছে। আহফিন ইচ্ছা করে এমন টা করেছে এটা তার অজানা নয়।

“তূবা দেখলে তো কতটা কষ্ট হয়? বিশ্বাস করো আমি এমন টা চাই নি। খুব রেগে গিয়েছিলাম তখন। তাই এমনটা করে ফেলেছি। যা করেছি তোমাকে রিয়েলাইস করানোর জন্যে করেছি। আমাকে দয়া করে ভুল বুঝো না। প্লিজ তূবা। সরি।”

দরজার নিচে পাওয়া কাগজ টা পড়ে তূবা ছিড়ে সেটা ফেলে দিল। তারপর আবারও কাঁদতে লাগল।

রাত তখন ১১ টার উপরে। তূবা এখনো দরজা খুলেনি। আহফিন দরজার সামনে অনেকক্ষণ বসে ছিল। নিজের করা কাজটার জন্যে এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আহফিন অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

—-
সকালে তূবা আহফিন কে না জানিয়ে চলে গিয়েছে। আহফিন সারা বাড়িতে খুঁজে যখন তাকে পেল না তখন সে বুঝেছে তূবা চলে গেছে। এর একটু পরই তূবা একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আহফিনের কাছে। সে দ্রুত তা ওপেন করল। তাতে লেখা ছিল,
“আমি তুসির অপারেশনের পর বাড়ি ফিরব।”

সারাদিন বাদে রাতে আহফিন তূবাদের বাড়ি চলে গেল। আহফিন কে আসতে দেখে তূবা অবাক হলো। কিন্তু তেমন কিছু বলে নি। শিরিণ বেগম এসে বললেন
“জামাই বাবা তুমি কাইল এমনে গেছিলা গা যে?”

“আসলে মামুনি কাজ ছিল।”

“কয়দিন আমগো বাড়িতে থাকবা। একটু আদর যত্ন করনের সুযোগ দিও। না করতে পারবা না কিন্তু তাইলে রাগ করবাম।”

“আচ্ছা” হেসে বলল আহফিন।

তূবা তুসির কাছে গিয়ে বসে আছে। তুসির মাথায় তেল দিয়ে আচড়ে দিচ্ছে। আহফিন রুমে ঢুকে তূবার দিকে তাকাল। সে মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করছে। আহফিন গলা কাঁশল। এতেও তূবা তাকাল না আহফিনের দিকে। সে বিছানার এক পাশে গিয়ে বসল।

“তুসি কেমন আছো?”

“ভালো আছি ভাইয়া আপনি?”

“এই তো তোমার আপা যেমন রাখছে।”

এই কথা শুনে তুসি মাথা উপরে তুলে তূবার মুখ দেখল। তূবা বকুনি স্বরে বলল “নাড়াচাড়া করছিস কেন? চুপচাপ বসে থাক।”

তুসি বুঝতে পারল হয়তো তাদের মাঝে রাগ অভিমান হয়েছে।

“ভাইয়া আপনার মন কি ভালো নেই?”

“না তুসি। আমার মন তো তোমার আপার কাছেই।”

“তুসি বড় বেড়ে গেছিস। এত কথা বলিস কেন? ঠিক করে বেণি টা করতে দে।”

“দেখলে তো তোমার আপা কত পাষাণ।”

“আমি কথা বললেই তো আপা বকবে ভাইয়া।”

“বকবেই তো রাক্ষসনী যে।”

এই কথা শুনে তূবা আহফিনের দিকে তাকাল রাগান্বিত বড়বড় চোখ নিয়ে। আহফিন একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল।

“দেখো না পেত্নীর মতো কি করে তাকিয়ে আছে কখন না ঘাড় মটকে দেয়।”

“….
তূবা রাগে ফুসফুস করছে। গাল গুলি ফুলে লাল হয়ে উঠছে। তাদের দুষ্টুমি দেখে তুসি মুচকি মুচকি হাসছে।

বেণি করা শেষ হতেই তুসি বাহানা ধরে চলে গেল। তূবা যেতে চাইলে আহফিন খপ করে হাত ধরে নেয়।
“কোথায় যাচ্ছো?”

“ছাড়ুন আমার হাত।”

“ছাড়ব কেন?”

“ছাড়ুন বলছি।”

“তুমি বললেই ছেড়ে দিতে হবে? তা তুমি কোন দেশের মন্ত্রী?”

তূবা বড় চোখ করে তাকাল আহফিনের দিকে। সে মিষ্টি করে হেসে তাকে জানাল
“ইশশ লাল স্টবেরি। মন চায় টুপ করে খেয়ে ফেলি।” তারপর আবার মুচকি হাসল। আহফিনের মুখ দেখে তূবার হাসি আসতে চাইলেও আটকে নিল সে। কাল যেটা করেছে আহফিন তা একদম ঠিক করে নি। সে না হয় পরিস্থিতির স্বীকার হচ্ছে কিন্তু আহফিন কি করে ইচ্ছা করে জেনে বুঝে এমন টা করতে পারল? আহফিন ভাবান্তর তূবা কে হেচকা টানে কাছে নিয়ে এলো। দাঁড়িয়ে কোমর টেনে আনতেই তূবা ছুটার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
“ও আমার পাখিরে!” বলে আহফিন তূবার ঠোঁটে ঠোঁট দেওয়ার আগেই শিরিণ বেগমের ডাক পরে।

“তূবা জামাইরে লইয়া খাইতে আয়।”

তূবা ঝাড়ি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। মুচকি হেসে আহফিনও পিছুপিছু গেল।

রাতে তূবা ঘুমাবে তুসির সাথে আর আহফিন তূবার রুমে একা থাকবে। তূবার বিছানায় একা শুয়ে আছে আহফিন। অনেকক্ষণ ধরে ফোন টিপছে তূবা কে আসতে না দেখে ম্যাসেজ করল।

“আসো না কেন এখনো?”

ম্যাসেজ টা পড়ে তূবা রাগবে না হাসবে জানে না। কিন্তু দাঁত কিটে জবাব দিল।
“আসব না।”

“কেন? আমি একা ঘুমাব কি করে?”

“একাই ঘুমান না হলে জেগে থাকুন। আমি তুসির সাথে।”

“আরে আজব আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাব কি করে? না আছো তুমি না আছে কোলবালিশ। অন্তত একটা কোলবালিশ তো দিয়ে যাও।”

“আজ কোলবালিশ ছাড়াই ঘুমান।”

“প্লিজ লক্ষ্মী টা আমার সোনাপাখিটা দিয়ে যাও না।”

“পারব না বললাম তো।”

“ওই আসো না।”

তূবা আর কোনো রিপ্লে দেয় নি।

আহফিন একটু পর আবার ম্যাসেজ দিল।

“মাই ডিয়ার পানি নেই জগে। পানি তো দিয়ে যাবে?”
অনেকদিন পর আহফিনের কাছ থেকে “মাই ডিয়ার” শব্দটা শুনে তূবার মন টা খানিক নরম হয়ে গেল। তুসির কাছ থেকে আস্তে আস্তে উঠে এলো সে।

ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল টা নিয়ে তূবা নিজের ঘরে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকার আগেই তার হাত চেঁপে টেনে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। দেওয়াল ঘেঁষে আহফিন তূবার কোমর চেঁপে রেখেছে। আরেক হাত দেওয়ালে ঠেকিয়ে তূবার যাওয়ার পথ আটকে দিয়েছে। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে তূবা কে মোহনীয় লাগছিল। আহফিন তূবার মুখের খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল
“মাই ডিয়ার সেই আসতেই হলো তো তোমাকে।”

“ছাড়ুন।”

“ইশশ বউ কে ছেড়ে দিব এই রাতে? তবে ঘুম কি করে হবে?”

“দেখুন বেশি হচ্ছে কিন্তু।”

“একটু বেশি হতেই দাও না। সাথে একটু রোমান্স।”

“একদম ভালো হবে না কিন্তু।”

“আমি যদি এখন তোমার ঠোঁটে কিস করি তাহলে কি হবে?”

“তাহলে ঠোঁটে কামোর খাবেন।” রেগে গিয়ে বলল তূবা।

“তাই? তাহলে তো একটু টেস্ট করতেই হয়। বেগমের ঠোঁটের স্পর্শে তো শিহরণের সাগরে ভেসেছি এবার না হয় ইঁদুর দাঁতের কামোর খেয়ে দেখি কেমন লাগে।”

আহফিন এগিয়েই আসছে ক্রশম তার দিকে। না পেরে সে চোখ বন্ধই করে নিল। আহফিনের উষ্ণ নিশ্বাসের ছুঁয়াতে বুঝতে পেল আহফিন তার খুব কাছে। আহফিন যেই না ঠোঁট ছু্য়ে দিবে তখনি তূবার কল এলো। তূবা ভয় নড়েচড়ে উঠল। আহফিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
“এত রাতে কে কল দিয়েছে?”

তূবা একবার আহফিনের দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কলদাতার আওয়াজ শুনেই তূবা ফোন টা কেটে দিল। আহফিন আবার জিজ্ঞেস করল।
“কে কল করেছিল তূব?”

“র রং নাম্বার।”

“দেখি দাও তো।”

“অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন।” বলে এক প্রকার পালিয়ে এলো তূবা সেখান থেকে। বিড়বিড় করে বলল
“মাফ করবেন আমাকে আহফিন। আমি আর ঝামেলা চাই না।”

আহফিন স্ট্রেচুর মতো শূন্যে চিন্তিত নয়নে তাকিয়ে তূবা কে নিয়ে ভাবতে লাগল।

চলবে♥

#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া

২৩
অনেক বেলা করে আহফিন রুম থেকে বের হলো। তার চোখ রান্নাঘরে রান্না করা তূবার দিকে। খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না করছে সে। আহফিন কে দেখে শিরিণ বেগম চেয়ার টেনে দিয়ে বসতে বললেন। তূবা দৌড়ে গেল আহফিনের কাছে। নীরবে তাড়াতাড়ি করে নাস্তা দিতে লাগল। আহফিন শান্ত স্নিগ্ধ নয়নে একবার তূবার দিকে তাকাল। নাস্তা দিয়ে আবার তূবা দৌড়ে চুলার উপর বসানো তরকারি নাড়তে চলে গেল। আহফিন খাচ্ছে আর তূবার দিকে তাকিয়ে আছে। তূবা তরকারি নেড়েচেড়ে আবার আহফিনের কাছে এসে ফ্রিজ থেকে পানি এনে দিল।
“কিছু লাগবে আরো?”

“….

“খাবার কি মজা হয় নি? খাচ্ছেন না যে?”

আহফিন কিছু না বলে আবার রুমে চলে গেল। তূবা বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার রান্নাঘরে গেল।
আজ সে রনি কে নিজের রান্না করা খাবার খায়িয়ে দিয়ে চলে আসবে। আর যেন তার সামনে না আসে তাও বলবে। কাল আবার তুসির অপারেশন। আজ বিকেলে হসপিটাল গিয়ে ভর্তি হতে হবে। আর আহফিনের সাথেও আর কোনো মিথ্যে সে বলতে চায় না। আহফিন জেনে যদি রাগারাগি করে আর তাকে যেতেও না দেয়? একজনের দাবীর নিচে থাকার তো কোনো মানে হয় না। হয়তো এর পর থেকে সব কিছু আগের মতো হয়ে যাবে।

তূবা রান্না শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১১ টা ৫৫ বেজে গেছে। তূবা নিজের রুমে গেল। গিয়ে অবাক হয়ে রইল। আহফিন হঠাৎ সিগারেট খাচ্ছে কেন? বাজে গন্ধে পেট গুলিয়ে বমি আসছে তূবার। রাগে সে আহফিনের কাছে গেল। আহফিন তখন জানালার দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আপন মনে সিগারেট টানছিল।

“আপনি সিগারেট খাচ্ছেন?”

“….

“কি হলো এখনো ফালছেন না কেন? আপনি আবার সিগারেট খাওয়া শুরু করলেন কবে থেকে?”

“….

“আমি কি বলছি শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?”

আহফিন পিছন ফিরে তূবা কে কাছে টেনে নিল। কোমরে বেশ শক্ত করেই ধরেছে। তূবা আহফিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আহফিনের চোখ গুলি রাগে লাল হয়ে আছে। কেমন ছলছলও করছে। তূবা চোখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে আহফিন কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

“এই সিগারেটের আগুন দেখছো না? এমন টা হাজারও সিগারেটের আগুন এক করলেও আমার বুকের জ্বালার সমান হবে না তূবা। এই আগুন দেখতে পাচ্ছো ভেতরের আগুন কেন দেখতে পাচ্ছো না তূবা?” দাঁতে দাঁত চেঁপে শান্ত ভাবে বলল আহফিন। তার কথা শুনে তূবার চোখ পানি তে উপছে উঠছে।

“কি হলো? কথা বলছো না কেন? আমার পরিবর্তন টা সহ্য করতে পারবে তো পরে?”

“আ আমাকে আজকের দিন টা সময় দিন প্লিজ।”

আহফিন তূবাকে আরো টেনে আনল কাছে। চোখ বন্ধ করে তূবার মুখের খুব কাছে চলে গেল। নাকে নাক ঢলতে ঢলতে হৃদয় কাঁপানো স্বরে বলল
“কেন তূবা? আজকের পর কি হবে?”

“…..

“কি হলো কথা বলছো না কেন?”

“দয়া করে অন্যকিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে। আজকের পর থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবেন। প্লিজ একটু বিশ্বাস করুন আমায়।”

আহফিন তূবা কে ছেড়ে দিল। তূবার দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম আহফিন পিছনে চলে গেল। কিছুই বলল না। শুধু লাল লাল চোখ নিয়ে তূবার দিকে তাকাল আর মুখে কষ্টে জর্জরিত একটা হাসি দিয়ে হনহন করে চলে গেল। তূবা তাকে পিছন থেকে দুই বার ডাকল। কিন্তু মানুষটা আর ফিরে এলো না।
বিছানায় বসে তূবা কাঁদতে লাগল।
“আমি কি করব আহফিন আপনিই বলুন। এখানে আমার কি করার আছে? রনি আমাকে আপনার কসম দিয়েছে কাল যেন শেষ বারের মতো তার ইচ্ছাটা রাখি। ও এটা না বললেও আমি তাকে খাওয়াতাম। হয়তো আবার না। কিন্তু আমি আর রনির সাথে দেখা করব না আপনাকে কথা দিলাম। আমি বলতে চেয়েও পারি নি আপনাকে সবটা বলতে। আপনি যদি আমার সাথে রাগারাগি করেন? আমি বলতে পারি নি। মাফ করবেন আমায়।”

তুসি কে খায়িয়ে দিয়ে শিরিণ বেগম কে বলল সব কিছু রেডি করে রাখতে। সে এসে হসপিটাল যাবে।

১ টা ১০ মিনিটে তূবা বের হয়েছে দুইটা টিফিন বক্স হাতে নিয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা রিকশায় উঠে পরল। দোকানের আড়াল থেকে আহফিনও গাড়ি স্টার্ট দিল। কাল রাত থেকে তূবা কে নিয়ে সে ভাবছে। রাতে সে তূবার ঘরে গিয়েছিল। নাম্বার টা নিয়ে কল করার পরও ধরেনি কেউ। প্রায় রাত ২ টার সময় কল রিসিভ করল অজানা ব্যক্তিটা। পুরুষ কন্ঠ শুনে সে কেটে দিয়েছিল। মনে মনে ধারণা করেছে এটা রনি হবে। আর একটু আগে যখন তূবা আজকের দিন টা সময় চাইল তখনই সে কিছু আন্দাজ করেছে। তাই আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল তূবার পিছু নিতে।

যেতে যেতে আহফিন খেয়াল করল তূবা সেই এতিমখানাতেই এসেছে। গাড়িটা এতিমখানার গেইটের পাশের বড় আম গাছটার পিছনে রেখে সে লুকিয়ে পড়ল।

তূবা এসেছে দেখে সব বাচ্চারা ভিড় করেছে এখানে। একটা টিফন বক্স ওদের কে দিয়ে সে বটগাছটার নিচে চলে যায়। তখন আহফিন রনি কে দেখে যে খুব অবাক হয়েছে এমন টা নয়। সে এটা আশাই করেছিল তূবার কাছ থেকে। রাগে আহফিনের পায়ের রক্ত মাথায় গিয়ে উঠতে লাগল। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। চোখ গুলি বড় বড় হয়ে আসছে।

তূবা আসতেই রনি বলে উঠল।
“তোর কথা মতো কহন থেইকা আইয়া বইয়া রইছি আমি।”

তূবা জবাব দিল না।

“তুই যে আমার লাইগা রাইন্ধা আনবি আমি ভাবতেই পারতাছি না রে তূবা।”

“…..
তূবা চুপচাপ টিফিন থেকে খাবার বের করতে লাগল।

“কিরে তূবা কথা কছ না কেরে?”

“এখানে রান্না করা আছে খেয়ে নাও।”

রাজ্যজয়ের হাসি হেসে রনি বলল “দে।”

হাত না ধুয়েই রনি তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করেছে। তূবা অবাক হয়ে দেখছে রনি কে। অবাক নয় খানিক টা ভয়ের চোখে। কারণ রনি এভাবে খাচ্ছে যেন এক মাসেরও বেশি অনাহারী। কপাল কুঁচকে সে তাকিয়ে আছে রনির দিকে।
হঠাৎ রনি বিশম খাওয়া তে ব্যাগ থেকে পানির বোতল টা বের করে দিল। তখনি তূবার চোখ গুলি আম গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে গেল। ভয়ে তূবার কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। যে ভয়ে সে সবটা বলেই নি সেটাই হলো এখন। তূবার শরীর কাঁপনি দেওয়া শুরু করেছে। দূর থেকেই আহফিনের চোখ গুলি লাল টকটকে দেখাচ্ছিল। তূবা যেন তার রাগ টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে। তার এখন কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। চিন্তাভাবনা সব শূন্য হয়ে গেছে।

রনি পানি খেয়ে আবার খেতে শুরু করল। তূবার দিকে তাকিয়ে যখন দেখল তূবা থরথর করে কাঁপছে তখন সে বলে উঠল
“কিরে তূবা কি হইছে তোর?”

“….

তূবার দৃষ্টি অনুসরণ করে রনি তাকিয়ে আহফিন কে দেখতে পেলে উঠে দাঁড়াল। সে কি করবে জানে না। রনি আবার তূবার দিকে তাকাল। তূবা তখনো আহফিনের রাগ কেই ভয় পাচ্ছিল।

আহফিন তূবা কে কিছুই বলে নি। ডাকও দেয়নি। গাছের একটা পাঞ্চ করেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। তূবা গলা ছেড়ে ডাকলেও শুনল না আহফিন। খুবই স্পিডে চলে গেল সে।

“তূ তূবা?”

“রনি আজ আমি এসেছিলাম তোমাকে একটা কথা জানাতে তুমি আর কখনো আমার সামনে এসো না। আমি তোমার সাথে আর কথা বা তোমাকে দেখতেও চাই না। আমি আমার সংসারটা আপন মনে করতে চাই। তোমার চাওয়া আমি পূরণ করেছি এবার তুমি আমার চাওয়া টা পূরণ করবে নিশ্চয়। তুমি প্লিজ আর কখনো আমার সামনে এসো না।”

তূবা কোনো রকম ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে বের হলো। আশেপাশে কোনো রিকশা না পেয়ে পায়েই হাটা শুরু করেছে।

রনি একবার খাবার গুলির দিকে তাকায় আরেকবার তূবার যাওয়ার দিকে। আনমনে চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল “আমি তো এমনিতেই যাইয়াম গা রে তূবা।”

রিকশায় বসে হাজারটা ফোন করেছে আহফিন কে একটা ফোনও তুলেনি সে। তূবার চোখ বেয়ে এমনি এমনি পানি পড়ছে। আল্লাহ কেন এমন টা করল। আজকের পর তো আর দেখাই হতো না রনির সাথে তাহলে কেন এমন টা করল আল্লাহ। তা ভাবেই চোখ দিয়ে পানি ফালাতে লাগল।

রাস্তায় জ্যামে আরো কিছুক্ষণ দেরি হলো তূবার যেতে। দৌড়ে দরজা খুলে গিয়ে আবার থমকে গেল। আজ আহফিন একা বসে আছে। কিন্তু তার সামনে ড্রিংক। তূবা কি বলবে এই মুহূর্তে জানে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।

আহফিন টেবিল থেকে ড্রিংকের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে তূবাকে বলল
“কি চাই এখানে?”

তূবা আবারো অবাক হলো। বিস্মিত নয়নে চুপ করে আছে।

“এখানে কেন এসেছো তুমি? চলে যাও এখান থেকে। রনির কাছে যাও। রনি কে সোহাগ করে রান্না করে খাওয়াও। ছিঃ তূবা তোমার চরিত্র যে এমন আগে ভাবতেই পারি নি।”

কাঁপা গলায় তূবা বলল
“কি কি বলছে আপনি?”

“লজ্জা করে না আমার সামনে যে আবার এলে? কোন মুখে এসেছো আবার এই বাড়িতে?”

“আহ আহফিন আপনি আমার কথাটা একটু শুনুন। আমি..”

“চুপ। একদম চুপ।”

“….

“তুমি যে নষ্টগলির নষ্ট মেয়ে আগে বুঝি নি। আমার আগেই বুঝা উচিৎ ছিল। তোমাকে নর্দমা থেকে তুলে বুকে ঠাই দিয়েছিলাম। আর তুমি কি করলে? বারবার না করেছি রনির থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু কি করলে? রনি কে এত পছন্দ করো। ওর ঘর কেন করো নি?”

আহফিনের মুখে এসব কথা শুনে তূবা কিছু বলার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু গা ঘিনঘিন করে উঠছে।

“আমারই ভুল। ছোটলোক কে লেম দিতে নেই তাহলে এমন হবেই। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গেছো আমার ভালোবাসা কেও ভেঙ্গে খানখান করে দিয়েছো তুমি। আমি তোমাকে আর আমার ঘরে তুলতে চাই না। মানে চাই না। মোট কথা হলো আমি তোমার সাথে আর সংসারই করতে চাই না।”

শেষের কথা গুলি আহফিন চিৎকার করে বলল। এই কথা শুনে তূবার সাথে পরিবেশও যেন কেঁপে উঠেছে। সব কিছু থমকে গিয়েছে। বারবার কানে লাগছে কথাটা। তূবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

“তোমার থেকে লুবনা হাজার গুন ভালো ছিল। সে আমাকে পছন্দ করে নি বলে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তুমি? তুমি কি করলে? তুমি দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলে। আমার সাথে নিজের নাগর কেও ধরে রাখতে চেয়েছিলে। না হলে এত বার না করেও আমি তোমাকে কথা শুনাতে পারি নি কেন? আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব। কারণ তোমার মতো অবিশ্বাসী নষ্ট চরিত্রের মেয়ের সাথে থাকতে পারব না আমি। না জানি রনির সাথে আর কি কি করেছো। তোমার তো চরিত্রের ঠিক নেই। নষ্ট দুশ্চরিততা মেয়ে একটা ছিঃ।”

“ব্যাস মিস্টার আহফিন চৌধুরী। আর একটা কথাও বলবেন না আপনি।”
হঠাৎ বজ্র পাতের মতো চিৎকার করে বলে উঠল তূবা। এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন আর চুপ থাকা সম্ভব নয়। চোখের পানি মুছে নিজেকে কঠিন করে নিল সে।

আহফিন রাগে ঘচঘচ করে তার কাছে এলো। তূবার দুই বাহু নিজের শক্তি দিয়ে চেঁপে ধরল। মুখ নিজের খুব কাছে এনেই বলল
“তুই কেন আমাকে ঠকালি? কেন? আমি বিশ্বাস ভালোবাসা কেন ভাঙ্গলি বল?”

তূবাও রেগে গিয়ে আহফিন কে ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিল। চিৎকার করতে করতে বলল “ছুবেন না আমায়। একদম ছুঁবেন না। আপনার লজ্জা করে না নষ্ট চরিত্রের মেয়ে কে ছুঁতে? আমি আপনাকে ভালোবাসার দুঃসাহস দেখি নি। আপনি দেখিয়েছেন বলেই দেখেছি। আপনি কি ভাবেন কি আমাকে? আমি মানুষ না? আমারও মন বলতে একটা জিনিস আছে। আপনি আমাকে রনির সাথে কথা বলতে না করেছেন। আমি তো ইচ্ছা করে কোনো দিন রনির কাছে যাই নি আপনি বলার পর থেকে। ও বারবার সামনে আসত আমার পায়ে পরত আমাকে নিজের শেষ ইচ্ছার কথাটুক রাখতে বলত। আমি কি করে না করতাম? আপনার কসমও দিয়েছিল এটা রাখতে। এরপর না খায়িয়ে আমি কি করতাম? বলুন কি করতাম? আমি মন থেকে ওয়াদা করেছিলাম আর যাই হয়ে যাক রনির সাথে কথা বলব না। ওকে আমার সামনে আসতে না করব। আপনি আমার কথাটুক না শুনেই চলে এলেন। আপনাকে বলতাম কি করে আমি? বললে রাগারাগি ঝগড়া হতো। আপনি না করতেন যেতে। কিন্তু আপনার দেওয়া কসম টার কথা আমি ভুলতে পারতাম না। আপনার কিছু হলে আমি..
অনেক হয়েছে। আমাকে দুশ্চরিততা বলেছেন না? আমি নষ্ট গলির নষ্ট চরিত্রের মেয়ে তো। আমার সাথে আপনি সংসার করবেন না ডিভোর্স চান। তাই না? ডিভোর্স?”

এক নাগাড়ে বলে তূবা দম নিল। নাক টেনে চোখ মুছে চুল ঠিক করল। এদিক ওদিক তাকিয়ে ড্রয়ার থেকে সাদা একটা স্ট্রেম্প কাগজ বের করল। তূবা জানে আহফিনের ব্যবসার কাছে বাসায় এই গুলি থাকেই। আহফিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে তূবার কান্ড দেখছে কিন্তু কিছুই বলছে না। তূবা চোখ মুছে নিচে সাইন করে দিল। সেটা নিয়ে আবার গেল আহফিনের কাছে।

“নিজের মতো যা ইচ্ছা বসিয়ে নিন। ধরে নিন এটাই ডিভোর্সের সাইন। আপনার লাইফ থেকে নষ্ট চরিত্রের মেয়েটা আজ দূর হলো মিস্টার আহফিন চৌধুরী।”

তূবা দৌড়ে চলে গেল। আহফিন তূবা কে একবারও ডাকে নি। সে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে গ্লাসের ড্রিংক টা শেষ করে নিল। তারপর আরেক গ্লাস ঢেলে সেটাও খেয়ে নিল। গ্লাস টা হুট করে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে বিকট ভাবে শব্দ করে উঠল আহফিন।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here