#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৫
ফারহাজ চোখের চশমা নামিয়ে বলল, “আমি বলব ওকে লন্ডন নিয়ে যা, বাবা-মার কাছে।”
ছন্দ ভড়কে উঠে বলে, “তুই কি পাগল ভাই? এটা অসম্ভব।”
“অসম্ভবের দেখছিস কি তুই?”
“তুই ভালো করেই জানিস, বাবা-মা কতটা ট*ক্সি*ক। প্রাণের সম্পর্কে জানলে তারা রিয়্যাক্ট করবে। তার উপর না জানিয়ে বিয়ে করেছি বলে যে ঝামেলা করবে, সে-টা আলাদা।”
“তুই সবসময় আব্বু-আম্মুকে নেগেটিভলি নিস কেন? এত কি সমস্যা তোর তাদের সাথে?”
ছন্দ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কারণ তারা কোন কিছু পজেটিভলি নিতে জানে না। আমার বেলায় কি করেছে দেখোনি? কত সমস্যা ছিল আমাকে নিয়ে। তুমি তো তাদের বাধ্য ছেলে ছিলে, তাই তুমি যাই করতে তাই ঠিক। কিন্তু আমি? অবাধ্য ছিলাম। যার জন্য আমি যাই করতাম তা খারাপই। কোন কাজটা আমার আজ পর্যন্ত পছন্দ করেছে তারা? কোনদিন আমার ক্রিকেট খেলা সাপোর্ট করেনি। আমি খেলতে চাইলে বাবা বে*ত দিয়ে পিটাতো। মনে নেই?”
“তুই তাদের ভুল বুঝছিস। তারা কিন্তু তাদের জায়গায় ঠিকই ছিল। তুই পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত থাকতি বলেই তারা এমন করতো। তখনকার দিনে ক্রিকেট খেলাকে পেশা হিসাবে ধরা হতো না। এই সেক্টরে কোন ভবিষ্যৎ-ই ছিল না। তাই তারা চাইতো তুই পড়ালেখা ঠিক মত কর, নিজের ক্যারিয়ার গড়।”
“তো এখন কি করিনি নিজের ক্যারিয়ার? এই ক্রিকেটের মাধ্যমেই কিন্তু পুরো বিশ্ব চিনে আমায়।”
ফারহাজ নিরলস কন্ঠে বলল, “তুই এই সেক্টরে নিজের জায়গায় করে নিতে পেরেছিস বলে যে সবাই পারবে তা তো না। বেশিভাগ মানুষই অর্ধেক রাস্তায় এসে ঝরে পড়ে। পারে না টিকে থাকতে, ক্যারিয়ার করতে। তাই সে হিসাবে বাবা-মায়ের চিন্তা ঠিকই ছিল।”
ছন্দ কথা বলল না কোন। তা দেখে ফারহাজ বলল, “তুই টিকে থাকতে পেরেছিস, পরিশ্রম করেছিস বলেই সব সম্ভব হয়েছে ফায়াজ। তাই তাদের ভুল বুঝিস না। আব্বু-আম্মু তোর প্রতি কঠোর হয়েছে আমি মানছি কিন্তু তারা সবসময় তোর ভালোই চেয়েছে৷ আর আব্বু-আম্মুর সাথে কখনো সেভাবে মিশিসনি তাই জানিস না তারা কেমন।”
ছন্দ এবারও নিরুত্তর। ফারহাজ বলল, “তুই নিশ্চিন্তে সেখানে প্রাণকে নিয়ে যা। কিছুই হবে না। এভাবেও প্রাণের এখন নতুন পরিবেশ ও একটা ফ্যামিলি টাইপ অ্যাটমোসফিয়ার ভীষণ দরকার। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম সাজেস্ট করছি, সেখানে গিয়ে তাকে দেখাতে পারিস। চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের সাথে মিশতে পারলে, কথা বললে ওর মন এদিকেই থাকবে। রিকোভার করবে দ্রুত।”
ছন্দ বুঝলো ফারহাজের কথা। এখন সে ফ্রি আছে ঠিক তবে বিসিবি থেকে পুনরায় ডাক পড়তে পারে যেকোনো সময়। তখন না চাইলেও তার যেতে হবে আর প্রাণকে থাকতে হবে একা। সেই একাকিত্ব তাকে হ্রাস করবে। তাহলে লাভ কি হবে? তাই ভিনদেশে নেওয়াটাই এখন সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তবে মনের সংশয়ের জন্য মুখে বলল, “তুই যত যাই বলিস না কেন ভাই, তাদের উপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই।”
“আচ্ছা যা, আমি আগে থেকে বুঝিয়ে বলব নে তাদের সব। আশা করি এরপর ঝামেলা হবে না কোন। তুই জাস্ট যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
ছন্দ ফারহাজের কথায় আশ্বস্ত হলো। নীরবে সম্মতি জানালো। ফারহাজ হেসে বলল, “বাবা-মাকে এবার ভরসা করেই দেখ, নিরাশ হবি না।”
____
ছন্দ রুমে ঢুকলো রাত বারোটা বাজার একটু আগে। এতক্ষণ বাহিরেই পায়চারি করছিল সে। ত্রাসিত মনে ব্যগ্রতার ছাঁপ ছিল প্রখর। অজানা এক কারণে বেশ সংকোচ,দুঃশ্চিন্তা কাজ করছিল তার। সেসময় প্রাণ রেজিস্ট্রার নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুললেও পরবর্তীতে যে তুলবে না তা ভাবা বোকামি। কখন যে কি বলে বসে? তার উপর বিয়েটা নিয়ে প্রাণ কি ভাবছে তা জানা জরুরি। প্রাণ যে বিয়েটা আশা বেগমের জন্য করেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ছন্দ জানতো, প্রাণকে আশা বেগমের কথা বললে কিছুটা হলেও গলে যাবে। বিয়ের জন্য রাজি হলে হতেও পারে। তাই কিঞ্চিৎ আশার আলো নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সে এই বিষয়টা তুলে এবং কাজেও লাগে। তবে প্রাণ যে ধরণের মেয়ে, সকল ঘটনা শান্ত মাথায় ভাবলেই চট করে ধরে ফেলবে সব। তখন কোন প্র*ল*য়ং*ক*রী ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসবে, কে জানে। পরিস্থিতি আগের মত হলে বুঝানো যেত সে এসব তাকে পাওয়ার জন্য করেছে। তাকে ভালোবাসে বলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, প্রাণকে বুঝানো দুষ্কর ব্যতীত কিছুই না। এমতাবস্থায় প্রাণ যদি তাকে ভুল বুঝে? দূরে সরে যায়? সে কিভাবে সামলাবে সব? নিবিড় চিন্তাধারায় মাথাব্যথা করে উঠলো তার। নিজেকে কোনরকম বুঝ দিল, “যা হবে দেখা যাবে।” অতঃপর মন-মস্তিক শ্লথ করে সাহস সঞ্চার করলো ভীতরের আসার।
ভিতরে ঢুকে ছন্দ প্রাণকে বিছানায় পেল না। শূণ্য ঘরে এক নজর বুলিয়ে সে দরজা ভিড়িয়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। চাঁদ উঠেছে গগনে। স্নিগ্ধ আলোর ছটা বারান্দার শিক গলিয়ে অন্দর স্পর্শ করছে নির্বিঘ্নে। ফুলের মাতাল করা সুবাস শূন্যে ছুটছে। চন্দ্রসুধা ঠিকড়ে পড়ছে রমণীর ম্লান মুখটায়। ম্রিয়মাণ দৃষ্টি, লাবণ্যতা নেই কোন। তবুও ছন্দের চোখে তাকে মায়াবী দেখাচ্ছে। সে নীরব পায়ে এগিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। স্তিমিত কন্ঠে বলল, “জ্বর কমেছে? দূর্বল লাগছে এখনো?”
কারো শব্দহীন আগমনে প্রাণ ভড়কালো না। তবে উত্তরও দিল না। মৌনতা যেন এখন তার একমাত্র সঙ্গী,শব্দের দেখা পাওয়াই যায় না। ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কক্ষে এসে কাবার্ড থেকে পাতলা চাদর নিয়ে ফেরত গেল। পিছনদিক দিয়ে প্রাণের গায়ে চাদরটা জড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে আছেন, শরীর পরে আরও খারাপ করবে তো।”
প্রাণ পাশ ফিরে এক ঝলক তাকালো। পুনরায় ঘুরিয়ে নিল আঁধারিয়া অম্বরের পাণে। ছন্দ কন্ঠস্বর যতটা সম্ভব নামিয়ে বলল, “কথা বলবেন না? রাগ করে আছেন?”
প্রাণ নিরুত্তর। ছন্দ তবুও অপেক্ষা করলো উত্তরের৷ কিয়ৎক্ষণ পর প্রাণ নিজ থেকে বলে উঠলো, “বাকি সবার মতই আপনি নিজের কথা ভেঙ্গেছেন ছন্দ। প্র*তা*র*ণা করেছেন।”
স্বাভাবিকের তুলনায় ছন্দ দ্বিগুণ ভড়কালো। আশ্চর্যান্বিত দেখালো নয়ন যুগল। তটস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে?”
প্রাণের কন্ঠস্বর শান্ত, শীতল অথচ প্রচন্ড শা*নি*ত, “আপনি কথা দিয়েছিলেন, কোন কিছুতেই আপনি আমাকে চাইবেন না।”
ছন্দ আগেভাগেই আন্দাজ করেছিল এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে। তবে এত দ্রুত তা আশা করেনি৷ নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো৷ সবটা ঠান্ডা মাথায় না সামলালে হাতের বাহিরে চলে যাবে। বলল, “আমি তো আপনাকে চাইনি। সই চেয়েছিলাম।”
“সেটা কি আমাকেই চাওয়া নয়?”
ছন্দ নিজের কথায় অটুট থেকে বলে, “না! সইয়ের মাধ্যমে আপনার নামের পাশে আমার নাম জুড়েছে শুধু। আপনাকে পাওয়া তো হয়নি আমার। আর সে-টা আপনার অনুমতি ব্যতীত হবেও না।”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “আমি যে বয়সে আপনার দুই বছরের বড় তা জানেন?”
ছন্দ হেসে বলল, “তাতে কি? এইজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার, হুইচ ডাজন্ট ম্যাটার। আর ভালোলাগা, ভালোবাসা এসব দেখে হয় না। নাহলে আজ আপনার পাশে আমি থাকতাম না।”
“আমার অতীত সম্পর্কে জানেন তো?”
ছন্দের ভাবান্তরহীন উত্তর, “জানার আর কিছু বাকি নেই।”
“তাহলে এটাও জানেন নিশ্চয়ই নয়ন ও জেসিকার জীবনের ধ্বং*সা*ত্ম*ক আমি? ”
“আপনি সকলের জন্য প্রা*ণ*না*শী*নি হলেও আমার জন্য প্রাণেশ্বরী। আমার একান্ত প্রাণেশ্বরী।”
“আপনার জন্য আমি যাই হই না কেন, আমার জন্য আপনি বিশেষ কেউ নন। আর আমি বিয়েটা করেছি একমাত্র আশামার ইচ্ছে রাখতে৷ এর ব্যতীত কিছু না।”
“বিয়েটা যেভাবেই হোক, আমরা এখন এক সম্পর্কে আবদ্ধ এটাই আসল।”
“একটা সম্পর্কের মূলভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। এটা ছাড়া কোন সম্পর্ক টিকে না। আর নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার মাঝে নেই। আমি পারবো না আর কাউকে আপন করে নিতে, সম্পর্কটা আগলে নিতে।”
“জীবনের এক মোড়ে এক হেরেছেন বলে, সব মোড়েই হারবেন তা ভাবা বোকামি।”
প্রাণ নিস্পৃহ কন্ঠে বলল, “আবেগ,মোহ ক্ষণস্থায়ী। কেটে গেলে বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। সবটা এত সহজ না। আমাদের সম্পর্কটাই এলোমেলো। দায়িত্ব, কর্তব্যের মাঝে টিকবে কতদিন?”
“কঠিন সব কিছুকেই নিজ উপায় সহজ করে তুলতে হয়। আর আপনাকে বুঝি আমি। তাই বলছি একটাবার সুযোগ দিয়েই দেখুন না, শেষবারের মত ভরসার হাতটা এগিয়ে দিন। কথা দিচ্ছি, মন ভা*ঙ্গ*তে দিব না আপনার। সর্বদা আগলে রাখবো, আপনাকে এবং সম্পর্কটাকে।”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। সে বুঝে গিয়েছে এই একরোখা মানবটাকে বুঝানো তার পক্ষে সম্ভব না। মানুষটা কোনভাবেই পিছপা হবে না আর। প্রাণ যৎসামান্য সময় মৌন রইলো। অতঃপর কোন কথা না বলে চলে গেল শয়নকক্ষের দিকে৷ ছন্দ সেদিক তাকিয়ে আলগোছে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
_______
ছন্দ চৈতির সাহায্যে প্রাণের সকল শুট,অ্যাড ও মুভির কন্ট্রাক্ট স্থগিত করে দেয়। ছুটি নিয়ে নেয় ছয়মাসের মত। সে সাথে প্রাণের পাসপোর্টসহ বাকি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যোগাড় করে নিয়ে এম্বাসিতে জমা দিয়ে দেয়। দুইজনের গ্রিন পাসপোর্ট হওয়ায় কয়েক সপ্তাহ মধ্যেই ভিসা পেয়ে যায় তারা। টিকেট কনফার্ম করে ছন্দ তার এবং প্রাণের লাগেজ গুছিয়ে নেয়। সব ঠিকঠাক থাকলে দুইদিনের মধ্যেই চলে যাবে তারা। তবে ইদানীং প্রাণ নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে একবারে। হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ বাদে কোন কথাই বলতে চায় না। সারাদিনে ছন্দ কত চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না। আগে তো ঔষধ খাওয়ানোর সময় তার মুখে শব্দ ফুটতো, এখন সচরাচর তাও হয় না। প্রাণের মনে কি চলছে তা বুঝাও দুষ্কর। মাঝে মধ্যেই ছন্দের ভীষণ ভয় হয়। প্রিয়তমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। পরিস্থিতি এখন যেভাবে এগুচ্ছে, তা নিম্নের দিকে। তার এখন জানা না এসবের পরিণতি কি হবে বা হতে চলেছে। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে, হয় লন্ডনে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে নাহয় সমাপ্তি। দেখা যাক, ভাগ্য তাদের কোন মোড়ে এসে দাঁড় করায়।
#চলবে
[ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত আছি বিধায় লেখায় মন বসাতে পারছি না। ছণ্ণছাড়া হচ্ছে লেখা। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে একটু সময়ের প্রয়োজন, সে সাথে পরবর্তী পর্ব লিখতেও৷ তাই পাঠকদের একটু অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ রইলো। অনিয়মিত হওয়ার জন্য দুঃখিত।]