প্রতিহিংসার_অনুরক্তি-৮

#প্রতিহিংসার_অনুরক্তি-৮
লেখিকা: সালসাবিল সারা

জোহানের স্তব্ধ দৃষ্টি সংজ্ঞাহীন নূরের পানে।সবেমাত্র ডাক্তার সাহেব নূরকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,”চিন্তার কিছু নেই;নূর বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে।”
নূরকে আরাম করতে দিয়ে পরিবারের সবাই নূরের রুম ত্যাগ করলো।নূরের এমন অবস্থার জন্যে জোহানের বাবা জোহানের সাথে পুনরায় অভিমানে সিক্ত হলেন।তবে,এইবার আনোয়ারা এবং জোহান দুইজনই জোহানের বাবাকে আশ্বাস দিয়েছে,নূরের সাথে সামনে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে।কিন্তু,এতেও জোহানের বাবা সন্তুষ্ট নন।উনি বারংবার জোহানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন।রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে জোহান দেরী না করেই নূরের সন্নিকটে চলে গেলো।নূরের মুখমন্ডল এবং নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ফ্যান চলছে,তাও নূরের মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত হয়ে আছে।নিজের পকেট থেকে টিস্যু নিয়ে, টিস্যু সমেত নূরের মুখ থেকে সেই ঘাম মুছে দিতে লাগলো জোহান খুবই ধীর গতিতে।অক্ষিজোড়া বন্ধ থাকলেও নূরের চোখের উপরিভাগ থেকেই চোখের মণির নড়াচড়া স্পষ্ট বুঝতে পারছে জোহান।জোহানের ধারণা নূর এখন কোনো স্বপ্ন দেখছে।জোহানের অধর প্রশস্থ হলো।নূরের কপালে ধীরে ঠোঁট বুলিয়ে যেই ঠিকভাবে বসতে যাবে,
অমনি দেখলো নূর ধপ করে নিজের ডাগর ডাগর নয়ন মেলে জোহানের দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো।জোহান যেনো বোকা বনে গেলো নূরের এমন চাহনীতে।
–“আমাকে তুমি চুমু দিয়েছো?”
নূরের প্রশ্নে জোহান অবাক হলেও নূরকে বিভ্রান্তিতে ফেলানোর জন্য জোহান ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
–“আমাকে পাগলে পেয়েছে?তোকে আমি চুমু দিবো?হাহাহা,জোহানের স্পর্শ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।এমন সৌভাগ্য তোর নেই।তোর কপালে তোর হবু বর নিজের কালো ঠোঁট ছুঁয়ে মাত্রই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।”
নূরের গা গুলিয়ে এলো অন্য লোকের কথা শুনতেই।নূরের মস্তিষ্কে কিছু না এলেও সে নিজের কপালে হাত রেখে জোরে ঘষা দিয়ে বলে উঠলো,
–“না থাকবে আমার কপালের চামড়া আর না থাকবে ঐ লোকের স্পর্শ। কার অনুমতি নিয়ে তোমরা আমার ঘরে অন্য পুরুষকে আসার নির্দেশনা দিয়েছো!”
জোহান নূরের হাত চেপে ধরলো।ইতিমধ্যে নূরের কপালে হালকা লাল দাগ পড়ে গিয়েছে। জোহান না থামালে আজ সত্যিই বুঝি নূর নিজের কপালের চামড়া উঠিয়ে নিতো!
–“এইসব করে লাভ নেই।এই ঠোঁটের ছোঁয়া মোছা তোর জন্যে অসম্ভব ব্যাপার।কাজেই তুই এইসব মেনে নে।”
জোহানের কথায় নূর জোহানের হাত ঝাটকি দিয়ে সরিয়ে নিজে উঠে বসলো।মাথায় এখনো চাপ অনুভব করছে সে।জোহান ধীরে জপলো,
–“আরে আস্তে।”
–“শাফকাত জোহান,আপনি এইবার আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
নূরের ভাঙা কণ্ঠে বলা কথায় জোহানের অস্থির লাগা শুরু করলো।নূরকে দেখতে এখন তার কাছে চোখ ধাঁধানো লাগছে।তার উপর নূরের এমন আবেগী কণ্ঠস্বর জোহানের মনে নূরের জন্যে বরাদ্ধ ভালোবাসা যেনো বুক চিড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।নূরের মুখমন্ডল শক্ত করে চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো জোহান। এতে আর নূরের বকবক করা হলো না।জোহানের চোখজোড়া নূরের কাছে নেশাপুরীর রাজ্য মনে হচ্ছে।যেনো জোহানের চোখে শুধু নূরকে পাওয়ায় নেশা!
–“আমাকে তোর জীবন থেকে সরানোর ক্ষমতা কারো নেই। স্বয়ং তোরই নেই।”
নিজের মুখ নূরের মুখের সম্মুখে নিয়ে কথাটা বললো জোহান।বিরাট ভুল করার পূর্বে সামলে নিয়েছে জোহান নিজেকে।নূর এমতবস্থায় চিল্লিয়ে তার মাকে ডাকলো,
–“মা!”
নূরের মা এক মিনিটের মাথায় রুমে এসে হাজির।সাথে আনোয়ারা এসেছে।
–“ঠিক আছিস,নূর?”
নূরের মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–“আমার ঘরে অন্য পুরুষ কেনো এসেছে?কি অধিকারে যাকে তাকে আমার রুমে আসার অনুমতি দাও?পরেরবার আমার ঘরের আমার রুমের ত্রিসীমানায় অন্য কোনো পুরুষ যদি প্রবেশ করে,আমি তার ইতি ঘটিয়ে ছাড়বো।”
কথাটা বলে নূর মাথায় হাত রাখলো।আজব রকমের ব্যাথা অনুভব করছে সে তার মাথায়।
–“ঘরের জামাই ঘরে তো আসবেই।দেখলে মা, ঐ ছেলে এক ইশারায় নূরকে দেখতে চলে এসেছিল এইখানে।কি ভালোবাসা এদে..”
মশকরা করার ছলে জোহানকে কথাটা শেষ করতে দিলো না নূর।রাগী চোখে তাকিয়ে জোহানের দিকে তার কিনারায় থাকা বালিশটা নিক্ষেপ করলো,
–“তুমি বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে।মা ওকে যেতে বলো রুম থেকে।তোমার যদি ঐ লোককে এতই ভালো লাগে তাহলে তুমিই তাকে বিয়ে করে নাও।আমি কাউকে ভালোবাসি না মা,বিশ্বাস করো।আমি….”
নূরের দম ফুরিয়ে এলো যেনো।নূর বুকে হাত রেখে জোরে একটা শ্বাস ফেললো।জোহান চিন্তিত হয়ে নূরের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে আনোয়ারা তাকে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,
–“বাপ,বাইরে যা।আমরা দেখছি নূরকে।মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না।”
জোহান অসহায় দৃষ্টিতে নূরের পানে চেয়ে রুম ত্যাগ করলো।পরক্ষণে নূরকে নিজের করে নেওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে সাথে জোহানের প্রতিহিংসার প্রথম ধাপ সফল হয়েছে এই ভেবে জোহানের অধর প্রশস্থ হলো,
–“এক মাইরে কাঁদিয়েছি,আরেক মাইরে আরেকটু কাঁদিয়ে সারাজীবনের জন্যে আমার করে নিবো।আমার প্রতি তোর সব ঘৃণাকে ভালোবাসায় পরিণত হতে হবে।আর না হলেও চলবে।আমাদের জন্যে আমার একার পক্ষের ভালোবাসাই যথেষ্ট।ঘৃণা আর ভালোবাসার মিশ্রণের শেষ সবসময় ধামাকা নিয়ে আসে। আমিই তোর জীবনের একমাত্র ধামাকা,আমার প্রিয় ভালোবাসার নুড়ি পাথর!”
———-
জোহান তখনই নূরের ঘর থেকে চলে গিয়েছিলো তার নতুন অফিসে।অনেক কাজ হাতে রেখেই সে নূরদের বাসায় এসেছিল।
এইদিকে নূরের অবস্থার উন্নতি হলে আনোয়ারা এবং জোহানের বাবাও নিজেদের ঘরে চলে গেলো।নূরের মা নূরের বাবার দেখাশোনা করছে। নূর মনমরা হয়ে বসে রইলো তার রুমে।
জোহানকে নিজ হাতেই কুঁচি কুঁচি করতে মন চাচ্ছে তার।নূর আসলেই বুঝছে না তার সাথে আজ হলো টা কি?যেখানে নূরের পাশে অন্য ছেলেকে সহ্য করতে পারে না জোহান,সেখানে জোহানের সম্মুখে নূরের রুমে এসে অন্য ছেলে তাকে চুমু! নাহ,নূর আর ভাবতে পারছে না।চোখ বন্ধ করতেই কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে চুমু দেওয়ার সেই কাজটা জোহান করেছে।কিন্তু, আজ জোহানের কান্ড দেখে নূর সেইসব কল্পনা হাওয়ায় মিশিয়ে দিলো।নূর এক গভীর ভাবনায় পড়লো,
–“এতদিন ভেবেছি আমাকে সত্যি ভালোবাসো তুমি।তবে আজ তোমার কাজকর্মে আমি বুঝেছি আমি তোমার জন্যে এক প্রতিশোধের বস্তু।নিজের মুখেই তো স্বীকার করেছো কথাটা।কিন্তু আমি তো তোমাকে মিথ্যা ভালোবাসিনি।আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি।আমার মনে তোমার জন্যে বরাদ্ধ জায়গা আমি অন্য কাউকে না কখনো দিতে পেরেছি,আর না কখনো পারবো।শাফকাত জোহান,তুমি চাও আর না চাও;এই নূরিয়া নূর এতো সহজে তার মনের মানুষকে দূরে যেতে দিবে না।ভালোবাসায় না হলেও আমার জিদ দিয়ে আমার জীবনে তোমাকে আমি রেখে দিবো।কেনো যেনো মনে হয়,তুমি নিজে এক বড় অভিনেতা।আমার সাথে কোনো এক লুকোচুরির নাটক করছো তুমি!তাহলে…. হাহ্!”
নূরের আর ভাবান্তরের সুযোগ হয়নি।দুর্বলতার কারণে নূরের চোখ বটে আসছে।নূর চোখ বুঝতেই যাবে এমনি দরজায় কেউ কড়া নাড়লো, “ঠক্ ঠক্।”
–“কে?”
নূরের ভীত কণ্ঠ।নূরের ধারণা জোহানের ঠিক করা সেই লোকটি নয় তো!নূরের বুক ধুরুধুরু করছে।
–“আমি, জারা।”
জারার কণ্ঠে নূর নিজের দেহে প্রাণ ফিরে পেলো।
–“আসো পরী।”
জারা দরজা পূর্বের নাই ভিড়িয়ে নূরের মাথার কিনারায় এসে বসলো,
–“কেমন লাগছে আপু?”
–“ভালোই।”
নূরের কথায় জারা নূরের পাশে শুয়ে পড়লো।নূর এক হাতে জারার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে।হঠাৎ সে জারাকে বলে উঠলো,
–“আমার রুমে কি বাইরের কোনো ছেলে এসেছিল?”
–“নাহ তো।দেখিনি।”
–“কেউ না?”
নূরের পুনরায় প্রশ্নে ছোট্ট জারা ভেবে বললো,
–“জোহান ভাইয়াকে দেখলাম শুধু।আমি তো বাইরে খেলছিলাম।তাই পুরো ঘটনা জানিনা আপু।”
–“আচ্ছা।”
নূর স্বস্থির শ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারলো না।নূরের কাছে সব গোলক ধাঁধা বলে মনে হচ্ছে।আজকের বিষয় নিয়ে নূরের কিছু ভাবতেই ইচ্ছা পোষণ করছে না। অগত্য নূর জারাকে জড়িয়ে ধরে নিদ্রায় শায়িত হওয়ার প্রচেষ্টা করতে লাগলো।


দুইদিন অতিবাহিত হলো।এই দুইদিন নূর ভার্সিটিতে যায়নি।নূর অসুস্থ ছিলো, এই খবর পেয়ে তনয়া এবং পমেল আজ তার বাসায় আসবে বলে জানিয়েছে।বিকালের চা খেয়ে নূর তাই তাদের অপেক্ষা করছে।ঘরের চৌখাটে মোড়ায় বসে রইলো সে।তার হাতের মুঠোফোনে ভাইব্রেট হচ্ছে।নাম্বারটা চিনতে নূরের অসুবিধে হয়নি।এই দুইদিন নূরকে এই অচেনা নাম্বার থেকে বারংবার ফোন দিয়ে এসেছে কোনো এক অচেনা মানুষ।সেই অচেনা মানুষটা জোহানের ঠিক করা মানুষ ভেবে নূর আর সেই নাম্বার রিসিভ করেনি একবারও।প্রথম ফোনকলে কল রিসিভ করতো সে।কিন্তু অনিবার্য কারণ বশত প্রথম কল মিস করলে নূর, সেই নাম্বার থেকে বারংবার ফোন এসেই গিয়েছে এই দুইদিন।যার কারণে নূরের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় আর সে কল ধরেনি।কিন্তু,নূর আজও সেই মানুষটার পরিচয় জানতে মানুষটাকে ব্লক করেনি।নূরের বিশ্বাস নূরের এমন অবহেলা পেয়ে নূরকে অচেনা মানুষটা মেসেজ দিবে।আর নূর জানতে পারবে সেই মানুষটি আসলে কে?নূরের কল্পনাতীত সেই মানুষ নাকি অন্য কেউ?
মোবাইলের ভাইব্রেট বন্ধ হয়ে গেলো। নূর সেদিকে আর মাথা ঘামালো না।মিনিট খানেক পরেই তাদের বাড়ির প্রধান ফটক খুলে প্রবেশ করলো তনয়া এবং পমেল।নূরের মুখে হাসির চিলিক দেখা গেলো।
–“মুখ শুকিয়ে ফেলেছিস দুইদিনে।কি হয়েছে রে?”
নূর সত্যি বলতে গিয়েও বললো না।জোহানের বাম হাত যে নূরের সামনে!পমেল এবং তনয়াকে নিয়ে নিজেদের ছোট্ট ড্রইংরুমে হাজির হলো নূর।তাদের বসতে বলে নূর এইবার তনয়ার কথার জবাব দিলো,
–“কিছুই না।এমনি জ্বর ছিলো।”
–“আমিও তাই ভেবেছি,ভাবীপা।এখন কেমন আছেন আপনি?”
–“ভালো আছি,পমেল।”
নূর মলিন হাসলো।
–“ভার্সিটি কবে থেকে যাবি,নূর?”
–“আগামীকাল থেকে।”
নূরের শান্ত জবাব।
–“নূর নাস্তা নিয়ে যা।”
জহুরার কথায় নূর হুরহুর করে চলে গেলো ভেতরে।
সবাই নাস্তা সমেত আড্ডা দিচ্ছে।ঘরের মধ্যে দমবন্ধ লাগলে নূর তনয়া আর পমেলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“চল না কোথাও ঘুরে আসি?”
–“কই যাবি?”
–“যেকোনো কোথাও।বাসায় বসে বসে আড়ষ্ঠতা চলে এসেছে আমার।যেকোনো জায়গায় চল।”
–“ওকে ভাবীপা।আমি সিএনজি ঠিক করছি।”
পমেল কথাটা বলে এক চুমুকে চা শেষ করে বেরিয়ে পড়লো।
–“আরে আস্তে।”
নূরের কথা পমেল শুনলো না।এর পূর্বেই সে ঘর থেকে বাইরে চলে এলো।
–“আমি রেডি হয়ে নিই।চল রুমে।”
নূর বললো।

রেডি হয়ে নূর নিজের মোবাইল চেক করতেই থমকে গেলো।সেই অচেনা নাম্বার থেকে আগত মেসেজ ওপেন করলো সে,
–“আমার ফোন ধরা যায় না।কিন্তু দুই প্রেমিক জোহান এবং পমেলকে নিজের ঘরে তুলে নেওয়া যায়!আমার সামনেই যতো ভদ্রতা আর তলে তলে খুব মজা?”
নূর যেনো আকাশ থেকে পড়লো।সাথে সাথেই নূর ফোন ব্যাক করলো সেই অচেনা নাম্বারে।দুই রিং বাজতেই অপর পক্ষ ফোন রিসিভ করলে নূর খেঁকিয়ে উঠে,
–“তুই যেই হোস না কেনো,আমার ব্যাপারে খারাপ কথা বলার শাস্তি তুই পাবি।”
–“আহ,বাঘিনী। আই লাইক ইউর অ্যাটিটিউড।”
–“চুপ কর।কে তুই?”
–“মেহরাব।তোমারই মেহরাব।”
মেহরাব বেশ আকর্ষণীয় কণ্ঠে বললো।
–“শালা,বেয়াদপ।তোর সমস্যা কি?আমার পেছনে লেগেছিস কেনো?আজকের এই মেসেজের জন্যে তুই একবার আমার সামনে এলেই তোর অবস্থা আমি খারাপ করবো।”
কথাটা বলে খট করে ফোন কেটে দিলো নূর।
–“কে ছিলো নূর?”
–“এক জানোয়ার।”
–“আচ্ছা বাদ দে।গাড়ি পেয়েছে পমেল।চল।”
নূর নিজের সকল রাগ ফেলে,জোরে দুইটা নিঃশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।মুড ঠিক করতেই সে বাহিরে যাচ্ছে,তার এমন গোমড়া মুখ নিজের‌ই একেবারে ভালো লাগছে না।তাই সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নূর হাসিমুখে এগোতে লাগলো। যেনো একটু আগের ঘটনা নূর একেবারেই ভুলে গিয়েছে।

নূর,তনয়া এবং পমেল শহরের ব্যস্ততম এলাকায় এসেছে।এইখানে নানান ধরনের যানবাহন,খাবারের দোকান,মার্কেট কিছুরই কমতি নেই।সবাই মিলে টুকটাক ঘুরাফেরা করতেই তারা একটা খাবারের দোকানে গেলো।গরম গরম লুচি আর চিকেন কড়াই গোশত অর্ডার দিয়ে বাহিরে একপাশে এলো নূর এবং তনয়া। পমেল দোকানে আছে।স্ট্রিট ফুড কোর্ট হওয়ায় এইসব দোকানে অর্ডার দিয়ে বাহিরেই খেতে হয়।নিজেদের খাবার নিজেরা গিয়ে আনতে হয়,এক প্রকার সেল্ফ সার্ভিস টাইপ।
নূর এবং তনয়া কথা বলছে।দোকানে প্রচুর ভিড়।সেই ভিড়ে আটকে রইলো পমেল। তাদের দুইজনকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলো দুই জোড়া চোখ।সুযোগ বুঝে সেদিকে এগিয়ে গেলো সেই দুই চোখজোড়ার মালিক।
নূরের সামনে একজন মুখ এগিয়ে দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“সামনে পেলে আমাকে কি যেনো করবে বলেছিলে, না?”
নূর চমকে উঠলো এমন হওয়াতে। মেহরাবকে দেখে নূরের এতোই ঘৃণা হলো,নূর ঠাস করে একটা চড় দিয়ে দিলো মেহরাবকে।মেহরাব হয়তো সত্যি এমনটা আশা করেনি।সে নিজের চোয়াল শক্ত করে ফেললো।আশেপাশের কয়েকজন এইদিকটা মনোযোগ সহকারে নিজেদের মগজে ধারণ করছে।মেহরাব নূরের হাত চেপে ধরলো,
–“বেশি সম্মান করেছি তাই মাথায় উঠেছিস?তোকে আজ আমি!”
–“আরে না মেহরাব!”
আজিম কথাটা বলে যেই মেহরাবের হাত ধরতে গিয়েছিলো,অমনি কেউ এক ধাক্কায় মেহরাবকে জমিনে ফেলে দিলো।দেরী না করেই মেহরাবের পেটে সজোরে একটা লাথি দিলো জোহান।নূর এইখানে জোহানকে মোটেও আশা করেনি।নূরের জন্যে এইসব স্বপ্ন মনে হচ্ছে ।পুনরায় আঘাত করতে গেলে জোহানকে আঁকড়ে ধরলো অনি,
–“জোহান,কন্ট্রোল কর ভাই।”
–“কোন সাহসে আমার নূরের দিকে হাত দিয়েছে এই কুলাঙ্গার?ছেলেটা কি জানে,আমি চাইলে এখন একে মেরে গুম করে দিতে পারবো?”
জোহানের অগ্নিকণ্ঠ।
মেহরাব কোনো অংশে কম নেই।সে নিজেকে সামলে ধূর্ত শিকারির মতো জোহানকে আঘাত করতে নিলে, নূর চিল্লিয়ে উঠে,
–“জোহান ভাই!”
নূরের চিৎকারে সতর্ক হয়ে মেহরাবের হাত চেপে ধরলো জোহান,
–“মরার শখ জেগেছে?”
–“আমাকে চিনিস?”
–“মিনিস্টার তুই?”
হিংস্রমুখে জোহান প্রশ্ন করলো।
–“ভাই। আরহাব এর ভাই।”
মেহরাবের খুশিমাখা উত্তর।সে যেনো এই কথা বলে বেশ খুশি।
–“তোর ভাইকে গিয়ে আমার কথা বলিস।শাফকাত জোহানের নাম বললেই হবে।কানের নিচে যখন দুইটা দিবে তোর ভাই,এরপর বুঝবি জোহান কে?”
জোহানের কথায় মেহরাব ভরকে গেলো।ঝামেলা কঠোর হওয়ার পূর্বে মেহরাব নূরের দিকে কটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাত পা ঝাড়তে ঝাড়তে রাস্তার অন্য পাশে চলে যাচ্ছে।তার মনে একটাই কথা চলছে,
–“অপমানের প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।”

নূর জোহানের দিকে বাক ফিরে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“কেনো এসেছো তুমি?কে বলেছে তোমায় আসতে?”
–“আমার ইচ্ছা।আমার যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যাবো।এই দেশের সব জায়গা তুই কিনে রেখেছিস?”
জোহান দুইহাতে নিজের চুল পেছনের দিকে ঠেলে বললো।
–“খাবার চলে এসেছে।”
পমেল দুইহাতে খাবার এনে বলে উঠলো।
–“জোহান ভাইয়া,আপনি এত দ্রুত চলে এসেছেন?”
পমেল পুনরায় কথাটা বলে জিভ কাটলো।
–“ওহ!!তাহলে তুমি জানিয়েছ এই লোককে,আমরা বাইরে এসেছি।”
নূর বুকের সাথে নিজের দুইহাত বটে বললো।
–“জোহান ভাইকে জানিয়েছিলাম আমি আমরা বাহিরে যাবো।কারণ জোহান ভাই আমাকে বলেছে…”
–“পমেল!”
পমেল মুখ তালাবদ্ধ করে ফেললো জোহানের হুংকার শুনে।
–“ধেত!আমি গেলাম তনয়া।”
নূর রেগেমেগে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে।

জোহান কিছু না বলে নূরের পিছু চলছে।

–“এই দুইজনের কান্ড বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।আমরাই খাই।খাবার অপচয় করা ভালো না।”
অনির কথায় তনয়া আর পমেল হেসে উঠলো,
তিনজনই নিজেদের খাবারে মন দিলো।

–“নূর!”
জোহান তীব্রভাবে বললো।
–“কি?”
নূরের তীক্ষ্ণ জবাব।
–“বাইকে উঠে পড়।”
–“তুমি বললে আর আমি উঠে যাবো?আমি ভুলে যায়নি আমার জীবনে কি তুফান এনছো তুমি।তুমি বরং সেই তুফানকে উঠাও তোমার বাইকে।”
নূর হনহন করে হাঁটতে লাগলো।জোহান নূরের হাত চেপে ধরলো।
এইখানে এইসব দৃশ্য একেবারে সাধারণ।হাজারো কপোত কপোতীর মান অভিমানের দৃশ্য এইখানের মানুষ প্রতিনিয়ত দেখে।
–“কেনো মেজাজ খারাপ করছিস?”
–“তুমি এইভাবে রাস্তায় মারামারি করছিলে কেনো?তোমার যদি লেগে যেতো?”
–“আর যদি তোর লেগে যেতো?কসম বলছি, ঐ ছেলের শেষ দিন হতো এই দুনিয়ায়।”
জোহানের হিংস্র গলার স্বর।
–“আমার জন্যে কেনো তুমি অন্য একজনকে খুন করতে?আমি কে হই তোমার?আমি তো তোমার জন্যে একটা জিদ আর প্রতিশোধ।তাহলে;আমি মরি বা বাঁচি,তোমার কি?”
–“তুই আমার স…”
জোহান থেমে নূরকে জোরপূর্বক বাইকে বসতে বাধ্য করলো।
–“অসম্পূর্ণ কথা অন্য কিছুর লক্ষণ।কি চাও আমার থেকে তুমি?হঠাৎ তোমার এইসব যত্ন আবার অপমান, আমাকে অনেক ভাবায়।”
নূর থমকে গিয়ে বললো।জোহান বাইক চালু করেছে।কিছুদূর যেতেই জোরে ব্রেক কষলে নূর জোহানের পিঠে গিয়ে ঠেকলো।পড়ে যাওয়ার ভয়ে নূর পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো জোহানকে।
–“তুই আমার জিদ,প্রতিহিংসা সব।এইসবের চেয়েও দামী তুই।সবচেয়ে দামী।”
–“ভালোবাসা নয় কি?”
জোহানের ঠোঁটে বাঁকা হাসি,যেটা নূরের দৃষ্টির অগোচরে।
–“ভালোবাসা তো তুই ই আমার।আমার কঠিনতম ভালোবাসা।”
কথাগুলো জোহান মনে মনে বললেও,মুখে সে বলে উঠলো,
–“তোর হবু জামাইয়ের ভালোবাসা তুই।”
–“না।আমার কোনো হবু জামাই নেই।জোহান ভাই আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।”
নূর নিজের হুঁশ খোয়ায়ে দিলো এক কামড় জোহানের পিঠে।জোহানের পিঠ চিনচিন করে উঠলো ব্যথায়,
–“রাক্ষসী কোথাকার!”
–“আর তুমি কি?শয়তান তিতামুখী।”
জোহান হাহা করে হেসে উঠলো।নূরকে খ্যাপানো জোহানের প্রিয় কাজ।নূরকে খ্যাপিয়ে জোহান বেজায় খুশি।জোহানের বাইক ডানে বাক নিতেই নূর সতর্ক হয়ে জোহানের পিঠ আরো ভালো করে চেপে ধরলো।মুখে দুইজনের কথা দুইরকম হলেও মনের অনুভূতি একেবারে একই।দুইজনই তাদের মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।নূরের মনে আজকের দিনের পর সবটাই যেনো নতুন লাগছে,
–“তোমার এই ব্যবহার দেখে কিভাবে আমি ভেবে নিবো,তুমি আমাকে অন্য কারো হতে দিবে?তুমি চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়বো না,তিতামুখী।নিশি আপু আসছে তিনদিনের ভেতরেই।এরপরই আসল খেলা শুরু হবে।উস্তাদের মাইর শেষরাতে।সত্য সামনে এলেই আমরা দুইজনই অতীতের সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত হবো।আমার আর তোমার জীবনের আমি তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে আসতে দিবো না।এইভাবেই তোমাকে আমার বাহুডোরে আগলে রাখবো সারাজীবন।ভালোবাসি তোমায়।”
নূরের মনের সুন্দর পরিকল্পনা।

জোহানের জন্যে এইসব মুহূর্ত সবচেয়ে আবেগপ্রবণ হলেও সে তার পরিকল্পনায় অটুট রইলো,
–“শেষ ঝটকার জন্যে প্রস্তুত থাকো নুড়ি পাথর।আর একটু কষ্ট দিবো,এরপরই পুরোপুরি আমার হয়ে যাবে তুমি।”
জোহানের এমন মনোভাবনা হঠাৎই তাকে ভাবিয়ে তুললো,
–“নূরকে এমন কষ্ট দিয়ে আমি কি আদৌ ভালো করছি?”
পরক্ষণে তার ভেতরকার অন্য সত্ত্বা বলে উঠলো,
–“তুই তো তাকে ভালোবেসে আগলিয়ে রেখেছিস জোহান। কষ্টও দিবি তুই তাকে ভালোবাসবিও তুই।জিদ পূরণ হলেই ভালোবাসায় আর কোনো বাঁধা থাকবে না তোর।নুড়ি পাথর একান্তই তোর।”
জোহান বাইকের মিররে নূরের প্রতিচ্ছবি দেখছে।নূরের মুখে কষ্টের মাঝেও হাসির চিলিক দেখা যাচ্ছে।জোহানের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো,
–“হুম,এই মেয়ে শুধুই আমার।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here