#প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-০৫

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-০৫

নিশুতিরাতের নিস্তব্ধতা হ্রাস করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কারো গগনবিদারী কন্ঠ। দুইজন নর-নারীর মধ্যে চলছে তুমুল ত’র্কা’ত’র্কি। মাঝে-সাঝে শোনা যাচ্ছে জিনিসপত্র ভা’ঙ্গা’র বি’ক’ট শব্দ। নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে জেসিকা হাতের ফোনটা সজোরে মেঝেতে আ’ছা’ড় মেরে বসে৷ উ’গ্রকন্ঠে বলে উঠে, “আমাকে বলে যাওনি কেন তুমি প্রাণের সাথে বাহিরে যাচ্ছ? কেন বলনি আমায়? ওর সাথে তোমার এত কি?”

নয়ন একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে, “এখানে বলে যাওয়ার কি আছে? সি ইজ মাই ফিয়ান্সে, ওর সাথে আমি ডিনারে যেতেই পারি। এতে ওভাররিয়্যাক্ট মানে বুঝছি না আমি?”

জেসিকা এবার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সে নয়নের কাছে এসে ওর কলার চে’পে ধরে চিৎকার করে বলে উঠে, “ও তোমার ফিয়ান্সে হলে আমি কি? হ্যাঁ? আমি কি? আমি কিচ্ছু না? ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ডাবলক্রস মি নয়ন মেহরাব। নাইলে কিন্তু জ্বা’লি’য়ে সব ছা’ড়খা’ড় করে দিব আমি।”

নয়ন নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, “ছাড়ো আমাকে। অযথা ওভাররিয়্যাক্ট করছো তুমি। তুমি ভালো করেই জানো প্রাণকে আমার না চাইলেও সময় দিতে হবে, ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে,ভালো ব্যবহার করতে হবে,কাছে কাছে থাকতে হবে। সময় হলে বিয়েও করতে হবে। সব জানার পরও তোমার এসব পাগলামির কোন মানে হয় না। এমন চলতে থাকলে কিন্তু আমি তোমায় ছাড়তে বাধ্য হব।”

জেসিকা এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে। বুঝে, রাগ দেখিয়ে কিছু হবে না, নয়নকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে হলে তাকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের করতে হবে। হঠাৎ জেসিকা নয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ন্যাকাকান্না জুড়ে দিয়ে বলে, “আমি জানি সব কিন্তু আমি কি করবো বল? আমার সহ্য হয় না তোমাকে ওর পাশে। ভালো লাগে না তুমি যখন ওর সাথে সময় কাটাও,ঘুরতে যাও। ইনসিকিউরড ফিল হয়, হারিয়ে ফেলার ভয় ঝেঁকে ধরে আমায়। তুমি ভাবতেও পারবে না তোমাকে কতটা ভালোবাসি নয়ন, অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”

জেসিকার কথায় নয়নের মন এবার একটু নরম হয়। সে নিজের বাহুদ্বয়ে জেসিকাকে আবদ্ধ করে বলে, “আমি জানি কিন্তু প্রতিবার এমন রিয়্যাক্ট করলে তো চলে না। কিছু জিনিসে তোমায় ছাড় দিতেই হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে আমার প্রতি। আমি তো বলেছিই, আমি এখন আর প্রাণের প্রতি ইন্টেরেস্টড নই। যাব না আমি কখনো ওর কাছে। আমি তোমারই, আর কারো না।”

জেসিকা মুচকি হেসে বলে উঠে, “আই লাভ ইউ নয়ন। আই লাভ ইউ আ লট। প্লিজ আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। আই নিড ইউ বিসাইড মি। আই রিয়েলি নিড ইউ।”

______

আবহাওয়া আজ হুট করে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আকাশ ভর্তি মেঘ জমেছে, সূর্যের নেই কোন দেখা। প্রবল বাতাসে দোলায়মান র’ক্ত’ঝরা কৃষ্ণচূড়া,ঝিরঝির করে ঝড়ে পড়ছে পিচঢালা রাস্তার উপর। তার উপর দিয়েই হনহনিয়ে চলেছে যানবাহনেরা, পিষিয়ে যাচ্ছে বিশ্রিভাবে। কৃষ্ণচূড়ারা তা দেখে যেন ভয়ে শিউরে উঠলো, নিজের বেগ পাল্টিয়ে উড়ে চলে এলো খোলা অলিন্দে। প্রাণ তা দেখে স্বল্প পরিসরে হাসলো, ফুল-পাপড়ি গুলো কুড়িয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে খেলা করল। ক্ষানিক বাদে ফুলগুলো হাতের তালুতে নিয়ে ফু দিয়ে উড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের পাণে। প্রাণ তাকিয়ে থাকে ধূসর নীরদের মাঝে ভাসমান ঈষৎ র’ক্তি’ম কৃষ্ণচূড়ার পাণে। আচমকাই বাতাসের বেগ বাড়ে, গগনবিদারী শব্দে কেঁপে উঠে প্রকৃতি। আমন্ত্রণবিহীন নেমে আসে এক পশলা বৃষ্টি, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই সিক্ততার চাদরে মুড়িয়ে দিয়ে যায় প্রাণের সর্বাঙ্গ। আকস্মিক এমন আ’ক্র’ম’ণে ভড়কে উঠে প্রাণ,দ্রুত পায়ে বারান্দা হতে সরে আসে। একপলক নিজের দিক তাকিয়ে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকিয়ে ফেলে। বৃষ্টি তার কখনোই পছন্দের নয়, বলা যায় দুই চোখের সুচ। ছোট থেকেই বৃষ্টির আরেক নাম বিরক্তি তার নিকট। একদম সহ্য হয় না বৃষ্টি তার। এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার, বৃষ্টি আসবে জেনেও কেন যে বারান্দায় গেল। বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে রুমের ভিতর চলে আসে সে। ঠিক তখনই আশা বেগম রুমে এসে প্রাণকে ভেজা অবস্থা দেখে বেশ চমকে গেলেন। বিস্ময়কর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলেন, “কি রে হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজলি যে? তোর তো বৃষ্টি একদম পছন্দ না, তাহলে?”

প্রাণ অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “কথা বল না তো। ভালো লাগছে না।”

কথাটা বলে গটগট করে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল সে। আশা বেগম প্রাণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকলেন, চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ।

____

বিছানায় আধশোয়া বসে আছে প্রাণ। একহাতে গ্রিন টি নিয়ে তাতে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে আর অন্যহাতে ফেসবুক স্ক্রোল করে চলেছে। হঠাৎ ‘স্টার গল্প’ পেজে তাকে এবং নয়নকে নিয়ে বানানো একটা ইনফরমেশন ভিডিও দেখে থমকায় প্রাণ, কৌতূহল নিয়ে ক্লিক করে ভিডিওটিতে৷ ভিডিওটার মূল বক্তব্য এরূপ যে,” গোপন সূত্রে জানা যায় যে, ‘নুসাইবা আরা প্রাণ’ গতরাত যেই রেস্টুরেন্টে বসে থাকা ছবিগুলো পোস্ট করেছিলেন, সেই রেস্টুরেন্টে সেসময় সুপারস্টার ‘নয়ন মেহরাব’ ও উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে গুজব ছড়িয়েই আছে তারা দুইজন গোপনে একে অপরকে ডেট করে চলেছে সেহেতু সন্দেহ করাই যায় যে, প্রাণ এবং নয়ন একসাথেই সেখানে ডিনারে গিয়েছিলেন এবং প্রাণের পিকগুলো নয়নই তুলে গিয়েছিলেন। আশা করা হচ্ছে, ঢালিউড ইন্ড্রাস্টি থেকে খুব শীঘ্রই নতুন এক যুগলবন্দী উৎপত্তি হতে চলেছে।”

নিউজটুকু দেখে প্রাণের মধ্যে কোনরকম হেলদোল দেখা গেল না৷ আগের ন্যায় স্থির হয়েই বসে রইলো সে। অভিব্যক্তি এমন যে, সে যেন জানতোই এমন কোন নিউজ আসবেই। প্রাণ এবার ভিডিও এর নিচে কমেন্টবক্স চেক করতে থাকে। অতঃপর গতকাল পোস্ট করা নিজের ছবির নিচে কমেন্টগুলো দেখে নেয় একবার। মুহূর্তেই অধরের কোণ জুড়ে ফুটে উঠে এক বিস্তৃত হাসি। নয়ন যে গতকাল সেই রেস্টুরেন্টে ছিল সেই ইনফরমেশন ছ’দ্ম’বে’শী নাম দিয়ে প্রাণ নিজেই রিপোর্টারদের নিকট পৌঁছে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য নয়ন আর তাকে নিয়ে কন্ট্রোভার্সি তৈরি করা। আর হচ্ছেও তাই। সকল জায়গায় নয়ন ও তাকে নিয়ে নেটিজেনদের অজস্র মন্তব্যের ছড়াছড়ি, হাজার হাজার প্রশ্ন। প্রাণ শান্তিমত চা-টুকু শেষ করে সাইড টেবিলে রেখে পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল সে। স্মৃতিচারণে পিছিয়ে গেল কয়েক বছর আগে,নয়নের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর ঘটনায়। ঘটনা সব একেক করে মনে পড়তেই সে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,

“I was nineteen in a white dress
When you told me I’m your princess
So I played right in to your fantasy
Was your good girl, so I’d sit tight
And if I don’t speak, then we can’t fight
Looked in the mirror, now I can’t believe
I forgot I was a bad b*tch, tragic
Breaking all the rules ’cause they were only habits
Cinderella’s d’e’a’d now, casket
You thought the shoe fit but…

I forgot I was a bad b*tch..”

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে প্রাণ নীরব হয়ে যায়। আঁখিপল্লব খুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সেদিক, আশা বেগমকে প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠে, “কিছু বলবে?”

আশা বেগম প্রাণের পায়ের কাছে বসে বলেন, “পায়ের অবস্থা কেমন তোর? ঘা শুকিয়েছে নাকি? কাঁ’টা পা নিয়ে এত দৌড়াদৌড়ি কিভাবে করিস বল তো?”

কথাটা বলে প্রাণের ডান পা কোলে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন আশা বেগম। প্রাণ হেসে বলে, “এভাবেই!”

আশা বেগম কিছু বলেন না, ভালোমত ক্ষ’তস্থানটা দেখে নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। মোটামুটি শুকিয়ে গিয়েছে ক্ষ’তটা। মেয়েটার শরীরে ঘা,ঘ’ত বেশিদিন টিকে না দ্রুত শুকিয়ে যায় বলেই রক্ষা, নাহলে কত যে ভুগতে হতো মেয়েটাকে তাই ভেবে পান না আশা বেগম। তিনি এবার দৃষ্টি উঠিয়ে প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলেন, “নিচে শিলা এসেছে সাথে তোমার নিউ এসিস্ট্যান্টও। দেখা করে আসো যাও।”

প্রাণ মাথা নাড়িয়ে বলে, “হুম যাচ্ছি।”

_______

“আমাকে এভাবে হুট করে বের করার মানে কি ম্যাডাম? আমার দোষটা কোথায় বলুন?”

শিলার ব্য’থা’তুর কন্ঠ শুনে প্রাণ চোখ তুলে তাকায়। ভাবান্তরহীন কন্ঠে বলে, “কোন দোষ নেই, তবে আমার তোমার কাজ আর ভালো লাগছে না। আশা করি এর উপরে তোমার বলার কিছুই নেই।”

শিলা আ’শা’হ’ত দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের দিকে। প্রাণ টেবিলের উপর শিলার ফোন আর একটা খাম রেখে বলে, “খামে তোমার আগের মাসের এবং আগাম দুই মাসের বেতন আছে, নিয়ে যাও। আর তোমার ফোনটা আমি ভার্জিনিয়া থেকে মোবাইলটা আমার সাথে নিয়ে আসার জন্য দুঃখিত। এগুলা নিয়ে যেও আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে ওকে ভালোমতসকল কাজ বুঝিয়ে যাবে।”

শেষের কথাটা অপরপ্রান্তে নিশ্চুপ বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল প্রাণ। সাথে সাথে মেয়েটা শীতল দৃষ্টিতে তাকালো শিলার দিকে। শিলা তার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে প্রাণের দিকে তাকালো। প্রাণ তখন তাকে একপলক ভালোমত দেখে নিল। শ্যামবর্ণ গায়ে তার হালকা হলুদ চুড়িদার, চুলগুলো ক্লিপের সাহায্যে খোঁপায় আঁটা, অধর জুড়ে কিঞ্চিৎ হাসি,চোখে সিলভার ফ্রেমের গোল চশমা। চেহেরায় বোকা বোকা ভাব বিদ্যমান, তবে প্রকৃতিরূপে বোকা নয় তা তার আকার-ভঙ্গিমা, আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় বেশ বুঝা যাচ্ছে। শিলা একপলক তার দিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাণকে কিছু বলতে চাইলো তবে প্রাণের তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখে মুখ খোলার সাহস পেল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। প্রাণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম যেন কি বলেছিলে?”

“চৈতি! ইনসিয়া রহমান চৈতি ম্যাম।” সাবলীল ভাষায় উত্তর দিল চৈতি।

“আচ্ছা চৈতি, তুমি ওর থেকে কাজটা বুঝে নিও কেমন? আর কোনপ্রকার সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আজকেই যেন সব কাজ শেষ হয়ে যায়, কাল থেকে তোমাকে জয়েন করতে হবে। তাই কোন ভুল যাতে না হয় সেই খেয়াল রাখবে। ভুল করা আমি একদম পছন্দ করি না।”

চৈতি মাথা নাড়িয়ে বলে, “জি ম্যাম।”

প্রাণ আশা বেগমকে ওদের আপ্যায়ন করতে বলে সেখানে আর দাঁড়ায় না, চলে আসে রুমে। এখনো কিছু জরুরি কাজ পড়ে আছে তার।

_____

প্রাণ কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু একটা করছিল এমন সময় তার ফোন বেজে উঠে। ধ্যান ভ’ঙ্গ হয় তার। ফোন হাতে নিতেই ফ্রন্টস্ক্রিনে নয়নের নাম ভেসে উঠে। সে মৃদু হেসে কল রিসিভ করতে অপরপাশ থেকে নয়ন উদগ্রীব কন্ঠে বলে উঠে, “শুনলাম তুমি শিলাকে বের করে দিয়েছ?কিন্তু কেন? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে কি প্রাণ?”

#চলবে

[রি-চেক করা হয়নি। তাই পর্বটা কিছুটা খাপছাড়া লাগতে পারে। সময়-সুযোগ পেলে সংশোধন করে নিব আমি।]

[কপি করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here