#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৬
আজ রাতে ছন্দ ও প্রাণের লন্ডনের জন্য ফ্লাইট। ছন্দ পুনরায় সবকিছু তত্ত্বাবধান করে বেরিয়ে পড়লো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে৷ যাওয়ার পূর্বে ছন্দ চৈতির নিকট পাখিটা রেখে গেল, সে সাথে তার দায়িত্ব-কর্তব্যও বুঝিয়ে দিল। যাওয়ার পথে ছন্দ প্রাণকে নিয়ে একবার আশা বেগমের কবর দেখে আসলো। প্রাণের অভিব্যক্তি নিত্যদিনের মতই নিস্পন্দ, অনুদ্ধত রইলো। তবে দৃষ্টি হয়তো অনুভূতি আড়াল রাখতে পারলো না, অশ্রুকণায় ভর্তি হয়ে উঠলো কয়েক পলকের। সিক্ত হলো মসৃণ গাল,চিবুক। তবে শব্দরা নিরুদ্দেশ পথের পথিক হয়েই রইলো। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ঘন্টা খানেকের মাঝেই তারা শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে নামার আগে ছন্দ প্রাণকে পড়ার জন্য মাস্ক,কালোচশমা ও ক্যাপ দিল। যাতে কেউ তাকে চিহ্নিত করতে না পারে। যদিও প্রাণের এসবের বিশেষ প্রয়োজন হয় না, তাকে সাদামাটা অবস্থায় কেউ সহসা চিনতে পারে না। যদি না তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও ছন্দ ঝুঁকি নিতে চাইলো না। তাছাড়া তাদের হেফাজতের জন্য দুইটা বডিগার্ড সর্বক্ষণ তাদের সাথে আছেই।
ছন্দ ভেবেছিল প্রাণ হয়তো জানতে চাইবে তারা কোথায় যাচ্ছে বা কেন? কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে প্রাণ টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। কাঠপুতুলের ন্যায় তার প্রত্যেকটা কথা নীরবে মেনে গেল শুধু। যেমন এখন, ছন্দ তাকে একবার মাস্ক,ক্যাপ পড়ার কথা বললে সে কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে পড়ে নেয়। অথচ এমন প্রাণকে সে কখনোই চায়নি। সে তো শুরু থেকেই ঘাড় ত্যাড়া,বদমেজাজি, বেরসিক মেয়েটাকে চেয়েছে। যে কাঁদতে,হাসতে না জানলেও রাগ করতে জানে, ঝগড়া করতে জানে। যে কারো কল্পনার কল্পরতা নয়, স*র্ব*না*শি*নী হতে জানে। বাস্তবতা বুঝে। অথচ নব্য প্রবর্তনে সবটা বদলে গেল মিনিটেই। প্রাণের মৌনতা ছন্দকে ভিতরে ভিতরে হ্রা*স করলেও সে বাহিরে হাসিমুখেই তা গ্রহণ করে যাচ্ছে। বুঝতে দিচ্ছে না সামনের পক্ষকে তার অনুভূতি।
তাদের সি অফ করতে জিহান আসে। ছন্দ তার সাথে কথাবার্তা বলে চলে যায় ভিতরে। ফারহাজের ওটি থাকায় সে আসতে পারেনি তবে ফোনে কথা বলে নিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সকল কার্যপ্রণালী শেষ করে বিমানে উঠতে ঘন্টা খানেকের বেশি সময় লাগলো তাদের৷ টার্কিশ এয়ারলাইনসের বিজনেসক্লাসে উঠে তারা। ছন্দ যতবার বিমানভ্রমণ করে ততবারই জানালার সিট নেয়, এছাড়া সে জার্নি করে না। তবে আজ ভিন্ন কিছু হলো। সে ইচ্ছে করেই নিজের কাঙ্ক্ষিত সিটটা দিয়ে দিল প্রাণকে। এমনটা সে কেন করলো জানা নেই, তবে তার লাগলো এতে ঈষৎ পরিমান হলেও প্রাণ স্বস্তি পাবে। উপভোগ করবে।
উপরে যাত্রীরা আঁধারিয়া অম্বরে মেঘ স্পর্শ করছে, নিচেই যান্ত্রিক নগরী দ্যুতির আড়ম্বরে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কি অপরূপ সংমিশ্রণ৷ নিশুতি ঘনিয়ে আসতেই সকলে তলিয়ে যায় ভিনদেশি এক রাজ্যে। প্রাণ ঘুমিয়ে পড়েছে আরও আগে। ছন্দ উঠে প্রাণের গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে দিল ভালোভাবে৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। খানিকটা ঝুঁকে প্রাণের কপালে খুব সন্তর্পণে নিজের অধর দু’টো ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আপনাকে আমি কখনো মিইয়ে যেতে দিব না প্রাণ। কখনো না।”
____
দীর্ঘ একুশ ঘন্টার পথ পেরিয়ে অবশেষে তারা এসে পৌঁছালো গ্যাটউইক বিমানবন্দরে। ছন্দ প্রাণকে সামলে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো তার বাবা আরশাদ তুরহান এসেছেন তাদের নিতে৷ ফারহাজ আগেই জানিয়েছিল ছন্দকে, সে বাসায় তাদের বিয়ের কথা জানিয়েছে এবং সম্পূর্ণ ঘটনা,পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। কোনরকম ঝামেলা করতে একদম নিষেধ করে দিয়েছে। তারাও বুঝেছে বিষয়টা এবং ফারহাজকে আশ্বস্ত করেছেন কেউ কোন প্রকার ঝামেলা করবে না। ছন্দ ও প্রাণ যাতে আসে। ছন্দ যদিও এসব নিয়ে দ্বিধায় ছিল তবে ফারহাজ তাকে আলাদাভাবে বুঝিয়েছে যে, একসাথে থাকলে কথা কা*টা*কা*টি, মনোমালিন্য হতেই পারে। তাই এরকম কিছু হলে তখন যাতে সে রাগ না দেখিয়ে শান্ত মাথায় বিষয়টা সমাধান করার চেষ্টা করতে। মানিয়ে চলতে।
কথাগুলো ভেবে ছন্দ আলগোছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। যদিও ছন্দের কোন ইচ্ছা ছিল না আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার তবে যত যাই হোক সে তার বাবা লাগে, তাই সম্মান রক্ষার্থে সালাম জানিয়ে প্রাণের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার বাবা।”
প্রাণ দৃষ্টি তুলে তাকালো, আরশাদকে এক নজর দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো। মৌনতা ভে*ঙে মিনমিনে কন্ঠে সালাম দিল তাকে। আরশাদ হাসিমুখেই দুইজনের সালাম গ্রহণ করলেন। বুঝলেন, মেয়েটাই তার ছেলের বউ। তাই তিনি প্রাণকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভালো আছো মামণি?”
প্রাণ চটজলদি দৃষ্টি তুলে তাকায়। ‘মামণি’ বলে তাকে তার আশামা ডাকতো৷ খুব আদর করে। আজ এতদিন পর এই সম্মোধনটা শুনে বুকটা ধক করে উঠেছিল তার। সর্বাঙ্গে বয়ে গেল হিম শিহরণ। কোনরকম মাথা দুলিয়ে বুঝালো, সে ভালো আছে। কিন্তু বিপরীতে যে আরশাদের হালচাল জিজ্ঞেস করবে সেই জো আর তার থাকলো না। নয়নের কার্নিশে জল ভিড় জমাতেই মাথা নুয়ে ফেললো সে৷ এই এক জায়গায় এসে বার বার কেন সে দুর্বল হয়ে পড়ে জানা নেই৷ আরশাদ সবই আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ছন্দ চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝাতে নিশ্চুপ বনে গেলেন তিনি। ছন্দ এই ফাঁকে প্রাণকে পিছনের সিটে বসিয়ে গাড়ির ব্যাকসাইডে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে ফ্রন্ট সিটে এসে বসলো সে। আরশাদও আর বিলম্ব না করে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন।
ইংল্যান্ডের হাইওয়ে ধরে গাড়ি এগুচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ অরণ্যের দীর্ঘ বসতী। মাঝে মধ্যে নীলাভ আকাশের মধ্য দিয়ে দুই-একটা পাহাড় মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিচ্ছে যেন। গাড়ির ভিতর গুমোটভাব ছড়িয়ে। প্রাণ জানালার বাহিরে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর ছন্দ কানে ইয়ারফোন গুঁজে সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে বসে। ফাঁকে ফাঁকে প্রাণের কিছু প্রয়োজন কি-না তার খেয়ালও রাখছে সে। আরশাদ দেখছেন সবই কিন্তু কোন কথা বলছেন না। বড় ছেলের সাথে সহজে আড্ডা জমাতে পারলেও ছোট ছেলের সাথে সেভাবে পারেন না। শুরু থেকেই ছন্দ ও তার মধ্যকার সম্পর্ক কেমন খাপছাড়া। তাদের মাঝে দূরত্বও বেশ। হয়তো এককালে ছেলের প্রতি বেশি কঠোরতা দেখিয়ে ফেলেছিলেন বলে।
_____
ঘন্টা খানেকের পথ পেরিয়ে তারা এসে থামলো বিশাল এক অট্টালিকা সামনে। আরশাদ তাদের গেটের সামনে নামিয়ে বলল ভিতরে যেতে, সে গাড়ি পার্ক করে আসছে। তার কথা অনুযায়ী ছন্দ প্রাণ ও ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়লো। ছন্দ আগেও কয়েকবারের এসেছে এখানে। ইংল্যান্ডে যতবারই তার ম্যাচ থাকে ততবারই তার ছোট বোন ফারিনাজ খেলা দেখতে যায় এবং ফিরতি পথে তাকে জোরপূর্বক সঙ্গে নিয়ে আসে। একমাত্র আদরের বোন হওয়ায় ছন্দ তাকে নাও করতে পারে না। তবে দু’দিনের বেশি সে কোনবারই থাকে না। অথচ এবার সম্পূর্ণ আলাদা। কতদিনের জন্য থাকতে হয় তাকে কে জানে?
ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। এগারো তালায় এসে লিফট থামতেই নেমে পড়লো তারা৷ ব্লক-সি এর সামনে এসে ডোরবেল বাজাতেই ঊনিশ কি বিশ বছর বয়সী এক তরুণী এসে দরজা খুললো৷ ছন্দকে দেখামাত্র উচ্ছ্বাসে ‘ভাই’ বলে চেঁচিয়ে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ছন্দও আলতো হেসে ছোট বোনকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো৷ বলল, “কেমন আছিস ফারু?”
ফারিনাজ এবার সরে এসে বলল, “একবারে ফাস্টক্লাস। তুই কেমন আছিস? আর ভাবি কোথায়?”
ছন্দ পাশে ইশারা করতেই ফারিনাজ সেদিক তাকালো। প্রাণের মলিন নয়নে তার পাণেই তাকিয়ে ছিল। ফারিনাজ আলতো করে প্রাণকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি ভাবি! আগে খেয়াল করিনি তোমায়।”
প্রাণকে এবার ছেড়ে দিয়ে তার হাত ধরে টেনে বলল, “ভিতরে আসো। কতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”
প্রাণকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফারিনাজ তার হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে আসলো। ছন্দ লাগেজ সব ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। ভিতরে ঢোকার পর পরই ছন্দের মা নাফিসা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলেন। ফারিনাজকে বললেন, “যা ফ্রিজ থেকে ভাই আর ভাবির জন্য মিল্কশেক নিয়ে আয়। আমি বানিয়ে রেখেছি।”
ফারিনাজ মায়ের কথায় রান্নাঘরের দিকে ছুটলো৷ নাফিসা এবার ছন্দের মুখপানে তাকালেন। প্রফুল্লচিত্তে মন ভরে যেন উঠলো তার। ঠোঁটের কোণে আবির্ভাব হলো বিস্তৃত হাসির। প্রায় দুই বছর পর দেখছেন নিজের ছেলেকে। অভিমান করে ছেলেটা যে দূর হলো, এখন পর্যন্ত তা কমার নাম নেই। তিনি এই প্রতিক্ষায় দিন গুনছেন, কবে অভিমানের দেয়াল ভা*ঙ্গ*বে আর ছন্দের মন নরম হবে৷ সে নিজের নেত্রের জলটুকু মুছে এগিয়ে এসে বললেন, “কেমন আছিস বাবা? কতদিন পর আসলি৷ আর এত শুকিয়ে গিয়েছিস কেন? খাস না কিছু ঠিকমতো?”
ছন্দের হেসে বলল, “আমি ঠিকই আছি মা। আর আমার ফিট বডি কি তোমার চোখে পড়ছে না?”
নাফিসা বললেন, “মায়ের চোখে এটাকে শুকানোই বলে।”
ছন্দ শ্লেষাত্মক হাসলো। বলল না কিছু। নাফিসা এবার প্রাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরেহ! তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো! বসো! আমি রুমে এসি ছেড়ে দিচ্ছি।”
এই বলে নাফিসা ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসি ছেড়ে প্রাণকে সোফায় নিয়ে বসালেন। তারপর ছন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস!”
ছন্দ বলল, “আমি আগে ফ্রেশ হবো। অনেক ক্লান্ত লাগছে।”
“যা তাহলে। আমি তোর জন্য বা-দিকের রুম পরিষ্কার করে রেখেছি।”
ছন্দ মাথা দুলিয়ে প্রাণকে জিজ্ঞেস করলো, “প্রাণ আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
প্রাণ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকালো শুধু। নাফিসা প্রাণের দিকে তাকালেন। মেয়েটার উপর বেশ ধকল গিয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। চোখ,মুখ কেমন র*ক্ত*শূ*ণ্য দেখাচ্ছে। তাই তিনি দুইজনকে আগে ফ্রেশ হওয়ার রুমে পাঠিয়ে দিলেন।
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]
[রি-চেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন সকালে উঠে রি-চেক করে নিব নে।]