#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১২+১৩
সময়ে স্রোত অবশেষে এসে পৌঁছায় কাঙ্ক্ষিত কালের সন্নিকটে। শুরু হয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। উচ্ছ্বাসের আলোড়ন সৃষ্টি হয় জনসাধারণের মাঝে। নিজেদের প্রিয় তারকাদের একত্রে অনস্ক্রিন দেখার সুযোগ, সে সাথে কে কয়টা এবং কোন অ্যাওয়ার্ড জিতে নিল তা দেখার প্রবণতা৷ গাড়িতে বসে প্রাণ নীলিমা আকাশ দেখছে, নক্ষত্রদের উজ্জ্বলতায় ঘেরা। পাশেই চৈতি আরাম ভঙ্গিতে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। হঠাৎ সে বলে উঠে, “ম্যাম, এবার আপনাকে আর নয়ন স্যারকে নিয়ে বেশ কন্ট্রোভার্সি চলছে। সবাই আশা করছে সেরা জুটির পদবিটা এবার আপনারাই পাবেন।”
প্রাণ পাশ ফিরে তাকায়। স্মিত হেসে বলে, “খারাপ কি এতে? তবে তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমাকে আর নয়নকে একসাথে মানায় না?”
চৈতি হতবুদ্ধি দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের দিকে। সে এটা কখন বলল? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে, “নাহ! নাহ! আপনি ভুল বুঝছেন ম্যাম। আমি এটা বলতে চায়নি। আপনাকে আর নয়ন স্যারকে নিঃসন্দেহ খুব ভালো মানায়। আমি তো বিষয়টা আপনাকে এভাবেই বললাম।”
প্রাণ হেসে বলে, “ডোন্ট প্যানিক! মজা করছিলাম আমি।”
চৈতি বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। প্রাণকে সে খুব কম হাসতে দেখেছে, রসিকতা যেন তার মধ্যে নাই-ই। সবসময় গাম্ভীর্যে আচ্ছাদিত থাকে সে। আজ প্রাণের এমন রূপ দেখে চৈতি না থমকে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ পর বুঝলো প্রাণের মন-মেজাজ আজ ফুরফুরে। তার ঠোঁটের কোণে অমায়িক এক হাসি লেগেই আছে, যা তার রূপের মাধুর্য বাড়াচ্ছে কয়েক’শ গুণ। মেয়েটার হাসি এত সুন্দর অথচ মেয়েটা হাসেই না। কেন, কে জানে? চৈতি এবার আনমনে প্রশ্ন করে উঠল, “আজকে কি বিশেষ কিছু আছে?”
ঘন্টা খানেকের পথ পেড়িয়ে অবশেষে গাড়ি এসে থামলো অভিলষিত স্থানে। প্রাণ জামা গুছিয়ে বেরিয়ে আসতেই ক্যামেরাম্যানরা হু’ম’রি খেয়ে পড়ে তার ছবি তোলার জন্য। তারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে প্রাণের ছবি তুলেই চলেছে, ফ্ল্যাশের আলোয় অক্ষিকাচ ঝ’ল’সে যাওয়ার উপক্রম। এ যেন ঝিকিমিকি আলোর বর্ষণ। বাউন্ডারি থাকায় রিপোর্টরা পারছে প্রাণকে ঝেঁকে ধরতে। দূর থেকেই বজ্রকন্ঠে একের পর এক প্রশ্ন ছু’ড়েই চলেছে। প্রাণ অধরযুগল প্রসারিত রেখে ছবি তুলে তার মন মত কয়েক প্রশ্ন উত্তর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ভিতরে দিকে। ভিতরে প্রবেশ করতেই তার দেখা হয় নয়ন এবং নিহাল শিকদারের সাথে। নিহাল শিকদার প্রাণকে দেখে উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠেন, “ওয়েলকাম ডিয়ার!”
প্রাণ প্রত্যুত্তর না করে নিবিড় চোখে তাকালো শুধু। নয়ন এগিয়ে এসে প্রাণের সান্নিধ্যে এসে মন্থর কন্ঠে বলে, “ইউ আর লুকিং ডেম টু নাইট মাই লাভ। চোখই সরাতে পারছি না আজ তোমার থেকে।”
প্রাণ এবারও প্রত্যুত্তর করলো না। দুর্লভ হাসলো। নিহাল শিকদার এগিয়ে এসে বললেন, “নয়ন এবার তুমি আর প্রাণ একসাথে রেড কার্পেটে যাবে। জাস্ট লাইক আ কাপল।”
নয়ন কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাট আঙ্কেল, এটা কি ঠিক হবে? যেখানে আমরা আমাদের রিলেশনটাই হাইড রাখছি সেখানে….”
নয়ন আর বলতে না দিয়ে নিহাল বলে উঠেন, “এসব ভাবা তোমার বিষয় না, যা বলছি তা কর। বাদ বাকি আমি দেখছি।”
নয়ন মিনমিনে কন্ঠে বলে, “তুবও প্রাণের যদি কোন আপত্তি থাকে? ওকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয় না?”
“আমার কোন আপত্তি নেই নয়ন।”
নয়ন আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। সে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না প্রাণ বলছে এই কথা? যে মেয়ে কন্ট্রোভার্সি হবে বলে কখনো পাবলিকে বা ইভেন্ট-প্রোগ্রামে তার সান্নিধ্যেও ঘেঁষেনি, কয়েক হাত দূরে থেকেছে। আর আজ সে বলছে এই কোলাহল, জাঁকজমকপূর্ণ মহলে সে তার হাতে হাত রেখে হাঁটতে রাজি? এ আদৌ সম্ভব? নয়ন নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রাণকে তটস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ভেবেচিন্তে বলছ তো? মানে সিরিয়াস তুমি?”
“আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি সিরিয়াস না?”
নয়ন এবার দমে গেল। ভিতরে ভিতরে হাঁসফাঁস করতে থাকলো। তার মনে সন্দেহ জাগলো, “প্রাণ কি চাইছে তাদের সম্পর্কটা সকলের সামনে তুলে ধরতে?” পরবর্তীতে ভাবলো, “নাহ! প্রাণ নিজের প্রাইভেসি নিয়ে অত্যাধিত সচেতন। সে এমনটা চাইবে না। হয়তো লাইম লাইট পাওয়ার জন্য সে সম্মতি জানিয়েছে।” নিজের ভাবনা সব কোনরকম মনের মাঝে চাপা দিয়ে ওষ্ঠে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “দ্যান শেল উই গো?”
প্রাণ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হাস্যজ্বল মুখে নয়নের হাতের উপর হাত রাখলো। অতঃপর দুইজনই এগিয়ে গেল রেড কার্পেটের দিকে। রেড কার্পেটে পা রাখতেই সকল ক্যামারার ফোকাস এসে থমকালো তাদের উপর। দুইজনকে হাত ধরে আসতে দেখতে ভীমড়ি খেয়ে পড়লো সকলে, নতুন এক নিউজ পোর্টাল পেল বলে রিপোর্টারদের চোখ চকচক করে উঠলো। বাকি সবদিক থেকে ফোকাস সরিয়ে তারা প্রাণ এবং নয়নকে হাইলাইট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। নাহলে পরেরদিন রস-মশলা মাখিয়ে নিউজ বের করবে কিভাবে? প্রাণ ও নয়ন সম্মুখে এসে ছবি তোলার জন্য নিখুঁত দেহভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে তাকাতেই একেক পর এক ক্লিকের শব্দ ঝং’কা’র তুলে চারদিকে। ইতিমধ্যে পাপাজিরা, রিপোর্টাররা তাদের দিকে প্রশ্নের তী’র ছু’ড়’তে শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে নিহাল শিকদার এসে হাজির হয় তাদের মাঝে। বিস্তৃত হেসে বলে, “কেমন আছেন আপনারা সবাই?”
বিপরীত পাশ থেকে প্রত্যুত্তর মিলতেই নিহাল বলে উঠেন, “এই দিনটা জন্য আমি অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলাম, একটা বিশেষ ঘোষণা দেওয়ার ছিল বলে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।”
রিপোর্টাররা সকলে উৎসুক কন্ঠে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতেই নিহাল সকলের সামনে প্রাণ আর নয়নের এনগেজমেন্টের তথ্যটি প্রকাশ করেন। তিনি এটাও জানান যে খুব জলদি নয়ন আর প্রাণের বিয়ে হতে চলেছে। সে সাথে দুই সপ্তাহ পরে নয়ন ও প্রাণের একটি আসন্ন মুভি মুক্তি পাওয়ার তারিখটাও তিনি ঘোষণা করেন। সকলের দৃষ্টিতে এবার খেলা করে যায় বিস্ময়ান্বিত ভাব। পরপর দুইটা ব্রেকিং নিউজ তারা এভাবে পেয়ে যাবে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ঘটনাক্রমে নয়ন নিজেও বুদ্ধিভ্রষ্ট,বিমূড়। এমন কিছু সে মোটেও আশা করেনি৷ সে বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রাণ আর নিহালের পাণে। পরমুহূর্তে রিপোর্টারদের কথা মস্তিষ্কে টনক নাড়তে নিজেকে সামলে নেয় সে। এদিকে সকলের মধ্যস্থলে উচ্ছ্বাসের স্ফুরণ দেখা দেয়৷ অভিনন্দনের ভিতরে অজস্র প্রশ্নের ভেলা। বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠে তারা৷ দূর থেকে এই মনোরম পরিবেশ দেখে ফুঁসে উঠে জেসিকা। রো’ষা’গ্নি দৃষ্টিপাত করে প্রাণের উপর। আজ সে প্রাণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আকর্ষণীয় পোশাকে হাজির হয়েছিল, রূপের দিক দিয়েও কোন কমতি রাখেনি। মূলত প্রাণের থেকে এগিয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ধরেই নিয়েছিল এবার সকলের আকর্ষণ, স্পটলাইট সেই প্রাণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা গুড়ের বালি, এবারও প্রাণ স্পটলাইট নিয়ে গেল। কেন প্রতিবার এত বিশ্রীভাবে সে হেরে যায় প্রাণের কাছে? কেন? প্রাণের বাবা ডিরেক্টর বলেই কি প্রাণ এত প্রাধান্য পায়? সে কেন বারংবার পারিপার্শ্বিক চরিত্র হয়ে রয়ে যায়? রা’গ’দ্বে’ষে জেসিকার এবার নিজের চুল নিজেরই ছিঁ’ড়’তে ইচ্ছে করছে। পারছে না শুধু প্রাণের জীবনটা ক’ব’জ করে নিত, নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীটাকে নিমিষেই সরিয়ে ফেলতে। এরপর হয়তো প্রথম অগ্রাধিকার তার হবে। সেই পাবে সকলের মনোযোগ,স্পটলাইট, সুনাম।
দূর থেকে জেসিকাকে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইচ্ছে করেই প্রাণ জেসিকাকে নিজের সান্নিধ্যে আসার জন্য ডাক দেয়। জনসম্মুখে থাকার কারণে জেসিকা নিজের মনোভাব কৃত্রিম হাসির তলে পি’ষে এগিয়ে যায় প্রাণের দিকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে প্রচন্ড খুশি হওয়ার ভাণ করে জড়িয়ে ধরে প্রাণকে, অভিনন্দন জানায়। জেসিকার এসব অভিনয় দেখে প্রাণের মন শ্লেষাত্মকে পরিপূর্ণ হয়৷
____________
“আমাকে তুমি আগে কেন জানালে আঙ্কেল আজই আমাদের সম্পর্কটা পাবলিক করতে চলেছেন? কতটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম আমি জানো? মেন্টাল কোন প্রিপারেশন ছিল না।”
নয়নের কথা শুনে প্রাণ বলে, “সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, তাই জানায়নি। বাবাকেও সেজন্যই নিষেধ করেছিলাম তোমায় জানাতে।”
নয়ন অতিষ্ঠ কন্ঠে বলে, “তুমি ইদানীং একটু বেশি সারপ্রাইজ দিচ্ছ না আমায়? কবে না জানি এভাবে করে আমার জা’নটাও নিয়ে নাও।”
“এতো সবে শুরু, সামনে আরও সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য মি. নয়ন মেহরাব। তখন কি করবে তুমি? হার্ট এট্যাক নাকি ব্রেন স্টোক? এস দ্যা কাউন্ট ডাউন হেস বিন স্টার্টড নাও।” আনমনে কথাগুলো বললেও সম্মুখে সে দৃঢ় কন্ঠে বলে, “নিতেও পারি, ভরসা নেই কোন। তবে আমি জানতাম তুমি সারপ্রাইজ পেতে পছন্দ কর, তাই তো এত আয়োজন।”
নয়ন প্রাণের সাথে কথায় জিততে না পেরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো৷ এভাবেও পরিস্থিতি এখন হাতে-নাগালের বাহিরে চলে গিয়েছে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই কোন। প্রাণ এবার নয়নের কাছ থেকে সরে এসে কারো খোঁজ করে। কিয়ৎক্ষণ পর ঈপ্সিত ব্যক্তিটিকে খুঁজে পেতেই অধর দুইদিকে প্রসারিত হয়। সে এগিয়ে যায় ব্যক্তিটির দিকে, “হ্যালো মি. কর্মকার। কেমন আছেন?”
রবিন কর্মকার পিছনে ঘুরে প্রাণকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি এক হাসি উপহার দেন। কর্মে তিনি একজন প্রোডাকশন হাউজের মালিক। বয়স তার প্রায় পঞ্চাশোর্ধের, মুখশ্রীতে বার্ধক্যের ছাঁপ দেখা দিতে শুরু করেছে। যদিও বা তার ডাক-নাম দূর দূর পর্যন্তই আছেন। বেশ চেনা মুখ তিনি এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির নিকট। রবিন নরম কন্ঠে বলেন, “লং টাইম নো সি প্রাণ। কেমন আছো তুমি? আমি কিন্তু ভগবানের ক্রিপায় বেশ ভালো আছি।”
প্রাণ হেসে বলে, “আমিও বেশ আছি। আপনি কি এখন ব্যস্ত? আমার কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।”
রবিন হেসে বলেন, “আপাতত ব্যস্ত না আমি। বল কি বলবে?”
“কথাটা পার্সোনাল তাই যদি একটু নিরিবিলি জায়গায় আসতেন,ভালো হতো।”
রবিন এবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পরক্ষণে অপ্রীতিকর এক ভাবনা তার মন-মস্তিকে খেলা করতেই গা জ্বা’লা’নো হাসি দিয়ে তিনি বলে উঠেন, “সিউর! বল কোথায় যাবে?”
“করিডরের দিকটায় চলেন তাহলে।”
কথাটা বলে প্রাণ সেদিক এগিয়ে গেল,পিছনে রবিন কু’ৎ’সি’ত হাসি হেসে পিছনে চললো৷ তিনি ইতোমধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছেন প্রাণ কেন তার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাইছে। এমন নায়িকাদের তিনি ভালো মতই চিনেন, কিছু পাওয়ার বিনিময়ে নিজেদের উৎসর্গ করতেই এই আহ্বান জানায় তারা। তবে তিনিও সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে জানেন। ক্ষমতা আছে তার হাতে, সে-টা প্রয়োগ না করে এভাবেই ছেড়ে দেওয়ার মত বো’কা নন তিনি। উপরন্তু এবার অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের অভ্যন্তরীণ বিচারক তিনি, তার পিছে নায়িকারা ছুটবে এটাই স্বাভাবিক। কয়েকদিন যেমন একজন ছুটেছিল, প্রাণও তার বিপরীত না। যদিও বা তিনি প্রাণকে এমনটা ভাবেননি তবুও নিজের স্বার্থের কথা এলে সবাই এক। নিজের এসব জল্পনা-কল্পনা মাঝে তিনি করিডরে এসে থমকালেন। প্রাণের দিক শ্রীহীন হাসি উপহার দিয়ে বললেন, “তুমি কি চাও তা আমি বেশ ভালো করেই জানি। তবে সবকিছুর একটা মূল্য আছে জানো তো?”
প্রাণের মন্থর কন্ঠে বলে, “মূল্য যদি না থাকতো তাহলে আমি আজ আপনার সামনে থাকতাম না।”
“সবই তো জানো দেখছি।”
প্রাণ স্মিত হেসে বলে, “একটু বেশিই জানি।”
রবিন লো’লু’প দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাণের নিকটে আসতে নিলে প্রাণ তৎক্ষনাৎ কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বজ্রকন্ঠে বলে, “ভুলেও আমার কাছ ঘেঁষবার সাহস দেখাবেন না।”
নিজের বাবার বয়সী লোকের কাছ থেকে এমন এক কু’ৎ’সি’ত, বি’কৃ’ত আবহ পেয়ে ক্ষো’ভে,ঘৃ’ণায় সর্বাঙ্গ জ্ব’লে উঠে প্রাণের। রূঢ় কন্ঠে বলে, “আপনাকে এখানে আমাকে নয় বরং আপনার কুকীর্তি দেখানোর জন্য ডাকা হয়েছে। তাই ভয় পেতে শিখুন মি. কর্মকার।”
রবিন ঘাবড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
প্রাণ নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে বলে, “বুঝেননি তাই না? দাঁড়ান! এখনই বুঝে যাবেন।”
কথাটা বলে প্রাণ নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে কিছু ছবি তুলে ধরে রবিনের মুখের সামনে। ছবিগুলায় স্পষ্ট তার এবং অল্প বয়সী এক নারীর আ’প’ত্তি’ক’র মুহূর্ত প্রদর্শিত হচ্ছে। রবিন কর্মকার এবার ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়ান, সারা শরীর তার মৃদু মৃদু কাঁপছে। প্রাণ তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “এই ছবিগুলা যদি কোনভাবে মিডিয়ার কাছে যায় তাহলে কি হবে বলুন তো? রাতারাতি বেশ ফেমাস হয়ে যাবেন আপনি।”
রবিনের মাথা থেকে এবার ঘাম ছুটতে শুরু করল। এই ছবিগুলো যদি একবার পাবলিশড হয় তাহলে তার সাজানো গুছানো সংসার,ক্যারিয়ার,ক্ষ্যাতি ধুলোয় মিশে যাবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি ত্রাস কন্ঠে বলেন, “ছবিগুলা তোমার কাছে কিভাবে আসলো? আর কি চাও তুমি?”
প্রাণের ভাবলেশহীন কন্ঠ, “ছবিগুলা আমার কাছে কিভাবে আসল তা বড় কথা না। তাই আপনার সে-টা না জানলেও হবে। আর আমি বেশি কিছু চাই না, শুধু চাই অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের সকল সিদ্ধান্ত যাতে নির্ভুল হয়। অসৎ পথ অনুসরণ করে কেউ যেন কোনরকম পুরস্কার না পায়। এর মানে এই না আমি আমার কথা বলছি। যে যোগ্য সেই যেন পুরস্কারটা পায়,আর কেউ না। এটাই বুঝাতে চাইছি আমি।”
রবিন মাথা নাড়িয়ে বলেন, “তাই হবে। তুমি কোন চিন্তা নিও না।”
“তাই যেন হয়। অন্যথায় পরবর্তীতে আপনার সাথে যা হবে তার দায়ভার কিন্তু একান্ত আপনার। আমাকে বলবেন না পরে।”
“নাহ! নাহ! তুমি যেমনটা বলছ ঠিক তেমনটাই হবে৷ দয়া করে ছবিগুলো কোথাও দিও না। ভগবানের দোহাই লাগে।”
“যতক্ষণ আপনি আপনার কথায় অনড় থাকবেন ততক্ষণ আপনি নিরাপদ থাকবেন। চিন্তা নেই। আর আমাদের মাঝের কথা যাতে তৃতীয় কেউ জানতে না পারে। জানলে কিন্তু..”
রবিনের সামনে নিজের ফোনটা ঘোরাতে ঘোরাতে কথাটি বলল প্রাণ। রবিন দ্রুত বলে উঠেন, “কেউ জানবে না।”
“গুড ফর ইউ!এখন আপনি আসতে পারেন।”
রবিন কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে সেই স্থান প্রস্থান করেন। রবিন যেতেই প্রাণ দৃষ্টিপাত করে তার ফোনস্ক্রিনে ভাসতে থাকা ছবিটার দিকে। ছবিতে থাকা নারীটির পাণে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। এই নারীটা তার পরিচিত। একটু বেশিই পরিচিত। সে বিরবির করে উঠে, “গেট রেডি টু লুস এভ্রিথিং।”
__________________
আকাশ ভরা নক্ষত্রের দীপ্তি যেন আজ নেমে এসেছে ভূপৃষ্ঠে। আড়ম্বরে ঘেরা পরিবেশ। কোলাহলে পরিপূর্ণ৷ সকল তারক-তারকাদের ভীড় জমেছে একই ছাদের নিচে, বছরের বেশ বাঞ্ছিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। সর্বোপরি, অ্যাওয়ার্ড ফাংশন বলে কথা। কেউ না এসে কি পারে? কে কেমন পোশাকে পড়েবে, কে কেমন নাচ-গান করবে, কে কোন অ্যাওয়ার্ড পাবে তা নিয়ে কৌতূহল,ব্যগ্রতা সকলের। প্রাণ,নয়ন,জেসিকা একই সারিতে বসে। ক্যামারাও ঘুরে ঘুরে নয়ন আর প্রাণকেই হাইলাইট করছে বার বার, নতুন যুগল বলে কথা। তাদের একটু বেশি প্রাধান্য না দিলে কি চলে? জেসিকা এসব লক্ষ্য করে ফুলে ফেঁপে উঠলেও শেষে ঈপ্সিত কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় নিজেকে অনুদ্ধত রাখে। হাসি মুখে সবটা গোগ্রাসে আহার করে নেয়। সন্ধ্যার পর পরই শুরু হয় অনুষ্ঠানটি। নাচ,গানের মাঝে পারিপার্শ্বিক অবস্থা রমরমা রাখার অবিশ্রান্ত চেষ্টা। ধীরে ধীরে সময় কাটা ঘুরতেই অভিলষিত মুহূর্তটি ধরা দেয়। আরম্ভ হয় পুরস্কার বিতরণী৷ সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বা বস্তুকে করা হতে থাকে পুরস্কৃত। এর মাঝে সেরা ছায়াছবি হিসাবে ‘নীলচে তারা’ এবং পর্দায় সেরা জুটি হিসেবে প্রাণ ও নয়নকে পুরস্কৃত করা হয়। সে সাথে নয়নকে সেরা অভিনেতা হিসাবেও পুরস্কৃত করা হয়। পালাক্রমে এবার আসে সেরা অভিনেত্রী পুরস্কারের। নমিনেশনে নাম উঠে প্রাণ,জেসিকা,লাবনী ও নুহা এর। নিজের নাম শুনতে পেয়ে জেসিকার অক্ষিকাচ জ্বলজ্বল করে উঠে। পুরস্কৃত ব্যক্তির নাম নেওয়ার পূর্বেই জেসিকা ঠিকঠাক হয়ে বসে, আকার-ভঙ্গি এমন যে মঞ্চে এখন তাকেই ডাকা হবে। আত্মবিশ্বাস ঠিক এতটা প্রবল। প্রাণ আড়চোখে একবার জেসিকার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। নির্লিপ্ত তার দেহভঙ্গি। অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী এবার বলে উঠে, “চলচ্চিত্র সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার-২০২০ হচ্ছে……”
#চলবে
[১-বিঃদ্রঃ পোস্ট রেস্ট্রিকশনের কারণে কাল গল্পটি পোস্ট করতে পারিনি। বিলম্বের জন্য এবার আমার দোষ ছিল না। ☹️
২- গঠনমূলক মন্তব্য একেবারেই পাচ্ছি না। সকলের কাছে অনুরোধ একটু রেসপন্স করার। ভালোবাসা অসীমান্ত❤️]
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৩
“চলচ্চিত্র সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার-২০২০ হচ্ছে নুসাইবা আরা প্রাণ। অভিনন্দন জানাই তাকে।”
জেসিকা দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুতিই নিচ্ছিল কিন্তু প্রাণের নাম শুনে সে অবিচল হয়ে গেল। আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকিয়ে থাকলো মঞ্চের দিকে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। পা থেকে জমিন সরে যাচ্ছে মন্থরগতিতে। সেরা অভিনেত্রী হিসাবে আজ তার নাম গুঞ্জিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে প্রাণের নাম আসে কিভাবে? তার মানে কি সে প্র’তা’রি’ত হয়েছে? পুনরায় তাকে ছাপিয়ে প্রাণই সেরার খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছে? এদিকে প্রাণ নিজের নাম শুনে স্থিরচিত্তে তাকিয়ে রইলো শুধু। সম্পূর্ণ বিষয়টা তার প্রত্যাশার বাহিরে হলেও বিস্ময় জিনিসটা তখনও তার মধ্যে লক্ষ্য করা দুরূহ৷ চারপাশ থেকে করতালির আওয়াজ কম্পন তুলছে, চিয়ার আপ করছে প্রাণকে। সামীপ্য থেকে নয়ন প্রাণকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছে, এমন এক ভাব প্রাণের অর্জনে তার চেয়ে খুশি আর কেউ নেই। প্রাণের সান্নিধ্য থেকে সড়ে আসার পূর্বে সে জেসিকার হাতে চিমটি কেটে তার অভিনিবেশ নিজের দিকে এনে চোখে ইশারায় কিছু একটা বুঝাতে জেসিকা নিজের মুখভঙ্গি বদলে জড়িয়ে ধরলো প্রাণকে। ক্যামেরার সামনে দেখালো প্রাণের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী সে। এর মাঝে মঞ্চে আবার বলে উঠলো, “প্রাণ আপনাকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।”
প্রাণ এবার উঠে দাঁড়ালো, নম্র পায়ে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে, উপরে উঠে প্রাণ নিজের পুরস্কার গ্রহণ করতেই অনুষ্ঠান পরিচালক তাকে প্রশ্ন করে উঠে, “পর পর তিনটে পুরস্কার জিতে নিলেন আজ আপনি৷ নিজের অনুভূতিটা যদি একটু দর্শকদের জানাতেন।”
মাইকটা প্রাণের হাতে দেওয়া সত্ত্বেও প্রাণ কিছুটা সময় নীরব থাকলো। অতঃপর বলল, “জনপ্রিয় বস্তুটা আমি কখনো অর্জন করতে চায়নি, সাধারণ কেউ হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কখন মোড় ঘুরে গেল আর আমি এই পর্যায়ে এসে পৌঁছালাম সত্যি আমার জানা নেই। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ঠাসা আমার জীবন, তাই বলার মত তেমন কিছুও নেই। শুধু এতটুকু বলতে চাই…”
কথাটুকু বলে প্রাণ থেমে জেসিকার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে উঠে, “নীরবে নিজের কাজ করে যান, সাফল্যকেই নাহয় গুঞ্জন তুলতে দিন। ধন্যবাদ!”
কথাটা বলে প্রাণ নেমে এসে নিজের নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসে। জেসিকা পাশেই মুখ খিঁ’চে বসে আছে। প্রাণ তা দেখে ক্ষীণ হাসে।
____________
শয়নকক্ষের হু’ল’স্থু’ল অবস্থা৷ বালিশ-বিছানা, জিনিসপত্র সব হামাগুড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। দূরেই মুঠোফোনটি চূ’র্ণ’বি’চূ’র্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সোফায় বসে জেসিকা সেদিকই তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পূর্বেই সে রবিন কর্মকারকে ফোন করেছিল আজকে ঘটনার শোধন চাইতে। অহেতুক চিল্লাপাল্লা করতেই রবিন তাকে মুখের উপর কথা শুনিয়ে দিয়েছেন, জেসিকার কোন যোগ্যতা নেই এসব পুরস্কার পাওয়ার। সে শুধুমাত্র বিনোদনের খড়ক, এ ব্যতীত তার কোন ভূমিকা নেই। এখানে যে যোগ্য সেই পুরস্কার পেয়েছে। আর জেসিকা যা করেছে তা স্বেচ্ছায় তাই যদি সে তার উপর কাঁদা ছুড়তে আসে তাহলে তাকে ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া হতে হবে।
সব শোনার পর জেসিকা নিজের ফোনটি দেয়ালে ছুঁড়ে মারে। উ’ন্মা’দে’র ন্যায় আচরণ করতে থাকে। যার পরিণাম স্বরূপ কক্ষের এই করুণ অবস্থা। নিজের অবস্থা যে বেশ ভালো তাও না, মুখের সাঁজ উঠে গিয়ে বি’ভ’ৎ’স দেখাচ্ছে, আঁখিপল্লবের নিচে কাজল লেপ্টে আছে কদাকার, লক্ষ টাকার জামা টান লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে, হাতে-পায়ে আঁচড়ের দাগ। মাঝে মধ্যেই বিরবরিয়ে উঠছে সে। কিয়ৎক্ষণ এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর নয়নের ডাক শোনা যায়, “এই কি অবস্থা করেছ রুমের?”
নয়নের কথায় জেসিকা প্রত্যুত্তর তো দূরের কথা দৃষ্টি তুলে তাকাবারও প্রয়োজনবোধ করলো না। নত অবস্থায় বসে রইলো। নয়ন সামনে এগিয়ে এসে জেসিকার মুখ বরাবর হাটু গেড়ে বসলো। তার গালে নিজের হাত গলিয়ে বলে, “কেন এমন পাগলামি করছো? এটা সামান্য একটা পুরস্কার।”
জেসিকা এবার মাথা তুলে তাকায়। গগনবিদারী স্বরে বলে উঠে, “সামান্য পুরস্কার? এটা তোমার কাছে সামান্য পুরস্কার? ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আমার কাছ থেকে সকল কিছু প্রাণ ছিনিয়ে আসছে। যে-টার যোগ্য আমি সে-টা ও পেয়ে আসছে, সব জায়গায় প্রাধান্যও ওই পাচ্ছে। কেন? শুধুমাত্র সে নিহাল শিকদারের মেয়ে বলে? আর আমি? আমি কিছু না? সকল অন্যায়,বৈষম্য কেন আমাকে নিতে হচ্ছে? নিজের স্বার্থের জন্য প্রাণও আমাকে সবসময় তার থেকে নিচু পর্যায়ে রেখেছে, উপরে উঠতে দেয়নি। মানুষ হিসাবে ক’ল’ঙ্ক ও। ক’ল’ঙ্ক!”
নয়ন জেসিকাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে শান্ত করার চেষ্টা করে। জেসিকা তবুও বলে চলে, “ও আজ তোমাকেও আমার থেকে কেঁ’ড়ে নিল নয়ন। একবারে নিঃস্ব করে দিল। প্রাণকে আমি ছাড়বো না, কখনো না। আমার থেকে সব কেঁ’ড়ে নেওয়ার মাশুল ওকে দিতেই হবে৷ ব’র’বা’দ করে দিব আমি ওকে, জা’নেই মেরে ফেলব আমি।”
নয়ন সান্ত্বনা দিতে বলে, “তোমার কাছ থেকে আমায় কেউ কেঁ’ড়ে নেয়নি। আমি শুধু তোমারই এবং তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি জানোই প্রাণের সাথে আছি আমি নিজের স্বার্থের জন্য, যেদিন আমার স্বার্থ পূরণ হয়ে যাবে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিব আমি ওকে।”
“কিন্তু তবুও তোমার স্ত্রীর স্বীকৃতি তো সেই পাবে। আমার পরিচয় তখন কি হবে? সকলে থার্ড পার্সন আমাকেই বলবে।”
নয়ন ভেবে বলে, “কেউ কিছু বলবে না। আর দরকার পড়লে প্রাণকে বিয়ে করার আগে আমি তোমাকে বিয়ে করে নিব কিন্তু তবুও তোমায় কষ্ট পেতে দিব না। তুমি শান্ত হও।”
জেসিকা যেন এটা শোনার অপেক্ষায় ছিল৷ শেষ পেয়াদা তার হাতের মুঠোয়, এখন প্রাণের স’র্ব’না’শ কে ঠেকাবে? হাসির রেখা ফুটে তার অধরের কার্নিশে। নয়নকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আই লাভ ইউ নয়ন। আই লাভ ইউ আ লট। কখনো ছেড়ে যেও না আমায় প্লিজ।”
নয়ন আশ্বস্ত কন্ঠে বলে, “কখনো না!”
_____________
আঁধারে নিস্তব্ধ শহর, আধভাঙ্গা চাঁদের উঁকি দিচ্ছে মাথার উপর অজস্র তারার ভিড়ে, কোলাহলে পূর্ণ নগরী নিষুপ্তিচ্ছন্ন। ফাঁকা রাস্তা-ঘাটে নিয়ন বাতির আদুরে আলো উপচে পড়ছে। কোন এক ব্রিজের উপর গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে গাড়ির সামনের দিকে পা তুলে বসে আছে প্রাণ। ভারী পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরিধানে, কৃত্রিম প্রসাধনীর ছিঁটেফোঁটাও নেই মুখে। বৈচিত্র্যহীন এই বেশভূষায় কাছের মানুষ ব্যতীত প্রাণকে চিহ্নিত করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। অনস্ক্রিন কপটতায় আচ্ছাদিত রমণী এই সময়টায় বদলে যায় নিমিষেই। মিল খুঁজে পাওয়া অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তখন। উপরন্তু, এই আঁধারে সময় তাকে লক্ষ্য করার মত সময় কারই আছে?
প্রাণ পিছনে দুই হাত নিয়ে ভর দিয়ে বসে আছে। উপভোগ করছে রাতের শহর। নির্ভয়ে,নিশ্চিন্তে৷ নিচেই খেলা করে যাচ্ছে নদীর স্রোত,তার মধুময় ধ্বনি বাতাসে ভাসছে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বে’ও’য়া’রি’শ জন্তুর হাঁক। মনোমুগ্ধকর এই নিস্পন্দিত পরিবেশে হঠাৎ কোন এক মানবের রাশভারী কন্ঠ বিঘ্ন ঘটায়, “আপনি এই রাত-বিরেতে এখানে কি করছেন মিস. ল্যাভেন্ডার?”
প্রাণ হকচকিয়ে না উঠে নির্ভীক দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকায়। ছন্দকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলে, “আপনি যা করছেন তাই।”
ছন্দের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে তো বাসায় যাচ্ছিল, ব্রিজের ধারে প্রাণকে দেখেই গাড়ি থামায় সে। এত রাতে কোলাহলবিহীন পরিবেশ একা বসে থাকতে দেখে কোন বিপদ হলো নাকি অন্যকিছু, জানার কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। তাই এগিয়ে আসে খোঁজ নিতে। তাহলে প্রাণের কথার অর্থ কি দাঁড়ায়? ছন্দ তাই প্রশ্ন করে, “আপনি আদৌ জানেন আমি কি করছি এখানে?”
প্রাণ ভাবান্তরহীন কন্ঠে উত্তর দেয়, “করছেন হয়তো কিছু। অকারণে নিশ্চয়ই এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন না।”
ছন্দ নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে শুধু। সে বার বার ভুলে যায়, সে আসলে কার সাথে কথা বলছে। প্রাণের থেকে সহজ-সরল উত্তরের আশা রাখাই জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি। ছন্দ বলে, “জনমানবহীন রাস্তায় একা বসে আছেন, যদি এখন কোন বিপদ নেমে আসে?”
“পাশে তো এখন আপনি আছেন, তাহলে বিপদটা কি আপনাকে ধরে নিব?”
ছন্দ বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে দেখতে কি বিপদজনক মনে হয় আপনার?”
প্রাণ ছন্দের দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরোক্ষ করে নিয়ে বলে, “চেহেরায় শুদ্ধতা আছে তবে অন্তরে বিশুদ্ধতা আছে কি-না কে জানে?”
ছন্দ এবার হাল ছেড়ে বলে, “আপনার সাথে কথায় পেড়ে উঠা অসম্ভব৷”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করে না। দৃষ্টি ঘুরায় দূর আকাশের পাণে। বাতাসে উড়তে থাকে তার মুক্ত চুল, এলোমেলো হয়ে গেলেও সামলে নেওয়ার কোন তাড়া নেই। চোখে মলিনতার ছড়াছড়ি, মসৃণ গালে ম্লান রেখা। ছন্দ প্রাণের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বিরল বস্তুর দিকে হাত বাড়াতে নেই তা সে ভালো করেই জানে। নিউজ দেখেছে সে, প্রাণ আর নয়নের এনগেজমেন্টের নিউজ আ’গু’নের ন্যায় ছড়িয়ে আছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। নজরে না পড়ার উপায় নেই কোন। ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আপনার এনগেজমেন্টের খবর শুনলাম, কংগ্রাচুলেশন!”
প্রাণ দুর্বোধ্য হাসে। ছন্দ জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি বাস্তবে সর্বদাই এমন নির্জীব,নিষ্প্রাণ থাকেন?”
প্রাণ ছন্দের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করে, “আমাকে নিয়ে আপনার কৌতূহল একটু বেশি না?”
ছন্দ নিঃশব্দে হেসে উঠে বলে, “তাই বোধহয়। এই কৌতূহলের চক্করে খুব বাজেভাবে ফেঁ’সে গিয়েছি এবার।”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই প্রাণ ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে ছন্দের দিকে তাকায়, “মানে?”
ছন্দ কথা ঘুরানোর জন্য নিজের হাত ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে বলে, “রাত দুটোর বেশি বাজে, জায়গাটা কিন্তু এখন একদমই নিরাপদ না। বাসায় যান।”
প্রাণ কিয়ৎক্ষণ অপলক নয়নে ছন্দের দিকে তাকিয়ে থেকে নেমে পড়ল। গাড়িতে উঠে বসার পূর্বে ছন্দের দিক তাকিয়ে বলল, “আসি! ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।”
কথাটা বলে প্রাণ গাড়িতে উঠে চলে গেল৷ ছন্দ সেদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে প্রাণের শেষ বাক্য গুলো আওড়ে বলল, “আদৌ কি আর দেখা হবে?”
______________
মাঝ দিয়ে কেটে যায় কয়েকদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখনও প্রাণ ও নয়নকে নিয়ে হাজারো নিউজ,গোসিপ। নেটিজেনরা নয়ন ও প্রাণের যুগলবন্দী হওয়ায় বেশ খুশি। শুভকামনায় ভরে যাচ্ছে দুইজনের কমেন্ট বক্স। হট টপিক হয়ে উঠেছে তারা, সে সাথে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে আকাশ ছোঁয়া। সব নিউজ দেখে প্রাণের মধ্যে প্রসন্নভাবটা লক্ষ্য করা গেল। বুঝতে আর বাকি রইলো না সে এমনটাই চাইছিল। সে চাইছে আর কয়েকদিন এমনভাবেই সবটা চলতে দিতে, এরপর সে চলবে তার পরবর্তী দান।
সন্ধ্যায় নিজের শুট শেষ করে বের হতেই জেসিকার মেসেজ নোটিফিকেশন বারে দেখতে পায় প্রাণ। তাকে কোন এক জরুরি বার্তা জানাতে **** হোটেলে ডিনারের জন্য ডেকেছে তাকে। প্রাণ কিয়ৎক্ষণ ভেবে জেসিকাকে ‘হ্যাঁ’ বলে চৈতিকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জেসিকার বলার ঠিকানার দিকে।
.
হোটেলে এসে প্রাণ হাজির হতেই জেসিকা ও নয়নকে একত্রে দেখতে পায় সে। প্রাণ ভ্রুযুগল এক করে সামনে এগুতেই জেসিকা নিজের আসন ছেড়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে। নয়নও উঠে দাঁড়িয়ে একগুচ্ছ গোলাপ এগিয়ে দেয় তার দিকে। প্রাণ সেটা গ্রহণ করতেই নয়ন তার জন্য চেয়ার টেনে দেয়। সে স্মিত হেসে নিজের আসনে বসতেই নয়ন ও জেসিকাও তার মুখোমুখি হয়ে বসে৷ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার পূর্বেই একজন ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে দিয়ে যায়। প্রাণের বুঝতে দেরি নেই, তারা আগেই অর্ডার করে রেখেছিল। তবে হঠাৎ এমন আপ্যায়নের মানে খুঁজে পেল না প্রাণ। কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত থাকার পর নয়নকে সে জিজ্ঞেস করে এসবের মানে কি? তখন নয়ন বলে, “তোমার সাকসেসের উপলক্ষে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তাই জেসিকাকে বলে তোমাকে এভাবে আনি। তোমার তো আবার সোরগোল পছন্দ না তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বড় করে কিছু করতে পারলাম না৷ তা পছন্দ হয়নি তোমার?”
প্রাণের বিষয়টা হজম না হলেও কিছু বলল না। ম্লানমুখে জানালো সবটাই তার ভালো লেগেছে। নয়ন এবার কথা না বাড়িয়ে প্রাণের প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিজের প্লেটেও খাবার তুলে নেয়। এরপর কথায় মশগুল হয়,তার সাথে জেসিকাও তাল মিলায়। প্রাণ দুইজনের কথা নীরব দর্শকের ন্যায় শুনতে থাকে আর খেতে থাকে। খাওয়া যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন হুট করেই প্রাণের মাথা ঘুরে উঠে। তীব্র ব্য’থায় মাথা চেপে ধরে বসে সে। সময় খানিক গড়িয়ে যেতেই নয়নযুগল ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করে তার। কর্ণকুহরে বাজতে থাকে নয়ন আর জেসিকার উৎকন্ঠিত কন্ঠ। কি হয়েছে তার জিজ্ঞেস করছে তারা। খুব কষ্টে মাথা তুলে একবার দুইজনের দিক তাকায় অতঃপর কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই মূর্ছা যায় সে। হেলে পড়ে নিচের দিকে।
#চলবে
[সকলে কষ্ট করে একটু রেসপন্স করবেন।]
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]