#প্রতিহিংসার_অনুরক্তি-৬,৭
লেখিকা: সালসাবিল সারা
শুক্রবার।সপ্তাহের এই দিনে নূর বেশ আয়েশ করে নিদ্রায় শায়িত থাকে।তবে,আজ নূরের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলো বেশ ভোরে।যার দরুণ নূর এখনো সজাগ রয়েছে।নূরের নিদ্রা থেকে সজাগ হওয়ার কারণ হলো,আজ সে কেমন এক বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছে।সেই স্বপ্নে নূর দেখলো,জোহান নূরকে অন্য এক ছেলের সাথে বাগদান সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে।নূর অত্র ছেলের চেহারা মনে রাখতে না পারলেও জোহানের ক্ষিপ্ত চেহারাটা এখনো তার মনে গেঁথে আছে। সাত সকাল এইসব স্বপ্ন দেখে নূরের নিদ্রা পালিয়েছে তখনই।নূর ভেবে পায় না,এই স্বপ্ন দেখার কারণ কি!যখনই তার ঘুম আসবে বা ঘুমাবে এমন মনোভাব তৈরি হয়,তখনই জোহান এর কল্পনাতীত মুখমন্ডল নূরকে সজাগ থাকতে বাধ্য করছে।নূর ভাবছে,
–“এমন স্বপ্ন দেখার কি মানে?জোহান ভাই আমার সাথে অন্য ছেলের বিয়ে,কখনোই কি মেনে নিবে?নাকি,
সত্যি জোহান ভাই পাল্টে গিয়েছে।বয়স বর্ধনের সাথে সাথে উনার মন থেকে আমার জন্যে বরাদ্ধ ভালোবাসাটাও কি কমে গিয়েছে?যদি এমনটা হয়,
তাহলে গতকাল উনার চোখের সীমানায় আমার প্রতি যে ভালোবাসাময় দরদী চাহনী লক্ষ্য করেছিলাম,
সেটাও কি আমার মনের ভুল ছিলো?”
কিন্তু,নূরের মন বলছে,”জোহান ভাই শুধুমাত্রই আমাকে ভালোবাসে।উনার ভালোবাসায় হিংস্রতা থাকলেও,
আমি জানি জোহান ভাই কখনো আমাকে অন্যর হতে দিবে না।মেহরাবের সাথে হওয়া ঘটনাটাই এর তাজা উদাহরণ।সাথে আরো ঘটনা আছে,এগুলো পুরোনো।আমি আমার জোহান ভাইকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।একবার নিশি-পিশি আসুক,সত্যিটা বের হোক,এরপর তোমার সকল অভিমান ভোলানোর দায়িত্ব আমি নিলাম,জনাব তিতামুখী।”
নূর গভীর ভাবনায় পড়লো।এইদিকে বেলাও বাড়তে লাগলো নূরের এমন গভীর মনোভাবের সাথে।বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় নূর খেয়াল করলো তার মা হুড়মুড় করে রুমে এসে কিছু একটা খুঁজছে ড্রয়ারের ঠিক উপরে।
–“কি খুঁজছো,মা?”
নূরের প্রশ্নে তার মা বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে গভীর চিন্তায় পড়লো যেনো,
–“সেটাই তো ভাবছি।কি খুঁজছি আমি?”
–“কিসব আবোল তাবোল বলছো?”
–“কিছু না।”
বলেই তার মা রুম ত্যাগ করতে নিলে,থেমে পিছনে বাক ফিরে নূরকে বলে উঠলো,
–“তোর কাছেই তো এসেছিলাম আমি।”
নূরের মা হেঁটে তার কাছে চলে এলো,
–“জারাকে ড্রইং স্কুল থেকে নিয়ে আয়।আমি আজ যেতে পারবো না।তোকে ডাকতে এসেই ভুলে গিয়েছিলাম,কেনো এসেছি তোর রুমে।ফটাফট উঠে পড়।”
–“আর কতো উঠবো।এই দেখো আমার দুই অক্ষিজোড়া ড্যাব ড্যাব করে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।”
নূর তার চোখজোড়া বড় করে দেখালো।
–“খাবি এক মাইর,নূর।”
নূরের মা হাত তুলে বললো।
–“তুমি আজ যাচ্ছো না কেনো?বাবা কি বেশ অসুস্থ?”
–“না। সবই ঠিক আছে।কিন্তু ঘরের কাজ বাকি রয়েছে অনেক।সেগুলো শেষ করে ফটাফট রেডি হতে আমাদের। জুম্মাহ এর পরই তো জোহানের অফিসের অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”
কথাটা বলে নূরের মা বিদায় হলেন।
–“আরে হ্যাঁ।কিন্তু,আমার কি?আমি এইসব অনুষ্ঠানে যাবোই না।জোহান ভাইয়ের কাছে আর কটু কথা শুনতে চাই না আমি।দেখা যাবে,অনুষ্ঠানে পা রাখতেই আমার কাছে এসে বলবে,তোকে দেখতে এতো বাজে লাগছে আমার রীতিমত বমি পাচ্ছে।”
নূর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে আবারও বলে উঠলো,
–“উহু,নেভার।আমি সেই তিতামুখীর তিতা অনুষ্ঠানে যাবো না।এই হলো নূরের শপথ।”
নূর নিজের পোশাক পরিবর্তন করে বিনা নাস্তায় বেরিয়ে গেলো জারার ড্রইং স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।নূরের বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথেই ড্রইং স্কুল।অগত্য নূর মাথায় ওড়না চেপে তার এলাকার কিনারা ধরে হাঁটতে লাগলো।
ড্রইং স্কুলের সামনে যেতেই নূর দেখলো জারা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে।নূর পায়ের গতি বাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডে পৌঁছে গেলো জারার সম্মুখে,
–“বাহিরে কেনো?ভেতরে অপেক্ষা করা যায় না?”
–“আমি ভাবলাম, মা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”
জারার ক্লান্ত জবাব।
–“এইভাবে বাহিরে আসবে না।মা অবশ্যই তোমাকে ভেতর থেকে পিক করবে সবসময়।”
–“ঠিক আছে,বড় আপু।”
নূর জারার হাত ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলো।পথিমধ্যে জারা বায়না করলো আইস্ক্রিম খাবে সে।নূরের কাছে আইস্ক্রিম তার সর্বকালের প্রিয়।পথের কিনারায় আইস্ক্রিমের গাড়ি দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলো দুইবোন।জারাকে নিজের মন মতো আইস্ক্রিম কিনে দিয়ে নূর একটা কমদামী আইস্ক্রিম নিলো।কারণ,তার পার্সে টাকার লাল বাতি জ্বলছে।নূর যেই আইস্ক্রিম মুখে দিলো অমনি দেখলো জারার সামনে এক ছেলে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো।নূর জারার হাতে টান দিয়ে জারাকে নিজের আড়ালে নিলো,
–“কি অসভ্যতামো এইসব?”
ছেলেটি উঠে দাঁড়াতেই নূরের চোখ কপালে উঠলো,
–“মেহরাব?”
নূরের অস্ফুট স্বর।
মেহরাব দাঁত দেখিয়ে হাসলো,
–“ইয়েস,বাঘিনী।তোমার বোন বুঝি?খুব কিউট।”
–“এইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”
নূরের রাগী কণ্ঠ।
–“এই এলাকায় থাকো বুঝি?”
–“সেটা তোমায় বলার প্রয়োজন মনে করছি না।”
নূরের কথায় অন্য এক ছেলে বলে উঠলো,
–“হ্যাঁ বন্ধু,সামনের এক তলা বাড়িতেই থাকে।”
নূর অত্র ছেলের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো না।কারণ, সেই ছেলে তাদের এলাকারই; নাম আজিম।
–“আজিম ভাই,তুমি এই ছেলেকে বন্ধু বলছো কেনো?তাছাড়া আমার বাড়ির কথায় বা বলছো কেনো?”
নূর চমকে প্রশ্ন করলো।
আজিম কিছু বলার পূর্বে মেহরাব নিজের মুখ খুললো,
–“কারণ আমি আজিমের ফ্রেন্ড আর আমি এই এলাকায় ঐযে বড় মসজিদে জুম্মাহ পড়তে এসেছি।”
–“আমি কি করবো এতে?”
কথাটা বলে নূর চলে আসতে নিলে,মেহরাব একটু জোর গলায় বলে উঠলো,
–“মাথায় কাপড় দিলে তোমাকে একেবারেই বাঘিনী লাগে না।খুব ভালো লাগছে তোমাকে।”
নূরের কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বেরিয়ে গেলো। জারা সাথে আছে এবং এটা তার নিজের এলাকা, যার কারণে নূর নিজের মুখ বন্ধ রেখেছে।এইখানে কিছু বললে লোকেরা খারাপ চোখে দেখবে,তার বাবারই অসম্মান হবে।তাই সেসব ভেবে নূর হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলো,
–“তোর এই ভালো লাগা আমি ভার্সিটিতে গিয়ে তুলবো।শালা,মাস্তান।”
নূরের মনের হিংসাত্মক পরিকল্পনা।
বাড়ির গেইটে ঢুকে নূর জারার কাঁধে হাত রেখে তাকে বলে উঠলো,
–“রাস্তার ঘটনা যেনো মা না জানে,কেমন?”
–“আচ্ছা,বড় আপু।”
–“আমার জারাপাখিকে অনেকগুলো চকলেট কিনে দিবো।”
জারার গালে নূর ঠোঁট ছুঁয়ে বললো।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই নূরের মা তাকে তাড়া দিতে লাগলো,
–“এতক্ষণ লাগে? দশ মিনিটের কাজ ত্রিশ মিনিটে শেষ করেছিস।এখন জলদি গোসল সেরে তৈরি হয়ে নে।খুতবা শুরু হতে চললো।”
জারা দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।কিন্তু নূর তার মায়ের কথায় বাঁধা দিলো,
–“আমি যাবো না।আমি বাবার সাথে থাকবো বাসায়।”
–“কোন বাবার সাথে থাকবি?তোর নিজের বাবা তো জুম্মাহ এর উদ্দেশ্যে মসজিদে গিয়েছেন।সেখান থেকে এসেই আমরা বেরিয়ে যাবো সবাই।দেখ নূর,আমার মেজাজ খারাপ করবি না।”
–“মা,আমি..”
নূরের কথা অসম্পূর্ণ থেকে গেলো।তার মা তার কথা কর্ণপাত না করে নিজের কাজে চলে গিয়েছে।নূর আফসোসের সহিত সোফায় বসে পড়লো,
–“কি জ্বালায় ফেললে আমাকে তুমি,আল্লাহ্! ঐ জোহান ভাই যেনো আমাকে উল্টোপাল্টা না বলে।আজ যদি উনি কিছু বলে আমাকে তাহলে উনার ঘাড় মটকে দিবো আমি সবার সামনে।”
এক বুক আক্ষেপ নিয়ে নূর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
গোসল শেষ করে নূর বিছানায় নিজের কাপড় দেখতে পেলো।তার মায়ের কাজ এইসব।নূরের সবচেয়ে প্রিয় জামা তার মা বিছানার উপর রেখেছে।এই জামাটা নূর একদিনও পড়েনি।কোনো এক বিশেষ দিনে নিজেকে এই জামাতে রাঙিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিলো তার।এমনকি নূর তার মাকেও তার এই পরিকল্পনায় শামিল করেছিলো।কিন্তু,নূর জানতো না তার মায়ের কাছে আজকের দিনটাই নূরের জন্যে বিশেষ দিন বলে মনে হবে।নূর তার মায়ের সাথে আর ঝামেলায় জড়ালো না।চুপচাপ সেই সুন্দর কারুকাজ করা সোনালী আর গাঢ় খয়েরির মিশ্রণে রাঙা জামাটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলো সে।আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে একটু মুগ্ধ হলো নূর।এই পোশাকে নূরকে বড্ড মোহনীয় লাগছে।ম্লান হেসে নূর একে একে বিভিন্ন প্রসাধনীর সাহায্যে তার সাজসজ্জা সারতে লাগলো।মায়ের তাড়া দেখে খুব দ্রুত নূর হাত চালিয়ে নিজের সাজসজ্জা শেষ করে যেই কানের দুল পড়তে যাবে অমনি নূর কেঁপে উঠলো গত রাতের স্মৃতির স্মরণে….
গতরাতে জোহান সশরীরে নূর এবং জারাকে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়।নূর ঘুমন্ত জারাকে কোলে নেওয়া অবস্থায় ঘরে ঢুকতে নিলে জোহান তার পথ আগলে দাঁড়ায়।নূর কিছু বুঝে উঠার পূর্বে জোহান তার দিকে ঝুঁকে তার কানে বেশ কড়া একটা কামড় দিয়েছিল।নূরের তীব্র ব্যথা অনুভব হয়েছিল,কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না।নূরের চোখে পানি দেখে জোহান মুচকি হেসে তাকে বললো,
–“ইস,সামান্য কামড়ে কি কারো চোখের পানিতে সমুদ্র হয়ে যায়?”
–“ব্যথা পেলে কেউ হুহু করে হাসে?আমি অন্তত অমানুষ না।আমি মানুষ। ব্যথা পেয়েছি তাই কষ্টটা চোখের পানি দিয়ে বহমান হলো।এতেও তোমার সমস্যা?”
নূর থমকে বললো।
–“কাল তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে নুড়িপাথর।তোকে আল্লাহ্ যেনো সেই সারপ্রাইজ সহ্য করার ক্ষমতা দেয়।”
–“কালকে আমি মরে গেলেও যাবো না।”
–“যেতে বাধ্য তুই!”
নূরের কানে আবারও সে নিজের অধর ছোঁয়ালো।তবে এইবার জোহানের স্পর্শে নূরের শরীরে অন্য শিহরণ নিয়ে এলো।নূর জোহানকে কিছু বলার পূর্বেই সে গাড়িতে উঠে পড়লো।এক মিনিটের মাথায় গাড়িটা যেনো বিদ্যুতের গতিতে ছুটতে লাগলো।
‘
—“বড় আপু, মা জলদি আসতে বললো।”
জারার কথায় নূর বাস্তবে ফিরলো।কানের দুলটা পড়তে নিলে কানের কিনারায় হাল্কা কালচে দাগ দেখতে পায় সে আবারও।নূরের মাথা থেকে কাল রাতের কাহিনী একেবারে ছুটে গিয়েছিল।জোহানের সারপ্রাইজের কথা বলা,তার মায়ের তাকে জোহানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে জোর করা,তার প্রিয় জামাটা আজকের জন্যে নির্ধারণ করা,সবটাই নূরের কাছে অদ্ভুত লাগছে।তার মন বলছে,আজ তার সাথে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে।কিন্তু,পরক্ষণে তার ভেতরকার অন্য সত্ত্বা বলছে,
“আজকে তোর সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে,নূর।”
–“জলদি আয় না বাপ,তোর আনোয়ারা আন্টি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।এই জারা হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেনো? উঠে পড় গাড়িতে।”
মায়ের ধমকে নূর বিছানার উপর থেকে ওড়না নিয়ে গলার উপর বিছিয়ে দিলো।জারার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো সে।মায়ের উদ্দেশ্যে সে চেঁচিয়ে বললো,
–“কোটিপতির বিয়েতে যাচ্ছি নাকি আমরা?এমন ভাব করছো তুমি মা,আমরা দেরীতে গেলে যেনো জোহান ভাই আমাদেরকে ঢুকতে দিবে না।অসহ্যকর।”
মুখে নানান কথা বললেও,নূরের মনটা আজ ভালো খারাপ দুইটাতেই রাঙা হয়ে আছে।বুকটা তার কেমন যেনো ধকধক করছে।
—————————
বিশাল আয়োজন করা হয়েছে অফিসের ভেতরকার পরিবেশে।অফিসের ডেস্ক,চেয়ার,এখনো সেটাপ না করার কারণে,এই জায়গাটা দেখতে আসলেই একটা হলের মতো লাগছে।কিন্তু পর্দার আড়ালে নানান কেবিন আর কিছু রুম স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারছে নূর।দূর থেকে জোহান,অনি এবং শালুকে দেখতে পেলো সে।তবে তার নজর আটকে যায় জোহানকে দেখে।সাদা পাঞ্জাবিতে জোহানকে যেনো দূর থেকেই আকর্ষণ করছে নূরের চোখজোড়া।জোহান মুচকি হেসে সবার সাথে কথা বলছে,তার ইশারা দেখে নূর বুঝছে;জোহান অনেককে বসতেও বলছে।জোহান নিজের অবাধ্য চুলগুলো আজ এমন ভাবে সেট করেছে তারা যেনো তাদের জায়গায় বসে থাকতেই বাধ্য।জোহানের হাসি দূর থেকেই নূরের কাছে অমৃত লাগছে।হঠাৎ করেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো।নূর নিজের ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিলো।নূরের সারা সত্ত্বায় যেনো অদ্ভুত জ্বালা করছে।নূর ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি,জোহানের চোখের তীব্রতা এতটাই তীক্ষ্ণ হবে!
–“জারা,আমার বেবি।”
কথাটা বলে জোহান জারার গালে চুমু দিলো।
নূর নিজের জামা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে।কেমন যেনো লজ্জা পাচ্ছে তার।জোহান নিজের মা এবং জহুরাকে কিছুর নির্দেশনা দিলে তারা অনি আর শালুর দিকে পা বাড়ালো। এতে নূর যেনো আরো অস্বস্তিতে পড়লো।
–“তুই নাকি আসবি না! যেই সেই ফিটফাট হয়ে চলে এসেছিস?অবশ্য এইখানে আসবি নাই বা কেনো?তোর মতো মেয়ের জন্যে ছেলেদের কাবু করার অন্যতম জায়গা এইসব পার্টি।”
নূরের মনটা ভেঙে গেলো।রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে জোহানের দিকে,
–“অপমান করতেই যদি হয়,তাহলে দাওয়াত করো কেনো মানুষকে?”
–“আমার ইচ্ছা।অপমান কাকে বলে জানিস?এইখানে শুধু আমি কথা বলছি আর তুই শুনছিস।অন্য কেউ তো শুনছে না।তার মানে আমি তোকে কটু কথা শোনাচ্ছি,
অপমান করছি না।আর সত্যি কথা বললে কিসের অপমান?”
জোহানের হিংস্র জবাব।
–“আমার এইখানে আসায় উচিত হয়নি।ভেবেছি,
অমানুষ থেকে মানুষ হয়েছে তুমি।কিন্তু,হায়েনা তো কখনো মানুষ হয় না।”
–“নূর!”
–“নূর পরপারবাসি।আপনি এইবার আসতে পারেন।”
নূর মুখ ফুলিয়ে বললো।
জোহান কিছু বললো না।চুপ করে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে।অবশ্য লুকিয়েই দেখছে সে নূরকে জারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে।নূরের নাকের ডগা লাল রং ধারণ করেছে।নূরের চোখে জল টইটুম্বুর থাকার কারণে কান্নার আগামাবার্তা হিসেবে নূরের নাকের রং পরিবর্তিত হয়েছে।জোহানের ইচ্ছে করছে নূরকে আরো জ্বালাতন করতে।কিন্তু বেশি মানুষ চলে আসায় সেটা আর করা হয়ে উঠলো না তার।নূরের কাঁদো কাঁদো চেহারা জোহানের সর্বকালের প্রিয়।তার এমন কন্নামুখ দেখেই তো নূরের প্রেমে মত্ত হয়েছিল জোহান।আজও নূরের এই জিনিসটা জোহানের কাছে নেশার মতো মনে হয়।
–“বড় আপু,আমার জুতার ফিতা ঠিক করে দাও।”
জারার কথায়,নূর নিজেকে সামলে জারার পাশে ফিরতেই দেখলো জোহান এখনো দাঁড়িয়ে আছে পূর্বের স্থানে।নূর জোহানের চেহারার দিকে আর দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো না।জোহানের পাঞ্জাবি দেখেই নূর জোহানের অস্তিত্ব বুঝে নিলো।
–“ঠিক করে দিয়েছি।”
জারাকে জবাব দিলো নূর।
–“জারা,কিছু দরকার হলে ভাইয়াকে বলবে।আর এই কাঁদুনির মাকে বলো;অল্পতে যারা চোখের জল ফেলে ভবিষ্যতে তাদের শরীরে পানির অভাবে স্যালাইন দিতে হয়।”
জোহানের এমন আজগুবি কথা শুনে নূরের হাসি পেলো।কিন্তু,নূর হাসলো না।জোহান সামান্য নড়তেই নূর হুহু করে হেসে উঠলো জারার হাত চেপে,
–“তোর জোহান ভাইয়ের মুখে হস্যকর কথা মোটেও মানায় না।”
–“তাহলে কেমন কথা মানায়?”
জোহানের কথায় নূর চুপসে গেলো।
–“জোহান ভাইয়ের আজকে কি হলো?এমন উদ্ভট আচরণ করছে সেই তখন থেকেই।এইমাত্র না চলে গিয়েছিলো আবারও চলে আসলো!অদ্ভুত।”
–“তোমার মুখে আমার জন্যে বলা কোনো কথায় আমার ভালো লাগে না।যাও তুমি এইখান থেকে।”
নূর মুখ বেঁকে বললো।
–“বলতে তো আমার হবেই!সারাজীবন যে একসাথে থাকতে হবে!তবে জোহানকে পেতে একটু কষ্ট করতে হবে তোমার,নুড়ি পাথর।এরপর শুধু সুখ আর সুখ।”
জোহানের বলা বিড়বিড় কথায় কর্ণপাত করলো না নূর।
অনুষ্ঠানের ইতি ঘটলো শান্তশিষ্ট ভাবে।এখন অফিসে উপস্থিত আছে শুধু নূরের এবং জোহানের পরিবার সাথে অনি এবং শালু।জোহান যেনো একটা সুযোগ খুঁজছে বড় বোমটা ফাটানোর জন্যে।জোহানের বাচনভঙ্গি বুঝে আনোয়ারা জোহানকে একপাশে নিয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
–“বাবা,এইকাজ না করলেই কি হয় না?”
–“মা,প্লিজ?”
আনোয়ারা মুখ বন্ধ করে ফেললো।
জোহানের ইশারায় আনোয়ারা সবার মাঝে চলে গেলো। জোহানও ধীর পায়ে উপস্থিত হলো সবার মাঝে।আনোয়ারা হলো খাঁকারি দিলো,
–“আমার কিছু বলার আছে।”
–“হ্যাঁ,বলো।”
নূরের মা একটু জোর করেই কথাটা বললো।আনোয়ারা এখন কি বলতে যাচ্ছে,এই সম্পর্কে নূরের মা পূর্ব থেকে অবগত আছেন।
–“বলছি কি,আমাদের নূরের তো বিয়ের বয়স হয়েছে। নূরের পছন্দও আছে।ছেলেটা জোহানের বন্ধু।জোহান ছেলের সবকিছু সম্পর্কে ভালো করেই যাচাই করে নিয়েছে।ছেলেটা বিদেশ যাওয়ার পূর্বে নূরের সাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।এখন আপনাদের কি মতামত?”
নূর এইসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো।নিজের কানে এইসব শুনেও কথাগুলো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।নূর কিছু বলতে নিলে তার মা তার কথা কেটে বলে উঠলো,
–“এটা তো ভালো খবর।আমিও মেয়েটার জন্যে চিন্তা করছিলাম। তা ছেলে কি করে?”
–“চাকরি করে আন্টি।বেশ ভালো কোম্পানি।মাইনেও পায় মোটা অংকের।”
জোহানের এইসব কথা বলা সময় নূর জোহানের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।জোহানের মুখে একটুও অনুশোচনাবোধ নেই।নূরের আমলে আসছে না,এই জোহান কোন জোহান?
তার দেখা সকালের স্বপ্নের কথা নূরের মনে আসলো।আজকের এই কাহিনীর ইঙ্গিত দিচ্ছিলো স্বপ্নটা তাকে।কিন্তু,নিজের প্রিয় জামাটা গায়ে জড়িয়ে যেনো সে অন্য এক ভুলের দুনিয়া সাজাচ্ছিলো!
জোহানের কথায় অনি,শালু নূরের মতোই অবাক হলো।তারা চুপ করে জোহানের এমন নাটক হজম করে যাচ্ছে।
–“আমার কোনো পছন্দ নেই।আর না আমি কোনো বিয়ে করবো।”
নিজের অশ্রুজল নিয়ন্ত্রন করে বললো নূর।জোহানের এমন আচরণে নূরের বেশ ধাক্কা লেগেছে।জোহানের বদলে অন্য কাউকে যেনো তার মনে বসাতে নারাজ সে।মাথাটা হুট করেই যেনো চক্কর দিলো তার।জোহানের জন্যে তার মনে এখন শুধু ঘৃণার অনুভূতি পাচ্ছে নূর।এতবড় মিথ্যা জোহান কিভাবে বলছে এটা নূরের মাথায় আসছে না।
–“মেয়ে বড় হলে মেয়েদের অন্যের ঘরে যেতে হয়।আমি পরিবারকে ম্যানেজ করবো।চিন্তা করো না তুমি।”
জোহানের অভিনয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না সে।নূর আরো বেশি চমকে উঠলো যখন জোহান পুনরায় বলে উঠলো,
–“ছেলেটা আসবে একটু পরেই।আপনারা সবাই কথা বলে নিতে পারবেন।দুইজন যখন দুইজনকে ভালোবাসে তাহলে এটা আমাদের আটকানো উচিত না।”
–“বেশ ভালো।”
নূরের বাবা হেসে জবাব দিলো।
নূর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।এক প্রকার টলছে সে।খুব ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিলো,
–“আমি বাসায় যাচ্ছি।কোনো ছেলের সাথে আমি দেখা করবো না।আর না আমি অন্য ছেলেকে ভালোবাসি।আমি ভালোবাসি…”
নূর মুখ বন্ধ করে ফেললো।যে তার কদর করে না,তার জন্যে নূরের ভালোবাসা সবার সামনে প্রকাশ করাটা নূরের বোকামি বলে মনে হলো।তাছাড়া নূরের বাবা এবং জোহানের বাবা দুইজন মুরুব্বির সামনে এইভাবে বেহায়ার মতো ভালোবাসার কথা বলার মেয়ে নূর নয়।তাই,অন্য কারো উত্তরের আশা না করে নূর দৌড় লাগালো।আনোয়ারা চমকে উঠলো,
–“নূর,মা আমার।”
–“জোহান!আমার মেয়ের যদি কিছু হয়!”
আনোয়ারা আবার জোহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–“আমি বেঁচে থাকতে কিছুই হবে না,নূরের।অপেক্ষা করো তোমরা।আমি দেখছি।”
জোহান নূরের পিছনে ছুটলো।নূরের অস্তিত্ব এখন অফিসের ঘর পেরিয়ে গেলো মাত্র।
–“আন্টি,জোহান এইসব কি বলছে?”
–“আমিও বুঝছিনা আন্টি।ওর কি মাথা খারাপ?”
অনি,শালুর চিন্তিত কণ্ঠ।
–“সবটাই জোহানের নাটক।”
জহুরার কথায় অনি,শালু,এবং উপস্থিত দুই ভদ্রলোক নূর আর জোহানের বাবাও অবাক হলো।অতঃপর আনোয়ারা নিজের মুখ খুললো।
জোহান বাইরে যেতেই দেখলো নূর সিঁড়ি সমেত নেমে যাচ্ছে।লিফট এর জন্যে অপেক্ষা করলো না মেয়েটা।নূরের অশ্রু এইবার বাঁধ ভেঙেছে।চোখের কাজল, সাজ সবটাই তার মুখে লেপ্টে আছে।দুই সিঁড়ি নামতেই পায়ে মোচড় লেগে সিঁড়িতে বসে পড়ে নূর।জোহান দ্রুত নূরকে আগলে ধরে,
–“পাগল হয়ে গিয়েছো।এইখান থেকে পড়লে আস্ত থাকবে না।”
–“আমার জন্যে এত দরদ থাকলে আমার এতো বড় ক্ষতি করতে না তুমি।তুমি একটা বহুরূপী,ভন্ড।আমি কবে বলেছি আমি অন্যকে ভালোবাসি?কবে বলেছি? ছাড়ো আমাকে।তোমার এই নোংরা হাত দিয়ে আমাকে ধরবে না।”
নূরের কান্না দেখে জোহানের মন গললো না।কিন্তু,
জোহানের বেশ খারাপ লাগছে নূরের এমন অবস্থা দেখে।মেয়েটা এতো ভেঙে পড়বে এটা জোহান ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।
–“উঠে আয়।বুঝছিস ই তো,কোনো জিনিস না করেও সেটার দোষ বয়ে বেড়ানো কতো খারাপ লাগে!”
জোহান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নূর,
–“প্রতিশোধ! জনাব জোহান আমার থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে?”
–“একদম,ঠিক ধরেছিস!”
জোহান নূরের মুখ শক্ত করে চেপে বললো।
–“আহ,কি করেছি আমি!কি করলাম আমি?যে মানুষটা আমাকে বুঝেই না আমি তাকে!হাহা,ভালো নূর ভালো।আমি তোমাকে ঘৃণা করি জোহান।আমি তোমাকে ঘৃণা করি,হাজারবার করি।আমি ভুল মানুষকে ভালো.. ভা..”
নূরের কথা ফুরিয়ে গেলো।এত বড় মানসিক চাপ নূরের সহ্য হয়নি।ঢলে পড়লো নূর জোহানের বাহুডোরে।
–“আর আমি তোমাকে ভালোবাসি,নূরিয়া নূর।তুমিও আমাকে ভালোবাসো আমি জানি।তুমি আমাকে ভালোবাসলেও,আমি তোমাকে ভালোবাসি;আর না বাসলেও আমি তোমাকে ভালোবাসি। সারাজীবন আমার কাছেই থাকতে হবে তোমার।”
জোহান পাঁজাকোলা করে নূরকে তুলে নিলো।লিফট ছেড়ে সিঁড়ি দিয়েই নামতে আরম্ভ করলো সে।শুক্রবার হওয়ার সুবাদে অন্যান্য অফিস বন্ধ এই বিল্ডিং এর।নিজের মুখের সাহায্য নূরের মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিলো জোহান।নূরের অল্প ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটজোড়ায় নিজের অধর ছুঁয়ে দিলো জোহান।খুব ধীর গলায় নূরকে বলে উঠলো,
–“সরি,খুব সরি।জানোই তো,জোহানের ভালোবাসা এবং জিদ দুইটাই তুমি।আর কিছুদিন এইসব সহ্য করা লাগবে তোমার।তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমার,বাসলেও আমার।আর আমি তো শুধুই তোমার,আমার নুড়ি পাথরের!”
নূরকে পার্কিংয়ে নিতেই গার্ডকে ডেকে নিলো জোহান। গার্ড জোহানের নির্দেশে তার পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির লক খুলতে সাহায্য করলো।গার্ড পুনরায় নিজের কাজে চললো জোহানের কাজ শেষ করে। গাড়ির পেছনের সিটে শুয়ে দিয়ে তার মায়ের কাছে ফোন দিয়ে সবাইকে নিচে নামতে বললো সে।পকেটে মোবাইল পুরে পুনরায় গাড়ির ভেতরে ঝুঁকে নূরের খয়েরী রঙা অধরে নিজের অধর স্পর্শ করলো জোহান,
–“আবারও,সরি।”
নূরের এখন হুঁশ নেই।সজাগ অবস্থায় নূর জোহানের মুখে আজকের কান্ডের জন্যে “সরি” শুনলে,কি করতো?নিশ্চয় জোহানের গলা চেপে ধরে তাকে বলে উঠতো,
–“দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খারাপ তুমি,তিতামুখী।”
চলবে…..